অরুন্ধতী রায়ের দ্বিতীয় উপন্যাস নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে অনুবাদ করেছেন আশফাক স্বপন

‘কথাসাহিত্য তার নিজস্ব গতিতে আপন সময়ে আত্মপ্রকাশ করে’
অরুন্ধতী রায়, দ্বিতীয় উপন্যাস লিখতে কেন ২০ বছর লাগলো, সেই প্রসঙ্গে
ডেকা এটকিনহেড, দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে অনুবাদ করেছেন আশফাক স্বপন।

কুড়ি বছর পর এই প্রথম অরুন্ধতী রায় একটি নতুন উপন্যাসের কাজ সমাপ্ত করলেন। কাজ শেষ করে তার প্রকাশনা এজেন্ট কে বললেন: ‘পাণ্ডুলিপি নিলামে তুলে দরাদরি করা চলবে না – এই সব বেহায়াপনা আমার একদম পছন্দ না, বুঝলে?’ বললেন, আগ্রহী প্রকাশকেরা যেন তাকে চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তারা পাণ্ডুলিপি পড়ে গল্পটা ‘কেমন বুঝলেন’ তার বর্ণনা দেবেন।
কিছুদিন পর তিনি এদের সবাইকে নিয়ে একটি সভা ডাকলেন। সভার পর এজেন্ট তাড়াতাড়ি প্রকাশক বাছাই-এর সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি জানো ওরা কী বুঝেছে। দেখাও তো হলো। এবার ঠিক করে ফেলো।‘
‘না, না। এখনো না।‘ অরুন্ধতী উত্তর দিলেন। ‘আগে আমার পরামর্শ নিতে হবে।‘
এজেন্ট মহাফাঁপড়ে পড়লেন।
‘তুমি তো আমার থেকেই পরামর্শ নেবে, নাকি?’
‘না, আমার লোকেদের সাথে পরামর্শ করতে হবে, বুঝলে, আমার বইয়ে যেসব লোক আছে।‘
লেখক ও এজেন্ট একসাথে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসলেন। ততক্ষণ অরুন্ধতী তার উপন্যাসের চরিত্রদের শুধালেন কোন প্রকাশককে তাদের পছন্দ। গল্পের চরিত্ররা বাছাই করল প্রকাশক।  সেই ব্যক্তি যে অন্য প্রকাশকদের চাইতে অর্ধেক টাকা দিতে চাইছেন, সেকথা এজেন্ট মনে করিয়ে দিলেন।
অরুন্ধতী নির্বিকার। ‘তা হোক। আমার চরিত্রদের ওকেই পছন্দ।‘
আমাকে এই গল্পটি বলার পর আমার চেহারায় বিস্ময় দেখে অরুন্ধতী হেসে ফেললেন। ‘সবাই ভাবে আমি একা থাকি, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। আমার চরিত্রগুলো সব আমার সাথে থাকে।‘
সব চরিত্ররা তার সাথে বাস করে?
‘অবশ্যই। দরজা বন্ধ করতে না করতেই প্রশ্ন করি – ওই লোকটা সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা হলো – একটা
আহাম্মক, তাই না?’
এই সাক্ষাৎকারে শেষে আমি চলে গেলেও কি অরুন্ধতী চরিত্রদের প্রশ্ন করবেন? যেটা জানা কথা তাই নিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম দেখে অবাক হলেন। ‘অবশ্যই।‘
গত কুড়ি বছরে অরন্ধতীর লেখালেখি নিয়ে তার সাহিত্যের গুণগ্রাহীরা অনেকেই ধাঁধায় পড়েছেন। তিনি কি যথার্থই সাহিত্যিক, নাকি তার প্রথম উপন্যাস একটা আকস্মিক ঘটনা? তার প্রথম উপন্যাস The God of Small Things (‘ক্ষুদ্র জিনিসের ঈশ্বর’) যখন প্রকাশিত হয়, তখন তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। অরুন্ধতীর বয়স তখন ৩৫। কাহিনি এক ক্ষয়িষ্ণু ভারতীয় পরিবার নিয়ে। সেই পরিবারে নানান বেদনাময় সঙ্কট, কেলেঙ্কারি। বইটি বিলেতের বিখ্যাত বুকার প্রাইজ পায়। ৪২টি ভাষায় ৮০ লক্ষ বই বিক্রি হয়। এক অখ্যাত চিত্রনাট্যকার রাতারাতি হয়ে যান আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। অনেকেই ধরে নেন অরুন্ধতী তার প্রজন্মের সাহিত্যিক কণ্ঠস্বর হতে যাচ্ছেন।
তারপর ২০ বছর হলো, অরুন্ধতী বহু নিবন্ধ-প্রবন্ধ লিখেছেন, নানা বিষয়ে আলোচনামূলক বই লিখেছেন, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। হিন্দু জাতীয়তাবাদ, পরিবেশ বিনষ্টকরণ, তীব্র অসাম্য – এসবের বিরূদ্ধেও প্রতিবাদ করেছেন। কাশ্মীরের স্বাধীনতা, মাওবাদী বিদ্রোহী আর আদিবাসীর জমির অধিকার – এসবের পক্ষে আন্দোলন করেছেন। মার্কিন সাপ্তাহিক Time পত্রিকার বিশ্বের ১০০জন শীর্ষ প্রভাবশালীদের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়।
তার রাজনৈতিক সমর্থকদের চোখে তিনি সৎ প্রতিরোধের সপক্ষে কড়া বামপন্থী কণ্ঠস্বর। নিন্দুকের চোখে তিনি অপরিণত আদর্শবাদের চুড়ান্ত উদাহরণ; তার চিন্তা ভাবনা অবাস্তব, তিনি বড্ড নিজেকে নিয়ে মশগুল। আদালত অবমাননা এবং দেশদ্রোহিতার জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন, জেল খেটেছেন, গত বছর কিছু সময়ের জন্য প্রাণভয়ে ভারত থেকে পালিয়েছেন। তবে এই বই প্রকাশিত হবার আগে এক বর্ণও গল্প-উপন্যাস প্রকাশ করেননি।
২০১১ সালে একবার ঠারে-ঠোরে জানিয়েছিলেন দ্বিতীয় উপন্যাসের কাজ চলছে। তারপর বছরের পর বছর গেল, উপন্যাসের টিকিটিরও দেখা নেই। কারো কারো কাছে অরুন্ধতীকে সাহিত্যিক হিসেবেই বিবেচনা করা কঠিন হয়ে উঠলো। The God of Small Things (‘ক্ষুদ্র জিনিসের ঈশ্বর’) উপন্যাসের ভাষা ছিল বাঙ্ময়, সুক্ষ্ম, ইঙ্গিতময়, কিন্তু অরুন্ধতীর নিবন্ধ-প্রবন্ধের ভাষা আর রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে অভিযোগ উঠলো যে অরুন্ধতীর ভাষা বড্ড চড়া, অতিসরলীকরণে দুষ্ট।
লণ্ডনের একটি হোটেলে অরুন্ধতীর নতুন উপন্যাস The Ministry of Utmost Happiness (‘পরম সুখ মন্ত্রণালয়’) নিয়ে যখন কথা বলতে এলাম, তখনো আমি নিশ্চিত নই অরুন্ধতীর কোন কণ্ঠস্বর আমি শুনবো।
অরুন্ধতী যখন এলেন, দেখলাম তিনি শাড়ির মত পেঁচিয়ে সারা ঊর্ধ্বাঙ্গে হাল্কা গোলাপী লিনেন জড়িয়েছেন। সাথে জিনস, পায়ের দিকটা গোটানো। পায়ে মুখ-খোলা স্যান্ডেল। নখে টকটকে লাল নেলপালিশ। হাঁটাচলায় সৌকুমার্য চমকে দেবার মত, কথা বলেন খুব নীচু স্বরে। বয়স ৫৫, তবে চালচলনে খানিকটা কিশোরীর নিষ্পাপ চপলতা রয়েছে। হাসির মধ্যে অনুচ্চারিত দুষ্টুমির ঝিলিক। মনে হয় তার রাজনৈতিক গোঁ যে সমাজে তোলপাড় করেছে, সেটা নিয়ে খানিকটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন। কথা বলার ভঙ্গী এমন, যেন তাতে কিছু কিছু কথা না বলা রয়ে যায়। কথা শেষ করেন সুন্দর অঙ্গভঙ্গিমায় বা পরিহাসতরল অর্থবোধক মুখভঙ্গিতে।
তিনি কি সাহিত্যিক? অরন্ধতীর উত্তর: “কথাসাহিত্যের ওপরে কিচ্ছু নেই। আমি মূলত কথাসাহিত্যিক। আমি গল্প বলি। পৃথিবীকে বুঝতে, ঠিক কী খেলা চলছে এখানে, সেটা বোঝার ঐ একটাই পথ আমার।‘
দ্বিতীয় উপন্যাসে শুরু করেছিলেন সম্ভবত ১০ বছর আগে। অন্তত তাই তার ধারণা, তবে নিশ্চিত নন। (‘বিষয়টা এত জটিল, আমার মনে নেই।‘) কতদিন লেগেছে সে বিষয়ে ভাবতে তিনি নারাজ। মুচকি হেসে বললেন, তার প্রকাশনার এজেন্ট তাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। তাই তাড়া দিয়ে মিছেমিছি সময় নষ্ট করেনি। তার নিবন্ধ-প্রবন্ধ নির্দিষ্ট সময় ধরে লেখা হয়েছে সময়েরই প্রয়োজনে – সেনা অভিযান, আদালতের রায়, ইত্যাদির প্রতিক্রিয়ায়। কিন্তু গল্প-উপন্যাস লেখা ‘তার নিজের সময়ানুযায়ী ঘটে। এতে কোন তাড়া দেবার সুযোগ নেই। আমি চাইলেও আরো ধীরে বা তাড়াতাড়ি লিখতে পারব না। এ যেন পুরাকালের পাথর, দীর্ঘ সময়ের হাত ধরে ধরে তাতে নানা স্তর জমছে, তার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। গল্প আর প্রবন্ধ-নিবন্ধ – এই দুইয়ের স্বভাবে যে ভিন্নতা, সেটা জরুরি তাগিদ আর অনন্তকালের তফাৎ।‘
তিনি এটুকু জানতেন যে God of Small Things (‘ক্ষুদ্র জিনিসের ঈশ্বর’)-এর দ্বিতীয় খণ্ড লেখার বাসনা তার ছিল না।
তবে একটুখানি মিল রয়েছে। তার প্রথম উপন্যাসের অনুপ্রেরণা পরিবারের ছেলেবেলার কাহিনি থেকে, আর তার দ্বিতীয় উপন্যাসও ভিন্ন অর্থে আত্মজীবনীমূলক। এইবার তিনি তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের স্বভাব আর মানসিকতাকে ধরার চেষ্টা করেছেন। ‘এই যে আমি এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, দিল্লীতে যেমনটা করি, মসজিদে বা অদ্ভুত সব জায়গায়, আমি সারাজীবনই এমন করেছি, সেসব নিয়ে লিখতে চেয়েছি। এই যে সব পাগলের দল, এত ভাল মানুষের দল, এদের কথা ভেবে আনন্দ পাওয়া, খুব দুঃখের জায়গাতেও একটু সুখ পাওয়া, এই যে কত ব্যাপার আছে যে ভাবাই যায় না, এইসব।‘ সামাজিক দৃষ্টিতে হীনতম লোকটির ব্যাপারেও অরুন্ধতীর আগ্রহ, তিনি তার সাহচর্য চান। ‘আমি কাউকে পাশ কাটিয়ে, এড়িয়ে যেতে চাই না। আমি চাই তার সাথে বসে আড্ডা মারতে। একটা সিগারেট ধরিয়ে তাকে শুধাতে – কী ভাই, কেমন চলছে সব?’ আমারতো মনে হয় এইসব নিয়েই আমার বই।
‘পরমসুখ মন্ত্রণালয়’ আসলেই ঠিক তাই। এক হিজড়া নারীকে নিয়ে সুবিস্তৃত, বর্ণাঢ্য  কাহিনি। এই নারী ছোটবেলায় বাড়ি ছেড়ে চলে আসে পুরোন দিল্লীর ভাঙাচোড়া জীর্ণ পরিবেশে একটি হিজড়ার গোষ্ঠীর সাথে বসবাস করতে। এই গোষ্ঠীর সদস্যদের যেমন নায়িকাসুলভ গুমোর ও দর্প রয়েছে, এরা আবার খুবই বন্ধুবৎসল। এরা তেজী অথচ বিপন্ন। এরা একদিক দিয়ে সমাজে একঘরে, আবার অন্যদিকে এদের প্রতি মানুষের একধরনের নিষিদ্ধ, জৌলুসময় কৌতুহল। কিন্তু ৪৬ বয়স্ক আনজুম গুজরাতের নরমেধযজ্ঞে জড়িয়ে পড়ে। সেখানে সে ঠিক করে  সে হিজড়াসমাজে আর থাকবে না, বৃহত্তর সমাজে আবার ফিরে আসবে। আনজুম অন্তরে ক্ষতবিক্ষত, কিন্তু লক্ষ্যে স্থির। এক গোরস্থানে সে ঘর বাঁধে। আস্তে আস্তে কবরের ওপর একটি একটি করে ভাড়া দেবার ঘর বানায় – অবশেষে তার জান্নাত গেস্ট হাউস হয়ে ওঠে নানা ব্রাত্য মানুষের এক অতি উদ্ভট সমাহার: অচ্ছুৎ, ধর্মান্তরিত মুসলমান, হিজড়া, মাদকাসক্ত, এমনকি জয়নাব নামে একটি পরিত্যক্ত  শিশুও সেখানে উপস্থিত হয়। এই বাচ্চাটিকে আনজুম নিজে লালন করার দায়িত্ব্ব নেয়।
এই কাহিনির পাশাপাশি সমান্তরালভাবে আরেকটি সুবিস্তৃত কাহিনি রয়েছে। তার ঘটনাস্থল ও বিষয় কাশ্মীর। আমার মতে কাশ্মীরের কাহিনি একটা আলাদা উপন্যাস হলে ভাল হতো, কিন্তু অরুন্ধতীর মত হলো দুটো কাহিনি পরস্পরের সাথে ওতোপ্রতভাবে সম্পৃক্ত – বইটাই তো সমাজের নানা সীমান্ত নিয়ে। ‘ভৌগলিকভাবে কাশ্মীর নানা সীমান্তে ক্ষতবিক্ষত, আবার বইটিতে প্রত্যেকটি চরিত্রের নিজের ভেতর একটা সীমান্ত আছে। এই সীমানাগুলো আপনি কীভাবে বোঝেন, উপলব্ধি করেন – সেটা নিয়েই বই। সব বুঝবার পর কীভাবে সবার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন, বলে ওঠেন: ‘জান্নাত গেস্ট হাউসে আসুন।‘ বুঝতে পারলেন তো আমার কথা? সবাইকে স্বাগতম।‘
‘পরমসুখ মন্ত্রণালয়’-এর কাহিনি হৈ-হট্টগোলে ঠাসা বর্ণিল মেলার মত। লেখিকার মতই কাহিনি দুঃখ-বেদনায় হাস্যরসের সন্ধান পায়, প্রচলিত সংস্কারের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখায়। গল্পে অজস্র অদ্ভুত, পাগলাটে চরিত্রের আনাগোনা এক সময় ক্লান্তিকর ঠেকে। এ যেন এমন একটা দাওয়াতে গিয়েছেন যেখানে একের পর এক অতিথি আসছে তো আসছেই। তবে কাহিনিতে যথেচ্ছ চরিত্রের আনাগোনা শুধু লেখকের সচেতন সিদ্ধান্ত নয়, এটি অরুন্ধতীর রাজনৈতিক ভাবনা ও বইটির মৌলিক বিষয়বস্তু।
‘জাতিভেদের উদ্দেশ্যই হলো মানুষে মানুষে এমনভাবে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা যাতে কোনভাবেই আর মানুষের একতাবদ্ধ হবার উপায় না থাকে। কারণ নিচু জাতির মধ্যে আবার গোত্র আছে, আরো ভাগ আছে। সবাইকে এই আধিপত্যের ক্রমানুসারে গঠিত, পরস্পর বিচ্ছিন্ন গণ্ডিবদ্ধ সমাজ রক্ষার কাজে লাগানো হয়েছে। এই হলো শ্রেণি, জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম অনুযায়ী ছক তৈরির রাজনীতি। সেই ছককে আরো সুক্ষ্ম ভাগে ভাগ করাটা গোটা পৃথিবীকে তাঁবে রাখার অপরিহার্য অংশ। মানুষকে এই কথা বলে বশীভূত রাখা: ‘তুমি মুসলমান, তুমি হিন্দু, তুমি শিয়া, তুমি সুন্নি, তুমি বারেলভি, তুমি ব্রাহ্মণ, তুমি সারস্বত ব্রাহ্মণ, তুমি দলিত, তুমি সমকামী, তুমি অপর লিঙ্গের প্রতি আসক্ত, তুমি লিঙ্গত্যাগী – তাই তুমি শুধু নিজের পক্ষেই কথা বলতে পারো, কারো সাথে ঐক্যবদ্ধ হবার কোন পথ নেই।‘ অর্থাৎ মানুষ যাকে মুক্তি ভাবছে সেটা বাস্তবে দাসত্ব।‘
অরুন্ধতী বললেন যে বর্তমান ‘আধুনিক’ ভারতে ১%-এর কম মানুষ নিজ জাতির বাইরে বিয়ে করে। ‘আনজুমের যে জিনিসটা আমার ভীষণ ভাল লাগে তা হলো সে যখন (গুজরাতে নরমেধযজ্ঞের ফলে) বিপদে পড়ে, তখন সে হিজড়া বলে রক্ষা পায়।‘ যেই পরিচয়ের কারণে সমাজচ্যুত হয় তার ফলেই সে বেঁচে যায় আর তাতেই ‘সে একাত্মতা অনুভব করে, তার আত্মপরিচয়ের গণ্ডির বাইরে যে পৃথিবীটা রয়েছে, সেখানে কী ঘটছে তা সে উপলব্ধি করতে চায়। সে যখন জয়নাবের মা হয়, তখন জয়নাবের জন্যই সে এই জগৎটাকে বুঝতে চায়। সে এই ছক আর মানে না। সে এই ছক ভেঙে বেরিয়ে আসে।‘ অরুন্ধতীর মুখ স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত হয়। ‘আমার জন্য এটি ভারি সুখের।‘
***
অরুন্ধতী সারাজীবন এই ‘ছকের’ বাইরে কাটিয়েছেন। তার জন্ম ১৯৬১ সালে মেঘালয়ে। মা সম্ভ্রান্ত সিরীয় খ্রীষ্টান, বাঙালি হিন্দু বাবার সামাজিক অবস্থান আরো নিচে – তাই তাঁদের বিয়েটা খানিকটা কলঙ্কজনক। তার যখন দুই বছর বয়স, বাবা মার বিয়ে ভেঙে যায়। মা ও ভাইয়ের সাথে তিনি চলে যান কেরল অঙ্গরাজ্যে। সেখানে মা মেয়েদের একটি ইস্কুল স্থাপন করেন। তিনি মানবাধিকার কর্মী হিসেবে পরিচিত হন। মায়ের ছিল প্রখর ব্যক্তিত্ব। দাপুটে এই মহিলাকে দাবিয়ে রাখার উপায় ছিল না। ‘মা আমার যেন ফেলিনির কোন চলচ্চিত্র থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা কোন চরিত্র,’ অরুন্ধতী একবার রসিকতা করে বলেছিলেন। মা তার চোখে আদর্শ চরিত্র বটে, কিন্তু রসিকতা করে বললেন যে মা মেয়ে একসাথে থাকলে ‘আমাদের দুজনকেই একটু সাবধানে চলতে হয়। আমরা যেন দুজনে পারমাণবিক বোমা অধিকারী দুটি রাষ্ট্র।‘
দিল্লীতে স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বিয়ে করেছিলেন প্রদীপ কিষেন নামে এক চলচ্চিত্রকারকে, যিনি ব্যবসায়িক সাফল্যের চাইতে নান্দনিক উৎকর্ষের প্রতি বেশি মনোযোগী ছিলেন। তবে স্ত্রীধর্ম বা মাতৃত্ব্বের প্রচলিত সামাজিক অনুশাসনের প্রতি অরুন্ধতীর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। বরাবর বলে এসেছেন যে তার নিজের ছেলেবেলায় মাকে সাহায্য করার জন্য স্কুলে এত সময় ছোট মেয়েদের দেখাশোনায় ব্যয় করেছেন যে ‘যখন ১৬ বছর বয়স হলো, তখন থেকে আর একটি বাচ্চাও দেখার ইচ্ছে হয় নি।‘
রাজনৈতিক বিশ্বাসের টানে চলে গেছেন জঙ্গলে ভারতীয় মাওবাদীদের সাথে বাস করতে, বা মস্কোতে এডোয়ার্ড স্নোডেন-এর সাথে দেখা করতে, অথবা আফগানিস্তানে মার্কিন নীতির বিরূদ্ধে আন্দোলন করতে। কখনো বা বিশ্বায়নবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। এই সব অবস্থান তাকে নিজ দেশের মূলধারার আধুনিকতামুখী জনমতের বিপরীতে স্থাপন করেছে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারত সরকারের সাথে অরুন্ধতীর টক্কর এখন তুঙ্গে। ‘লোকে যখন মার্কিন দেশে ট্রাম্পের অভ্যুদয় নিয়ে কথা বলে, একই সাথে মোদীর নামও উচ্চারণ করে। কিন্তু দুটো এক কথা নয়, কারণ ট্রাম্প হলো একটি বিষাক্ত শিল্প প্রণালীর বর্জ্য, কিন্তু মোদী সেই প্রণালীর ফলশ্রুতি। সে RSS নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ফল।‘ RSS ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী আধাসামরিক প্রতিষ্ঠান। সংগঠনটি ক্ষমতাসীন BJP-কে সমর্থন করে।
গত বছরে গোড়ার দিকে ভারত জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ করে। একজন কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীর ফাঁসি নিয়ে ছাত্রদের ক্ষোভ। এই ব্যাক্তির পক্ষে অরুন্ধতী লিখেছিলেন। ‘পুলিশ এসে (ছাত্রদের) গ্রেফতার করলো, তারা হাজতে গেল, আদালতে হাজিরা দিতে লাগলো। আর গুণ্ডারা আদালতে গিয়ে সবাইকে বেধড়ক পেটাতে লাগলো। মানুষকে উন্মত্ত গণরোষের শিকার করা হলো, বেদম মার দেওয়া হলো। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলা বড় একটা টিভি চ্যানেলের উপস্থাপক বললেন: ‘হ্যা এইসব ছাত্ররাই দায়ী, তবে এদের পেছন থেকে কে মদদ দিচ্ছে? কে এদের পক্ষে এই এই কথা লিখছে? আপনারা জানেন, ইনি হচ্ছেন অরুন্ধতী রায়।‘ আদালত জুড়ে দুর্বৃত্তের দাপাদাপি, তাদের কণ্ঠে ঐ আওয়াজ: ‘ইনিই সেই ব্যক্তি যিনি এসব কথা লিখেছেন।‘ যেহেতু তখন আমি এই বই নিয়ে কাজ করছিলাম, আর জানতাম যে কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি, আমি চট করে একটা টিকেট কিনে দেশত্যাগ করে এখানে লণ্ডনে চলে এলাম। নিজেকে নিয়ে খুব গ্লানি অনুভব করলাম।‘
দেশত্যাগ করেছিলেন বলে?
‘হ্যা, আমি এখানে চলে এলাম। সঙ্গে একটা জিনিস, যেটা আমি রক্ষা করছিলাম। আমি বইটা নিয়ে কাজ করছিলাম, প্রায় শেষ করে ফেলেছি। তাই পালিয়ে এলাম। মন তখন চরম হতাশা, শঙ্কা আর গ্লানিতে ভরা।‘
অরুন্ধতী একটি হোটেলে ঘরভাড়া নিলেন। রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে রক্ষা পাবার জন্য এই প্রথম বিদেশে আশ্রয় নিলেন বটে, কিন্তু গত ২০ বছর ধরে আদালতে তার আইনী লড়াই চলছে। সেটা যেন তার জীবনে একটি বিরতিহীন নেপথ্য সুর হয়ে উঠেছে। সেই কথা উঠলে চোখ কপালে তুলে ধৈর্যচ্যুতি প্রকাশ করেন। যখন ‘ক্ষুদ্র জিনিসের ঈশ্বর’ প্রথম প্রকাশিত হয় তাতে যমজ সহোদরের রতিক্রিয়ার বর্ণনা ছিল।
কোথার থেকে পাঁচজন উকিল দল বেঁধে এই অভিযোগে মামলা দায়ের করল যে আমি নাকি মানুষের মূল্যবোধ নষ্ট করছি, এটা দণ্ডনীয় অপরাধ, ইত্যাদি ইত্যাদি।‘
২০০২ সালে গুজরাতের নর্মদা বাঁধ প্রকল্পের বিরূদ্ধে অরুন্ধতীর আন্দোলনের বিরূদ্ধে আদালত অবমাননার রায় ঘোষিত হবার পর তাকে এক দিনের ‘প্রতীকী’ হাজতবাস করতে হয়। অতীতে ভারতের কাশ্মীর নীতি সমালোচনার জন্য তার বিরূদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’-এর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত, হুইলচেয়ারবদ্ধ এক অধ্যাপকের পক্ষে প্রবন্ধ লেখার কারণে অরুন্ধতী বর্তমানে আদালত অবমাননার অভিযোগের মুখোমুখি। স্বভাবসিদ্ধ ধীরগতিতে ভারতীয় আদালতে সেই মামলার বিচার চলছে।
‘ওহো, সেই অবমাননার মামলা!‘ অরুন্ধতী মুখ বিরক্তিতে বিকৃত হলো। ‘জানেন, এসব মামলায় দণ্ডটা আসল কথা নয়, দণ্ড দেবার পদ্ধতিটাই আসল কথা। মানুষের হয়রানি করার একটা বাঁধা উপায় হল কারো বিরূদ্ধে ১০০টা শহরে মামলা দায়ের করা। তখন – এই আদালতে যাও, উকিল ঠিক কর, এই শংসাপত্র জমা দিয়েছ তো? (রাষ্ট্র যার মুখ বন্ধ করতে চায়) তাদের সকলের বিরূদ্ধে এই হলো কৌশল। সবখানে উন্মত্ত জনতার দল বা জাতিগত গোষ্ঠী লেখকদের আক্রমণ করছে – কোন একটা কাজে হাত দেবার জন্য এই সময়টি খুব অস্থির, বিক্ষুব্ধ।‘
নতুন উপন্যাস নিয়ে মামলার আশঙ্কা করেন কিনা জিজ্ঞেস করলাম। যেই উপন্যাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই একটি চরিত্র, সেখানে মামলা হলে তো আশ্চর্য হবার কথা নয়।
‘আরে, ঈশ্বর জানেন। কোন চরিত্র যদি কিছু বলে, ওরা বলবে: ও-ই তো বলেছে!’ মানে ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়ায় – কী করে আপনি...?’ বাক্যটা অসমাপ্ত রয়ে যায়। ‘এই বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না, কারণ আমি চাইনা নিজেকে...’ আবার মাঝপথে থেমে যান অরুন্ধতী। ‘জানেন, হয়তো কিছুই হবে না। হয়তো ওরা ছেড়ে দেবে‘ একটু থামলেন, তারপর যেন খানিকটা হেসে উঠলেন। ‘আরেকটা ব্যাপার আছে। ধরুন কোন কিছু নিয়েই আসলে কোন কিছু অভিযোগ করার নেই, কিন্তু লোকে ভাবে, ‘আমি যদি তার পেছনে লাগি, তাহলে কাগজে আমার নাম ছাপা হবে।‘
কী বলতে চাইছেন অরুন্ধতী?
‘মানে, রাস্তা থেকে কোন একটা মুর্খ লোক যদি আমার বিরূদ্ধে মামলা করে, সে বিখ্যাত হয়ে যাবে।‘ একবার তাকে একটি শহরে যেতে হয়েছিল অবমাননার মামলায় হাজিরা দিতে। ‘যারা মামলার বন্দোবস্ত করেছিল তারা আমাকে এসে ফুল দিয়ে গেছে। ওদের কী আনন্দ! ব্যাপারখানা যেন ‘দেখ, ওকে ধরেছি!’ বুঝলেন? এই জিনিস চলছে তো চলছেই।‘ অরুন্ধতীর উকিলরা তার থেকে টাকা নেন না, ‘কারণ ওরা আমাকে ভালবাসে। কিন্তু ভাবুন তো আমি যদি গরীব মানুষ হতাম তাহলে কী দশাটা হতো? তখন আপনি কী করবেন? আপনি কী করে এই শহর, ঐ শহরে টো টো করে ঘুরে বেড়াবেন? তখন লেখালেখি আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে। আপনাকে সেটাই করতে হবে।‘
এত রাজনৈতিক আক্রমণ, আদালতে রেষারেষি দেখে ভেবেছিলাম ভারতে অরুন্ধতী একরকম সমাজচ্যূত, কিন্তু তিনি বললেন আসল ঘটনা একদম বিপরীত। প্রতিদিনের জীবনে তার এমন কারো সাথেই দেখা হয় না যে তাকে দেশদ্রোহী মনে করে। ‘না, না। একেবারেই না। বরঞ্চ উল্টোটা সত্যি।‘ অরুন্ধতীর এই দাবি যাচাই করা বা সেটা নিয়ে তর্ক করা কঠিন।
পৃথিবীর আনাচে কানাচে তার বক্তৃতা শুনতে হাজার হাজার গুণমুগ্ধ ভক্তরা জমায়েত হয়। অথচ যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় তিনি সমমনা মানুষের সমর্থন সবচাইতে বেশি অনুভব করেন, একবাক্যে তিনি বলে ওঠেন: ‘নিঃসন্দেহে ভারতে। আমি তো কোন একাকী মানুষ নই। সমর্থনের এক প্রশস্ত নদী, ঝর্ণা, একাত্মতার এক ক্রমবর্ধমান, ক্ষিপ্রগতি স্রোতের মাঝে আমি কাজ করি।‘
তা হোক, তবে তাকে আক্রমণ করার জন্য লোক পাঠানো হয়। হেসে উঠলেন। ‘ওরা গিয়ে ভুল বাড়ি ভাঙচুড় করে আসে। বেশ ক’বার এমনটা ঘটেছে।‘
অরুন্ধতীর কোন আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। কারণ ‘আমার ওটাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। আমার কাছে সবাই – ট্যাক্সিওয়ালা, সিগারেটওয়ালা, রাস্তার কুকুর – ওরাই আমার নিরাপত্তা। অনেকগুলো রাস্তার কুকুর আমার বাড়ির সিড়িতে ঘুমায়।‘ আবার হেসে উঠলেন। ‘ওদের দেখতে ভয়ঙ্কর লাগে, কিন্তু আসলে একটুও ভয়ঙ্কর নয়।‘
প্রথম উপন্যাসের সাফল্যের ফলে যে মনোযোগ আকৃষ্ট করেন, অরুন্ধতী একেবারেই তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ‘এর ঝামেলা অনেক। এমন একটা পর্যায়ে চলে এসেছিলাম যে আমার মনে হচ্ছিল, আচ্ছা, এই বইটা লেখার জন্য কি আফসোস করব কোনদিন? আমি কিন্তু একেবারেই এমন লোক নই যে ভাবে, ওহ, আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি। এবার লণ্ডন বা নিউ ইয়র্কে গিয়ে স্বপ্নময় জীবনযাপন করব।‘ হাসলেন। ‘জানেন, কোন ককটেল পার্টিতে আমি একদম অসহায়। হাতে পানীয় নিয়ে খুব সম্ভ্রান্ত কিছু লোক একটা ঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছে – এমন পরিস্থিতি আমার জন্য দুঃস্বপ্নের মত। উফ, ভাবতেও গা-হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।‘
‘ক্ষুদ্র জিনিসের ঈশ্বর’ থেকে কত টাকা আয় হয়েছিল? পরিষ্কার করে উত্তর দিলেন না। ‘জানি না। যত টাকায় বিক্রি হয়েছে, তত টাকাই হয়েছে আর কি। আমি এসব হিসেব-পত্তর জানিনা। তবে টাকাটা শুরুতে ভীষণ গোলমাল বাঁধিয়েছিল।‘ বই প্রকাশনার পর থেকে বইয়ের সম্মানীর টাকায় চলছিলেন, তবে আয়ের বেশির ভাগ দান করেছেন। প্রচলিত অর্থে সমাজসেবী দানবীর হবার কোনরকমেরর ইচ্ছা তার ছিল না, ব্যাপারটা তার জন্য অস্বস্তিকর। তাই ‘একটা উপায় বের করে’ অন্য লোককে দায়িত্ব দিয়েছেন। এরা সম্মানী বিতরণের দিকটা দেখেন। ‘হ্যা, দান করাটাও সার্বক্ষণিক কাজ হয়ে দাড়াতে পারে।‘ বিশদে আরে বললেন না, শুধু এটুকু বললেন যে এমন ব্যবস্থা করেছেন যে টাকাটা তার কাছেই আসে না। ‘আমি তো ‘আমার টাকাটা দিয়ে দাও’ কথাটাও ব্যবহার করিনা, বুঝলেন? আমরা একটা রাস্তা ঠিক করেছি। টাকাটা আর আমার নয়। যখন দিয়ে দেওয়া হয়, সেটা একাত্মতার মনোভাব নিয়ে দেওয়া হয়।‘
তার বিনয় অথবা মিতব্যয়িতায় কোন ফাঁকি দেখতে পাইনি, তবে তার মানে এই নয় যে অরুন্ধতীর অহমিকা নেই। একটা গল্প বললেন – যেটা একরকম বিনয় নিয়ে অভিমান। কেরলে স্তন পরীক্ষার mammogram করতে গেছেন। এমন সময়ে হাসপাতালে যাবার জন্য ফোন পেলেন। খুব ভয় পেলেন। ‘আমিতো ভাবছি, সর্বনাশ। গিয়ে দেখি আমার অটোগ্রাফের জন্য ডাক এসেছে। সারা হাসপাতালের লোক হাজির। অদ্ভুত কাণ্ড!’
নিজেকে পোষ-না-মানা পাগলাটে হিসেবে দেখে সুখ পান। ‘আমার কিছু বন্ধু আছে যারা জানে যে আমি যখন লেখালেখি করি – বেশ ক’বার বাড়িতে আরেকটু হলে আগুন লেগে গিয়েছিল। আমি নাচার হয়ে বলেছি ‘আমি রাঁধতে পারিনা, বাইরে যেতে পারি না। আচ্ছা একটা ডিম তো সেদ্ধ করি’ – তারপর সব ভুলে যাই, আর আগুন লেগে যায়, ডিম পুড়ে কাল কয়লা হয়ে যায়। তখন বন্ধুরা বলে: ‘আচ্ছা, আমরা তোমাকে খাবার পাঠাচ্ছি।‘
বলতে বলতে আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায় অরুন্ধতীর।
বহু বছর আগে স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়, তবে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি। তার চোখে স্বামী আর তার দুই কন্যা – ওরা  বড়ো হয়ে গেছে – এখনো তার ‘পরিবার,’ যদিও দিল্লীতে একা থাকেন। ওদের নিজেদের কখনো ছেলেপুলে হয় নি, এবং এই নিয়ে তার আক্ষেপ নেই। ‘আমি নিজেকে কারো স্ত্রী মনে করিনা, তবে আইনত আমি বিবাহিতা।‘ একটু থেমে মুচকি হাসলেন। ‘অবশ্য সত্যি সত্যি যখন বিবাহিত ছিলাম, তখনো নিজেকে স্ত্রী মনে করতাম না। সবই কিছুটা এলোমেলো।‘
যখন প্রথম অরুন্ধতীকে দেখতে এলাম, একটা প্রথম ধাক্কায় হতবুদ্ধি হয়েছিলাম – স্বভাবে এমন ভীষণরকমের একটা সাহিত্যিক কী করে ২০ বছর ধরে গল্প না লিখে থাকতে পারলেন? অরুন্ধতী নিজেই তো বলেন, ‘আমার মনে হয় আমার মস্তিষ্ক একজন কথা-সাহিত্যিকের মস্তিষ্ক।‘
বিদায়ের সময় যখন এলো, তখন ভাবছি অরুন্ধতী কতটুকুই বা বানিয়ে বলেন – এমনকি আদৌ কিছু বানিয়ে বলেন কিনা। ‘পরমসুখ মন্ত্রণালয়’-এর চরিত্রগুলো বহু কাল্পনিক চরিত্রের চাইতেও উদ্ভট হতে পারে, কিন্তু অরুন্ধতীর আসল গুণ নিজের কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে এদের সৃষ্টি করা নয়। তার কৃতিত্ব তার চারপাশে গভীর মনোনিবেশ করে এদের অস্তিত্ব উদ্ধার করা।
‘লোকে যখন ‘ তিনি যাদের বলবার ভাষা নেই, তাদের ভাষা দিয়েছেন’- এই জাতীয় কথা বলে, আমি ক্ষোভে পাগল হয়ে যাই।’ অরুন্ধতীর কণ্ঠে তাচ্ছিল্য। ‘আমি তো বলি: ‘ভাষাহীন বলে কিছু নেই। তাদের জবরদস্তি করে মুখ বন্ধ রাখা হয়েছে, বুঝলেন, অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের কথা শোনা হয় না।‘
গল্প না লিখেও এতদিন বেঁচেছিলেন হয়তো এই কারণে যে তার নিজের জীবনযাত্রা উপন্যাসের কল্পলোকের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় অভিষিক্ত। অরুন্ধতী গোরস্থানবাসিনী হিজড়া না হতে পারেন, কিন্তু আনজুমের মনোভঙ্গি, তার কণ্ঠস্বর – সম্পূর্ণভাবেই তার।
অরুন্ধতী প্রসন্ন তৃপ্তির সাথে সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন। ‘তা বটে। আমার জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ গতানুগতিকতার বাইরে।‘
মানে আনজুমের মত অতটা গতানুগতিকতার বাইরে?
‘তা বলতে পারেন। আমার তো নানান জায়গার থেকে বন্ধু। নিজেদের পুরুষ মনে করে এমন নারী। সমকামী ছেলে। এক বন্ধু দিল্লীর বাসে একদিন এক দম্পতির আলাপ শুনছিল।‘ অরুন্ধতী বলতে বলতে হাসেন।
সেই বন্ধু অরুন্ধতীকে জানান যে দম্পতির পুরুষ সঙ্গিনীকে বলছিল: ‘আমার সারাজীবনে একটিই চাওয়া – আমি অরুন্ধতী রায়ের বৌ হতে চাই।‘
অরুন্ধতীর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তিনি জোরে হেসে ওঠেন।
‘মানুষের ভাবনায় এই গোলমেলে মাধুর্য আমার দারুণ লাগে।'
----------------

আশফাক স্বপন ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী উপমহাদেশীয় সংবাদ মাধ্যমে সাংবাদিকতা করছেন। বর্তমানে ঢাকার Daily Star পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। তার লেখা বাংলাদেশের  প্রথম আলো, সমকাল, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, পাকিস্তানের Dawn, ভারতের Times of India ও Statesman পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আটলান্টায় থাকেন।

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট