ছবির দেশে কবিতার দেশে (পর্ব ০২) - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়




''কুসুমের মাস রূপান্তরের মাস

মে মেঘহীন জুনের পৃষ্ঠে ছুরি

ভুলবো না আমি লিলির গুচ্ছ গোলাপের নিঃশ্বাস

বসন্তে আরও লুকানো যে মঞ্জরী...''

—লুই আরাগঁ

আমি যখন প্রথম বিদেশে যাই, তখনও জাহাজের যুগ পুরোপুরি শেষ হয়নি, বিমানের যুগ শুরু হয়ে গেছে। আগেকার দিনে আমরা কত ভ্রমণকাহিনিতে জাহাজযাত্রার বর্ণনা পড়েছি। সমুদ্রপৃষ্ঠে তৈরি হয়েছে কত রোমান্স, গল্প-উপন্যাস। স্বদেশ ছেড়ে বিদেশযাত্রার সময় জাহাজের আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও অন্যান্যদের সঙ্গে বেশ কয়েক দিনের মেলামেশায় মনকে অনেকটা প্রস্তুত করে তোলে, হঠাৎ একটা কালচার শক হয় না। সেই তুলনায় বিমানভ্রমণের কয়েকটি ঘণ্টা নিতান্তই বর্ণহীন।

সেই সময় আমার পরিচিত নামকরা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই, যেমন অমর্ত্য সেন, নবনীতা দেবসেন, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত প্রমুখ, সমুদ্রপথেই প্রবাসে গিয়েছিলেন। আমারও বাল্যকাল থেকেই জাহাজভ্রমণের স্বপ্ন ছিল। বাচ্চা বয়েসে যখনই কেউ আমাকে জিগ্যেস করত, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও, আমি বিনা দ্বিধায় উত্তর দিতাম, নাবিক! অথচ প্রাপ্ত বয়েসে আমাকে প্রথম সমুদ্র ডিঙোতে হল, হনুমানের মতন, আকাশপথে।

ছবির দেশে কবিতার দেশে (পর্ব ০১) - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ছবির দেশে কবিতার দেশে - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ছবির দেশে কবিতার দেশে

ভ্র ম ণ কা হি নী

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়




''আমি খুলে ফেলি পোশাক ও টুপি সেই মুহূর্তে

বালির ওপর উলঙ্গ দেহে চিৎ হয়ে শুই

বন্য রৌদ্রে শরীর পুড়িয়ে প্রতীক্ষা করি, বেরুবে কখন

আমাদের এই চামড়ার নীচে লুকিয়ে যে আছে, সেই ভারতীয়।''

—জাঁ ককতো

আমি দেশের বাইরে গিয়ে জীবনে প্রথম যে-বিদেশের মাটিতে পা রাখি, সেটা ফরাসিদেশ। সে অনেককাল আগেকার কথা।

আমার তখন অল্প বয়েস, বেশ গড়া-পেটা শরীর স্বাস্থ্য, ঝুঁকিবহুল জীবন কাটাতে ভালোবাসি। হঠাৎ হঠাৎ বন্ধুদের সঙ্গে বনে-পাহাড়ে চলে যাই, কিংবা সিমলা-হায়দ্রাবাদের মতন বড় শহর দর্শন করতে গিয়ে পয়সার অভাবে এক-আধদিন না খেয়ে কাটিয়ে দিই। কিংবা মধ্যরাত্রে কলকাতা শহরে অকারণে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে মারামারি বাঁধিয়ে পুলিশের গুঁতো খাই, গারদে চোর-পকেটমারদের সঙ্গে রাত কাটাই। তবু কিছুই গায়ে লাগে না, সবই যেন মজা। স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপনের মধ্যে জীবনকে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখার চেষ্টা।

কিন্তু আমার বিদেশ যাওয়ার, বিশেষত সাহেবদের দেশে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। সে বড় দামি, দুর্লভ ব্যাপার।

যদিও অল্প বয়স থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল বিশ্ব ভ্রমণের। বলা যেতে পারে, কাটা মুণ্ডের দিবাস্বপ্ন। কিংবা অন্ধের অভ্র-পুষ্প চয়ন। আমি পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু ও অতি গরিব পরিবারের সন্তান, কলেজ জীবনের শুরু থেকেই একাধিক টিউশনি ও নানারকম খুচখাচ পার্ট টাইম কাজ করে পড়াশুনো চালিয়েছি, তাই পড়াশুনোয় খুব মন দিতে পারিনি। তেমন একটা মেধাবী ছাত্রও ছিলাম না। তা ছাড়া সেই সময় থেকেই মাথায় কবিতা লেখার পোকা ঢোকে, লিটল ম্যাগাজিন বার করা ও কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে আড্ডা মারাটাই পরমার্থের মতন মনে হত। খুব ভালো ছাত্র ছাড়া অন্য কারুর সে সময়ে বিদেশে যাওয়া দুঃসাধ্য ছিল। ধনী ব্যক্তিরা যে নিজ ব্যয়ে বিদেশ ভ্রমণে যেতেন আগে, তাও পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ফরেন এক্সচেঞ্জ কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য ভারত সরকার বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

মনসা মথুরা ব্রজ। বিভিন্ন লেখকের ভ্রমণ কাহিনি পড়ে এবং গ্লোব ও ম্যাপ সামনে রেখে আমি পৃথিবী পরিক্রমা করেছি বহু অলস দুপুরে। ম্যাপ দেখা ছিল আমার প্রিয় নেশা। স্নানের সময় বাথরুমের নিভৃতিতে কখনও আমি স্পেনের জলদস্যু, কখনও আলাস্কার অভিযাত্রী। কাল্পনিক তলোয়ার এতবার চালিয়েছি যে আমার ধারণা হয়েছিল আমি ডগলাস ফেয়ার ব্যাঙ্কসের সঙ্গে লড়ে যেতে পারব।

যাই হোক, দারিদ্র্য, বাউণ্ডুলেপনা ও কবিতা নিয়ে হইহই করে দিন-টিন বেশ ভালোই কাটছিল, এমন সময় অকস্মাৎ আমার জীবনে একটা পরিবর্তন এসে গেল।

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট