জগতের সবচেয়ে-সুন্দর জলে-ডোবা পুরুষ মূল গল্প : গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস অনুবাদঃ মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

জগতের সবচেয়ে-সুন্দর জলে-ডোবা পুরুষ
মূল গল্প : গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়



যে বাচ্চারা প্রথম দেখেছিল ওই কালো আর চুপি-চুপি আসা ফোলা-ফোলা জিনিসটা সমুদ্দুরের মধ্য থেকে আসছে, তারা গোড়ায় নিজেদের বুঝিয়েছিল এ নিশ্চয়ই শত্রুপক্ষের কোনো জাহাজ।

তারপর তারা দেখতে পেলে যে এর কোনো নিশেনও নেই কিংবা নেই এমনকি মাস্তুলও, তখন তারা ভাবলে যে এ নিশ্চয়ই কোনো তিমিঙ্গিল। কিন্তু ঢেউ যখন সেটা ধুতে-ধুতে আছড়ে এনে ফেললো বেলাভূমিতে, তারা সরালে শ্যাওলার আস্তর, জেলিমাছের সব কর্ষিক আর মাছ আর জাহাজডুবির টুকিটাকি যা লেগে আছে গায়ে, আর তখনই তারা দেখতে পেলে এ-যে এক ডুবে-যাওয়া পুরুষমানুষ। 

সারা বিকেলটা তারা তাকে নিয়ে খেলেছিল, কবর দিচ্ছিল তাকে বালিতে, ফের তাকে খুঁড়ে-খুঁড়ে তুলছিল, এমন-সময় দৈবাৎ কে-একজন তাদের দেখতে পেলে আর গাঁয়ে গিয়ে বিপদের সংকেত ছড়িয়ে দিলে। যে-পুরুষরা তাকে ধরাধরি করে সবচেয়ে কাছের বাড়িটায় নিয়ে এলো তারা খেয়াল করলে যে অ্যাদ্দিন তারা যত-সব মৃতদেহ দেখেছে তাদের সকলের চাইতেই এ-লাশটার ওজন অনেক বেশি, প্রায় কোনো একটা ঘোড়ারই মতো ওজন, আর তারা পরস্পরকে বললে, হয়তো সে অনেকদিন ধরেই জলে ভাসছিল, আর তাইতে এমনকি তার হাড়ের মধ্যেও বোধহয় জল ঢুকে গিয়েছে। তারা তখন লাশটাকে মেঝেয় শুইয়ে দিলে আর তারা বলাবলি করলে সব লোকের চাইতেও এ-যে দেখছি লম্বা, ঘরটায় সে প্রায় আঁটেই না যে; তবে, তারা ভাবলে, হয়তো কোনো-কোনো ডুবে-মরা মানুষের প্রকৃতিই থাকে মৃত্যুর পরেও কেবলই বড়ো-হতে-থাকা। গায়ে তার দূর সিন্ধুর গন্ধ, শুধু তার আকৃতি দেখেই কেউ আন্দাজ করে নিতে পারে যে সে এক মানুষেরই লাশ, কারণ চামড়াটা তার কাদা আর আঁশের একটা শক্ত আস্তরে ঢেকে গিয়েছে।

মৃত লোকটা যে অচেনা-কেউ, এটা জানবার জন্যে তাদের এমনকি তার মুখটাও ধুয়েমুছে সাফ করতে হলো না। গ্রামটা গড়ে উঠেছে শুধুমাত্র বিশ-পঁচিশটা কাঠের বাড়িতে; সেসব বাড়ির উঠোন শান-বাঁধানো, কিন্তু কোথাও কোনো ফুল নেই, আর গ্রামটা ছড়িয়ে গেছে কোনো-একটা অন্তরীপের মরুভূমির মতো ঊষর প্রান্তে। ডাঙা এখানে এতই কম যে মায়েরা সবসময়েই ভয়ে-ভয়ে থাকে কখন হাওয়া এসে তাদের ছেলেমেয়েদের উড়িয়ে নিয়ে যায়, আর বছরগুলো তাদের মধ্যে যে-কজনকে এখানে সাবাড় করেছে, তাদের তীরের পাহাড় থেকে জলে ছুঁড়ে ফেলতে হয়েছে, কিন্তু সমুদ্র এখানে শান্ত, নিস্তরঙ্গ ও সুন্দর, আর সাত-সাতটা নৌকোতেই গ্রামের সব্বাই এঁটে যায়। কাজেই যখন তারা এই ডুবন্ত লোকটাকে আবিষ্কার করলে, পরস্পরের দিকে শুধু একবার তাকিয়েই তারা নিশ্চিন্ত হয়ে নিলে যে সকলেই তারা এখানে আছে।

সে-রাতে তারা আর সমুদ্রে কাজ করতে গেলো না। যখন লোকে হদিস নিতে গেলো যে আশপাশের গাঁগুলো থেকে কেউ হারিয়ে গেছে কি না, মেয়েরা থেকে গেলো পেছনে, এই ডুবন্ত লোকটার যত্ন-আত্তি করবার জন্যে। ঘাসের চাপড়া দিয়ে ডলে-ডলে তারা তাঁর গা থেকে কাদা তুলে নিলে, তারা সরিয়ে দিলে জলের তলার যেসব নুড়িপাথর তার চুলে জট পাকিয়ে ছিল, আর যা দিয়ে তারা মাছের আঁশ ছাড়ায় তা-ই দিয়ে তারা তার গায়ের শক্ত আস্তরটা চেঁচে নিলে। এসব করতে করতেই তারা খেয়াল করে দেখলো যে উদ্ভিদ বা শ্যাওলা যা তার গায়ে লেপটে আছে সেসব এসেছে দূর-দূরান্তের সাগর থেকে, গভীর জল থেকে, তার জামাকাপড় সব ফালি-ফালি চিলতে মাত্র, যেন সে প্রবালের গোলকধাঁধার মধ্য দিয়েই পাল খাটিয়ে গিয়েছিল। তারা আরো খেয়াল করলো যে সে মৃত্যু বহন করেছে স্বগর্বেই, কারণ অন্য-যেসব ডুবে-যাওয়া লোক আসে সমুদ্র থেকে সে-রকম কোনো নিঃসঙ্গ ভঙ্গি তার নেই, কিংবা নেই সেই কোটরে-বসা খ্যাপা কাতর চোখ যারা ডুবে মরে নদীতে। তবে শুধু যখন তারা তাকে আগাপাশতলা সাফ করলে তখনই আবিষ্কার করলে কেমনতর পুরুষ ছিল সে আসলে, আর এই আবিষ্কার যেন তাদের দম আটকে দিলে। তাদের দেখা সব পুরুষের মধ্যে সে-যে শুধু সবচেয়ে লম্বা, বলবান, তেজস্বী আর সবচেয়ে সুঠাম সুগঠন পুরুষ ছিল তা-ই নয়, আরো-কিছু-একটা ছিল যেন তার মধ্যে; তবে যদিও তারা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল তাদের কল্পনায় কিন্তু তার জন্যে কোনো ঠাঁই ছিল না।

সারা গাঁ খুঁজে তারা এমন-একটা বড়ো বিছানা পেলে না যার ওপর তারা তাকে শোয়াতে পারে কিংবা কোনো শক্তপোক্ত টেবিলও মিললো না যেটা তারা ব্যবহার করতে পারে মৃতদেহের নিশিজাগরের সময়। সবচেয়ে ঢ্যাঙা লোকের ছুটির দিনের পাতলুনও তার গায়ে লাগে না, সবচেয়ে হোঁত্কা লোকের রোববারের জামাও তার খাটো হয়, আর সবচেয়ে বড়োমাপের পায়ের জুতোতেও তার পা গলে না। তার এই অতিকায় আকৃতি আর রূপে মোহিত হয়ে, মন্ত্রমুগ্ধ মেয়েরা ঠিক করলে মস্ত একটা পালের কেম্বিস কাপড় দিয়ে তারা তার জন্যে একটা পাতলুন বানাবে, আর একটা জামা বানাবে কারো বিয়ের মূল্যবান ক্ষৌম বস্ত্রে, যাতে সে মৃত্যুর মধ্যেও নিজের মর্যাদা বজায় রেখে শুয়ে থাকতে পারে। গোল হয়ে ঘিরে বসে তারা যখন সেলাই করছে, আর সেলাইয়ের ফোঁড়ের মাঝে-মাঝে লাশটার দিকে তাকাচ্ছে, তখন তাদের মনে হলো সে-রাত্রির মতো হাওয়া যেন কখনও এমন অস্থির ছিল না অথবা সমুদ্রও এমন অশান্ত ছিল না, আর তারা আন্দাজ করলে এই বদলের সঙ্গে এই মৃতদেহের কোনো সম্বন্ধ আছে নিশ্চয়ই। তারা ভাবলে যে যদি এই গরীয়ান পুরুষ তাদের গাঁয়ে থাকতো, তবে তার বাড়ির দরোজা হতো সবচেয়ে প্রশস্ত, ছাত হতো সবচেয়ে উঁচু, মেঝে হতো সবচেয়ে পোক্ত, তার খাট বানানো হতো কোনো জাহাজের পাটাতন দিয়ে যেটা লোহার বলটু দিয়ে লাগানো থাকতো, আর তার স্ত্রী নিশ্চয়ই হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে। তারা ভাবলে, তার নিশ্চয়ই এতটাই কর্তৃত্ব থাকতো যে সে সমুদ্র থেকে মাছ নিয়ে আসতে পারতো শুধু তাদের নাম ধরে ডেকে-ডেকেই আর সে তার জমিতে এতই কাজ করতো যে পাথরের মধ্য থেকেও নিশ্চয়ই ফেটে বেরুতো ফোয়ারা, যাতে সে তীরের শৈলশিরায় বুনে দিতে পারতো ফুলগাছ। গোপনে-গোপনে তারা তাদের নিজেদের পুরুষদের সঙ্গে তার তুলনা করলে, এ-কথাই ভাবলে যে সারা জীবন ধরে তারা যা করতে পারতো না সে নিশ্চয়ই সে-কাজ করতে পারতো মাত্র একরাত্রের মধ্যেই, আর তারা তাদের হৃদয়ের একেবারে গভীরে নিজেদের পুরুষদের খারিজ করে দিলে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল, সবচেয়ে তুচ্ছ ও হীন, সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় জীব হিসেবে। তারা তাদের স্বপ্নবিলাসের গোলকধাঁধাতেই এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় তাদের মধ্যে সবচেয়ে যে প্রবীণা, যে বয়সে বুড়ি হয়ে গিয়েছে বলেই ডুবে-যাওয়া পুরুষটির দিকে কামনার চাইতে সহানুভূতির সঙ্গেই তাকিয়েছিল, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললে :

‘এর মুখটা যেন এস্তেবানের।’

সে-কথা সত্যি। বেশিরভাগই তার দিকে আরেকবার তাকিয়ে নিয়েই বুঝতে পারলে যে এস্তেবান ছাড়া অন্য আর-কোনো নামই তার হতে পারতো না। তাদের মধ্যে যারা একটু বেশি জেদি আর একরোখা, তারা আবার বয়েসেও সবার ছোট; তারা তখনও কয়েক ঘণ্টার জন্যে এই মায়াবিভ্রমে কাটিয়ে দিলে যে যখন তারা তাকে পোশাক পরাবে আর পেটেন্ট চামড়ার জুতো পরিয়ে শোয়াবে ফুলের মধ্যে, তার নাম হয়তো হয়ে উঠবে লাউতারো। কিন্তু এ তো শুধু এক অলীক বিভ্রম। কেম্বিস কাপড় যথেষ্ট ছিল না, বিচ্ছিরিভাবে কাটা আর সেলাই করা পাতলুনটা খুব আঁটো হলো, আর তার বুকের গোপন বল তার জামার বোতামগুলো পটপট করে ছিঁড়ে ফেললো। মাঝরাতের পর হাওয়ার শিস মরে গেলো, সমুদ্র ঢুলে পড়লো তার বুধবারের ঘুমে। স্তব্ধতাই শেষ সন্দেহগুলোতে ইতি টেনে দিলে, এস্তেবানই ছিল সে, এস্তেবান। যে-মেয়েরা তাকে পোশাক পরিয়েছিল, তার চুলে কাঁকই দিয়েছিল, তার নখ কেটে তার দাড়ি কামিয়ে দিয়েছিল, তারা তাদের করুণার শিহরণ চেপে রাখতে পারলে না যখন তাকে মাটির ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাবার ব্যাপারটা মেনে নিতে হলো। তখনই তারা বুঝতে পারলে কতটা অসুখী ছিল সে, নিশ্চয়ই অসুখী ছিল, তার ওই বিশাল বপুটা নিয়ে, কারণ মৃত্যুর পরেও সেটা তাকে জ্বালাতন করছে। তারা তাকে যেন দেখতে পারছিল সজীব, হেলে মাথা নুইয়ে দরোজার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করবার দণ্ড পেয়েছে সে, মাথা ঠুকে-ঠুকে যাচ্ছে কড়িবরগায়, কারো সঙ্গে দেখা করতে গেলে দাঁড়িয়েই থাকতে হচ্ছে তাকে, তার নরম গোলাপি সী-লায়ন মাছের মতো হাত দুটি নিয়ে সে যে কী করবে ভেবেই পাচ্ছে না, বিশেষত যখন গৃহকর্ত্রী খুঁজছেন তাঁর সবচেয়ে দুর্দম্য চৌকি, আর তাঁকে অনুনয় করছেন, এদিকে যদিও আতঙ্কে মরো-মরো, বসুন এখানে, এস্তেবান একটু বসুন, অনুগ্রহ করে, আর সে, দেয়ালে হেলান দিয়ে, মৃদু হেসে, আপনি মোটেই ব্যস্ত হবেন না সেনিওরা, আমি এই-তো বেশ আছি, এখানে, তার গোড়ালি ঘায়ে-ঘায়ে দগদগে, তার পিঠ পুড়ে ঝামা, সেই একই জিনিস করে-করে, এতবার, এত জায়গায়, যখনই কারো সঙ্গে দেখা করতে যায়, আপনি ব্যস্ত হবেন না সেনিওরা, আমি এই-তো বেশ আছি, শুধু একটা চৌকি ভেঙে দেবার ভয়ে আর সংকোচে, কখনও এটা না-জেনেই যে হয়তো তাঁরা বলতো, যাবেন না এস্তেবান, অন্তত কফি খেয়ে যান, এই-তো তৈরি হয়ে গেছে, হয়তো তাঁরাই পরে ফিসফিস করে বলাবলি করতেন, যাক, অবশেষে মস্ত আপদটা বিদেয় হয়েছে, কী ভালো, কী-যে সুপুরুষ এই আকাটটা, কিন্তু অবশেষে চলে গিয়েছে। এইভাবেই মেয়েরা দেহটার পাশে বসে-বসে ভাবছিল ভোরের একটু আগে। পরে, যখন তারা তার মুখ ঢেকে দিলে একটা রুমালে, যাতে চোখে আলো পড়ে তাকে বিরক্ত না-করে, তাকে এমন মৃত দেখালো, এমন চিরকাল-মৃত দেখালো, এত অসহায় আর প্রতিরোধহীন, এত তাদের নিজেদের পুরুষদের মতোই যে তাদের বুকে খাঁজ কেটে-কেটে বেরুলো প্রথম অশ্রুর ফোঁটাগুলো। অল্প বয়েসিদের মধ্যে একজন সরাসরি কাঁদতে শুরু করে দিলে। অন্যরা, যোগ দিয়ে, দীর্ঘশ্বাস থেকে বিলাপের পথে চলে গেলো, আর যত তারা ফোঁপালো ততই তাদের গলা ছেড়ে ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করলো, কারণ এই জলে-ডোবা পুরুষটি ক্রমেই তাদের কাছে আরো এস্তেবান হয়ে উঠছে, এর ফলে তারা এতই কান্নাকাটি করলে যে তার যেন শেষই নেই, কারণ সে যে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্ব, সবচেয়ে পরিত্যক্ত, সবচেয়ে শান্তিপ্রিয়, সবচেয়ে কৃতজ্ঞ, সবচেয়ে বাধ্য ও বশম্বদ পুরুষ, বেচারা এস্তেবান। কাজেই পুরুষরা যখন খবর নিয়ে ফিরে এলো যে জলে-ডোবা এই লোকটা আশপাশের গ্রামেরও কেউ নয়, মেয়েরা তাদের দরোদরো চোখের জলের মধ্যেও আনন্দ-উচ্ছ্বাসের একটা ফাঁক পেয়ে গেলো :

‘ঈশ্বরই ধন্য,’ দীর্ঘশ্বাস ফেললে তারা, ‘এ শুধু আমাদেরই।’

পুরুষরা ভাবলে এই আদিখ্যেতা নেহাতই মামুলি মেয়েলি খামখেয়াল। রাত্তির-জোড়া কঠিন খোঁজখবরের পর ক্লান্ত আর অবসন্ন, তারা শুধু চাচ্ছিল এই নবাগত আপদটাকে এই ঊষর; হাওয়াবিহীন; দিনটায় রোদ তেতে-ওঠার আগেই বিদেয় করে দিতে। তারা মুখমাস্তুল আর কোঁচের ঝরতি-পড়তি দিয়ে উদ্ভাবন করে নিলে এক খাটুলি, সব জড়ো করে দড়িদড়া দিয়ে শক্ত করে বেঁধে, যাতে, যতক্ষণ-না তারা উপকূলের পাহাড়ে পৌঁছোয়, লাশটার ওজন সামলাতে পারে। তারা চেয়েছিল এক মালের জাহাজের নোঙরও তার সঙ্গে বেঁধে দিতে, যাতে সে গহন ঢেউয়ে সহজেই ডুবে যেতে পারে, যেখানে, গভীরে, মাছেরা সব অন্ধ আর ডুবুরিরা মরে পিছুটানে, আর মন্দ চোরাটানগুলো যাতে তাকে আর ফিরিয়ে না-আনে বেলাভূমিতে, যেমন ঘটেছিল অন্য অনেক মৃতদেহের বেলায়। কিন্তু যতই তারা তাড়াহুড়ো করলে, ততই মেয়েরা সময় নষ্ট করার কৌশল বার করতে লাগলো। আঁতকে-ওঠা মুরগিদের মতো হাঁটছিল তারা, বুকের মধ্যে সমুদ্দুরের মাদুলি-তাবিজ ঠুকরে-ঠুকরে, কেউ তার কাঁধে সুবাতাসের অংসফলক বেঁধে দেবে বলে বাধা দিচ্ছে, অন্যপাশে কেউ তার মণিবন্ধে বেঁধে দিচ্ছে কব্জিদিগ্‌দর্শিকা, আর বহুৎ, ‘ওখান থেকে সরো তো মেয়ে, কই, দেখি, পথ থেকে সরো,’ ‘এই দ্যাখো, তুমি আমাকে এক্ষুনি লাশটার ওপর ফেলে দিচ্ছিলে,’ কথাবার্তার পর, পুরুষরা টের পেতে শুরু করলে নিজের জীবনেরই অবিশ্বাস অনাস্থা, আর ঘ্যান-ঘ্যান করতে শুরু করে দিলে অচেনা একটা লোকের জন্যে কেন এমন আদিখ্যেতা, কেন প্রধান বেদির এত-সব শোভাভূষণ, কারণ যত-খুশি ক্রুশের পেরেক বা দিব্য-জলের শিশিই তার সঙ্গে দেখা যাক-না কেন, হাঙররা তাকে একইভাবে চিবিয়ে খাবে। তবু মেয়েরা তার ওপর স্তূপ করেই চললো অর্থহীন সব প্রত্ননিদর্শন, সাধু-সন্তের নখ-চুল ইত্যাদি, ছুটলো বারে-বারে সামনে-পেছনে, টালমাটাল, থুবড়ে পড়তে-পড়তে, যখন চোখের জলে যা তারা প্রকাশ করেনি তা প্রকাশ করতে শুরু করলে ঘন-ঘন দীর্ঘশ্বাসে; শেষটায় পুরুষরা সব ফেটে পড়লো এই বলে ‘কবে থেকে, শুনি, ভেসে-যাওয়া কোনো মড়ার জন্যে কেউ এমন আদিখ্যেতা করেছে, জলে-ডোবা একটা কেউ-না, বুধবারের মাংসের একটা হিমঠাণ্ডা চাক আর-কিছুই সে নয়,’ তখন মেয়েদের একজন, এত অযত্নে মরমে মরে গিয়ে, মরা পুরুষটির মুখ থেকে একটানে খুলে দিলে রুমাল, আর পুরুষদেরও তার মুখ দেখে দম আটকে গেলো।

এ যে এস্তেবান। তাকে চেনবার জন্যে নামটা ফিরে আওড়াবারও দরকার নেই। যদি তাদের বলা হতো এ হলো সার ওয়ালটার র‍্যলে, তার গ্রিঙ্গো উচ্চারণের ঝোঁকে তাদের ওপর ছাপ ফেললেও ফেলতে পারতো, কাঁধে ল্যাজ ঝোলা সবুজ টিয়া, নরখাদক-মারা গাদাবন্দুক; কিন্তু জগতে শুধু একজনই এস্তেবান হতে পারে, আর এই-তো সে, হাত-পা ছড়িয়ে চিত পড়ে আছে তিমিঙ্গিলের মতো, পায়ে জুতো নেই, পরে আছে এক বাঁটকুল বাচ্চার পাতলুন, আর হাত-পায়ের পাথুরে ওইসব নখ যাকে কাটতে হলো একটা ছুরি দিয়ে। তার মুখ থেকে রুমালটা একবার সরাবামাত্র দেখা গেলো লজ্জায়শরমে সে গুটিয়ে আছে, এ-তো আর তার দোষ নয় যে সে এমন অতিকায়, কিংবা এত ভারী, কিংবা এত সুন্দর, আর যদি সে জানতো যে সে তা-ই হতে চলেছে তবে জলে ডুবে মরবার জন্যে সে নিশ্চয় আরো-দূর কোনো গহনগোপন জল বেছে নিতো, সত্যি, আমি হলে গলায় ঝুলিয়ে নিতাম এস্পানিয়ার বৃহৎ রণতরীর নোঙরটাই, আর টলতে টলতে আছড়ে পড়তাম কোনো সুদূর শৈলচূড়া থেকে সেই-তার মতো যে খামকা-খামকা ব্যস্তসমস্ত করে তুলতে চায় না লোকজনদের নিজের এই বুধবারের লাশটা দিয়ে, যেমন বাপু তোমরা বলো, কাউকে এই নোংরা ঠাণ্ডা মাংসের চাকটা দিয়ে বিরক্ত করতে চাই না বাপু — এই মাংসের টুকরোর সঙ্গে আমার কিন্তু কোনো সম্পর্কই নেই। তার ভাবেভঙ্গিতে এতটাই সত্য ছিল যে এমনকি সবচেয়ে অবিশ্বাসী সন্দেহপ্রবণ পুরুষও — সেই যারা সমুদ্রের মধ্যে অন্তবিহীন রাত্রির তিক্ততা টের পায় হাড়ে-হাড়ে যখন ভাবে যে তাদের স্ত্রীরা তাদের সম্বন্ধে স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে শেষটায় কোনো জলে-ডোবা পুরুষেরই স্বপ্ন দেখবে — এমনকি তারাও, আর অন্যরাও — যাদের বুক আরো ডাকাবুকো কঠিন — তারা শুদ্ধ তাদের অস্থির মধ্যে মজ্জায় মজ্জায় শিউরে-শিউরে উঠলো এস্তেবানের এই অকৃত্রিমতায়।

এমনি করেই তারা সবচেয়ে জমকালো সবচেয়ে চমত্কার সবচেয়ে আশ্চর্য এক অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্থা করলে, যতটা তারা ভাবতে পারে ততটাই, আর তা কি না কোনো এক নিঃস্ব দুস্থ পরিত্যক্ত জলে-ডোবা পুরুষের জন্যে। কয়েকজন মেয়ে গেলো আশপাশের গ্রাম থেকে ফুল আনতে, ফিরে এলো আরো-অনেক মেয়ের সঙ্গে, যারা শুনেও বিশ্বাস করেনি তাদের কী বলা হলো, আর যখন তারা নিজের চোখে দেখলো মৃতদেহটা ফিরে গেলো আরো, আরো ফুল আনতে, আর তারা আনলো তো আনলোই, আরো আরো ফুল, কত-কত ফুল, শেষটায় সেখানে স্তূপ হয়ে রইলো এত ফুল আর জড়ো হয়ে গেলো এত লোকজন যে সেখানে এক-পা হাঁটাও মুশকিল হয়ে উঠলো। শেষ মুহূর্তে তাদের ভারি কষ্ট হলো তাকে অনাথের মতো জলে ফিরিয়ে দিতে, আর তারা সেরা লোকজনদের মধ্য থেকে তার জন্যে বেছে নিলে বাবা আর মা আর মাসি-পিসি, মামা-খুড়ো-তুতোভাই, তুতোবোন যে এর মারফতই গাঁয়ের সবাই হয়ে উঠলো একে-আরের আত্মীয়। কয়েকজন খালাসি যাঁরা দূর থেকে শুনলো কান্নার রোল, পথ ভুল করলো জাহাজের; আর লোকে শুনতে পেলো এমন একজনের কথা যে নিজেকে বড়ো মাস্তুলটায় বাঁধিয়ে নিয়ে মনে করলো প্রত্নপ্রাচীন মোহিনী মায়াবিনী সাইরেনদের কথা ও কাহিনী। কারা তাকে কাঁধে করে নিয়ে যাবে সেই গৌরবের অধিকারের জন্যে যখন তারা হাতাহাতি করলে — তারা যাবে উপকূলের শৈলচূড়ার খাড়া গড়খাই বেয়ে — নারীপুরুষ সকলেই প্রথমবারের মতো সচেতন হয়ে পড়লো তাদের পথঘাটের ঊষর নিরানন্দ অবস্থার কথা, কেমন শুষ্ক খরখরে তাদের উঠোন, কতটা সংকীর্ণ তাদের স্বপ্ন, যখন তারা মুখোমুখি দাঁড়ালে তাদের জলে-ডোবা পুরুষটির সুঠামসৌষ্ঠব আর সৌন্দর্যের সামনে। তারা তাকে যেতে দিলে কোনো নোঙর ছাড়াই যাতে সে ফিরে আসতে পারে, আবার যদি তার ইচ্ছে করে, আর তারা সবাই শতাব্দীর একটা টুকরোর জন্যে শ্বাস রোধ করে রইলো যখন মৃতদেহ আছড়ে পড়লো পাতালের উদ্দেশে। পরস্পরের দিকে তাকাবারও কোনো দরকার হলো না তাদের এটা জানতে যে এখন আর তারা সকলে একসঙ্গে উপস্থিত নেই, যে তারা কখনোই আর সবাই মিলে একসঙ্গে উপস্থিত থাকবে না। কিন্তু তারা এও জেনে গেলো যে সবকিছুই এখন থেকে অন্যরকম হয়ে যাবে, যে তাদের বাড়িঘরে থাকবে প্রশস্ত সব দরোজা, উঁচু-উঁচু কড়িবরগা, শক্তপোক্ত মেঝে যাতে এস্তেবানের স্মৃতি যে-কোনোখানেই ঘুরে বেড়াতে পারে থামে-ছাতে ঘা না খেয়ে, যাতে কেউ পরে ফিসফিস করে বলতেও সাহস না-পায় যে মস্ত আপদটা অবশেষে টেঁশে গিয়েছে, খুবই খারাপ ব্যাপার, তবে সুপুরুষ হাঁদাটা অবশেষে মরেই গেলো, কারণ এখন তারা তাদের বাড়িঘর রঙ করে দেবে হাসিখুশির রঙে আর ছটায়, এস্তেবানের স্মৃতিকে শাশ্বত করে তোলবার জন্যে; আর তারা পাথর ফাটিয়ে জলের ফোয়ারা বার করে দেবার জন্যে অক্লান্ত খেটে-খেটে তাদের শিরদাঁড়া ভাঙবে, শৈলচূড়ায় রুইবে ফুলগাছ যাতে ভবিষ্যৎ বছরগুলোয় ঊষার সময় বড়ো-বড়ো যাত্রীজাহাজের লোকেরা বারদরিয়ায় জেগে যায় বাগানের ফুলের গন্ধে ঝিম ধরে গিয়ে আর কাপ্তেন নেমে আসে তার পোশাকি উর্দি গায়ে সাঁকো থেকে, তার নভশ্চরী, তার ধ্রুবতারা, উর্দিতে তার যুদ্ধপদকের সারি-সারি ভূষণ বসানো, দিগন্তের দিকে অন্তরীপের গোলাপি ভাঙা টুকরোটা দেখিয়ে কাপ্তেন বলে উঠবে চোদ্দটা ভাষায়, দ্যাখো-দ্যাখো, দ্যাখো ওখানে, যেখানে হাওয়া এখন এত শান্ত যে এ যেন ঊনপঞ্চাশ বিছানার তলায় ঘুমোতে গিয়েছে, ওই ওখানে, যেখানে রৌদ্র এত উজ্জ্বল যে সূর্যমুখীরা জানেই না কোনদিকে মুখ ফেরাবে, হ্যাঁ, ওই ওখানে, ওটা তো এস্তেবানের গ্রাম।
প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট