রাশিয়া ভ্রমণ - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রাশিয়া ভ্রমণ
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মস্কো বিমানবন্দরে পা দিলুম খুব ভোরবেলায়। সারা রাত প্রায় জেগেই কাটাতে হয়েছে। কলকাতা থেকে এরোফ্লোট বিমানে চেপেছিলুম বিকেলবেলা, তারপর বোম্বে, করাচি আর তাসকেন্টে বিমানটি মাটি ছুঁয়েছিল, আমাদেরও নামতে হয়েছিল দুবার। তার মধ্যে শেষ রাতে তাসকেন্টে নেমে আমি ঝোলা থেকে একটা সোয়েটার বার করে পরে নিয়েছিলুম। রাশিয়ার ঠান্ডা সম্পর্কে অনেকেই ভয় দেখিয়েছিল আগে থেকে, কিন্তু আমি খুব একটা শীত-কাতুরে নই, তা ছাড়া কিছুদিন আগেই ডিসেম্বর-জানুয়ারির ক্যানাডার তুষারের রাজ্য ঘুরে এসেছি, সুতরাং মে মাসের রাশিয়াকে ডরাব কেন? অবশ্য সঙ্গে একটা পাতলা ওভারকোটও এনেছি।

বিমানে রাত্তিরটা বেশ গল্প-গুজবেই কেটে গেছে। সহযাত্রী পেয়েছিলুম দুই বাঙালি তরুণকে। একজনের নাম সুবোধ রায়, সে মস্কোতে আছে প্রায় সাত-আট বছর, উচ্চশিক্ষার্থে। কিছুদিনের জন্য কলকাতায় ছুটি কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছে আবার। সুবোধ খুব দিলদরিয়া ধরনের, উচ্ছ্বাসপ্রবণ এবং আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। অন্যজনের নাম অসিতবরণ দে, সে প্রায় চোদ্দো বছর বাদে চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে কলকাতা-দর্শনে এসেছিল। সে একটু চাপা ও লাজুক স্বভাবের। আমরা তিনজনে মিলে মস্কো-প্রাহা-কলকাতার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছিলুম। সন্ধে থেকে মাঝেমধ্যেই আমাদের খাদ্য-পানীয় পরিবেশন করা হচ্ছিল, বিমানযাত্রার একঘেয়েমি কাটাবার জন্যই বোধহয় ওরা অত ঘন ঘন খাবার দেয়, কিন্তু অত কি খাওয়া যায়? শেষবারের খাবার আমি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলুম।

রবীন্দ্রসংগীতে ভাববার কথা - সত্যজিৎ রায়

প্রবন্ধ
রবীন্দ্রসংগীতে ভাববার কথা
সত্যজিৎ রায়


আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে, দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে কথোপকথনে রবীন্দ্রনাথ লোকের মুখে তাঁর গানের কী দশা হচ্ছে সেই নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন

গানের ভিতর দিয়ে আমি যে জিনিসটি ফুটিয়ে তুলতে চাই সেটা আমি কারও গলায় মূর্ত হয়ে ফুটে উঠতে দেখলুম না। আমার যদি গলা থাকত তাহলে হয়তো বা বোঝাতে পারতুম কী জিনিস আমার মনে আছে। আমার গান অনেকেই গায়, কিন্তু নিরাশ হই শুনে।


আজকাল অনেকেই রবীন্দ্রসংগীতের পক্ষ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই খেদোক্তির পুনরাবৃত্তি করছেন। স্বরলিপিতে অনেক গানের মূল সুর বিকৃত হচ্ছে, বা পুরোনো স্বরলিপির সঙ্গে তার নতুন সংস্করণের বেমিল পাওয়া যাচ্ছে, সে দিকেও কেউ কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

নোনাজল - সৈয়দ মুজতবা আলী

ছোটগল্প
নোনাজল 
 সৈয়দ মুজতবা আলী

সেই গোয়ালন্দ চাঁদপুরী জাহাজ৷ ত্রিশ বৎসর ধরে এর সঙ্গে আমার চেনাশোনা৷ চোখ বন্ধ করে দিলেও হাতড়ে হাতড়ে ঠিক বের করতে পারব, কোথায় জলের কল, কোথায় চা-খিলির দোকান, মুর্গীর খাঁচাগুলো রাখা হয় কোন জায়গায়৷ অথচ আমি জাহাজের খালাসী নই—অবরের-সবরের যাত্রী মাত্র৷

ত্রিশ বৎসর পরিচয়ের আমার আর সবই বদলে গিয়েছে, বদলায় নি শুধু ডিসপ্যাচ স্টীমারের দল৷ এ-জাহাজের ও-জাহাজের ডেকে-কেবিনে কিছু কিছু ফেরফার সব সময়ই ছিল, এখনও আছে, কিন্তু সব কটা জাহাজের গন্ধটি হুবহু একই৷ কীরকম ভেজা-ভেজা, সোঁদা-সোঁদা যে গন্ধটা আর সব-কিছু ছাপিয়ে ওঠে, সেটা মুর্গী-কারি রান্নার৷ আমার প্রায়ই মনে হয়েছে, সমস্ত জাহাজটাই যেন একটা আস্ত মুর্গী, তার পেটের ভেতর থেকে যেন তারই কারি রান্না আরম্ভ হয়েছে৷ এ-গন্ধ তাই চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, গোয়ালন্দ, যে কোন স্টেশনে পৌঁছানো মাত্রই পাওয়া যায়৷ পুরনো দিনের রূপরসগন্ধস্পর্শ সবই রয়েছে, শুধু লক্ষ্য করলুম ভিড় আগের চেয়ে কম৷

ভিখারিনী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ছোটগল্প)

ছোটগল্প
ভিখারিনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


গল্পগুচ্ছের প্রথম গল্পটির নাম ‘ঘাটের কথা’। এটি প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকার কার্তিক ১২৯১ সংখ্যায়। তার আগে একই পত্রিকার ১২৮৪ বঙ্গাব্দের (১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ) শ্রাবণ-ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘ভিখারিণী’ গল্পটি। এখন পর্যন্ত যতদূর জানা যায়, এটিই তাঁর লেখা প্রথম গল্প, যা কোনো সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন মাত্র ষোলো। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর কোনো গ্রন্থে অবশ্য এ-গল্পটিকে স্থান দেননি। বিশ্বভারতী প্রকাশিত গল্পগুচ্ছের চতুর্থ খ– (১৩৬৯ বঙ্গাব্দ/ ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ) এবং রবীন্দ্র রচনাবলীর চতুর্দশ খ– (১৩৯৮ বঙ্গাব্দ) এটি অন্তর্ভুক্ত হয়।
আসুন আজ পড়া যাক ভিখারিণী গল্পটি।


প্রথম পরিচ্ছেদ

কাশ্মীরের দিগন্তব্যাপী জলদস্পর্শী শৈলমালার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র গ্রাম আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটিরগুলি আঁধার আঁধার ঝোপঝাপের মধ্যে প্রচ্ছন্ন। এখানে সেখানে শ্রেণীবদ্ধ বৃক্ষচ্ছায়ার মধ্য দিয়া একটি-দুইটি শীর্ণকায় চঞ্চল ক্রীড়াশীল নির্ঝর গ্রাম্য কুটিরের চরণ সিক্ত করিয়া, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপলগুলির উপর দ্রুত পদক্ষেপ করিয়া এবং বৃক্ষচ্যুত ফুল ও পত্রগুলিকে তরঙ্গে তরঙ্গে উলটপালট করিয়া, নিকটস্থ সরোবরে লুটাইয়া পড়িতেছে। দূরব্যাপী নিস্তরঙ্গ সরসী--লাজুক উষার রক্তরাগে, সূর্যের হেমময় কিরণে, সন্ধ্যার স্তরবিন্যস্ত মেঘমালার প্রতিবিম্বে, পূর্ণিমার বিগলিত জ্যোৎস্নাধারায় বিভাসিত হইয়া শৈললক্ষ্মীর বিমল দর্পণের ন্যায় সমস্ত দিনরাত্রি হাস্য করিতেছে। ঘনবৃক্ষবেষ্টিত অন্ধকার গ্রামটি শৈলমালার বিজন ক্রোড়ে আঁধারের অবগুণ্ঠন পরিয়া পৃথিবীর কোলাহল হইতে একাকী লুকাইয়া আছে। দূরে দূরে হরিৎ শস্যময় ক্ষেত্রে গাভী চরিতেছে, গ্রাম্য বালিকারা সরসী হইতে জল তুলিতেছে, গ্রামের আঁধার কুঞ্জে বসিয়া অরণ্যের ম্রিয়মাণ কবি বউকথাকও মর্মের বিষণ্ন গান গাহিতেছে। সমস্ত গ্রামটি যেন একটি কবির স্বপ্ন।

এই গ্রামে দুইটি বালক-বালিকার বড়োই প্রণয় ছিল। দুইটিতে হাত ধরাধরি করিয়া গ্রাম্যশ্রীর ক্রোড়ে খেলিয়া বেড়াইত; বকুলের কুঞ্জে কুঞ্জে দুইটি অঞ্চল ভরিয়া ফুল তুলিত; শুকতারা আকাশে ডুবিতে না ডুবিতে, উষার জলদমালা লোহিত না হইতে হইতেই সরসীর বক্ষে তরঙ্গ তুলিয়া ছিন্ন কমলদুটির ন্যায় পাশাপাশি সাঁতার দিয়া বেড়াইত। নীরব মধ্যাহ্নে স্নিগ্ধতরুচ্ছায় শৈলের সর্বোচ্চ শিখরে বসিয়া ষোড়শবর্ষীয় অমরসিংহ ধীর মৃদুলস্বরে রামায়ণ পাঠ করিত, দুর্দান্ত রাবণ-কর্তৃক সীতাহরণ পাঠ করিয়া ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিত। দশমবর্ষীয়া কমলদেবী তাহার মুখের পানে স্থির হরিণনেত্র তুলিয়া নীরবে শুনিত, অশোকবনে সীতার বিলাপকাহিনী শুনিয়া পক্ষ্ণরেখা অশ্রুসলিলে সিক্ত করিত। ক্রমে গগনের বিশাল প্রাঙ্গণে তারকার দীপ জ্বলিলে, সন্ধ্যার অন্ধকার-অঞ্চলে জোনাকি ফুটিয়া উঠিলে, দুইটিতে হাত ধরাধরি করিয়া কুটিরে ফিরিয়া আসিত। কমলদেবী বড়ো অভিমানিনী ছিল; কেহ তাহাকে কিছু বলিলে সে অমরসিংহের বক্ষে মুখ লুকাইয়া কাঁদিত। অমর তাহাকে সান্ত্বনা দিলে, তাহারঅশ্রুজল মুছাইয়া দিলে, আদর করিয়া তাহার অশ্রুসিক্ত কপোল চুম্বন করিলে, বালিকার সকল যন্ত্রণা নিভিয়া যাইত। পৃথিবীর মধ্যে তাহার আর কেহই ছিল না; কেবল একটি বিধবা মাতা ছিল আর স্নেহময় অমরসিংহ ছিল, তাহারাই বালিকাটির অভিমান সান্ত্বনা ও ক্রীড়ার স্থল।

একটি দিন - হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (ছোটগল্প)

ছোটগল্প
একটি দিন

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

মেয়েটার জ্বর আর ছাড়ে না৷ কী যে ঘুসঘুসে জ্বর হয়েছে তা বোঝাও যায় না৷ রামরতনবাবু অস্থির হয়ে ওঠেন৷ রমা মেয়েটি আবার অবুঝ৷ রোজ সকালে উঠেই রামরতনবাবুকে বলে, 'বাবা আজ কী খাব?'

উত্তর বাবাকে আর দিতে হয় না— মা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, 'খাবি আবার কী? মেয়ের জ্বর তা যেন বোঝেন না৷ হাড়মাস আমার জ্বালিয়ে খেলে৷'

রামরতনবাবু মৃদুস্বরে বলেন, 'আহা ছেলেমানুষ ওকে অমন করে বকছ কেন? ওরে রমা এবার তোর জ্বর ছেড়ে যাবে রে৷ তার পর তোকে ভাত দেব৷ এই দেখ না আর কটা দিন৷'

বাবার আশ্বাসবাণী শুনে রমার মুখে হাসি দেখা দেয়— বিছানার ওপরে উঠে বসে বলে, 'হ্যাঁ বাবা তাড়াতাড়ি আমার জ্বর সেরে দাও না, তার পর—'

রমা তার কথা শেষ করতে পারে না৷ কথার মাঝেই মা বলেন, 'হ্যাঁ গো, আজকে একটা ডাক্তার ডাকবে তো? আর তো পারা যায় না মেয়েটাকে নিয়ে৷ রোগে ভুগে ভুগে দেখ না মা আমার আধখানা হয়ে গেছে৷'

পিঁপড়া - হুমায়ূন আহমেদ (ছোটগল্প)

ছোটগল্প
পিঁপড়া 

হুমায়ূন আহমেদ

আপনার অসুখটা কি বলুন।

রুগি কিছু বলল না, পাশে বসে-থাকা সঙ্গীর দিকে তাকাল।

ডাক্তার নূরুল আফসার, এমআরসিপি, ডিপিএস, অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। তাঁর বিরক্তির তিনটি কারণ আছে। প্রথম কারণ হচ্ছে- আটটা বেজে গেছে, রুগি দেখা বন্ধ করে বাসায় যেতে হবে । আজ তার শ্যালিকার জন্মদিন । দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- গ্রাম থেকে আসা রুগি তিনি পছন্দ করেন না । এরা হয় বেশি কথা বলে, নয় একেবারেই কথা বলে না। ভিজিটের সময় হলে দর-দাম করার চেষ্টা করে। হাত কচলে মুখে তেলতেলে ভাব ফুটিয়ে বলে, কিছু কম করা যায় না ডাক্তার সাব। গরিব মানুষ ।

আজকের এই রুগিকে অপছন্দ করার তৃতীয় কারণটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবু নূরুল আফসার সাহেবের কাছে এই কারণটিই প্রধান বলে বােধ হচ্ছে। লোকটির চেহারা নির্বোধের মতো। এই ধরনের লোক নিজের অসুখটাও ঠিকমতো বলতে পারে না, অন্য একজনের সাহায্য লাগে ।

আইডিয়ার কামড়া - হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (ছোটগল্প)

আইডিয়ার কামড়া
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়


১৪ বছর বয়স থেকে গল্প লেখা শুরু করেছিলাম৷ তখন আমি ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র৷ ওই বয়সেই আমরা কয়েকজন সহপাঠী মিলে একটা সাহিত্যিক গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলাম৷ সন্তোষকুমার ঘোষ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রমাকৃষ্ণ মৈত্র, জগৎ দাস এবং আমি— এই ক'জন ক্লাসফ্রেন্ড এক সঙ্গে লেখালেখি করতাম৷ সন্তোষ আর সুভাষ উত্তরকালে বাংলা সাহিত্যে বড় মাপের প্রতিষ্ঠা পেয়েছে৷ রমাকৃষ্ণ ও জগতের লেখার হাতও ছিল চমৎকার৷ কিন্তু, আমারই মতো ওরা লেখার অভ্যাসটা দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারেনি৷ পারলে ওরা সাহিত্য জগতে নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠা পেত বলে আমার বিশ্বাস৷ যাই হোক, যেটা ঘটেনি তা নিয়ে আক্ষেপ করা নিরর্থক৷ পুরনো দিনের দিকে একটু ফিরে তাকালে রোমন্থনজনিত বিষণ্ণতা সম্পূর্ণ কাটিয়ে ওঠা মুশকিল৷ মনে পড়ছে, স্কুলে পড়ার সময় গড়ে তুলেছিলাম কল্যাণ সঙ্ঘ সাহিত্যসভা৷ শাঁখারিপাড়ায় আমার মামাবাড়িতে এই সাহিত্যসভার অধিবেশন হত৷ প্রতি মাসে৷ আমার মামাতো দাদা অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সাহিত্যসভার মূল পান্ডা৷ তা ছাড়া তিনি ছিলেন বিপ্লবী রাজনীতির একজন একনিষ্ঠ কর্মী৷ ওঁর আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সের খবর আমি অবশ্য জানতে পেরেছিলাম অনেক পরে৷ যাই হোক, কল্যাণ সঙ্ঘ সাহিত্যসভার আমন্ত্রণে নরেন্দ্র দেব, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং বুদ্ধদেব বসুর মতো দিকপাল সাহিত্যসেবীও শাঁখারিপাড়ায় আমার মামাবাড়িতে আসতেন৷ ওঁদের ধরে আনার ব্যাপারে আমার মামাতো দাদার কৃতিত্বই ছিল সব থেকে বেশি৷ আমাদের সাহিত্য জীবনের গার্জেন ছিলেন মাস্টারমশাই সুধাংশু সেনগুপ্ত, নন্দগোপাল সেনগুপ্তের ছোটভাই৷ আমরা একটা লাইব্রেরিও চালাতাম৷ লাইব্রেরিতে বইয়ের সংগ্রহ খুব বিরাট কিছু ছিল না৷ কিন্তু, আমাদের মতো খুদে সাহিত্যিসাধকের কাছে এই লাইব্রেরি ছিল মন্দিরের মতো৷ পাঠ্যপুস্তকের জগতের বাইরে যে আরও একটা জগৎ আছে তা কিন্তু আমরা কল্যাণ সঙ্ঘ সাহিত্যসভার আশীর্বাদেই টের পেয়েছিলাম৷

তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

ভ্রমণ কাহিনী
তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী


আমরা যখন কলকাতা থেকে কোথাও যাই, তখন আসলে কলকাতার দিকেই আবার যাত্রা করি-ঘুরে তো সেই কলকাতাতেই আসতে হয় ৷ একটু ঘুরপথে আবার সেই কলকাতায় ফিরি ৷ বললাম বটে এটা ঘুরপথ, কিন্তু এই পথে ঘোরার মধ্যে একটু আনন্দ রয়েছে ৷ কলকাতা থেকে যে কারণে আমরা পথ ধরে বেরিয়ে পড়ি, তার তো একটা উদ্দেশ্য আছে ৷ সেই উদ্দেশ্যটা খুব একটা সিদ্ধ হয় না, যখন আমরা আবার কোনও বড় রকমের শহর-টহরে যাই ৷

আমার নিজের বেড়াতে খুব ভালো লাগে, ছোটখাটো মফস্বল শহরে ৷ খুব ছেলেবেলায় বাবা আমাদের প্রত্যেক বছর বাইরে নিয়ে যেতেন ৷ আমাদের তো দেশের বাড়ি ছিল ৷ দেশ বলতে পুববাংলার গ্রামের বাড়ি ৷ সে-ও ছিল খুব চমৎকার ব্যাপার ৷ দেশের বাড়িতে গিয়ে মাসখানেক কাটিয়ে তারপর কলকাতায় ফেরা-সেটা খুব মজার ব্যাপার ছিল আমাদের কাছে ৷

একটি নীল বোতাম - হুমায়ূন আহমেদ | ছোটগল্প

ছোটগল্প
একটি নীল বোতাম

হুমায়ূন আহমেদ

বারান্দায় এশার বাবা বসেছিলেন।

হাঁটু পর্যন্ত তোলা লুঙ্গি, গায়ে নীল রঙের গেঞ্জি। এই জিনিস কোথায়

পাওয়া যায় কে জানে? কী সুন্দর মানিয়েছে তাকে! ভদ্রলোকের গায়ের রঙ ধবধবে শাদা। আকাশি রঙের গেঞ্জিতে তাঁর গায়ের রঙ ফুটে বেরুচ্ছে। সব মিলিয়ে সুখী-সুখী একটা ছবি। নীল রঙটাই বোধহয় সুখের। কিংবা কে জানে ভদ্রলোকের চেহারাটাই বোধহয় সুখী-সুখী। কালো রঙের গেঞ্জিতেও তাকে হয়তো সুখী দেখাবে।

তিনি আমাকে দেখতে পাননি। আমি ইচ্ছা করেই গেটে একটু শব্দ করলাম। তিনি আমাকে দেখলেন। সুন্দর করে হাসলেন। ভরাট গলায় বললেন, “আরে রঞ্জুু, তুমি? কী খবর? ভালো আছ?”

'জি ভালো ।' ‘গরম কি রকম পড়ছে বল দেখি?” ‘খুব গরম।” “আমার তো ইচ্ছা করছে। চৌবাচ্চায় গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকি।”

মুখে বললেন, “বসো। তোমার কাছ থেকে দেশের খবরা-খবর কিছু শুনি।”

জনৈক অপদার্থ পিতা - মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ছোটগল্প
জনৈক অপদার্থ পিতা 
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বাসের মানুষজন শঙ্কিত মুখে বসে আছে। বাসটির এখানে থামার কথা নয়, কালো কাপড় পরা মিলিশিয়া ধরনের একজন এটিকে থামিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়েছে। রাস্তাঘাটে বাস থামিয়ে চেক করা কোন ব্যাপার নয়, তবু ব্যাপারটিতে কেউ অভ্যস্ত হতে পারছে না। মিলিটারির কেউ একজন ভেতরে ঢুকে বাসটি পরীক্ষা করে যেতে দেবে, যতক্ষণ সেটা না হচ্ছে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই।

আজাদ কাজলকে বুকে চেপে ধরে বাসের অন্য সবার সাথে চুপ করে বসে থাকে। কাজলের বয়স চার, যদিও তাকে দেখে আরো কম মনে হয়। গত কয়েক মাস দৌড়াদৌড়িতে তার চেহারার মাঝে আতঙ্কের একটা ছাপ পাকাপাকিভাবে পড়ে গেছে। ছেলেটার শরীর ভাল নয়। গত কয়েকদিন থেকে কেঁপে কেঁপে জ্বর উঠছে। রোগ শোক সম্পর্কে আজাদের ভাল ধারণা নেই, কিন্তু দেখেশুনে মনে হয় ম্যালেরিয়া। যে গ্রামে গত কয়েক মাস থেকে লুকিয়ে আছে সেখানে কোন ডাক্তার নেই। ডাক্তারের খোঁজে সে ময়মনসিংহ শহরে যাচ্ছে।

আত্মজা ও একটি করবী গাছ - হাসান আজিজুল হক

ছোটগল্প
আত্মজা ও একটি করবী গাছ
হাসান আজিজুল হক



এখন নির্দয় শীতকাল, ঠাণ্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। ওদিকে বড় গঞ্জের রাস্তার মোড়ে রাহাত খানের বাড়ির টিনের চাল হিম ঝক ঝক করে। একসময় কানুর মায়ের কুঁড়েঘরের পৈঠায় সামনের পা তুলে দিয়ে শিয়াল ডেকে ওঠে। হঠাৎ তখন স্কুলের খোয়ার রাস্তার দুপাশের বনবাদাড় আর ভাঙা বাড়ির ইটের স্তূপ থেকে হু-উ-উ চিৎকার ওঠে। ঈশেন কোণ থেকে ধর ধর লে লে শব্দ আসে, অন্ধকারে—ভূত অন্ধকার কেঁপে কেঁপে ওঠে, চাঁদের আলো আবার ঝিলিক দেয় টিনের চালে। গঞ্জের রাস্তার ওপর উঠে আসে ডাকু শিয়ালটা মুখে মুরগি নিয়ে। ডানা ঝামরে মুমূর্ষু মুরগি ছায়া ফেলে পথে, নেকড়ের মতো ছায়া পড়ে শিয়ালটারও, চাঁদের দিকে মুখ তুলে চায় সে, রাস্তা পেরোয় ভেবেচিন্তে, তারপর স্কুলের রাস্তার বাদাড়ে ঢোকে। হাতে লাঠি চাঁদমণির বাড়ির লোক ঠ্যাঙাড়ের দলের মতো হল্লা করে রাস্তায় পড়ে, কোনদিকি গেল শালার শিয়েল, কোনদিকি ক দিনি।

বুড়ি - হুমায়ূন আহমেদ । ছোটগল্প

ছোটগল্প
বুড়ি
হুমায়ূন আহমেদ


রাত দুপুরে কুঁ-কু পো-পো শব্দ।
সবে শুয়েছি, ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছে- বিচিত্র শব্দে উঠে বসলাম,
ব্যাপারটা কী? আমেরিকায় নতুন এসেছি। এদের কাণ্ডকারখানার সঙ্গে এখনো
তেমন পরিচয় হয়নি। ক্ষণে-ক্ষণে চমকে উঠতে হয় ।
এখন যেখানে আছি তার আমেরিকান নাম রুমিং হাউস। পায়রার খোপের মতো ছোট্ট একটা ঘর। সেই ঘরে সোফা কাম বেড, পড়ার টেবিল। টেবিলের একপাশে একটা এফ.এম. রেডিও । এই হলো আমার ঘরের সাজসজা। ভাড়া পঞ্চাশ ডলার--- জলের দাম বলা চলে । আমেরিকান এক দম্পতি তাদের বসতবাড়ির দোতলার সব ক’টা ঘর ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। দরিদ্র বিদেশী ছাত্ররা এইসব ঘরে থাকে। কমন বাথরুম। রান্নাঘর নেই। খেতে হয় বাইরে। সিগারেট খাওয়া যায় না, ল্যান্ড লেডি ঘর ভাড়া দেয়ার সময় কঠিন গলায় এই তথ্য জানিয়ে দিয়েছেন। উচু ভল্যুমে স্টেরিও শোনা নিষিদ্ধ। নানান বায়নাক্কা। তবুও এখানে উঠে এসেছি। কারণ- সস্তা ঘর ভাড়া, তা ছাড়া জায়গাটা ইউনিভার্সিটির খুব কাছে। ওয়াকিং ডিসটেন্স। নর্থ ডেকোটার এই প্রচণ্ড শীতে দূর থেকে ক্লাস করতে আসা সম্ভব নয়। একটা গাড়ি কিনে নেব সেও দুরাশা। দুপুরে ইউনিভার্সিটি মেমোরিয়াল ইউনিয়নে খেয়ে নেই। সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরি সঙ্গে থাকে একটা হ্যামবার্গার। ঐ খেয়ে রাত পার করি ।
প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট