বিশ্বমহামারি: নবতর বিশ্বের প্রবেশদ্বার - অরুন্ধতী রায়


বিশ্বমহামারি: নবতর বিশ্বের প্রবেশদ্বার

অরুন্ধতী রায়
ফাইনানশ্যাল টাইমস
৩ এপ্রিল, ২০২০


অনুবাদ: আশফাক স্বপন

মূল রচনা
Arundhati Roy: ‘The pandemic is a portal’
Financial Times
April 3, 2020


লিঙ্ক
https://www.ft.com/content/10d8f5e8-74eb-11ea-95fe-fcd274e920ca

কোথায় চলেছে আমার দেশ? হায়রে আমার সমৃদ্ধ অথচ দরিদ্র দেশ, সামন্ততন্ত্র আর ধর্মীয় মৌলবাদের মাঝামাঝি, জাতপাত আর পুঁজিবাদের মাঝামাঝি কোনো এক স্থানে ঝুলে থাকা দেশ, চরম ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী শাসিত দেশ!

গত ডিসেম্বরে যখন চীন উহানে ভাইরাস আবির্ভাবের মোকাবেলায় ব্যস্ত, ভারত সরকার তখন অধুনা সংসদে পাশ করা মুসলমান-বিরোধী নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের গণজাগরণ মোকেবেলা করছে।

ভারতে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের প্রথম ঘটনা ৩০ জানুয়ারি। তার কয়েক দিন আগে দিল্লী থেকে বিদায় নেন আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবসের মহামান্য প্রধান অতিথি, ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জায়ির বোলসোনারো (Jair Bolsonaro), যিনি আমাজন জঙ্গল ধ্বংসে নিরলস ও কোভিড ভাইরাসকে গ্রাহ্যই করেন না। তবে কিনা ফেব্রুয়ারি মাসে এতই কাজের ভীড় ছিল যে শাসকদলের দিনপঞ্জিতে ভাইরাসের ঠাঁই হয়ে উঠল না। মাসের শেষ সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক সফর। তাঁকে গুজরাতের ক্রীড়া স্টেডিয়ামে ১০ লক্ষ লোকের জনসমাগমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে টোপ ফেলা হয়েছে। অত বড় আয়োজনে অর্থ, সময় দুই-ই লাগে।

তার ওপর আবার দিল্লীর প্রাদেশিক নির্বাচন। ভারতীয় জনতা পার্টি রাজনৈতিকভাবে তৎপর না হলে সেখানে ভরাডুবির সম্ভাবনা। তা দল তৎপর হয়ে উঠল ঠিকই। নির্বাচনী অভিযানে দলটি নগ্ন হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রচারণায় মত্ত হল – সেখানে শারীরিক সহিংসতা, ও ‘দেশদ্রোহীদের’ গুলি করার হুমকি কিছুই বাদ যায়নি।

কিন্তু শেষরক্ষা হলনা, নির্বাচনে পরাজয় হল। দোষ দেওয়া হল দিল্লীর মুসলমানদের, এবং তাদের যথাযোগ্য শাস্তি দেবার বন্দোবস্ত করা হল। পুলিশের ছত্রছায়ায় সশস্ত্র হিন্দু গুণ্ডার দল উত্তর পূর্ব দিল্লির শ্রমিক মহল্লায় মুসলমানদের আক্রমণ করল। ঘর-বাড়ি, দোকান, মসজিদ, স্কুল পোড়ান হল। মুসলমানরা এমন আক্রমণের আশঙ্কা করেছিল, তারাও প্রত্যুত্তরে লড়াই করল। পঞ্চাশের অধিক মানুষ, মুসলমান ও কয়েকজন হিন্দু, মারা গেল। হাজার হাজার মানুষ স্থানীয় গোরস্থানের শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই নিল। সরকারী কর্মকর্তারা যখন কোভিড-১৯ নিয়ে প্রথম সভায় মিলিত হয়, আর বেশির ভাগ ভারতীয়রা যখন প্রথমবারের মত hand sanitizer (হাত পরিষ্কারক)-এর অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়, তখনও দুর্গন্ধময় নর্দমা থেকে ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হচ্ছে।

মার্চও কর্মব্যস্ত মাস। প্রথম দু’সপ্তাহ কাটল ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে কংগ্রেস-শাসিত সরকারের পতন ঘটিয়ে সেখানে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আনতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১ মার্চ কোভিড-১৯ বিশ্বময় মহামারি বলে ঘোষণা করল। তার ঠিক দুই দিন পর ১৩ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানাল কোরোনা ‘জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা’ নয়।

অবশেষে ১৯ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তার বিশেষ পূর্বপ্রস্তুতি ছিলনা। তিনি ফ্রান্স আর ইতালির পথ ধরলেন। তিনি আমাদের ‘সামাজিক দূরত্বের’ প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বললেন। (জাতপাত যে সমাজে মজ্জাগত, সেখানে বিষয়টা বুঝতে বেগ পেতে হলনা।) তিনি ২২ মার্চ ‘জনতার সান্ধ্য আইন’-এর আহবান জানালেন। এই সঙ্কট নিরসনে সরকার কী করছে, সে সম্বন্ধে তিনি কিছু বললেন না, কিন্তু জনগণকে বললেন তারা যেন যার যার বারান্দায় এসে ঘণ্টি বাজিয়ে, হাড়ি বা কড়াই পিটিয়ে স্বাস্থ্য কর্মীদের অভিনন্দন জানায়।

ভারত যে নিজের দেশের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সংরক্ষণ করার পরিবর্তে প্রতিরোধক সরঞ্জাম ও শ্বাসরক্ষাকারী যন্ত্রপাতি ঠিক সেই মুহূর্ত পর্যন্ত বিদেশে রফতানি করছিল, এই কথাটি আর তিনি উল্লেখ করলেন না।

নরেন্দ্র মোদির আহবানে মানুষ প্রচণ্ড সাড়া দিল। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। হাড়ি-পেটানো মিছিল, পাড়ার লোকের মিলিত নৃত্য, কিছুই বাদ রইল না। সামাজিক দূরত্ব তেমন দেখা গেল না। পরবর্তী দিনগুলোতে মানুষ পবিত্র গোবরভর্তি পিপেতে ঝাপ দিল, বিজেপি সমর্থকরা গোমূত্র পানের আসর আয়োজন করল। মুসলমানরাও পেছনে পড়ে থাকার পাত্র নয়। বহু মুসলমান সংগঠন ঘোষণা করল যে ঈশ্বরই ভাইরাস ঠেকানোর একমাত্র উপায়, এবং দলে দলে মুসল্লিদের মসজিদে একত্র হতে আহবান জানাল।

২৪ মার্চ সন্ধ্যে ৮টায় মোদি আবার টিভির পর্দায় হাজির হলেন। তিনি ঘোষণা করলেন যে মধ্যরাত্রির পর থেকে সারা ভারত ‘লক ডাউন’-এ যাবে। বাজার বন্ধ। সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ।

তিনি বললেন এই সিদ্ধান্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, পারিবারিক প্রবীণ হিসেবে নিয়েছেন। আর কার পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব? বিন্দুমাত্র কোন আগাম ব্যবস্থা না নিয়ে, মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যে ১৩৮ কোটি মানুষের একটা দেশে এত বড় একটা আদেশ। সব দায় আর ঝামেলা যেই রাজ্য সরকারগুলোর ওপর পড়বে, তাদের সাথে কোনরকম আলোচনা করা হল না। তার কর্মপদ্ধতি দেখে মনে হয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষকে প্রতিপক্ষ হিসেবে মনে করেন। এদের ওপর হঠাৎ করে চড়াও হতে হয়, চমকে দিতে হয়, কিন্তু কখনো বিশ্বাস করা যায় না।

আমাদের লকডাউন হল। বহু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য পরিসংখ্যানবিদরা এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের কথা ঠিক হতে পারে। কিন্তু পরিকল্পনা আর প্রস্তুতির ভয়াবহ অভাবে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও কঠোর লকডাউন-এর ফলে হিতে বিপরীত হল, এটা নিশ্চয়ই তাঁদের কেউই সমর্থন করতে পারেন না।

যে মানুষটা তামাশা পছন্দ করেন, তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তামাশা সৃষ্টি করলেন।

অবাক, স্তম্ভিত পৃথিবী দেখল, কীভাবে ভারত নগ্নভাবে নিজের গ্লানিময় স্বরূপ প্রকাশ করল – তার নির্মম, কাঠামোগত সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য, মানুষের দুঃখে-কষ্টে তার নিষ্ঠুর নিস্পৃহতা।

যেন এক রাসায়নিক বিক্রিয়ার মত লকডাউন অনেক গোপন জিনিস আলোকিত করে তুলল। দোকান, রেস্তোরা, কারখানা, গৃহনির্মাণ কাজ বন্ধ হবার সাথে সাথে ধনী ও মধ্যবিত্ত মানুষ নিজেদের সংরক্ষিত আবাসনে রয়ে গেল, আর আমাদের শহর আর সুবিশাল মহানগরগুলো যেন আবর্জনার মত খেটে খাওয়া মানুষ – অভিবাসী শ্রমিক – এদের পরিত্যাগ করতে লাগল।

বাড়িওয়ালা বা কাজের মালিক এদের বহুজনকে বিতাড়িতে করেছে। কোটি কোটি দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত মানুষ, তরুণ ও বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ, শিশু, অসুস্থ মানুষ, অন্ধ মানুষ, প্রতিবন্ধী মানুষ, এদের আর কোথাও যাবার জায়গা নেই, ত্রিসীমানায় কোন জনপরিবহন নেই – বাড়ি ফেরার জন্য নিজ গ্রামের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করল। দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে চলল। বাদাউন, আগ্রা, আজমগঢ়, আলীগঢ়, লখনৌ, গোরখপুর – শত শত কিলোমিটার দূরে। কেউ কেউ পথেই মারা গেল।

এরা জানে বাড়িতে পৌঁছুলে মোটামূটি মন্থরগতির দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে হবে। হয়ত জানে, শরীরে ভাইরাস বাসা বেঁধেছে, বাড়িতে তাদের পরিবার, বাবা-মা, পিতামহ-মাতামহকে আক্রমণ করতে পারে, কিন্তু তারা যে ভীষণ কাঙাল একটুখানি পরিচিত পরিবেশের, একটু আশ্রয়ের, একটু আত্মসম্মানের, একটু খাবারের, হয়তোবা একটু ভালোবাসারও।

হাঁটতে হাঁটতে কেউ কেউ নির্মমভাবে পুলিশের হাতে লাঠিপেটা হল, অপমানিত হল। পুলিশের দায়িত্ব কঠোরভাবে সান্ধ্যআইন জারি রাখা। তরুণদের জোর করে হাঁটু গেড়ে বসান হল, অথবা রাস্তার ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে বাধ্য করা হল। বারেলি শহরের কাছাকাছি একদল লোককে একত্র করে কেমিকাল স্প্রে দিয়ে ধোলাই করা হল।

বিতাড়িত মানুষ গ্রামে ভাইরাস ছড়াবে এই আশঙ্কায় কয়েকদিন পর সরকার এমনকি পদব্রজে আগত মানুষের জন্যও রাজ্যের সীমানা বন্ধ করে দিল। দিনের পর দিন যেসব মানুষ হেঁটে এসেছে, তাদের থামিয়ে জোর করে যেই শহরগুলো থেকে তাদের জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানকার শিবিরে ফেরত পাঠান হল।

যাদের বয়স হয়েছে, তাদের ১৯৪৭ সালে দেশভাগে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় জনসংখ্যা বদলাবদলির কথা মনে পড়ল। তফাত হল এবার এই জনস্রোতের গৃহত্যাগের ভিত্তি শ্রেণি, ধর্ম নয়। তারপরও এরা ভারতের সবচাইতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী নয়। এদের তো তবুও (অন্তত এখন পর্যন্ত) শহরে কাজ ছিল, আশ্রয় নেবার মতো গ্রামের বাড়ি ছিল। যারা বেকার, গৃহহীন, আশাহত, তারা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল – শহরে আর গ্রামে। এই সর্বনাশ আসার আগে থেকেই গ্রামে গভীর কষ্ট ক্রমবর্ধমান ছিল। এই যে এতগুলো ভয়াবহ দিন গেল, এই পুরো সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জনসাধারণের আড়ালেই রয়ে গেলেন।

দিল্লীতে যখন পদযাত্রা শুরু হল, আমি তখন একটা সাময়িকীর (এখানে আমি মাঝে মাঝে লিখি) প্রেস পাস ব্যবহার করে দিল্লী আর উত্তর প্রদেশ রাজ্যের সীমানায় অবস্থিত গাজীপুরে গাড়ি চালিয়ে গেলাম।

চিত্রটি যেন বাইবেল থেকে তোলা। নাহ, কথাটা ঠিক নয়। বাইবেলেও এত লোকের উল্লেখ নেই। শারীরিক দূরত্ব তৈরির জন্য যে লকডাউন, তার ফল হয়েছে উলটো – মানুষ গাদাগাদির ফলে অভাবনীয় শারীরিক নৈকট্য। ভারতের সব শহর আর উপশহরের বেলায় এই কথা খাটে। বড় বড় রাস্তা জনশূন্য হতে পারে, কিন্তু গরীব মানুষ বস্তিতে গাদাগাদি করে আটকে রাখা হয়েছে।

হেঁটে চলা মানুষের সাথে আমি কথা বলে দেখেছি, ওরা প্রত্যেকে ভাইরাস নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে এটি কিন্তু তাদের জীবনে তুলনামূলকভাবে অতটা বড় চিন্তা নয়। আগামী দিনের বেকারত্ব, দুর্ভিক্ষ, পুলিশের সহিংসতা – এসবই কঠিন বাস্তবতা। সেদিন অনেকের সাথে কথা বলেছি। তার মধ্যে একদল মুসলমান দর্জিও ছিল, যারা সবেমাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মুসলমানবিরোধী আক্রমণের ধকল সামলে উঠেছে। এদের মধ্যে একজনের কথা আমাকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। তাঁর নাম রামজিত, পেশায় কাঠমিস্ত্রি। হেঁটে হেঁটে সেই নেপাল সীমান্তবর্তী গোরখপুরের দিকে চলেছে।

‘হয়ত যখন মোদিজী এই কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন কেউ তাঁকে আমাদের কথা বলেনি; হয়ত তিনি আমাদের কথা জানেন না,’ রামজিত বলল।

‘আমাদের’ মানে প্রায় ৪৬ কোটি মানুষ।

মার্কিন দেশের মত ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোও এই সঙ্কট মোকাবেলায় আরো সুবিবেচনা ও মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন, সাধারণ মানুষ ও অন্যান্য সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী খাবার ও জরুরি জিনিসপত্র সরবরাহ করছে। এরা অর্থের জন্য মরিয়া আবেদন করেছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের সাড়া আশাব্যঞ্জক নয়। দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিলে টাকা নেই। তার পরিবর্তে শুভানুধ্যায়ীদের টাকা যাচ্ছে নতুন PM-CARES তহবিলে, যেটির অস্তিত্ব খানিকটা রহস্যময়। মোদির চেহারা সম্বলিত তৈরি খাবারের প্যাকেট নানান জায়গায় দেখা দিচ্ছে।

এর সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী তার যোগনিদ্রা ভিডিও জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করছেন। এই ভিডিয়োগুলোতে এ্যানিমেশনের মাধ্যমে সুঠাম দেহের চিত্রাঙ্কিত মোদি নানা যোগাসনের মাধ্যমে মানুষের একাকী থাকার মানসিক চাপ সামলানোর উপায় প্রদর্শন করেন।

এই ধরনের আত্মমগ্নতা গভীর উদ্বেগজনক। আচ্ছা, একটা আর্তি-আসন থাকলে কেমন হয়? এই আর্তি আসনের মাধ্যমে মোদি ফরাসী প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন আমাদের ৭৮০ কোটি ইউরোর রাফাল ফাইটার বিমান ক্রয়ের প্রশ্নবিদ্ধ চুক্তিটি মূলতবি রাখার অনুমতি দিন যাতে আমরা লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ফরাসীরা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝবেন।
লকডাউনের দ্বিতীয় সপ্তাহে পণ্যপ্রস্তুতির যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ওষুধপত্র, জরুরি জিনিসের সরবারহ কম। মহাসড়কে হাজার হাজার ট্রাক অন্তরীণ, খাবার বা পানি প্রায় নিঃশেষ। যে ফসল ঘরে তোলার সময় এসেছে, সেসব ক্ষেতেই পচতে শুরু করেছে।

অর্থনৈতিক সঙ্কট একেবারে দ্বারপ্রান্তে। রাজনৈতিক সঙ্কট চলমান। মূলধারার সংবাদ মাধ্যম কোভিড-এর গল্প তাদের সার্বক্ষণিক বিষাক্ত মুসলমানবিরোধী প্রচারণার সাথে সম্পৃক্ত করেছে। তবলিগী জামাত নামে এক সংগঠন লকডাউন ঘোষণার আগে দিল্লীতে এক সমাবেশের আয়োজন করে। এই সমাবেশ সংক্রমণের একটা বড় কেন্দ্রবিন্দু বলে চিহ্নিত হয়। ব্যস, এই খবরটি মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করা, তাদের বজ্জাত হিসেবে চিহ্নিত করার কাজে ব্যবহার করা হল। ভাবখানা যেন মুসলমানরাই এই ভাইরাস আবিষ্কার করেছে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে একধরনের জেহাদ হিসেবে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে।

কোভিড সঙ্কট আসা এখনো বাকি। বা হয়ত আসবে না। আমরা জানিনা। যদি বা যখন এই সঙ্কট আসে, আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে ধর্ম, জাতপাত আর শ্রেণী নিয়ে আমাদের সকল বিরাজমান ভেদবুদ্ধি অক্ষুণ্ণ রেখেই আমরা এই সঙ্কটের মোকাবেলা করব।

আজ (২ এপ্রিল) ভারতে প্রায় ২,০০০ নিশ্চিত সংক্রমণ ও ৫৮ জনের মৃত্যু ঘটেছে। অত্যন্ত অল্পসংখ্যক পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে এইসব সংখ্যা প্রাপ্ত, তাই এইসব সংখ্যা নির্ভরযোগ্য নয়। বিশেষজ্ঞদের মাঝে মতভেদ আছে। কেউ বলছে লক্ষ লক্ষ লোকের মাঝে সংক্রমণ ঘটবে। কেউ বলছে অত বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে না। যখন সঙ্কট আসবে, তখন তার চৌহদ্দীটা যে কী, সেটা হয়ত আমরা কোনদিনই জানতে পারব না। এখন এইটুকু মাত্র আমরা জানি যে হাসপাতালের সেবা নিয়ে কাড়াকাড়ি এখনও শুরু হয়নি।

বছরে প্রায় ১০ লক্ষ শিশু পেটের অসুখ, অপুষ্টি আর অন্যান্য অসুস্থতায় মারা যায়, লক্ষ লক্ষ যক্ষ্মা রোগী (ভারতে পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ যক্ষ্মা রোগী), জনসংখ্যার একটা বড় অংশ রক্তের স্বল্পতা ও অপুষ্টিতে ভোগে, ফলে অজস্র সামান্য ব্যাধিতেই এদের মৃত্যু হয় – এদেরই ভারতের সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা সদনগুলো সামাল দিতে পারে না। ইউরোপ আর মার্কিন দেশ আজ যেই সঙ্কটের মোকাবেলা করছে, ভা্রতের হাসপাতালগুলো সেই সঙ্কট সামাল দেবে কী করে?

ভাইরাসের সেবায় হাসপাতালগুলোতে আর সকল স্বাস্থ্যসেবা একরকম মূলতবী রাখা হয়েছে। দিল্লীর সুবিখ্যাত অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব মেডিক্যাল সাইন্সেস-এর জরুরি বিভাগ বন্ধ, এই বিশাল হাসপাতালের আশে পাসে রাস্তায় বসবাসকারী শত শত ক্যান্সার রোগী – যাদের ক্যান্সার শরণার্থী বলে অভিহিত করা হয় – তাদের গরু-ভেড়ার মত তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

মানুষ বাড়িতে অসুস্থ হবে, বাড়িতেই মারা যাবে। ওদের কথা হয়ত আমরা কোনদিন জানব না। এমনকি তাদের হিসেব পরিসংখ্যানও রাখবে না। আমাদের একটাই আশা, কয়েকটি গবেষণায় জানা গেছে ভাইরাস শীত পছন্দ করে - সেকথা যেন সঠিক হয়। (যদিও অন্যান্য গবেষকরা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।) অগ্নিঝরা, কঠোর গ্রীষ্মের জন্য এমন ব্যাকুলভাবে কোন জাতি অপেক্ষা করেনি।

আচ্ছা, আমাদের মধ্যে কী ঘটছে? এটা ভাইরাস, সে কথা ঠিক। ভাইরাসের নিজের তো কোন নৈতিক নিশানা নেই। তবে এটা ভাইরাসের অতীত আরো কিছু, সেটা নিশ্চিত। কারো বিশ্বাস, এর মাধ্যমে ঈশ্বর আমাদের সুমতি দেবার চেষ্টা করছেন। অন্যরা ভাবেন এটা চীনের চক্রান্ত, এর মাধ্যমে তারা সারা পৃথিবীর কর্তৃত্ব দখল করতে চায়।

করোনাভাইরাস যাই হোক, সে যেভাবে মহাশক্তিমানকে ধরাশায়ী করেছে, পৃথিবী থমকে দাড়িয়েছে, এমনটা আর কেউ করতে পারেনি। আমাদের মনের মধ্যে এখন ভীষণ উথাল-পাথাল, কবে আবার ‘স্বাভাবিকতা’-তে ফিরব তার আকুতি। আমরা অতীতের সাথে ভবিষ্যত জোড়ার মরিয়া চেষ্টা করছি, অতীত আর ভবিষ্যতের বিচ্ছেদকে অস্বীকার করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এই বিচ্ছেদ অনস্বীকার্য। এই ভয়ঙ্কর হতাশার সময়ে আমরা নিজেদের জন্য পৃথিবী চালু রাখার যে সর্বনাশা যন্ত্র গড়ে তুলেছি, সেটা সম্বন্ধে নতুন করে ভাবতে এই বিচ্ছেদ আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে। পুরনো স্বাভাবিকতাতে প্রত্যাবর্তন সবচাইতে নিকৃষ্ট পথ।

ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় যে একেকটা বিশ্বমহামারি মানুষকে অতীতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে পৃথিবী সম্বন্ধে নতুনভাবে কল্পনা করতে বাধ্য করে। এবারও তার অন্যথা হবে না। এটি একটি পৃথিবী থেকে নবতর পৃথিবীতে পদার্পণের প্রবেশদ্বার।

সেই প্রবেশদ্বারে দিয়ে দুই ভাবে ঢোকা যায়। আমরা আমাদের পিছু পিছু আমাদের ভেদবুদ্ধি আর ঘৃণা, অর্থের লোভ, তথ্যের পাহাড় আর বস্তাপচা ভাবনা, আমাদের মৃত নদী আর ধূসর আকাশের গলিত মৃতদেহগুলো টানতে টানতে প্রবেশ করতে পারি। অথবা আমরা প্রবেশ করতে পারি হাল্কা পায়ে, যৎসামান্য মানসিক ভার সাথে নিয়ে, নতুন একটা পৃথিবীকে কল্পনা করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে। আর হ্যা, সেই নতুন পৃথিবীর জন্য লড়াই করবার প্রস্তুতিও থাকা চাই।

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট