দ্য নিকেল বয়জ (গ্রন্থ আলোচনা) - নিউ ইয়র্ক টাইমস অনুবাদ আশফাক স্বপন

গল্প হলেও বিস্মৃত এক ভয়াবহ সত্য
ফ্র্যাঙ্ক রিচ
নিউ ইয়র্ক টাইমস। ১৪ জুলাই, ২০১৯

In ‘The Nickel Boys,’ Colson Whitehead Depicts a Real-Life House of Horrors
By Frank Rich
The New York Times | July 14, 2019

আমেরিকার পুলিৎজার পুরস্কার এদেশে বিশাল ব্যাপার। কালো আমেরিকান লেখক কোলসন হোয়াইটহেড-এর ‘The Nickel Boys’ উপন্যাসটি ক’দিন আগেই এবছর কথাসাহিত্যে পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করে। এই নিয়ে কথাসাহিত্যে দুই-দুইবার এই পুরষ্কার পেয়ে লেখক আমেরিকার সুধীমহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
এদেশে কালো আমেরিকানদের ওপর অত্যাচারের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমন ভয়াবহ। হোয়াইটহেডের উপন্যাস গল্প, কিন্তু তার ভিত্তি ভয়ঙ্কর বাস্তব একটি ঘটনা। গত বছর নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ উপন্যাসটির পুস্তক সমালোচনা বেরোয়।


THE NICKEL BOYS
By Colson Whitehead

মূল পুস্তক সমালোচনার লিঙ্ক

যে স্কুলের বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে উপন্যাসটি রচিত সে সম্বন্ধে National Public Radio-এর প্রতিবেদনের লিঙ্ক (ইংরেজি)

Tampa Bay Times পত্রিকায় উপন্যাসের ভিত্তি Dozier School নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের লিঙ্ক (ইংরেজি)

দশকের পর দশক ধরে এই হৃদয়বিদারক বাস্তবতা প্রকাশ্য দিবালোকে সবার সামনে উপস্থিত, অথচ সেটা কীভাবে যেন আমাদের সবার চেতনার আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে। অবশেষে ২০১৪ সালে আচমকা একটা পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে কোলসন হোয়াইটহেড তাঁর ভয়ার্ত মর্মভেদী নতুন উপন্যাস The Nickel Boys (পাঁচ পয়সার পোলাপান)-এর অনুপ্রেরণা পেলেন। তার বইয়ের ঋণস্বীকারে যেমনটা তিনি বলেছেন, খবরটা তিনি The Tampa Bay Times সংবাদপত্র থেকে পেয়েছিলেন। খবরে প্রকাশ, দক্ষিণ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের কিছু ছাত্রছাত্রী কিছু কালো স্কুলছাত্রের দেহাবশেষ খুঁড়ে উদ্ধার করে তাদের সনাক্ত করার চেষ্টা করছে। মৃত ছাত্ররা ম্যারিয়ানা শহরে রাজ্য সরকার-চালিত ডোজার আবাসিক বালক বিদ্যালয়ের ছাত্র । এই কিশোর ছাত্রদের ওপর অত্যাচার করে, ওদের ধর্ষণ করে, দেহ ক্ষতবিক্ষত করে, ইস্কুল চত্ত্বরে একটা গোপন গোরস্থানে পুঁতে রাখা হয়েছিল। ডোজার ইস্কুলের ১০০ বছরের বেশি দীর্ঘ ত্রাসের রাজত্ব সবেমাত্র ২০১১ সালে শেষ হয়েছে। হোয়াইটহেডের উপন্যাস যখন ছাপা হচ্ছে, তখনো নতুন নতুন কবর আবিষ্কৃত হচ্ছে। মার্চ মাসে খুঁড়ে পাওয়া নতুন প্রমাণের ফলে মনে হচ্ছে মৃতের সংখ্যা ৮০ ছুঁতে পারে। সঠিক সংখ্যাটা আমরা কোনদিন জানতে পারব না। ঠিক যেমন এই দেশের জন্মলগ্নের পর থেকে আরো কত ক্ষতবিক্ষত কালো দেহ আবর্জনার মত গুপ্ত কবরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে তারও সম্পূর্ণ হিসাব-নিকাশ কখনো করা হবে না।

The Nickel Boys উপন্যাসে এই ভয়ঙ্কর স্কুলঘরটির কাল্পনিক নাম দেওয়া হয়েছে Nickel Academy of Eleanor, Fla. এটি ফ্লোরিডার এলেনর শহরে। একটা বেনামী গোরস্থান এই স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে এখন এক গৃহনির্মাণ কোম্পানি অফিসপাড়া নির্মাণ করছে। সেই কোম্পানি ভাবল, এ আবার কী উটকো ঝামেলা রে বাবা! একই প্রতিক্রিয়া সরকারপক্ষের উকিলের। তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন একাডেমির অপরাধ তদন্তের কাজ সমাপ্ত হয়ে গেছে। উপন্যাসের পূর্বকথায় নিস্পৃহ কণ্ঠে হোয়াইটহেড লেখেন, ‘শালার পুরো জায়গাটা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে, আবর্জনা পরিষ্কার করে ইতিহাস থেকে এর অস্তিত্ব মুছে ফেলা দরকার। কাজটা যে বহু আগেই করা উচিত ছিল, সে বিষয়ে সবাই একমত।’ এই তো আমেরিকার স্বভাব। দেশের ক্রীতদাসপ্রথার মূল পাপটা (সাধারণত) স্বীকার করে, তার সূচনার পর থেকে কালো আমেরিকানদের বিরুদ্ধে লাগাতার অপরাধ (মাঝে মাঝে) স্বীকার করৈ, ইতিহাসের ক্ষণে ক্ষণে আশার দিকচিহ্ন (শীর্ষ আদালতের রায়, নাগরিক অধিকারের আইন, ‘বর্ণবাদ-উত্তর’ প্রেসিডেন্ট) নিয়ে আত্মপ্রসাদ পাও, তারপর সামনে এগিয়া চলো, যতক্ষণ না আরেকটা রর্ণবাদী বিস্ফোরণ ঘটে। তখন আবার নতুন একটা ‘বর্ণবাদ নিয়ে মতবিনিময়’-এর ডাক দাও। হোয়াইটহেডের মতো একজন আফ্রিকান আমেরিকান লেখকও যদি ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত ডোজার স্কুলের কথা না শুনে থাকেন, ভেবে দেখুন এমন কতো ভয়ঙ্কর কাহিনি আজও প্রকাশের অপেক্ষায় লুকিয়ে রয়েছে। কখনো আক্ষরিক অর্থেই লুকানোর ব্যাপারটা ঘটে, হয়তো বা কোন এলাকার সাম্প্রতিক আর্থ-সামাজিক বিত্তায়ন (gentrification)-এর নীচে অপ্রিয় সত্য চাপা পড়ে যায় (যেমন ১৯২১ সালের টালসা শহরে শত শত কালোদের হত্যাকাণ্ডের পর গণকবর দেওয়া)। কখনো অপ্রিয় সত্যকে অস্বীকারের প্রবণতার ফলে জাতীয় চেতনায় সেই মর্মান্তিক বাস্তবতা চাপা পড়ে যায়। নিকেল ‘তো শুধু একটিমাত্র স্থান,’ বইটি বেশ অনেকখানি পড়ার পর হোয়াইটহেড আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন। ‘কিন্তু যেখানে এমন একটি স্থান আছে, সেখানে শ’য়ে শ’য়ে এমন স্থান আছে। এগুলো সারা দেশে বেদনার কারখানার মতো ছড়িয়ে রয়েছে।’ নিকেল-এর মতো এদের কাহিনিও প্রকাশিত হবে, যদি ‘কেউ শুনতে চায়।’

আমেরিকার ইতিহাসে বর্ণবাদী সন্ত্রাসের একটি ধামাচাপা দেওয়া অধ্যায়ের ওপর নির্মম আলো ফেলাই যদি হোয়াইটহেডের উপন্যাসের একমাত্র লক্ষ্য হতো, সেটাই একটা বড় অর্জন হতো। এই নতুন উপন্যাস এবং তার আগের উপন্যাস The Underground Railroad (ভুগর্ভস্থ রেলপথ) – এই দুটি রচনায় তিনি বাড়তি যা করেছেন, সেটা তার চাইতেও বেশী দুরুহ। আমেরিকার নিজের ইতিহাস সম্বন্ধে কল্পনাবিলাস যেখানে বর্ণবাদের মুখোমুখি হয়, সেই বিষয়টির উপলব্ধি সেই ১৯৯৮-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস The Intuitionist থেকে তার লেখকচিত্তকে জারিত করে আসছে। এরপর উপন্যাসের নানান বিচিত্র প্রকরণে তার বিহার ঘটেছে (বড় হয়ে ওঠার স্বপ্নময় উপন্যাস Sag Harbor থেকে zombie বা পিশাচ নিয়ে উপন্যাস Zone One)। এবার পরপর দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখলেন। আমেরিকার প্রবণতা তার মূল পাপের কথাটা নামমাত্র স্বীকার করা অথচ দেশটা তার ভয়াবহতা, তার অবিরত অনাচারের অপরিমোচনীয় ইতিহাসের মুখোমুখি হতে ব্যর্থ হয়েছে। মহাকাব্যের গভীর ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত এই দুটি উপন্যাস সেই ভয়াল ইতিহাসের ইতিবৃত্ত।

বইটি মনে হয় লেখকের একটা মহান ব্রতের ফসল, এবং অপরিহার্য সেই ব্রত। আমাদের দেশের আম জনতার সংস্কৃতিতে অন্য শিরোনামে ক্রীতদাসপ্রথা এবং তার পরিণতি নিয়ে কথাসাহিত্য, প্রামাণ্য রচনা, কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্রের তো অভাব নেই (সে গত শতাব্দীর দক্ষিণ অঞ্চলের ভয়ঙ্কর বর্ণবাদী Jim Crow আইনই হোক, বা গণহারে কালো মানুষের কারাবরণ হোক বা সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র ‘I can’t breathe’ [শ্বাস নিতে পারছি না] হোক)। হোয়াইটহেড আমাদের দিকে একটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন: এত কাজ হচ্ছে, কিন্তু তার প্রভাব এত সামান্য কেন? যাও বা প্রভাব, তার স্থায়িত্বই বা এত ক্ষণস্থায়ী কেন? তাঁর গল্পবলার দুর্দান্ত ক্ষমতা দিয়ে তিনি শুধু যে একটি ক্ষতবিক্ষত অতীত পুনুরুদ্ধার করেছেন তাই নয়, সেই সাথে তিনি যেই গল্পগুলো বলতে চাইছেন সেগুলো আমেরিকানরা কীভাবে খর্ব করে, বিকৃত করে, গোপন করে বা ‘পরিষ্কারভাবে মুছে’ দেয় সেই প্রক্রিয়াটি তিনি গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখেছেন। যেমন, Underground Railroad উপন্যাসে প্রাকৃতিক বিস্ময়ের জাদুঘরের একটা পরাবাস্তব মেজাজ আছে। অল্পবয়সী পলাতক ক্রীতদাসী কোরা বহু অত্যাচার সহ্য করেছে। সে এই জাদুঘরে কাঁচের বদ্ধ ঘরে ‘ক্রীতদাসের জাহাজে জীবনচিত্র’ বা ক্রীতদাসের শ্রমনির্ভর বিশাল খামারে ‘একটা প্রাত্যহিক দিনের চিত্র’ এই সব আয়োজনে সাদা দর্শকদের সামনে অভিনয়ের কাজ পেয়েছে। এ যেন মুক্তির ক্ষণস্থায়ী ভাণ। হোয়াইটহেড লেখেন: ‘সত্য যেন দোকানের জানালায় সাজানো এক নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রদর্শনী। আপনার নজরের আড়ালে অদৃশ্য হাত তার অদলবদল করছে। সত্য – সে বড়ো মোহময়, আর চিরকালই নাগালের বাইরে।’ এই লেখকের শক্তিশালী রায় - যারা ইতিহাসের বিস্মরণকে সম্ভব করে তুলে, তারা মানবতার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ মুছে ফেলায় সহায়তা করে, তারা নিজেরাও সেই সমস্ত পাপের অংশীদার।

মাত্র ২০০ পাতার বই। The Nickel Boys লেখকের পূর্ববর্তী বইয়ের চাইতেও সুতনুকা, কিন্তু তাই বলে বইটির নৈতিক কষাঘাত বিন্দুমাত্র কম শক্তিশালী নয়। The Underground Railway-এর পর ইতিহাস যদিবা অপরিবর্তিত রয়েছে, সময় আরো এক শতাব্দী এগিয়েছে। বইটির সময়কাল ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিক। মূল চরিত্র এক কিশোর, তার নাম এলউড কার্টিস। আগের উপন্যাসের কোরার মতো তাকেও মা খুব বিরূপ পরিস্থিতিতে ত্যাগ করেছে। মা তাকে তার নানী হ্যারিয়েটের জিম্মায় ছেড়া চলে গেছে। হ্যারিয়েট ফ্লোরিডার ট্যালাহাসি শহরে এক হোটেলে ঘরদোর পরিষ্কারের কাজ করেন । দৃঢ়চিত্ত এই মহিলা সহজে হার মানার পাত্রী নন। হ্যারিয়েট আর এলউডের পারিবারিক ইতিহাসের পেছনে আরো বৃহত্তর ইতিহাস রয়েছে। হ্যারিয়েটের বাবা ‘কারাগারে মারা যান। শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় এক সাদা মহিলা অভিযোগ করেছিলেন তিনি ফুটপাথে সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দেননি।’ ওঁর স্বামী, এলউডের নানা, ‘বিলিয়ার্ডের টেবিলে কে আগে, এই নিয়ে একদল টালাহাসির গ্রাম্য সাদা লোকের সাথে মারপিটে’ মারা যান। তার মেয়ে জামাই - এলঊডের বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রশান্ত মহাসাগরের রণক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ‘তিনি সেনাবাহিনীকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি তাঁর ঊর্দ্ধতন ক্যাপ্টেনকে কালো সেনাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিয়ে একটা চিঠি লিখেছিলেন, তার জন্য সেনাবাহিনীর থেকে প্রশংসাপত্র পেয়েছিলেন,’ হোয়াইটহেড জানাচ্ছেন। কিন্তু তিনি দেশে ফিরে আবিষ্কার করলেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রাক্তন যোদ্ধাদের সাহায্যার্থে G.I. Bill নামে যে সরকারী আইন হয়, কঠোর বর্ণবাদী বাস্তবতার সাথে সেটা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারেনা। ‘যেখানে সাদারা ব্যাঙ্কের ভেতর কালোদের ঢুকতেই দেয় না, সেখানে বিনাসুদের ঋণ থাকলেই বা কী লাভ?’ তার ওপর যেই শহরে থাকেন, সেখানে ‘সাদা ছেলেদের’ ‘জনসমক্ষে উর্দিপরা কালো মানুষদের খুন করার’ প্রবণতা রয়েছে। ক্রুদ্ধ ও তিতিবিরক্ত হয়ে একদিন মাঝরাতে সেই যে এলউডের মাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন – ছেলের বয়স তখন ছয় বছর – তারপর ‘একটি পোস্টকার্ডও পাঠায়নি।’

যে ছেলেটি তারা ফেলে যায়, তার সাথে যখন আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে সে তখন ইস্কুলে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। সে পড়ে ট্যালাহাসির একটা বর্ণবিভাজিত কালোদের স্কুলে। স্কুলটার কার্যক্রম দেখে কে বলবে ততদিনে সুপ্রিম কোর্ট Brown v Board of Education মামলার (ব্রাউন বনাম শিক্ষা বোর্ড) রায়ে বর্ণের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা স্কুল পরিচালনা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে? এলউড নিজে অবশ্য অস্বাভাবিকরকমের ‘শক্ত সামর্থ।’ ‘বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী, কালো জাতির গর্ব’ – এমনটাই সবার অভিমত। ক্রীতদাস মুক্তি দিবসে ছাত্রদের নাটকে মধ্যমণি সে। এই নাটক আগের উপন্যাসের সেই প্রাকৃতিক বিস্ময়ের জাদুঘরের কাঁচের কক্ষের প্রদর্শনীর কথা মনে করিয়ে দেয়। সে যার ভূমিকায় অভিনয় করছে সে হলো টমাস জ্যাকসন – ‘যে ট্যালাহাসির ক্রীতদাসদের সংবাদ দেয় যে তারা এখন মুক্ত।’ এলউড এখনো অলীক আশা আঁকড়ে আছে যে ‘মুক্ত বিশ্ব’ তারও নাগালের মধ্যে। সহিংস বর্ণবাদী Jim Crow আমেরিকা দাসত্বে শৃংখলিত পূর্বসুরীদের মতো এলউডকেও সাক্ষরতা থেকে বঞ্চিত করতে বদ্ধপরিকর – সাদা স্কুল থেকে যে পুরনো পাঠ্যবই আসে তাতে কারা যেন বর্ণবাদী গালমন্দপূর্ণ মন্তব্য লিখে রেখেছে। কিন্তু সে অধ্যাবসয়ী, হাল ছাড়ে না। এলউডের বাড়িতে টিভি না থাকলে কী হবে, পাড়ার যে সিগারেটের দোকানে সে স্কুলের পরে কাজ করে, সেখানে সে ‘লাইফ সাময়িকীর বিলাসী মোহজালে আবদ্ধ হয়ে যায়। সেই সাময়িকীতে সে কালোদের তখনকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের স্থিরচিত্র দেখে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।’ ১৯৬২ সালে ক্রিসমাসে পাওয়া একটি উপহার তার ভীষণ প্রিয়। সেটি তার সংগ্রহে একমাত্র রেকর্ড। রেকর্ডটির নাম ‘জায়ন হিল-এ মার্টিন লুথার কিং’। কালোদের কিংবদন্তী নেতার গীর্জায় বক্তৃতার রেকর্ড। সে কতবার যে সেই বক্তৃতা শোনে! বরাতটা তার ভালো, সে এক শিক্ষকের সুনজরে পড়ে। তিনি নিকটস্থ কারিগরী কলেজে ওপরের ক্লাসের কোর্সের প্রতি দৃষ্টি তার আকর্ষণ করেন।

কিন্তু হাই স্কুলের ১২শ শ্রেণি থেকে পাশ করে বের হবার আগেই এলউডকে নিকেল ইস্কুলে পাঠানো হয়। যেমন তার আগে ও পরে অসংখ্য কালো মানুষের ক্ষেত্রে ঘটেছে, তারও স্রেফ কালো মানুষ হয়ে গাড়িতে চড়ার জন্য কারাবাস ঘটলো। (এলউডের ক্ষেত্রে সে শুধুমাত্র যাত্রী ছিল।) নিকেল ইস্কুল আনুষ্ঠানিকভাবে কারাগার ছিলনা। ১৮৯৯ সালে ফ্লোরিডা বালক কারিগরী বিদ্যালয় নামে এটি স্থাপিত হয়। নিজেকে এটি সংস্কারমূলক বিদ্যালয় হিসেবে অভিহিত করে। বন্দীদের ‘কারাগারের সহিংস বন্দীদের থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার জন্য এদের বন্দী না বলে ছাত্র বলে ডাকা হয়।’ তাতে কী? এলউড টের পায় এখানে আসলে ‘সব সহিংস অপরাধীরা ইস্কুলের বেতনভুক কর্মচারী’। ট্রেভর নিকেল ‘সংস্কারের অঙ্গীকার’ নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্কুলের পরিচালক হন। তিনি এই চাকরি পেলেন কীভাবে? ভয়ঙ্কর বর্ণবাদী সংগঠন কু ক্লাক্স ক্ল্যান-এর সভায় ‘নৈতিক উন্নতি ও কাজের মূল্য’ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে শ্রোতাদের সমীহ আদায় করে তিনি চাকরিটা হস্তগত করেন। যেই একবার কাজটা পেয়ে গেলেন, সবকিছুর ওপরে তিনি “শারীরিক সুস্থতার’ প্রতি জোর দিলেন এবং প্রায়ই ‘শারীরিক শিক্ষার উন্নতি কেমন হচ্ছে সেটা দেখার জন্য স্নানঘরের উলঙ্গ ছাত্রদের ওপর নজর রাখতেন।’

নিকেল ইস্কুলে সাদা ছেলেও ছিল। তাদের সাথেও বর্বর আচরণ করা হতো। সাদা কালো ছাত্রদের আলাদা থাকার বর্ণবাদী বন্দোবস্ত। সাদা ছেলেরা অবশ্য একটু ভাল খাবার পেত, আর তাদের শ্রম কালোদের মতো অত নির্মম ছিলনা। নিকেল ইস্কুলে সাদা-কালো সব ছেলেদের এক সাথে হবার সুযোগ ছিল একটাই – বাৎসরিক সাদা বনাম কালোর মুষ্টিযুদ্ধ। রক্তের নেশা জাগানো এই ক্রীড়া দেখার জন্য স্থানীয় জনসাধারণ লালায়িত থাকত, এবং এটাই একমাত্র সময় যখন কালো ছেলেরা ‘ন্যায্য অধিকারের সাক্ষাৎ’ পেত।। আরেকটা স্থানেও কালো আর সাদা বন্দীরা এক সমান ছিল – সেটা হলো হোয়াইট হাউস বা সাদা বাড়ি। এটি একটি পুরনো গুদাম ঘর। এখানে স্কুলের পরিচালক ‘আইনের প্রয়োগ’ করতেন। সেই জন্য ব্যবহৃত হতো তিন ফুট লম্বা চামড়ার দড়ি, নাম ‘কৃষ্ণ সুন্দরী’। এছাড়া আরো মধ্যযুগীয় সরঞ্জাম তো ছিলই। পিটুনিতে চামড়া ফেটে যেত, তার ফলে প্রাণকাঁপানো চিৎকার। বিশাল কারখানার ফ্যানের আওয়াজে সেই সপাং সপাং পিটুনি, চিৎকারের শব্দ, সব ঢাকা পড়ে যেত । সেই আওয়াজ ‘বিজ্ঞানের সকল নিয়ম ভঙ্গ করে পুরো স্কুল এলাকায় ছড়িয়ে পড়তো।’ সেই পাখার বাতাস সাদা বাড়িটার দেয়ালে দেয়ালে রক্তের ছিটা ছড়্রিয়ে দিত। ‘আরো পেছনে’ আরো বীভৎস শাস্তি দেওয়া হতো। সেটা চিহ্নবিহীন কবরে পৌঁছুবার আগে সর্বশেষ গন্তব্য।

কোরার মত এলউডের গল্পও আসলে ক্রীতদাসের কাহিনি। Underground Railway উপন্যাসের মতো এখানেও হোয়াইটহেডের গোঁ - তিনি সহিংসতার ভয়ঙ্কর চিত্রতে কোনরকম কাট-ছাঁট করবেন না। এবং গল্পের চরিত্র বা পাঠক, কাউকেই পালাবার পথ দিতে রাজি নন তিনি। আগের উপন্যাসে যেমন কোরার বিরতিহীন অত্যাচারে সাদা সমর্থকরা সাময়িক আশ্রয়ের বেশি দিতে অক্ষম ছিলেন, এখানেও ফ্লোরিডার পাড়াগাঁয়ে কোন ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ঘটেনা (যেমনটা ঘটেছিল বর্ণবাদ নিয়ে রচিত আরেকটি কালজয়ী উপন্যাস To Kill a Mockingbird-এ। সেখানে ধর্ষণের মিথ্যা বর্ণবাদী অভিযোগের শিকার একজন কালো মানুষের সমর্থনে এক সাদা উকিল এগিয়ে আসে।) আগের উপন্যাসের মতো এখানেও কিম্ভুত সব প্রতিবন্ধকতার দুর্ভেদ্য জাল ভেদ করে, শিকারী কুকুর সদৃশ হিংস্র মানুষ (কখনো বা সত্যিকারের কুকুর)-এর তাড়া থেকে পালিয়ে গল্পের চরিত্ররা মুক্তি নামের মরীচিকার পেছনে ছোটে। আবারও হোয়াইটহেড গল্পে বিশাল সময়ের ব্যবধানের মধ্যে যাওয়া-আসা করেন। কখনো এক দৃশ্যে হয়তো তুলনামূলকভাবে একটুখানি আশা, একটু নিরাপদ আশ্রয়ের দেখা মিলল, পরমুহূর্তেই লেখক সেই অলীক কল্পনাকে কালের এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ভেঙে চুরমার করে দিলেন। এইসব গল্পে সমাপ্তি দূরে থাক, মধুরেণ সমাপয়েত তো আরো দুরস্ত, আদৌ কোন আশ্রয় যে মিলতে পারে লেখক এমন সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন। The Nickel Boys উপন্যাসে সময়ের এই বিচিত্র লুকোচুরি কাহিনির শরীরের সাথে এত অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গেছে যে পড়া শেষ করার আগ পর্যন্ত টেরই পাবেন না যে কাহিনির সময়ের ব্যাপ্তি এই শতাব্দী এবং গত শতাব্দীর অনেকটা জুড়ে রয়েছে। আমেরিকায় ক্রীতদাসপ্রথার আমলে যেসব ক্রীতদাস পালিয়ে ‘মুক্ত’ অঙ্গরাজ্যে বা কানাডায় যাবার চেষ্টা করত, সেইসব গোপন রাস্তা এবং পথে থাকবার নিরাপদ আশ্রয়, সব মিলিয়ে পুরো ব্যবস্থাটাকে Underground Railroad বলা হয়। কিন্তু হোয়াইটহেডের ঐ নামের উপন্যাসে কিন্তু সত্যি সত্যি একটা ভূগর্ভস্থ রেলপথ রয়েছে। ঐ উপন্যাসের জাদুবাস্তবতা নতুন উপন্যাসে পুরোপুরি আমদানি না করলেও, লেখক একটা জাদুকরি চমকের মাধ্যমে এলউডের লুকানো গল্প পুনরুজ্জীবিত করেছেন। ফলে একই সাথে একটা বিস্ময় ও একটি বেদনাবিধুর কাহিনি সৃষ্ট হয়েছে।

মার্টিন লুথার কিং-এর বাণী এলউডের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত, অথচ সেটা Jim Crow- এর বর্বর বর্ণবাদী বাস্তবতার প্রেক্ষিতে হোয়াইটহেড সেটা মেনে নিতে হিমসিম খান। মধ্যরাতের পর সাদা মুখোশ পরা হিংস্র সন্ত্রাসীদের আমাদের পাড়াগুলোতে পাঠাও, আমাদের কোন পাড়ার গলিতে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাও, তারপর আমাদের মারতে মারতে আধমরা করে ফেলে রেখে যাও, তবুও আমরা তোমাদের ভালোবাসব? যারা আপনার মনোবল ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর তাঁদের বেলায় ‘প্রতিটি হৃদয়ে শুভবুদ্ধি নিহিত সেটা বিশ্বাস’ করা কীভাবে সম্ভব? ‘হিংসায় হিংসা দূর হয়না, শুধু ভালোবাসা দিয়েই সেটা সম্ভব’ কী করে সত্য হতে পারে? ‘কী কথা!’ এলউড ভাবে। ‘যতসব অসম্ভব ভাবনা!’

এই জটিল সমস্যার হৃদয়বিদারক প্রত্যুত্তর দেয় The Nickel Boys। এই দুই বইয়ে হোয়াইটহেড ইতিহাসের যেই সঞ্চারপথ তুলে ধরেন – ১৮২০ থেকে ২০১৪ – সেটা শেষ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে যায়। যেই জায়গা থেকে দক্ষিণ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের ছাত্রছাত্রীরা ডোজার ইস্কুলের বিস্মৃত মৃতদেহ উদ্ধার করছে, তার থেকে মাত্র ৬০ মাইল দূরে একটা কণ্ঠস্বরের চিৎকার শোনা গেল: ‘ওদের গুলি করো!’ এইবার প্রসঙ্গ অন্য আরেকটা ঘৃণিত জনগোষ্ঠী – এইক্ষেত্রে মেক্সিকো সীমান্তের অভিবাসী শ্রমিক। মে মাসের হট্টগোলপূর্ণ এক জনসভায় ঘটনাটি ঘটে। ‘শুধু এইরকম জায়গাতেই এমন কথা বলে পার পাওয়া যায়,’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বললেন। জনসমাবেশে মুগ্ধ সাদা মানুষ মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি ও অট্টহাসি দিয়ে প্রেসিডেন্টের উক্তিকে স্বাগত জানায়। বাস্তবতা হলো ওদের ‘গুলি করে পার পাওয়া যায়।’ এ শুধু কথার কথা নয়। আমেরিকার অন্যখানেও এরকম জায়গা আছে। উইলিয়াম ফকনার বলেছিলেন অতীত ‘এখনো অতীতই হয়নি।’ এ যেন আমাদের চিরন্তন মন্ত্র। কিন্তু আজকের দিনে সেই কথাটাও যথেষ্ট মনে হয় না।আমরা আমাদের অতীতের নাগাল পেতে পারি বলে আমাদের যে নিশ্চিন্ত প্রতীতি, হোয়াইটহেড তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। এমন লেখক আজকের দিনে অত্যাবশ্যক।

বই-বাই - নবনীতা দেব সেন


বই-বাই
নবনীতা দেব সেন

মাঝে মাঝে আমাকে প্রশ্ন করা হয়, “কেমন করে আপনি এই বই লেখার পথে এলেন?”

(যেন এটা বিপথগমন!) উত্তর খুব সোজা, অন্য কোনও পথও যে হয়, সেটাই জানা ছিল না ছোটবেলাতে।” বাড়িটা ছিল বই-বাড়ি। বাবার পাঠশালা সম্পাদনা আমার খুব ছোটবেলায় বেশ জমজমাট ছিল—সারাদিন বাড়িতে অল্পবয়সি লেখক-লেখিকাদের আনাগোনা। বাণ্ডিল বাণ্ডিল গল্প-কবিতা আসত হাতে, ডাকে—সকলেরই একমাত্র আশা ও উদ্দেশ্য লেখক হওয়া। এ তো ছোটরা। আর বড়রা? বড়দের রোজ রোজ বই বেরুত। আর সেসব বই তারা এনে বাবা-মা-র হাতে তুলে দিতেন, আর বাড়িতে উৎসব পড়ে যেত। আমাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল যাদের তারা প্রত্যেকেই বই লেখেন। যারা বাস করেন, অর্থাৎ মা এবং বাবা, তারা প্রত্যেকেই বই লেখেন। আমি তো ভাবতাম বড়রা সকলেই বই লেখেন। যারা ট্রাম-কন্ডাকটর, বা রিকশাওলা হতে পারেন না, তারা হয় ইশকুলের মিস্ হন, নইলে লেখক। নিজে দুটোই হয়েছি, মাস্টার এবং লিখিয়ে। এবং বই-বাতিকটা বাবা-মা দুজনেরই ছিল। রক্ত বেয়ে এসে গেছে আমার মধ্যেও। কী করা!

বাড়িতে যারা আসতেন তাদেরও যে বই-বাতিক। পুলিনবিহারী সেন, অমল হোম, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায়, প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, প্রত্যেকেই বইবায়ুগ্রস্ত। কেউ কেউ বই লেখেন, কেউ কেউ বই জমান। কেউ দুটোই। আর একটু বড় হয়ে যেখানে খেলতে যেতুম আর তার পরে পড়তে যেতুম সেই কবিতা-ভবন আর এক বই-বাড়ি। বুব.র বই কেনা বাতিক ছিল। আর এক বন্ধুর বাবা, বিষ্ণু দে-রও বই এবং রেকর্ড কেনা বাতিক ছিল। পুলিনকাকু তো বই তুলে নিতেও পারতেন নিষ্পাপ হৃদয়ে। বাড়িতে কোনও বই খুঁজে না পেলে মা বলতেন—একটু পুলিনবাবুর বাড়িতে খোঁজ নাও।” লজ্জা লজ্জা হেসে পুলিনকাকু অধিকাংশ সময়েই ফেরত এনে দিতেন। যে বার ফেরত দিতে পারতেন না, সেবার রেগে যেতেন, অতি-দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ছিল। আমাদের কপিটা উধাও হয়ে গিয়েছিল অনেক দিন। মা শেষে ভয়ে ভয়েই একদিন পুলিনকাকুর কাছে প্রসঙ্গটি পাড়লেন। লাজুক লাজুক হেসে পরদিন বই-বগলে পুলিনকাকু এসে উপস্থিত। মা-র সে কী আহ্লাদ! দেবরপ্রীতি উপচে পড়ল।

বই আমার বাল্যকালে, আমাদের ছোট সংসারে, সবচেয়ে মূল্যবান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। বইয়ের চেয়ে জরুরি কিছুই ছিল বলে মনে পড়ে না। বাবা নিয়মিত বই গুছোতেন, বই বাধাতেন, বই ঝাড়তেন, বই রোদে দিতেন, বই খুঁজে বের করতেন, বইয়ের হিসেব রাখতেন। কোথায় কোন বই আছে অত হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে বাবা মুহূর্তে বলে দিতে পারতেন। মাসিকপত্র থেকে ভালো ভালো প্রবন্ধ, গল্প কেটে কেটে বাবা-মা আলাদা আলাদা বই বাঁধাই করে রাখতেন। প্রচুর ছবিও মাসিকপত্র থেকে কেটে কেটে গুছিয়ে রেখেছিলেন, অ্যালবাম বাধানো হয়ে ওঠেনি। দুই ড্রয়ার ভর্তি ছিল অমূল্য সব ছবি। শতীশ সিংহ, হেমেন মজুমদার, পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী, নন্দলাল, অবনীন্দ্রনাথ। জানি না সেসব কী হয়েছে। আমি বড় হয়ে সেসবের যথার্থ মূল্য বোঝার আগে বিশ বছরের বিদেশ চলে গেছি—বাবা-মার বয়স বেড়েছে, ক্ষমতা কমেছে, কমেছে হয়তো টানও, অত যত্নের ধন এলোমেলো হয়ে উড়ে-পুড়ে গিয়েছে। এখন কেদেও পাবে না তাকে...।

বাবার সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল না। মা ছিলেন আমার বন্ধু। বাবা ছিলেন বিশ্বের বন্ধু। সংসারে অতিথিমাত্র। বাবার সংসার ছিল তাঁর বই। বিয়ের অনেক আগে থেকে তার প্রথম প্রেম—বই। মায়ের নিজস্ব প্রিয় বস্তু ছিল অতি সুদৃশ্য রঙিন লাল বাদামি সবুজ চামড়ায় বাঁধাই, সোনার জলে নামে লেখা এক কাঠের আলমারি রবীন্দ্রনাথের বই। প্রথম সংস্করণ— অধিকাংশই মাকে বাবার উপহার—যেদিনই বেরুত, সেদিনই বাবা মাকে বইটি সযত্নে উপহার পাঠিয়ে দিতেন। বিয়ের আগের এই মধুর আচারটি বাবা বিয়ের পরেও নাকি চালু রেখেছিলেন।

প্রচুর ইংরিজি, ফরাসি, জার্মান সাহিত্য, ফোটোগ্রাফি ও ফিল্মবিষয়ক বাধানো জার্নাল ছিল বাবার। বাবাকে আজকাল আমি অনেকটা চিনতে পারি, যখন বইগুলো নাড়ি-চাড়ি। বাবার আধুনিক মন, উদার বিশ্ববীক্ষা, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা—সবই এখন আমার পরিণত চোখে ধরা দেয়, খুব মন কেমন করে। আমার বাবার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। কলকাতায় যত জনেরই বা ছিল? বাবা সুপুরুষ, বাবা বৈঠকী মেজাজের, উদার, পরোপকারী, কৌতুকপ্রবণ, অজাতশত্রু, সফল, সৎ, নির্লোভ শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন—সকলের মুখে তাই শুনেছি। জীবনে তাই দেখেছি। কিন্তু আর যা-কিছু দেখিনি তা এখন দেখতে পাচ্ছি, বইয়ের চয়নে। বইয়ের ধারে ধারে মার্জিনে মন্তব্য করা তার স্বভাব ছিল না। (মা করতেন মাঝে মাঝে—রেগে গেলে!) দাগ দিয়ে বই পড়তেন না বাবা—পেজমার্ক দিয়ে রাখতেন। শীতের কাপড় রোদে দেওয়া, বড়ি দেওয়া, আচার দেওয়া এসব যেমন মা-র ডিউটি ছিল, বাবার ডিউটি ছিল বই রোদে দেওয়া, বইতে গ্যামাক্সিন পাউডার দেওয়া। মা-র তো ঠিক আমারই মতন বইয়ের ধুলোতে অ্যালার্জি ছিল। মা বই ঘাটতে পারতেন না। আমিও পারি না—তবু ঘাটি। কেননা বই না ঘেটে উপার্জন হবে না আমার। অ্যান্টিহিস্টামিন খেয়ে লাইব্রেরির স্ট্যাকে যেতে হয় নাকে রুমাল বেঁধে। তবুও হাঁচি, তবুও প্রাণান্ত রুদ্ধশ্বাস।

বাবার বই-প্রীতি আমাকে প্রথম চমক লাগাল লন্ডনে। নেহাত বালিকা-বয়েসে, ১৯৫০-এ। বাবার সঙ্গে মা আর আমি লণ্ডনের 'ফয়েলস্‌'-এ গেলাম। Fpyles তখন ওখানে সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান। কোনো বইয়ের দোকান যে এত বড় হতে পারে, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। বাবা তো সেখানে গিয়ে ক্ষেপে গেলেন। একটা অংশে গিয়ে দেখা গেল রবীন্দ্রনাথের বইয়ের ম্যাকমিলানের প্রথম সংস্করণ পড়ে আছে কিছু কিছু। যা যা দোকানে ছিল, বাবা সবই কিনে ফেললেন, মনে আছে দু-একটি বই ছিল সেকেন্ডহ্যান্ড। সেগুলিও ওই একসঙ্গেই রাখা। যৎসামান্য মূল্যে সেই অমূল্য সম্পত্তি সংগ্রহ করে বাবা-মা দুজনেরই সে কী উত্তেজনা। রাস্তার ওপারেও আরও একটা Foyles-এর দোকান ছিল। একটা বইয়ের দোকান যে দুটো বিশাল বাড়ি জুড়ে রাজত্ব করতে পারে, তা কলকাতার বালিকাটি কেন, সম্ভবত তার বাবা-মায়েরও ধারণা ছিল না।

তারপর অবশ্য বিশাল বিশাল বই সাম্রাজ্য দেখেছি আমেরিকাতে। আমেরিকাতে পড়তে গিয়ে শুনলাম ম্যাকগ্র হিল-এর বইবিপণি নাকি বিশ্বের বৃহত্তম। সত্যিমিথ্যে জানি না, গিনেস রেকর্ডস-এর বইই জানে। তবে হ্যা, বিপুল কাণ্ডকারখানা—তাতে সন্দেহ নেই। আমার অবশ্য বার্নস অ্যান্ড নোবল-এর বহুতল মোহিনী বইয়ের দোকানে নিউ ইয়র্ক ভ্রমণের অনেকটা সময় কেটে যেত এককালে। ঈর্ষায়, বিস্ময়ে, আনন্দে আর আর্থিক অক্ষমতার জন্য কী শোক উথলে ওঠে এইসব বইয়ের দোকানে গেলেই! এখন তো কিছু নিজের ঘরে, আর কিছু খুঁজলে পাবেন আপনার ঘরেই হয়তো। (মন, না মতি। বই দেখলেই কুমতি!) আজকাল সবারই র্কাধে ঝোলা-ব্যাগ, পুলিনকাকুর মতো। তবে সবাই সংগৃহীত বইগুলি নিজের ঘরেই নিয়ে জমিয়ে রাখেন না, কেউ কেউ ফুটপাথে বেচে দিয়ে ফুচকা খান।

আমি তখন বছর দশেকের, পুলিনকাকু একদিন এসে ভীষণ গোলমাল শুরু করে দিলেন। বউদি, দেখুন আপনার গুণবতী কন্যার কীর্তি। এখন থেকেই কলেজ স্ট্রিটে বই বেচে চানাচুর খাচ্ছে!” আমি তখন জানিও না কলেজ স্ট্রিট কী বস্তু! মা ছুটে এলেন। এত অপমানে আমি কাদব কি কাদব না মনস্থির করতে পারছি না—স্বভাব-ছিচকাদুনে হলে কি হবে। এটা যে বড়ই বিস্ময়কর বিস্ফোরণ! পুলিনকাকুর ঝোলা থেকে বেরুল ছোটদের গল্প সঞ্চয়ন—উপহার-পৃষ্ঠায় লেখা কল্যাণীয়া নবনীতার চতুর্থ বার্ষিক জন্মদিনে আশীর্বাদ। মা বাবলা। বইটি আমার কাছে অবশ্য এখনও আছে। (অন্তত আমার আজ পর্যন্ত তাই ধারণা।) কিছু দিন আগে আমার এক প্রাক্তন ছাত্র আমায় তিন খণ্ড বার্ষিক শিশুসাথী উপহার দিয়ে গেছেন। প্রত্যেকটাই যত্নে বাঁধানো। সোনার জলে নিবনীতা দেব” লেখা। ভিতরে বাবা-মা-র অশীর্বাদী স্বাক্ষর। সেগুলি গোলপার্কে বিক্রি হচ্ছিল।

বই চুরির প্রসঙ্গে বলি, আমার বাবার একটা লােহার লম্বাটে সরু সিন্দুকমতন বাক্স ছিল, যেটা দেখলেই আমার মনে হতো একটি শিশুর কফিন। বাবা সেটি যক্ষের ধনের মতো আগলে চারতলার ঘরে তুলে রাখতেন। বিয়ের সময়ে, বাবা সেটি আমাকে উপহার দিলেন। দুরুদুরু চিত্তে খুলে দেখি লম্বা বাক্স ভর্তি এক সেট বই। অমর্ত্য খুলে লাফিয়ে উঠলেন—(১৯১১-এর এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা! যেটি যে-কোনো বইপ্রিয় মানুষের স্বপ্ন। এখনও পর্যন্ত যতগুলি এডিশন বেরিয়ে ছিল—লেখকতালিকার বৈশিষ্ট্যে ওইটি তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ! সম্ভবত এখনও। অনেক দিনই বিশ্বের দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের বই-বাজারের তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। জামাইকে দেওয়া হীরের আংটিতে জামাইয়ের কোনও উৎসাহ ছিল না। কিন্তু এই কিভূত লোহার বাক্সটি পেয়ে তার আহ্লাদ ধরে না। এটি অবশ্য বাবার বাড়িতেই রইল। আমরা চলে যাচ্ছি কেমব্রিজ। বাবার চেয়ে ভালো জিন্মাদার আর পাব কোথায়?

কথাটা কত সত্যি, জানা গেল আমি যখন ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এলুম, বরের কাছে হ্যাটা খেয়ে। কিছুকাল আগেই বাবা আর শ্বশুরমশাই হাত ধরাধরি করে তিন হপ্তার মধ্যেই স্বর্গে রওনা দিয়েছেন। তারা আর খুকুরানির প্রত্যাবর্তনটি দেখে যেতে পারেননি। ফিরে এসে তো প্রথম চাকরি-বাকরি শুরু করেছি, এনসাইক্লোপিডিয়া প্রায়ই কাজে লাগে। মাঝে মাঝে বের করতে হয়। আবার বাক্সতে ভরে রাখি। সেই সময়ে আমাদের বাড়িতে প্রফুল্ল নামক অতি প্রফুল্লবদন এক রাধুনী ছিল। তার ভাই নাকি রান্না করে আলিপুরে। আলিপুরে, কোথায়? —সেন্ট্রাল জেলে। শুনে তো আমাদের মাথায় হাত। তখন বাচ্চারা ছোট, মা-ও হঠাৎ খুব ভেঙে পড়েছেন, আমিও ব্যস্ত নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে। নিশ্চিত কিছু গর্হিত অবহেলা ঘটেছিল। ওপরে গিয়ে একদিন দেখি চারতলার ঘরের সিলিং-ছোওয়া বইয়ের তাকগুলি প্রায় শূন্য। আর লোহার কফিন বাক্সটা অদৃশ্য। এখন বুঝি, প্রফুল্ল পরচাবি করিয়ে নিয়েছিল। ওপরের ঘরে শরৎচন্দ্রের সব সই করা রাধুকে বড়দা বইগুলি, বাবাকে-মাকে উপহার দেওয়া তাদের অন্যান্য লেখক বন্ধুদের স্বাক্ষরিত যত বই সযত্নে রক্ষিত ছিল চাবিতালার মধ্যে, যাতে কেউ বেড়াতে এসে হঠাৎ অতিরিক্ত ঐশ্বর্যে মণ্ডিত হয়ে ফিরে যেতে না পারেন। কিন্তু এমন কথা কেউ ভাবিনি!

আমার ছোটবেলাতে সর্বক্ষণই বাড়িতে নতুন নতুন বই আসত। লেখকরা স্বহস্তে আনতেন। মা-বাবার সঙ্গে আনন্দ করে সেসব বই আমিও নাড়াচাড়া করেছি। নতুন বইয়ের ভিতরে কী আছে তা সর্বদা জানার অধিকার ছিল না আমার, বড়দের বই পড়া বারণ ছিল। কিন্তু ছোয়া তো বারণ ছিল না? নতুন বইয়ের ঝক্ঝকে মলাট, ভিতরে ছবি আছে কিনা খুঁজে দেখা, বইয়ের গন্ধ, নতুন কাগজের ফরফরানি—সবই মুগ্ধ করত। লেখকদের স্বাক্ষর যে বইতে থাকবেই, এটাই যেন স্বভাবসিদ্ধ বলে ধরে নিয়েছিলুম বাল্য-কৈশােরের কাঁচা অভিজ্ঞতায়। আমার বিয়েতে তারাশংকর তাঁর সমস্ত বইয়ের পুরাে সেট সই করে উপহার দিয়েছিলেন। আমার মেয়ের বিয়েতে সেই মূল্যবান আশীর্বাদ দিয়ে গেছেন গজেনকাকাবাবু। লেখকরা শুধু নাম সই করা বইই তো দেবেন। সেটাই তো সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। সময় গেলে তার দামটা হৃদয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

এই নাম সই করা বইয়ের কিছু গল্প আছে। আগে প্রফুল্লরটা সেরে নিই। আমি তো আছড়ে পড়লুম কবি-বন্ধু আয়ান রশিদ খানের কাছে। তখন তিনি ডি.সি.ডি.ডি। রসিদ দু-দিন সময় চাইলেন। তারপর উনত্রিশ খণ্ড বই উদ্ধার করে এনে দিলেন বিজয়গর্বে—স্থানে স্থানে ক্ষতি হয়েছে, নষ্ট হয়েছে, মরক্কো চামড়ার মলাটগুলি ছিড়ে নেওয়া হয়েছে কয়েকটি বই থেকে, সঙ্গে উড়ে গেছে কিছু পৃষ্ঠাও। এবং পাওয়া যায়নি লোহার বাক্সটা। যেন ধর্ষিত হয়ে নিরাবরণ হয়ে মেয়ে ঘরে ফিরল ক্ষতবিক্ষত শরীরে। বাবার অত সাধের সম্পত্তির যথাযথ যত্ন আমি করতে পারিনি, রশিদের কল্যাণে ফেরত পেয়েছি এই যথেষ্ট।

সই করা বইয়ের গল্প বলব বলছিলুম। ১৯৯৩-তে টুম্পার কাছে গেছি কেমব্রিজে—ম্যাসা চুসেটুসে তখন বসন্তকাল। হঠাৎ অফিস থেকে মেয়ে বাড়িতে ফোন করে বললে—মা, শিগগির চলে এসো Waterstone-এ, বিকেল ৫টার মধ্যে। Isabella Allende আসবেন, তার নতুন বই সই করবেন, আর পাঠ করবেন। দুটো টিকিট জোগাড় করছি।` গিয়ে হাজির হলুম—কী আশ্চর্য ভিড়,—কত মানুষ যে টিকিট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন!—(টিকিট কিনতে হয়নি, সংগ্রহ করতে হয়েছে সময়মতো।) খুব নাটকীয় প্রবেশ হল, মহিলার এক্কেবারে কাটায় কাটায় সাড়ে পাঁচটায়। চমৎকার মানুষ—সুন্দরী আর খুব সুন্দর করে কথা বললেন। বই থেকে অংশ পড়ে শোনালেন। আমাদের মন মুহূর্তে জয় করে নিলেন। বই বিক্রি হতে থাকল ঝালমুড়ির ঠোঙার মতন। তিনি সই করলেন আবার কথা বলছেন হাসিমুখে। আমরা তিনজনের নামে (অন্তরা, নন্দনা, নবনীতা) তিনটি বই সই করালুম। তাতে বিন্দুমাত্র অধীর না হয়ে সযত্নে প্রত্যেকটি নামের বানান জেনে এবং কে কী করি, কোথায় বাসা—প্রশ্ন করলেন। দীর্ঘ ক্রেতার কিউ, তাই আটকে না রেখে আমরা সরে গেলাম। ইসাবেলা বললেন—তুমিও লেখিকা, অথচ তোমার সঙ্গে আমার কথা বলাই হল না! তোমার বই কই?'—আমার আবার বই কোথায়, ইংরিজিতে? ইসাবেলার বই-সই যে দোকানে হয়েছিল, বস্টন শহরে এখন সেইটে সবচেয়ে বড় বই-বাজার। Waterstone নতুন খুলেছে, প্রাসাদোপম বাড়ি জুড়ে শুধু বই। ইংলন্ডের WH. Smith শুনেছি এর মূল মালিক।

আমেরিকাতে বইয়ের দোকান একটা আলাদা কালচার। তার আলাদা চরিত্র। অনেক বইয়ের দোকানের মধ্যেই কাফে থাকে। সেই কাফেতে মাঝে মাঝে সাহিত্যিকরা তাদের লেখা পাঠ করে শোনান। কখনও তা টিকিট কেটে, কখনও বা ফ্রি। ১৯৯১-তে সিয়াটুল শহরের বিখ্যাত বইয়ের দোকান 'এলিয়ট বে বুকস্টোরে আমার কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেটা হয়েছিল টিকিট কেটে। আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলুম ভিড় দেখে। কে বা আমাকে চেনে, সামান্য কজন বঙ্গসন্তান—বাকি সকলেই কৌতুহলী বিদেশি। আমার কবিতার অনুবাদ করেছেন ক্যারোলিন রাইট, তিনিই এর ব্যবস্থাপনা করেছিলেন। আমি বাংলা পড়ব, ক্যারোলিন সঙ্গে পড়বেন তার করা ইংরিজি অনুবাদ। এত যে প্রচুর শ্রোতা হবে আমি বা ক্যারোলিন কেউই ভাবতে পারিনি। আমার বস্টন থেকে সিয়াটুল দীর্ঘ পথ যাতায়াতের প্লেন-ভাড়া তারা দিতে পেরেছিলেন, এবং ক্যারোলিন স্থানীয় মানুষ, তাঁকে কিছু দক্ষিণাও। অথচ কোনও আর্থিক লাভ দোকানের হয়নি। আমার তো কোনও বইই নেই, যা তারা বিক্রি করতে পারেন। শুধুই একটি multicultural experience মাত্র। ভালো বইয়ের দোকানি হিসেবে মালিক যুবকটি মনে করেন এতে তার উৎসাহ দেওয়া কর্তব্য। আমাদের দেশে এখনও এভাবে চিন্তা করা হয় না। Ellient Bay Bookstore আমাকে একটি শক্তপোক্ত থলি উপহার দিয়েছিলেন, বই বহনের পক্ষে আদর্শ। ওদেশে বহু বইয়ের দোকান এবং প্রকাশকের এরকম শক্তপোক্ত সুদৃশ্য ক্যানভাসের থলে প্রস্তুত করেন, বিজ্ঞাপন হিসেবে। বই-প্রিয়দের নামমাত্র দামে বিক্রি করেন। বার্নস অ্যান্ড নোবেলস-এর থলি কী সুন্দর দেখতে। নন্দনার হোটন মিফলিন কোম্পানির থলিও ভারি সুন্দর।

১৯৯৪ গ্রীষ্মে আর একবার। এবার নন্দনা, অন্তরা, ক্যারােলিন তিনজনকেই নিয়ে শহরের একটি ছোট বইয়ের দোকান Discount Books-এ গেলুম। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেছি Erica Jong ওখানে তার নবতম বই Fear of Fifty সই করবেন ও বক্তৃতা দেবেন। এরিকা য়ঙের সম্পর্কে যা ধারণা ছিল, দেখে তা কিন্তু একটু বদলাল। Fear of Flying-এ যে অসামান্য কৌতুকপ্রিয়তা, ব্যক্তিগত আচরণে তার মধ্যে সেটা দেখিনি। বইটি থেকে যেসব অংশ পড়লেন, খুবই ভালো লাগল অবশ্য। কিন্তু সই করানোর সময়ে (যদিও এটা আমেরিকায় তার নতুন বইয়ের Promotional tour-এর এই প্রথম দিন, উদ্বোধনী সভা—অথচ বিশেষ ভিড় হয়নি।) তাকে খুব মিশুক বলে মনে হল না।

আমেরিকাতে এই Promonotional tour ব্যাপারটি চমৎকার। প্রকাশক লেখককে নিয়ে ঝটিকা-সফরে বেরোন এক শহর থেকে আর এক শহরে। দোকান থেকে দোকানে। নতুন বইটি থেকে পাঠ, প্রশ্ন-উত্তর, বই-সই, বই-বেচা। বইয়ের দোকানগুলি ব্যবসার খাতিরেই সংস্কৃতিচর্চার একটা জরুরি দিকের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে, লেখক ও পাঠককে মুখোমুখি আনা। আজকাল আমাদের কলকাতার বইমেলায় এ ধরনের দু-একটি সভা-সমিতি হয়। বই-উদ্বোধন ইত্যাদি ঘটে। এখনও অবশ্য বাংলা বই উদ্বোধনের Publishers Party হয় বলে শুনিনি।

ভারতীয় লেখকদের মধ্যে Promotional tour-এ বেরুতে দেখেছি কেবল স্যুটেবল বয়’কে। অমিভাতও গিয়েছেন কিনা, জানা নেই। কিন্তু বিক্রমের বেলায় আমি বিদেশে ছিলাম, ইংলন্ড, ইতালি ফ্রান্সের কাগজে তার ছবি, ট্যুরের বর্ণনা ও সাক্ষাৎকার পড়েছি। দিল্লিতে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে তার একটি পাঠ-সভাতেও যাবার সুযোগ হয়েছিল, যেটা হয়তো বই-বিক্রি সম্পর্কিত না হলেও নতুন বই-প্রকাশ সম্পর্কিত সভা। বাংলা বইয়ের বেলায় এ ধরনের কিছু হয় কি? বইমেলাতে মাঝে মাঝে বই-সইয়ের ঘটা অবশ্য দেখেছি এ-দোকানে সে-দোকানে। কিন্তু মেলার প্রাঙ্গণের বাইরে বই প্রকাশের উপলক্ষে উৎসবের বা সভার বিশেষ চল নেই এদেশে। এমনি এমনি কবি সম্মেলন হয়, কত গল্পপাঠের আসর বসে। কিন্তু কোনও নতুন বই প্রকাশের উপলক্ষে শুধু সেই লেখককে নিয়েই একটি সভা—এ ট্রাডিশন এখনও এদেশে শেকড় গাড়েনি। বইয়ের প্রচারের জন্যই এই সভা জরুরি, পাঠক-লেখক মুখোমুখি পরিচিতির এই সুযোগ দুজনের পক্ষেই লাভ ও আনন্দজনক (আর প্রকাশকের পক্ষেও বটে)।

বই-সইয়ের ব্যাপারে আর একটা ঘটনা মনে পড়ল। অনেক বছর আগে আমার দুজন বন্ধুর সঙ্গে নিউ ইয়র্কের পথে হেটে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি দীর্ঘ সর্পিল এক লাইন দিয়ে মানুষেরা দাড়িয়ে আছেন। লাইনের মুণ্ডু একটি ছোট বইয়ের দোকানের ভিতরে। লেজ রাস্তার মোড় ঘুরে গেছে। কী ব্যাপার? লিভ উলম্যান তার আত্মজীবনী সই করছেন। ইঙ্গমার বার্গম্যানের প্রাক্তনী প্রেয়সী এবং নায়িকা—কে না তাকে দেখতে চায়—আমরাও দাড়িয়ে পড়ি। কিন্তু বেলা বাড়তে থাকে। খিদে পেতে থাকে। সাধারণত এসব কিউয়ের আশপাশে ম্যাজিকের মতো হটডগ-কোকাকোলার স্ট্যান্ড নিয়ে বিধাতা পুরুষ চলে আসেন। কিন্তু সেবারে এলেন না। আমাদের শেষ পর্যন্ত পেটের দায়ে লাইন ত্যাগ করতে হল। তাড়াহুড়োয় অল্প কিছু খেয়ে ফিরে এসে দেখি সব শুনশান। কী হলো? এত শিগগির লাইন খতম? না, লাইন ফুরোয়নি, আগেই সই খতম। তার সময় ছিল বাধা, দু-ঘন্টা। সেই দু-ঘন্টা ফুরিয়েছে, পাখিও উড়ে গেছেন। তিনি আসার অনেক আগে থেকেই লাইন বাধা শুরু হয়েছিল। দোকানের জানলায় লিভ উলম্যানের ছবি, বইয়ের জ্যাকেট, সময়, বিজ্ঞাপন। সেই দেখেই পথচারী বই ক্রেতার ওই ভিড় হয়েছিল।

বস্টনে নিউবেরি রোডে হার্ভার্ড কাফে বুক স্টোর বলে এক দোকানে বইও বিক্রি হয়। সাহিত্যের পত্রপত্রিকাও থাকে, ভালো চা-কফিও। গত বছর আমি আর আমার এক বন্ধু বসে কফি খাচ্ছি। বন্ধু কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিন-স্ট্যান্ডে পত্রিকা ঘাটছে। হঠাৎ এসে হাজির—আরে। এ যে তোমার ছবি। দেখি শুধু আমারই নয়, কবিতা সিংহ, আমি, অনুরাধা মহাপাত্র—সহাস্যে American Poetry Review-তে শোভা পাচ্ছি। গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা সহ। সবই ক্যারোলিনের কীর্তি। হঠাৎ তিন বঙ্গকন্যাকে বস্টনের বইয়ের দোকানের তাকে দেখে যে আনন্দ হয়েছিল, বলাই বাহুল্য। বছর কুড়ি-বাইশ হবে, লন্ডনের Dillons বলে মস্ত বইয়ের দোকান হয়েছে। সেখানে বই কিনে ওজন করে Postge-এর দাম দিয়ে দিলে তারাই Stamp মেরে প্যাক করে পোস্ট করে দেয়। ১৯৭৪-এ এক বাক্স বই ওভাবে পাঠিয়েছিলাম। দিব্যি চলে এসেছিল ঠিক। ১৯৭৭-এ আরও বেশি বই কিনে পাঠালুম। হাওয়া হয়ে গেল। অতএব সাধু সাবধান! নিউ ইয়র্কের Barnes & Nobles থেকেও ১৯৮১-তে আমার প্রেরিত তিন প্যাকেট বইয়ের দুটি প্যাকেট এসেছিল মাত্র। জানি না বাণিজ্যটা কে করেছেন। বিদেশি বইয়ের দোকান, না দেশি পোস্ট অফিস। নাকি সে প্যাকেট এখন লেকের জলে অথবা ভিখিরিদের বালিশ ?

বিয়ে হয়ে কেমব্রিজ ইংল্যান্ডে গিয়ে দুটি বইয়ের দোকানের প্রেমে পড়েছিলুম। Heffers আর Bowes & Bowes; প্রথমটি বড় উজ্জ্বল, আধুনিক বহু পেপারব্যাক রাখে—বিষয়বস্তু অনুসারে সুসজ্জিত। দ্বিতীয়টি ছোট, মলিন, সেকেলে, অনেক পুরনো সেকেন্ডহ্যান্ড বইও আছে। পেপারব্যাক-ট্যাক, ক্লাসিকস ছাড়া বিশেষ রাখে না। এখনও Heffers টিকে আছে, Bowes & Bowes শুনেছি উঠে গেছে। কিন্তু ওখানে আমাদের অ্যাকাউন্ট ছিল। মাসকাবারিতে বই কেনা চলত। এখন অনেক দোকানেই তা সম্ভব। কেমব্রিজে যেমন হেফার্স, অক্সফোর্ডে তেমনি ব্ল্যাকওয়েলস্। দু-দিনের জন্যেও যদি অক্সফোর্ডে যান, Blackwells-এ টু মারলেই অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা হয়ে যাবে এক যাত্রায়—শপথ করে বলতে পারি। ব্ল্যাকওয়েলস্ ডিলনস, হেপার্সের চরিত্র অনেকটা এক ধরনের।

বইয়ের দোকান যে কত জ্বালা হতে পারে, তার গল্প বলি। কেমব্রিজে (USA) আমাদের বাড়িতে কিছু বন্ধুকে চা খেতে বলেছি। হঠাৎ দেখি ঘরে দুধ নেই। নন্দনার এক বন্ধুকে পাঠালুম, যা তো, দৌড়ে দুধ নিয়ে আয়।” সে দৌড়ে চলে গেল বটে, কিন্তু আর ফিরে এল না। অগত্যা লেবু-চা দিয়ে আপ্যায়ন করার পর দেখি বাবু ফিরেছেন, গলদধর্ম হয়ে। দু-হাতে দুই বোঝা বই। দুধ-টুধ নেই। ব্যাপার কী? দুধ কই?

—“ওই য্যাঃ। একটা দোকানে Hardcover বইয়ের ওপরে 25% discount দিচ্ছিল, সবই নতুন বই’—কী উত্তেজনা তার উজ্জ্বল চোখে-মুখে। “অত বই যে কিনেছ, টাকা ছিল সঙ্গে?

—মাস্টারকার্ড ছিল!” ইতিমধ্যে মেয়ে এসে ঠোট উল্টে বলল—“ওঃ! পথের দোকানটা “Barillari” তো? ওরা সারা বছরই 25% discount দেয়।” সত্যি, Discount না পেলে ব্যক্তিগত ক্রেতা আর ক'জনে নতুন হার্ডকভার বই কিনতে পারেন?

বিদেশে আবার প্রায় নতুন বেরুনো বইয়েরও 'সেল' দেওয়া হয় প্রকাশকের পাত-কুড়োনো বলে। যেহেতু গুদামে প্রচণ্ড স্থানাভাব, নতুনতর বই জমে উঠলে একটু পুরনো বই নামমাত্র দামে ছেড়ে দেওয়া হয়। তা পুরস্কৃত বইও হতে পারে। বইয়ের গুণের ওপর অনেক সময়েই সেল নির্ভর করে না । (বইয়ের গুণের ওপরে বইয়ের বিক্রি যে অনেক সময়েই নির্ভর করে না, তা অবশ্য আমরাও খুব জানি। বই লেখা ও বই বেচায়, বই কেনা ও বই পড়াতে যে অসামঞ্জস্য আছে তা কে না জানি ?) ওইভাবে আমি প্রকাশের অবশিষ্ট সেলে দু-এক ডলারে অনেক ভালো বই কিনেছি। এই কেমব্রিজ, ম্যাসাচুয়েটসে ব্যারিলারি ছাড়া আরও অনেক দোকানে ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়। বস্টনে, কেমব্রিজে, ওয়টারটাউনে, আর্লিংটনে—ওই অঞ্চলটাই বইয়ের দোকান ভর্তি। হাতে সময় এবং পকেটে ডলার থাকলে এত আনন্দ আহরণের যোগ্য শহর আর আমি দেখিনি। বইয়ের দোকান তো সর্বত্রই আছে। কিন্তু ডিসকাউন্টের বইয়ের দোকান তো সর্বত্র নেই।

Wordsworth বলে অতি উপাদেয় এক বইয়ের দোকান আছে ব্যাটল স্কোয়ারে, হার্ভার্ড স্কোয়ারের গায়েই। সেটা রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর ভিড়ে জমজম করে। সেখানে সব বইয়েরই দাম দু-তিন ডলার করে কম। বইগুলি কত সুন্দর সুন্দর বিভাগে সাজানো বিষয় অনুযায়ী—ভ্রমণ, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, শিশুসাহিত্য, কবিতা, উপন্যাস, চিত্রকলা, সমালোচনা, স্থাপত্য, প্রত্নতত্ত্ব—কী নেই? আবার ভাষা হিসেবেও ভাগ। আছে নারীবাদী সাহিত্য, কৃষ্ণাঙ্গ সাহিত্য, সমকামী সাহিত্য—নানান বিভাগ। লাইব্রেরিতে পড়তে গেলে কথা বলা চলে না। সেখানে মন আকুল করা আবহসঙ্গীত বাজে না। সঙ্গীতের গুণে শুনেছি নাকি গাভীও বেশি দুধ দেয়। খরিদ্দার বেশি কেনাকাটা করবেন, এটাও বিজ্ঞানসম্মত। লাইব্রেরিতে ধুলো ভর্তি। এখানে সব ঝকঝকে পরিষ্কার নতুন বই। শীততাপনিয়ন্ত্রিত আলো-ঝলমলে। রিল্যাক্সড় মানুষে ভরা। সময় পেলেই গিয়ে পছন্দসই তাক খুঁজে নিয়ে আমি থেবড়ে বসে পড়ি মেঝেয়, আর যত ইচ্ছে বই নিয়ে যেমন ইচ্ছে পড়ে যাই। চক্ষুলজ্জার ধার ধারি না। কেউ তুলে দেয় না। কেউ বলে না বিনীত হেসে আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি—” (অর্থাৎ কী, হচ্ছেটা কী হে?”) ওইভাবেই বসে বসে এক দুপুরে আমি পড়ে ফেলেছিলুম Misreading বইটি। কিন্তু মুশকিল হয়েছিল তার আগের এক বছরে। ওইভাবেই থেবড়ে বসে Foucault's Pendulum পড়তে পড়তে তিন দিনের সিটিং-এও শেষ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে কিনেই নিয়ে আসতে হয়েছিল দেশে hardcover বইটা।

হার্ভার্ড স্কোয়ার ভর্তি অগুনতি অত্যাকর্ষক বইয়ের দোকান আছে, আছে হার্ভার্ড কুপ' (কোঅপ)—আমার কিন্তু একটা দোকানে অনেকক্ষণ সময় যায়—হার্ভার্ড বুক স্টোর। তার বেসমেন্টে শুধুই পুরোনো বইয়ের স্তুপ আর প্রকাশকের অরুচি বই। এখানে মিলিলে মিলিতে পারে পরশরতন। তা ছাড়া এরা বই কিনলে কুপন দেয়। সেই কুপন জমিয়ে পরে ফ্রি বই কেনা যায়। আমরা কেন এমন করি না।

ভালো ভালো বইয়ের দোকান উঠে গেলে মনের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। কেমব্রিজে রিডিং ইন্টারন্যাশনাল' বলে একটি দোকান ছিল, প্রচুর বিদেশি সাহিত্য পত্রপত্রিকা রাখত—অনেক কবিতার বই। নানা দেশের নানা ভাষার চলতি সাহিত্যের খবর পাওয়া যেত সেখানে বই ঘেটে ঘুরে বেড়ালে। বই ছাড়া সঙ্গীতের ক্যাসেটও বিক্রি হত, মাঝে মাঝেই ক্যাসেটের সেল দিত। আর একটি দীর্ঘ টেবিলই ছিল—ডিসকাউন্ট টেবিল। তাতে সব বইই হেভি ডিসকাউন্ট 25% থেকে 50% কখনও 75% পর্যন্ত পেয়েছি। এ বছর গিয়ে দেখি সেখানে অন্য কার ঝকঝকে নতুন দোকান বসেছে। শৌখিন বোতলে রূপচর্চার সাজ-সবঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে। এরই মালিকের হার্ভার্ড স্কোয়ারে ঠিক মাঝখানের দ্বীপে এটি অদ্বিতীয় পত্রিকা বিক্রির দোকান আছে, তার নাম ‘আউট অফ টাউন নিউজ। রােজ তাতে আমেরিকার চল্লিশটা শহরের পাটভাঙা খবরের কাগজ মজুত থাকে। এবং ইওরোপের পাঁচটা দেশের কাগজ আমিই স্ট্যান্ডে দেখেছি—চাইলে হয়তো আরও পাওয়া যায়। সেখানে অনেক নোবেল লরিয়েটকে ঘুরতে দেখা যায়—পত্রিকা ঘাঁটছেন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে, লেখক-শিল্পীদের সঙ্গে। আমাদের কলকাতাতে এমনধারা একটি পত্রিকার দোকান হয় না। (পাতিরাম কী বলেন?)

আজকাল একজাতের বইয়ের খুব বিক্রি। লোকে কেনে, পড়ে, জ্ঞানলাভের পরে ফের বেচে দেয়। সেগুলো থাকে যেসব তাকে, তার শিরোনাম Self-help; এই বন্ধুদেরও চিনে নিন”। কে কে সাইকোপ্যাথ, কে কে নিউরটিক! ডেল কার্নেগির কল্যাণে—কী করে বন্ধুত্ব করতে হয়, কী করে সফল হতে হয়” ইত্যাদি বই প্রথম দেখি কলকাতাতে। পড়বার ইচ্ছেও হয়নি কখনও। বিদেশে এখন দেখি 'হাউ-টু' বইতে বাজার ছেয়ে গেছে। কী করে কৃপণ স্বামীর সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে, কী করে অবাধ্য সন্তানের সঙ্গে সংসার করতে হবে, বাবা-কাকা ধর্ষণ করলে, কীভাবে আবার আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে হবে, কীভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর বাচতে হবে, মদ ছাড়বেন কীভাবে, মনঃসংযোগ করবেন কীভাবে,—আমি তো এসব বই দেখতুম, আর নাক উলটে চলে যেতুম। কিন্তু সেদিন এক বন্ধুর বাড়িতে একটি বই দেখলুম—Time management বিষয়ে। কীভাবে সময়কে দীর্ঘতর করা যায়। দীর্ঘসূত্রিতা ভেঙে, সুশৃঙ্খলভাবে কাজ শেষ করা যায়। কি বলব, মিনমিন করে বইটা চেয়ে আনলুম। আমার বড্ড শেখা দরকার। কীভাবে সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হয়। এই তো দেখুন না, আপনাদের সময় কত নষ্ট করে দিলুম।

এটা কি প্যারিস? এ কি বুলভার সাঁ জারম্যা? দু-ধারে বই আর ছবির দোকান, আপনি হাটছেন, দেখছেন, ঘাটছেন, মাঝে মাঝে কাফেতে বসে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন, হয় এক পাত্র সুরা, নইলে এক পেয়ালা কফি নিয়ে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, মানুষের ভিড় বাড়ছে বই কমছে না, আর প্রত্যেককে দেখে মনে হচ্ছে তাদের হাতে অনন্ত সময়। তারা যেন এই বইয়ের দোকানে বেড়াবে বলেহ জন্ম নিয়েছে।

অবশ্য জগতের সর্বত্র বইয়ের দোকানে এই একই দৃশ্য। গয়ংগচ্ছ ভাব। ঢুকলে আর বেরুতে চায় না কেউই। যারা বইয়ের দোকানে ঢোকেন, তাঁরা সবাই ওই একই চরিত্রের লোক যে। একই বাকের পক্ষী।

এবার বর্ষার গল্পটা বলি। এখন তো দিকে দিকে Women's Book Store হয়েছে। কিন্তু আমি প্রথম Women's Book Store দেখি কানাডার ছোট্ট একটা ইউনিভার্সিটি শহরে। শহরের নাম Guelph (সেই দান্তের মতন) যেখানে বর্ষা পড়াত। ১৯৪৮-র কথা। বর্ষা বললে, একটা নতুন জিনিস দেখবি? খুব অবাক হয়ে যাবি। খুব ভালো লাগবে তোর।` যত বলি—কী জিনিস? বর্ষা তত রহস্যময়ী হয়ে বলে চল না, দেখতেই পাবি!” আমাকে নিয়ে তো বর্ষা গেল একটা ঘুপচিমতন কুঠুরিতে। ঢুকে দেখি বইয়ের দোকান। অতীব ক্ষুদ্র। যিনি বিক্রি করছেন সেই মহিলা, আমি ও বর্ষা ছাড়া আর চতুর্থ ব্যক্তির ঠাই হবে না সেখানে। বর্ষা বললে—ভালো করে দেখ।” আমার মুখ দেখেই সে বুঝেছিল। আমি কী ভাবছি। আমি ভাবছি, "আহাহা! কী জিনিসই দেখাতে এনেছিস্। ভারি তো একটা অতি ক্ষুদ্র বইয়ের দোকান, কোনও রকমে দাঁড় করানো।” বর্ষা তাড়া দিল, “দেখলি?'—তারপর দেখলুম। এই প্রথম দেখলুম প্রত্যেকটি বইয়ের বিষয়বস্তু নারী। প্রধানত প্রতিবাদী সাহিত্য, নারীবাদী প্রবন্ধ, সমাজতত্ত্ব, কবিতা, অর্থনীতি, নাটক, লেসবিয়ান সাহিত্য—সব বইই মেয়েদের নিয়ে। ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, যা যা বিক্রি হচ্ছে, তাতে মেয়েদের আঁকা ছবি। তা ছাড়াও নারীশিল্পীদের আঁকা ছবির প্রিন্ট বিক্রি হচ্ছে, মেয়েদের তৈরি ফিল্মের বিষয়ে বই। শুধু ইংরিজি নয়। ফরাসিতেও। গানের ক্যাসেট এবং রেকর্ডও রয়েছে। একসঙ্গে এত মেয়েদের লেখা বই এবং মেয়েদের বিষয়ে এই আগে কোনো দিন দেখিনি। আমার মুগ্ধতা দেখে ভুরু নাচিয়ে বর্ষা বলল—“দেখলি তো? বলেছিলুম কি না? চমৎকার একটি জিনিস দেখাবো?'—সেদিন *Women, Race & Class” বইটি ওখানেই কিনেছিলুম।

বর্ষা আর নেই। কনিষ্ক' উড়োজাহাজ তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে আরও চমৎকার, আরও অবাক করা এক জায়গায়। সেখানে সারি সারি ডিসকাউন্ট বুক সেন্টারে 90% discount ডিসকাউন্টে সদ্যপ্রকাশিত হার্ডকভার বিক্রি হচ্ছে, মৃদু আবহসঙ্গীত বাজছে স্বপ্নমেদুর, আর যার যতক্ষণ খুশি বসে বসে যা-খুশি বই ঘাটার অনুমতি আছে সেখানে, সঙ্গে ফ্রি কফি কিংবা ওয়াইন, এবং ঢুকতে-বেরুতে কেউ থলি-টলি কক্ষনো পরীক্ষা করে না। বর্ষা মনের আনন্দে সেই অনিঃশেষ বই-বীথিকায় হেটে বেড়াচ্ছে।

ভাবতে পারেন একদিন বই থাকবে না? একদিন তো বই ছিল না। ছিল বড় বড় পাথরের চাইতে খোদাই করা বাক্য, ছিল হাড়ের ওপর খোদাই করা ঈশ্বরের বাণী, ছিল বল্কলে, প্যাপিরাসে, ভূর্জপত্রে লেখা স্ট্রোল, ছিল তালপাতার পুঁথি। বই সভ্যতার ইতিহাসের কদিনের জন্যই বা এসেছে! মাইক্রোফিল্ম এসেছে, মাইক্রোফিস এসেছে, এখন তো সবই ডিস্কে তোলা থাকছে, (আছে ক্যাসেট-করা শ্রাব্য বইও) এর পরে হয়ে যাবে ডক্ট। একটি বিন্দুতে বিধৃত হবে জ্ঞানের সিন্ধু। বইয়ের যে ইন্দ্রিয়বাহ অবয়ব—বইকে দেখতে, ছুতে, ঘাঁটতে, তার গন্ধ শুকতে যে আনন্দ, বইয়ের দোকানে কিংবা তাতে ফেলা-ছড়ার উপরিপাওনা কই?

ছোটবেলায় বন্ধুরা সবাই ছিল পড়ুয়া। আর বই পড়া ছিল মানসন্ত্রমের প্রশ্ন। যেই শুনতুম কেউ কোনো নতুন বই পড়ে ফেলেছে, অমনি হিংসে। তক্ষুনি বইটা জোগাড় করে (কই? দেখি তো বইটা?”) ধার করে পড়ে ফেলে তবে নিশ্চিন্দি। বয়েস বাড়বার একটা লক্ষণ, ঈর্ষার লক্ষ্যগুলো পালটে যায়। আর একটা লক্ষণ, অমন গোগ্রাসে বই পড়াটা কমে আসে। অল্প বয়েসে বই দিয়েই তো জগতের সঙ্গে পরিচয় হয়, জীবনটা কীরকম তা গোড়ায় গোড়ায় চিনিয়ে দেয় বইই। ক্রমশ জীবনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় বাড়তে থাকে, বইয়ের পাঠ পার হয়ে এগিয়ে যায় বেঁচে থাকার পাঠ। সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে সংসারের ভার আর কমে আসে নিজস্ব সময়। তখন এসে কান ধরে চয়নের প্রশ্ন। তােমার সময় বাঁধাধরা ঠিক করে নাও—কী পড়বে? কী পড়বে না?

এতৎসত্ত্বেও যখন ঢুকি লাইব্রেরিতে কিংবা বইয়ের দোকানে, যে বইয়ের উদ্দেশ্যে সেখানে গমন, তা বাদে আশপাশের আরও দু-দশটা বই নেড়ে-চেড়ে পরকীয়ের আহ্বাদটা তো পাই! ডটু-বইয়ের যুগে সেটি আর থাকবে না। তখন কেবলই স্পেশালইজড় রিডিং—শুধুই প্রয়োজনসম্মত, সকারণ, বিশুদ্ধ পঠনপাঠন। কী বোরিং—ভেবে দেখুন? এই যে অল্প অল্প করে পাতা উলটোচ্ছি, বই চাখছি, বই দেখছি, এভাবে বই পছন্দ করা, আর মনিটরের পর্দায় বই পড়লে কি সেই স্বাদ পাব? বই পড়াটা আমাদের অনেকের কাছেই একটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দ—পড়া তো পরে। নতুন বই হোক, পুরোনো বই হোক, দুয়ের আকর্ষণ দুই ধরনের। বই তো আগে নাড়ব-চাড়ব, উল্টেপাল্টে দেখব, ফোর-প্লে যাকে বলে। পড়লুম, তো ফুরিয়েই গেল। ও ডটু-বই কী প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে পড়া যাবে? কি জানি! হয়তো যাবে!

আমার অবিশ্যি দুঃখের কারণ নেই। এমনই একটা বাড়িতে বাস করি যেখানে প্রচুর হারিয়ে-চুরিয়েও যথেষ্ট বই মজুত। তিন প্রজন্মের পাঁচজন মানুষের বই-বাতিক (বাপ-মা আছেন, আমি আছি, আছেন আমার দুই মেয়ে—) এত যে বইয়ের সঙ্গে ঘর করি, এর বেশ মোটা অংশ এখনও আমার না-পড়া। আর্থা কিটু-এর সেই যে গানের কলিটা—থিংক অফ অল দ্য মেন ইউ হ্যাভেনটু কিস্ড?” ঠিক তেমনি। চারিদিকে প্রতীক্ষমাণ অপঠিত রহস্যময় বইয়েরা আমাকে ঘিরে আছে—এর আলাদা আনন্দ। এখনও সংসারের টানটা আছে, সময় সামলে উঠতে পারি না। তবু লোভে পড়ে কিনে ফেলি বই। তুলে রাখি পরে পড়ব বলে। বই তিন রকমের—চাওয়া বই, পাওয়া বই আর কেনা বই। চাওয়া বই সবার আগে পড়া হয়ে যায়। কেননা ফেরত দিতে হয়। উপহার পাওয়া বই তার পরেই পড়া হয়। কেননা বিবেকদংশন হয়। (আবার অনেক সময়ে পড়াটা শেষ হয় না, বইয়েরই দংশনে) বিবেক হার মেনে যায়। এখন তো লেখাপড়া জানলেই লেখক। তাই বইও বড্ড বেশি বেরোয়।) সবচেয়ে দুর্গতি এই কেনা বইয়ের। ঘরে আছে, পড়া হবে। কবে?

—হবে। একদিন সময় হবে। যখন পৃথিবী নিজেকে গুটিয়ে নেবে, যখন একা হয়ে যাব, তখন শীতের দুপুরে রোদে পিঠ দিয়ে বসতে হবে এই সব না-পড়া বই হাতে করেই। মুশকিলটা এইখানে—সেই অনাগত দিনটি কি কাছেই? নাকি তা যত দূরে থাকে ততই ভালো? ভালোই তো সেই অপঠিত, রহস্যময় পৃষ্ঠাগুলির জন্যে এই নিশ্চিত, নিশ্চিন্ত প্রতীক্ষায় থাকা।

দেশ, ভালোবাসা বই' ২৮ জানুয়ারি ১৯৯৫

বিদ্যানন্দ ও আমাদের বিবেকের লড়াই - আশফাক স্বপন

বিদ্যানন্দ ও আমাদের বিবেকের লড়াই
ধর্মান্ধরা যেন আমাদের পরিচয় নির্ধারণ না করে

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী, বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
- কাজী নজরুল ইসলাম

মানুষের সদিচ্ছা থাকলে অর্জন কী অভাবনীয় হতে পারে, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদ্যানন্দ তার একটা বিস্ময়কর উদাহরণ। সঙ্গত কারণে পেরু-প্রবাসী তরুণ প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাসের লক্ষ লক্ষ ভক্ত।
কিশোরবাবুর ওপর সাম্প্রতিক জঘন্য সাম্প্রদায়িক আক্রমণ দেখে তাই এত অবাক হলাম। বাংলাদেশে সংখায়গরিষ্ঠতান্ত্রিক মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কী জঘন্য হতে পারে এই আক্রমণ সেটা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়েছে। এই ঘটনা একপ্রকার নৈতিক যুদ্ধের আহবান।

এরকম মুহূর্তে আমাদের জাতীয় পরিচয়, আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে আমরা এক মর্মান্তিক প্রশ্নের সম্মুখীন হই।

আসলেই আমরা কে? আমাদের পরিচয় কী?

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যাবার কথা। সেই সময়কার বাংলাদেশ সরকারের একটা পোস্টারে মোদ্দা কথাটা বলা হয়েছে। পোস্টারের পটভূমিতে মন্দির, মসজিদ, গীর্জার ছায়া, তার ওপর দ্বার্থহীন উচ্চারণ: ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রীষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান – আমরা সবাই বাঙালী।‘

মনে হয় কিশোরবাবুর নিন্দুকদের কাছে সেই বার্তা এখনো পৌঁছেনি।

আসলে বাস্তব অনেক ঘোলাটে, গোলমেলে।

বাঙালি মুসলমানের নিজের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি আছে, নিজেদের মধ্যে মতভেদ আছে। বাঙালি মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের ফলশ্রুতি ১৯৪৭ সালের পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি। অথচ এক দশক পার না হতেই পাকিস্তানের ধাত্রী যে মুসলিম লীগ, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে তার ভরাডুবি হয়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পালটে আওয়ামী লীগ হয়। ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন দেশ ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে। রবীন্দ্রনথের ‘আমার সোনার বাংলা’ হয় দেশটির জাতীয় সঙ্গীত।

এই তো আমাদের ইতিহাসের চুড়ান্ত রায়, তাই না?

নির্মম সত্য হলো এরপর আমাদের জাতীয় পর্যায়ে পদস্খলন ঘটেছে। স্বাধীনতার পর গোঁড়া, ধর্মান্ধ ইসলামের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। আরব দেশের টাকা আর জাতীয় পর্যায়ের কিছু রাজনৈতিক শক্তির ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির প্রশ্রয় এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা বৃদ্ধিতে ইন্ধন জুগিয়েছে।

কিশোরবাবুর ওপর আক্রমণ এই জঘন্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। এর আগেও আরো আক্রমণের নজির রয়েছে।

বাংলাদেশের এক দুর্দান্ত ক্রিকেটার লিটন দাস। তিনি ফেসবুক পাতায় সবাইকে পূজার শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। ব্যস, আর যায় কোথায়? তার বিরুদ্ধে এমন অশ্রাব্য সাম্প্রদায়িক গালাগাল করা হলো, দেখে আমার রাগ আর ক্ষোভের সীমা ছিলনা।

আসলে বাংলাদেশি মুসলমানের সামাজিক পরিচয়কে একটি কাঙ্খিত দিকে ঠেলে দেবার জন্য এই সব আক্রমণ। মুসলমান হিসেবে আপনার সামাজিক পরিচয় দু’রকম হতে পারে। আমার প্রয়াত মা ও বোন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন/পড়ে, আবার দুজনেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভীষণ ভক্ত। আরেক রকম মুসলমান আছে যাদের চেতনাকে অসহিষ্ণুতা ও গোঁড়ামি এতখানি অধিকার করেছে যে বাংলা সংস্কৃতি, এমনকি ভাষার প্রতিও তাদের বিরাগ, অমুসলমানও তাদের গভীর অপছন্দ।

ধর্ম পালন থেকেই যে সবসময় এই ভেদবুদ্ধির জন্ম, তা নয়। মোহম্মদ আলি জিন্নাহ শুয়োরের মাংস খেতেন, মদ্যপান করতেন, আবার মনে করতেন হিন্দু আর মুসলমান আলাদা জাতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইসলাম ধর্ম পালন করতেন, কিন্তু যে উদার জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন সেখানে সকল ধর্মের বাঙালিদের সাদর আমন্ত্রণ ছিল।

ধর্মভীরু মানুষ – তাদের ধর্ম যাই হোক না কেন –দাবি করে যে তাদের সামাজিক মূল্যবোধের উৎস ধর্মীয় গ্রন্থ – কোরান, হাদিস, বাইবেল বা মনুস্মৃতি। কথাটা একদম ভুল। একই ধর্মের অনুসারী জনগোষ্ঠীর প্রবণতাভেদে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন রূপ হতে পারে। সমাজটি কূপমণ্ডুক, অসহিষ্ণু, হিংস্র হতে পারে, আবার মানবিক, উদার, পরমতসহিষ্ণু হতে পারে।

মাইমোনিডিসের (Maimonides) অভিজ্ঞতা থেকে কথাটি স্পষ্ট হবে। ইনি ১২শ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ইহুদী দার্শনিক ও চিকিৎসক। যখন স্পেনের কর্ডোবায় বেড়ে ওঠেন, তখন মুসলমান মূরীয় শাসনের রমরমা। তিনিও বড় হুন একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ, সুসংস্কৃত ইহুদীসমাজে। এরপর আলমোহাদ নামে উত্তর আফ্রিকা থেকে বারবার (Berber) মুসলমানের শাসকগোষ্ঠী মূরদের গদিচ্যুত করে। রাতারাতি ইহুদীদের অবস্থা পালটে যায়। পথ রইল তিনটি – ধর্মান্তর, নির্বাসন অথবা মৃত্যু। মাইমোনিডিস নির্বাসন বেছে নিলেন। জীবনের শেষের দিকে তিনি ক্রুসেড যুদ্ধের মুসলমান বীর সম্রাট সালাদিনের রাজসভার চিকিৎসক ছিলেন।
মুসলমান সমাজের পক্ষে কি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা পরিত্যাগ করে মানবিক, উদার মূল্যবোধে উত্তরণ সম্ভব?

নিজের হিংস্র অসহিষ্ণুতার কলঙ্কময় ইতিহাস সত্ত্বেও পাশ্চাত্য কিন্তু তা পেরেছে। ২০০১ সালে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় অমর্ত্য সেন মন্তব্য করেন: ‘১৫৯০-এর দশকে আকবর বাদশাহ যখন আগ্রায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতার সপক্ষে মত ঘোষণা করছেন, তখন খ্রীষ্টানদের পরধর্মবিরোধী ইনকিউজিশন চলছে। ১৬০০ সালে জরদানো ব্রুনোকে (Giordano Bruno) ধর্মধ্রোহিতার অপরাধে রোমের কাম্পো দি ফেওরে-তে (Campo di Fiore) জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।‘

বাংলাদেশে কিশোরবাবুর ওপর মুসলিম ধর্মান্ধ আক্রমণের ফলে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, তাতে বহু ক্ষুব্ধ মুসলমান সামিল আছেন। এর ইতিবাচক ফল এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে মনে হয়।
এর আগেও ব্যাপক গণধিক্কার কার্যকর হয়েছে। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল মুসলমান চরমপন্থীরা বাংলা নববর্ষে রমনায় ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠনে বোমা হামলা করে। (এবিষয়ে আমার ক্ষোভ গভীর ও ব্যক্তিগত । আমার বোন ও ভগ্নীপতি সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।)

হামলাকারীদের উদ্দেশ্য যদি ত্রাস সৃষ্টি হয়ে থাকে, সেটা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

পরের বছরগুলোতে ছায়ানটের অন্তুষ্ঠানে বাঁধভাঙা মানুষের ঢল নেমেছে। এরা অধিকাংশ মুসলমান। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষে যে অপূর্ব মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়, তার বিরুদ্ধে কিছু কাঠমোল্লা তীব্র ভাষায় অভিসম্পাত করে। আর প্রতিবছর মানুষ তার তোয়াক্কা না করে শোভাযাত্রায় যোগ দেয়।

ধর্মান্ধ মুসলমানদের স্থায়ীভাবে পরাস্ত করতে হলে যেটার প্রয়োজন, মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ হারবার্ট মারকুজ তাকে বলেছেন immanent critique - একেবারে জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তর থেকে উঠে আসা সমালোচনা।
ধর্মভীরু মুসলমানরা প্রায়ই উগ্র ধর্মান্ধ মুসলমানদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেন। তাদের বলতে শুনেছি, এদের বর্বরতার কারণে ইসলামের সম্মানহানি হচ্ছে। কিন্তু একথা শুধু মুখে বললেই তো চলবে না। কাজের মাধ্যমে এই সদুদ্দেশ্যের প্রমাণ রাখতে হবে।

যদি মনে করেন অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ মুসলমানদের ইসলামের সামাজিক পরিচয় নির্ধারণ করতে দেওয়া যাবে না, তাহলে আসুন, আপনার ধর্মের সম্মান রক্ষায় ময়দানে নামুন।

যেদিন ধর্মভীরু মুসলমান এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, সেদিন তারা যে ধর্মান্ধতা ও অসহিষ্ণুতা এত অপছন্দ করেন, তার বদলে যে পরমতসহিষ্ণু, মানবিক মুসলমান সমাজ কামনা করেন, সেটা অর্জনের পথ সুগম করবে।

এই কাজ করতে পাশ্চাত্যের কয়েক শতক লেগে গিয়েছে, কিন্তু পাশ্চাত্য তা পেরেছে। খোদ বাংলাদেশেও এটা সম্ভব। তবে বিনাযুদ্ধে সেটা হবে না।

আমরা বাঙালি না মুসলমান, এটাও আরেকটা অসার প্রশ্ন। বহু বাঙালি মুসলমান সগর্বে এবং সানন্দে দুই-ই। (আপনার ধর্মীয় মূল্যবোধে যদি সঙ্গীত গ্রহণযোগ্য না হয়, আপনার সেই মতে চলার অধিকার আমি মান্য করি। তবে অন্যের ওপরে এব্যাপারে জবরদস্তি করবেন না। আর জাতীয় পরিচয় ভৌগলিক, ধর্মীয় নয় – এই কথাটা মান্য করতে শিখুন।) এর ফলে আমাদের সমাজ আরেকটু মানবিক, সহনশীল হবে।
‘আমাদের পরিচয়ের কোন কষ্টকল্পিত একমাত্রিক সাদৃশ্য নয়, সৌহার্দ্যের জন্য সবচাইতে বড় সহায়ক বরং আমাদের পরিচয়ের বহুমাত্রিকতা। আমাদের পরিচয়ের নানান মাত্রা একে অপরকে অতিক্রম করে, তাতে কঠোর বিভাজনের মাধ্যমে দুইটি বিবদমান গোষ্ঠী সৃষ্টি ব্যাহত হয়।‘ অমর্ত্য সেনের উক্তি, প্রাগুক্ত ‘বিশ্ব সুপষ্ঠভাবে বিভাজিত নয়’ শীর্ষক নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর নিবন্ধে।

https://www.thedailystar.net/opinion/news/bidyanondo-and-the-battle-our-soul-1900726
প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট