একটি ছাগলের গল্প - পেরুমাল মুরুগান | নিউ ইয়র্ক টাইমসের পুস্তক সমালোচনা | আনুবাদঃ আশফাক স্বপন


সাম্প্রতিককালে ভারতে মুক্তবুদ্ধিচর্চা নানাভাবে হিন্দুত্ববাদীদের গণরোষের শিকার হয়েছে, এবং সেটা নিয়ে সেদেশের বুদ্ধিজীবী ও লেখকরাও সোচ্চার হয়েছেন। তামিল লেখক পেরুমাল মুরুগান আক্রান্ত হন কয়েক বছর আগে। তার সাম্প্রতিক উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেটা নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ পুস্তক সমালোচনা।
ভারতের অন্যতম শীর্ষ মৌলিক ও বিতর্কিত ঔপন্যাসিক ফিরলেন এক শক্তিশালী উপকথা নিয়ে।

পারুল সেহগাল
অনুবাদ: আশফাক স্বপন
মূল রচনা:
One of India’s Most Original and Controversial Novelists Returns with a Powerful Parable
By Parul Sehgal
The New York Times, Dec. 11, 2019

The Story of a Goat
By Perumal Murugan
Translated by N. Kalyan Raman
183 pages. Black Cat. $16, paper.

লিঙ্ক
https://www.nytimes.com/2019/12/11/books/review-story-of-goat-perumal-murugan.html

গত বছর স্টকহোমে নোবেল পুরস্কারের অভিভাষণে পোলিশ লেখিকা ওলগা তোকারচুক সাহিত্যজগতের প্রতি দৃষ্টিপাত করে হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন: সাহিত্যে যে শক্তি ও সম্ভাবনা নিহিত, সেটা আজ কোথায় গেছে? সাহিত্য তার আপন অধিকারবলে আমাদের আটপৌরে জীবন থেকে ঘাড় ধরে টেনে এনে চিরন্তন সত্যের মোকাবেলা করতে বাধ্য করে, আমাদের ইতিহাস ও পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত করে। কী হল সাহিত্যের সেই অধিকারের? তার পরিবর্তে আমরা স্মৃতিচারণ আর আত্মচরিতের কোলাহলে বুঁদ হয়ে গিয়েছি – এ যেন ‘একক শিল্পীদের নিয়ে গঠিত সম্মিলিত সঙ্গীত’। উপন্যাসে উপকথার ব্যবহার আজকাল লোপ পেতে বসেছে বলে তোকারচুক দুঃখ প্রকাশ করেন। সাহিত্য আমাদের এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারে যেখানে সুতীব্র মরমী দরদের সাহায্যে আত্মকেন্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার একটা সুযোগ আসে, তাতে আমাদের চারপাশের জগৎ সম্বন্ধে সংবেদনশীলতার পুনর্জাগরণ ঘটে। তারও আজ বড় ক্ষয়িষ্ণু রূপ দেখে তিনি আক্ষেপ করেন।

স্বীকার করতেই হবে অবস্থা যে এতটা খারাপ আমার ধারণা ছিলনা। তবে হতাশ হবেন না, ওলগা তোকারচুক। আমার হাতের কাছেই রয়েছে অব্যর্থ মহৌষধ। ‘The Story of a Goat’ (একটি ছাগলের গল্প) পেরুমাল মুরুগানের সদ্য অনূদিত উপন্যাস। ২০১৫ সালে তার বহুবিশ্রুত ‘সাহিত্যিক আত্মহত্যা’-এর পর এটি তার প্রথম কাজ। দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডারা ‘One Part Woman’ (এক ভাগ নারী) বইটি লেখার কারণে তাকে আক্রমণ করে। সেই উপন্যাসে একটি সনাতন মন্দিরের আচারের বর্ণনা রয়েছে। তাতে নিঃসন্তান নারীদের সন্তানলাভের আশায় অপরিচিত পুরুষের সাথে সহবাসের অনুমোদন রয়েছে। মুরুগানকে তার গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়, জোরপূর্বক তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। তিনি লেখালেখি ছেড়ে দেন। ফেসবুকে তিনি পোস্ট দেন: ‘লেখক পেরুমাল মুরুগান মৃত। তাকে রেহাই দিন।‘

আদালতের রায়ে তাঁর বাকস্বাধীনতার অধিকার রক্ষিত হয়। মুরুগান আবার কাজে ফেরেন, যদিও বেশ বড় একটা ঝাঁকুনিতে তিনি মানসিকভাবে বেসামাল হন। তিনি বলেন মানুষের সম্বন্ধে লিখতে তার অনীহা জন্মেছে (‘আমার ভেতরে একজন রক্তচক্ষু সেন্সর বসে আছে’)। তার প্রিয় বিষয়গুলো – জাতপাতের রাজনীতি, ক্রোধোন্মাদ জনতার ভয়ঙ্কর শক্তি – সেসব নিয়ে লেখার তো প্রশ্নই ওঠেনা।

ভাগ্যিস ছাগল ছিল!

লেখক পেরুমাল মুরুগান বহাল তবিয়তে আছেন, বরাবরের মতই নির্ভীক। গ্রামীণ জীবনের আরেকটি উপকথা নিয়ে তিনি ফিরেছেন। তারঁ লেখনভঙ্গির আপাতসরলতা স্তম্ভিত করে। তামিল থেকে অনুবাদ করেছেন এন কল্যাণ রমণ। এই উপন্যাসে গাত্রবর্ণ আর জাতপাতের ভিত্তিতে অত্যাচার, সরকারী নজরদারী, নারীর লাঞ্ছনা – এই সব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, তবে সবটাই সুচতুরভাবে লুকানো হয়েছে একটি অসুখী ছোট্ট ছাগলের জীবনবৃত্তান্তের অভ্যন্তরে।
সমগ্র সাহিত্যে পুনাচির মত অভাগা জীব পাওয়া যাবে কিনা বলা ভার। সে তার মায়ের সপ্তম ও সবচেয়ে ছোট্ট সন্তান। মায়ের জরায়ু থেকে বেরিয়ে যখন সে ভূমিষ্ঠ হয়, তখন সে ফুলের মত ভঙ্গুর, বর্ণে নিকষ কালো।

এক বুড়ো চাষী ও তার স্ত্রী তার পালনের দায়িত্ব নেয়। তারা অবাক হয়ে লক্ষ করে, তাদের নিস্তরঙ্গ গৃহকোণ যেন নতুন ঊষ্ণতা আর প্রত্যয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। লেখকের ভাষায়: ‘স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বহুদিন এত মধুর গল্পগুজব হয় নি। তাদের জীবনে ছোট্ট ছাগলের আবির্ভাবের ফলে তারা এখন পূরনো দিনের গল্প করে।’ তারা ছাগলটিকে খাইয়ে দাইয়ে নাদুস-নুদুস করে তুলল, তারপর নিজেদের ছাগলের পালের সাথে তাকে ভিড়িয়ে দিল। ছাগলটি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। সে সব কিছু খেয়াল করে, সহজে রাগে না। তার পেটটা নিয়ে সে সঙ্কোচ অনুভব করে। জীবনের শুরুতে ক্ষুধার কারণে তার পেটটা বড়। তার গায়ের লোমের জটা নিয়েও সে বিব্রত। ছোট বাচ্চার মত সে বুড়ো-বুড়িকে আকঁড়ে থাকে।

সাহিত্যে এর কৌলিন্য যাই থাক, জীবজন্তুর গল্পের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার সমালোচনা করবার এই পরম্পরাটি নিয়ে বরাবরই আমার সংশয়। ‘বাচ্চা ছাগল’ কথাটা আমার মগজে যেভাবে আঘাত করে তাতে আমি বেশ বিরক্ত হই। তবে কিনা মুরুগান কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত আপন পরিবারের ছাগলের দেখভাল করেছেন, তাই প্রাণীর জীবন (মৃত্যু, যৌন আকাঙ্ক্ষা, অসুয়া) নিয়ে তার লেখায় বিন্দুমাত্র অতিনাটকীয়তা নেই। তিনি এইসব প্রাণী দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন। তিনি জানেন বাচ্চা ছাগল যখন প্রথম মাতৃস্তন্য থেকে দুগ্ধপান করে, তখন তার চোয়াল ব্যথা করে। রাতের অন্ধকারে কেউটে সাপের গা থেকে কী গন্ধ বের হয় সেটাও তিনি জানেন।

এক ধরনের পাঠক আছে যারা এই পুস্তক সমালোচনার এতখানি পড়বার পর খানিকটা অন্যমনস্ক, কিছুটা অস্বস্তিতে পড়বেন। ভাবেন, ঈশ এই ছোট্ট ছাগলের বাচ্চাটিকে কী অনেক কষ্টভোগ করানো হয়েছে? যদি খুব কষ্টভোগ করানো হয়ে থাকে, তাহলে কী দরকার এমন গল্প পড়ার? কেন দুঃখ-কষ্ট দেখার জন্য সাহিত্যের কাছে যাওয়া? এই প্রশ্নের উত্তর ‘একটি ছাগলের গল্প’ এতটা সৌকর্য, রসবোধ আর দরদের সাথে দিয়েছে যার তুলনা আমি নিকট অতীতের কোন বইয়ে পাইনি। আসলে আমরা এসব গল্পের কাছে যাই সততার মধ্য দিয়ে স্বস্তির অণ্বেষণে; যা লুকানো, সেটা আলোয় কীভাবে আসে সেটা দেখার জন্য। আমাদের আশেপাশে কত জীবন, সেসব এতই অকিঞ্চিতকর যে তা মহৎ সাহিত্যের বিষয়বস্তু হতে পারে না। সেইসব জীবন অহরহ বেদনায় জর্জরিত হচ্ছে, সেই সত্যটি – হয়ত শুধু এখানেই – স্বীকার করার জন্য আমরা এসব গল্পের কাছে ছুটে আসি।

ছোট্ট ছাগলটার কী কষ্টটাই না ভোগ করতে হয়! তার সঙ্গীদের যৌনক্ষমতা লাভ করতে না করতেই পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হয়। সে প্রেমে পড়ে। (মুরুগান ছাগলের রতিক্রিয়ার একটি অস্বস্তিকর রকমের ভাল বর্ণনা দিয়েছেন।) বুড়ি চাষীবৌ কিছুতেই তার পোষা ছোট্ট ছাগলের সঙ্গ ছাড়বেন না, অথচ পুনাচিকে তার প্রিয়তম থেকে আলাদা করা হয়। সে তার মানুষ-মায়ের ওপর রাগে টগবগ করে। তাকে সহিংসভাবে সন্তানসম্ভবা করা হয়। এদিকে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।

এই সমাজের নানান অদ্ভত লক্ষণ গল্পে প্রবেশ করতে শুরু করে। মানুষ বা জন্তু – প্রতিটি নতুন সন্তানের হিসেব রাখতে হয়, এবং তার কর্ণ সূচিবিদ্ধ করতে হয়। চাষা ও রাখালদের জন্তুর বাবা-মা কে এই বিষয়ে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষ করে যাদের কালো ছাগল রয়েছে। কালো ছাগলের প্রতি বিশেষ বিরাগ। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটিতে ভবিষ্যতদ্রষ্টার সুর রয়েছে। ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন অভিবাসীদের অধিকারদানের ক্ষেত্রে তাঁদের ধর্ম বিবেচনা করে, যা কার্যত দেশটিকে একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দেশে পরিণত করেছে। এই উপন্যাসটি যেন আগে থেকেই সেটা আঁচ করতে পেরেছে।

চেকভের স্বচ্ছদৃষ্টি নিয়ে মুরুগান তার ছোট্ট ছাগলটির গোটা জীবন অনুসরণ করেন – তার হতাশা, তার ছোট ছোট বীরত্বের ঘটনা, তার আকুতি। রমণের সুষ্ঠু অনুবাদে প্রতিটি বাক্য আতিশয্যমুক্ত, সুগঠিত ও পরিষ্কার। কিন্তু এই আপাতসরল বাক্যগুলোর মধ্যে নিহিত রয়েছে বৃষ্টি, রাজনীতি, মানুষের আচরণ – এই সবকিছুর খামখেয়ালিপনা সম্বন্ধে এক গভীর প্রাজ্ঞ উপলব্ধি, সেটা আমরা কীভাবে যেন বুঝতে পারি। চেকভই তো একবার বলেছিলেন যে সক্রেটিসের জীবনী যে কেউ লিখতে পারে, কিন্তু এই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অজ্ঞাতনামা মানুষ, এদের গল্প বলতে গেলে মুনশীয়ানা প্রয়োজন।

‘একবার, একটি গ্রামে, এক যে ছিল ছাগল।’ এভাবে বইটির শুরু। ‘সাধারণ একটি প্রাণির জন্ম কোন চিহ্ন রেখে যায় না, যায় কী?’ মুরুগান আমাদের কাছে এই সত্য প্রকাশ করেন যে আমরা সবাই এই রকম সাধারণ প্রাণী। যদিবা আমাদের কোন পলাতক চিহ্ন রয়েই যায়, সেটা আমরা একে অপরের কাছে সমর্পণ করে যাই।
প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট