কায়েস আহমেদের সততা সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যে বিরল - আখতারুজ্জামান ইলিয়াস


কায়েস আহমেদের সততা সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যে বিরল
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

কায়েস আহমেদের বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর হওয়ার আগেই তার রচনাসমগ্র প্রকাশের উদ্যোগে উৎসবের আভাস নেই, এই প্রকাশ বরং শোক উদযাপনের আয়ােজন; এখানেই তার লেখার সঙ্গে শেষ যোগাযোগ, তার আর নতুন লেখা পড়ার সম্ভাবনার ইতি ঘটলো এখানেই।

গত বছর (১৯৯২) ১৪ জুন তারিখে কায়েস আহমেদের মৃত্যু হয়েছে। জীবনের বিনাশ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ও এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার কাজ তিনি সম্পন্ন করেছেন নিজেই। মরবার পর কোনোকিছু করা আর কিছুতেই সম্ভব নয়, নইলে নিজের দাফনের কাজটিও কায়েস মনে হয় নিজে নিজেই করতেন। নিজের কোনো কাজে কারো ওপর নির্ভর করা তার ধাতে ছিলো না। সংকলন ও সম্পাদনা করে তাঁর লেখা-প্রকাশের দায়িত্ব আর কারো ওপর চাপানো কায়েসের পক্ষে অচিন্তনীয়। তাঁর প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ, বিরল সততা ও অসীম সাহসের পরিণতিতে আত্মহত্যা অনিবার্য কি-না এবং কাজটি তাঁর শিল্পচর্চার সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ-এর জবাব খোজার জন্যে কায়েস আহমেদের শিল্পকর্ম পাঠকের মনোযোগ দাবি করে।

ঘনিষ্ঠ কারো মৃত্যুর কয়েক মাসের ভেতর তাঁর রচনার বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ভূমিকা লেখা খুব ভোঁতা মানুষের জন্যেও সহজ কাজ নয়। তা অত নিরপেক্ষতার দরকারই-বা কী? তার আগ্রহী পাঠক হিসাবে কথা বলতে বলতে নিজের ভাবনার জটগুলো খোলার চেষ্টা করা এবং কায়েস সম্বন্ধে আর দশজনের ভাবনা একটু উসকিয়ে তোলা যায়।

কায়েস আহমেদ লিখতে শুরু করেন স্কুলে থাকতেই। ১৯৬৫ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে এইচএসসি-র ছাত্র, তখন তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। এর পরপরই কামাল বিন মাহতাবের সম্পাদনায় ‘ছোটগল্প' প্রকাশিত হলে এখানকার এই প্রথম ছোটগল্প-পত্রিকার সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। নিজে গল্প লেখা ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত তরুণ এবং সম্ভাবনাময় তরুণতরদের মূল্যায়ন ও পরিচিত করার জন্যে তিনি উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। লেখার ব্যাপারে খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোক ছিলেন, আবার পাঠকের মনোরঞ্জন সাধন তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো না; তাই প্রথম বই অন্ধ তীরন্দাজ প্রকাশের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত।

কায়েস আহমেদের সাহিত্যকর্মে তাঁর প্রকাশরীতি, পর্যবেক্ষণের ভঙ্গি ও অনুসন্ধানের পদ্ধতির বিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু তার গল্পের মানুষদের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই প্রথম বইতেই। মিলনের জন্যে কাতর বিচ্ছিন্ন মানুষের পাশাপাশি এখানে দেখি দমবন্ধ-করা বৃত্তের ভেতর বন্দি অসহায় চরিত্র। রেলে কাটা মানুষের ছিন্নভিন্ন শরীর দেখি প্রেমের প্রেক্ষাপটে। মিষ্টি স্বভাবের বৌ স্বামীর সঙ্গে বিছানায় শুয়ে মিলনের চরম মুহূর্তে স্বামীর বন্ধুকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না কিছুতেই। নস্টালজিয়ায় কাতর মানুষ, নিঃসঙ্গ মানুষ, ক্লান্ত মানুষ, স্মৃতির স্বাদে ও কষ্টে আচ্ছন্ন মানুষ—এরা সবাই তাঁর পরবর্তী রচনার সূচিপত্র।

আট বছর পর ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় কায়েসের প্রথম উপন্যাস নির্বাসিত একজন। কায়েসের প্রথম বইয়ের প্রায় সব লোকই এখানে কোনো-না-কোনোভাবে এসে হাজির হয়েছে, কিন্তু এর প্রেক্ষাপট সমস্ত দেশের সমাজ। দাঙা এই উপন্যাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, দাঙাকে এই লেখার নায়ক বলেও চিহ্নিত করতে পারি। স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার সঙ্গী দাঙার ফলে মানুষকে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হয়, এই স্বাধীনতা তাই শুধু মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার অধিকার অর্জন। তার স্বাভাবিক জীবনের বিকাশ শােচনীয়ভাবে বিঘ্নিত। ক্ষোভ, অপমান ও গ্লানির ভেতর অহরহ যে-জীবন সে যাপন করে সেখানে এই উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষকে দিব্যি শনাক্ত করতে পারি। কিন্তু কাহিনীর শেষে এই প্রেক্ষাপটের গুরুত্ব আড়ালে পড়ে যায় যখন লেখক প্রধান চরিত্রের ভেতর একটি সিদ্ধান্ত আরোপ করিয়ে দেন যা তার জীবনযাপন বা স্বভাবের সঙ্গে খাপ খায় না। এখানে কায়েস ঝুঁকে পড়েন নিটোল কাহিনী রচনা করার দিকে এবং এদিক থেকে তিনি গড়পড়তা উপন্যাসের রীতির কাছেই আত্মসমর্পণ করে বসেন। মনে হয়, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক কাহিনী-বর্ণনার প্রবণতা তাঁর পরবর্তী রচনায় অব্যাহত থাকবে এবং একজন জনপ্রিয় লেখক হিসাবে তিনি পাঠককে আঠার মতো সেঁটে রাখবেন এবং তাঁর উপন্যাস পাঠের পর পাঠক পরম তৃপ্তিতে গা এলিয়ে দেবেন।

সৌভাগ্যক্রমে কায়েস আহমেদের পরিণতি তা হয়নি। তাঁর দ্বিতীয় ও শেষ উপন্যাস দিনযাপন পড়ে কায়েসের বিকাশ দেখে বিস্মিত হতে হয়। প্রথম বইতে মোটামুটি আয়ত্ত গল্প বলার রীতিটিকে তিনি এখানে এসে বর্জন করেছেন। প্রকরণের নতুনত্ব এখানে বড় কথা নয়, এই নতুন পথ অনুসরণের প্ররোচনা তিনি পান অনুসন্ধানের তীব্র স্পৃহা থেকে। ‘দিনযাপন’ কিন্তু কায়েস আহমেদের শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, দুই উপন্যাসের মাঝখানে লেখা একটি গল্প ‘জগদ্দল’ তার সাক্ষী। একই বইয়ের ভেতর ‘জগদ্দল’-এর সহ-অবস্থানের কারণ কি কেবল রোগা বইটির শরীরে মাংস যোগ করা? না। এই রচনা দুটির মধ্যে প্রধান সম্পর্কটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বৈইকী!—একটিতে আমাদের ১ নম্বর স্বাধীনতা ও তার সঙ্গী দাঙার দক্ষযজ্ঞের ভয়াবহ বিবরণ এবং আরেকটিতে ২ নম্বর স্বাধীনতার পর তুমুল অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের ছবি। কিন্তু কি গল্প বলার রীতি, কি চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক, কি দৃষ্টিভঙ্গি—সব ব্যাপারেই দুটি লেখায় লেখকের ভিন্ন স্বভাবের পরিচয় পাই। | ‘জগদ্দল’ গল্পে কায়েস আহমেদের স্যাতসেঁতে প্রকাশ ঝরে পড়েছে। কোনো চরিত্রের প্রতি তরল ভালোবাসা নেই। যে-যুবসম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ নিজেদের জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি নরখাদক সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছে, স্বাধীনতার পর দায়িত্বহীন রাষ্ট্রীয় শাসনের ফলে সেই যুবকদের মধ্যে প্রবলরকম অস্থিরতা, ক্ষোভ এবং এর পরিণামে চরম হতাশার সৃষ্টি হয় তাকে তেতো করে দেখানো হয়েছে এই গল্পে। ঐ সময়ের বাস্তবতা একটু রং পাল্টে কিন্তু এখনো অব্যাহত রয়েছে। এর ওপরকার দৃশ্যটি হলো লুটপাট, ছিনতাই, একবার উগ্র জাতীয়তাবাদী হুঙ্কার এবং আরেকবার ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের ঘেউঘেউ। কিন্তু ভেতরকার সত্যটি হলো এই যে, অনাচারের বিরুদ্ধে যাদের রুখে দাড়াবার কথা তারা নিদারুণভাবে পঙ্গু ও নপুংসক। | ‘জগদ্দল’-এর ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত দিনযাপন’-এর নায়ক। ঢাকা শহরের পুরনো এলাকায় একটি নড়বড়ে বাড়ির অধিবাসীরা হলো এর বিভিন্ন চরিত্র। তাদের সমস্যা ঠিক একরকমের না হলেও বড় করে দেখলে প্রায় একই ধরনের। ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে এরা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং এই কারণে এক ধরনের হীনম্মন্যতার শিকার। উপন্যাসের নায়ক হিসাবে বিশেষ একটি লোককে শনাক্ত করা যায় না। কোনো একক মানুষ কাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করা তত দূরের কথা, আলাদাভাবে চোখে পড়ার মতো ক্ষমতাও অর্জন করে না। এখানে সুস্থ জীবনযাপনের জন্যে উন্মুখ মানুষও আছে, কিন্তু সেই উন্মুখতা কখনো আকাঙ্ক্ষার পর্যায়ে ওঠে না বলে সেখানে কোনো সংকল্প নেই, তা শেষ পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ে লোভ হয়ে। পড়তে পড়তে পাঠক গ্লানিবোধ করতে পারেন, এখানেই কায়েসের সাফল্য। মধ্যবিত্ত, যে মানুষ নাম ধারণের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে---এই সত্যটিকে ঘােষণা করে পাঠককে অস্বস্তির মধ্যে ফেলার ভেতরই তার সার্থকতা।

ঐ সত্যটি কায়েস নিজেও উপভোগ করেন না। তাই গোটা উপন্যাসে তাঁর অস্থিরতা বড় প্রকট, মাঝে মাঝে প্রায় আপত্তিকর। নিজের উপলব্ধিকে জানাবার জন্যে তার তাড়াহুড়া ভাবটা চোখে খচখচ করে বেঁধে। একেকটি চরিত্রের স্কেচ এঁকেই তিনি মন দেন আরেকজনের দিকে, তাদের স্বাভাবিক বিকাশ দেখাবার জন্যে ধৈর্য ধরার মতো অবসর তিনি পান না।

অথচ তার সততা সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যে বিরল। এই সততার বলেই কাহিনীর নামে কেচ্ছা বয়ান করার লোভ থেকে তিনি বিরত থাকতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথম উপন্যাসে গল্প বলার যে-প্রবণতা তার মধ্যে পেয়ে বসেছিলো তা অব্যাহত থাকলে এখানে এসে পরিণতরূপ লাভ করতে পারত। এই বইতে যে-শক্তির পরিচয় পাই, তাতে নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, ঐ প্রবণতার কাছে আত্মসমর্পণ করলে মসৃণ ও গতানুগতিক কাহিনী ফেঁদে ব্যাপকসংখ্যক পাঠক এবং সমালোচকদের পৃষ্ঠপোষকতা তিনি লাভ করতেন। সহজ সাফল্যের ঐ নিরাপদ ও সুনিশ্চিত পথ পরিহার করতে পারাটাই তাঁর সততা ও শক্তির প্রকাশ। অনেক দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও কায়েস আহমদ নায়কবর্জিত, ছিমছাম গপ্পোমুক্ত একটি ভাষাচলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সততা ও শক্তির অধিকারী বলেই জীবনের জয়গান করার জন্যে ইচ্ছাপূরণের নাবালক বাণী ছাড়ার পথ তিনি অনায়াসে পরিহার করতে পেরেছেন। আবার এরই মধ্যে দেখি, নড়বড়ে বাড়িটির আসন্ন মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়েছে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের সাহায্যে।

কায়েস আহমেদের সর্বশেষ বই লাশকাটা ঘর একটি গল্পগ্রন্থ। এই বইতেই তার শক্তির সবচেয়ে পরিণত প্রকাশ ঘটেছে। মানুষের নানারকম বেদনা ও ফাপড়কে তিনি দেখতে পান সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের অজস্র বিস্ফোরণ বলে। এখানে মানুষের কেবলই মার খাওয়ার অসহায় বেদনা নেই, রোগের চিকিৎসা করতে সংকল্পবদ্ধ মানুষকেও এখানে পাওয়া যায়। এমন সব হতাশ যুবকদের দেখি যাদের কাছে দেশের স্বাধীনতা ও মানুষের স্বাধীনতা সমার্থক নয়। সামাজিক মূল্যবোধের নামে প্রচলিত সংস্কারকে ঝেড়ে ফেলে মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে হাতিয়ার তুলে নেয় নতুন যুবক। আবার এর ভেতরেই বেজে চলে তার নস্টালজিয়া, তবে নিজের স্মৃতিকে কেবল একটি ব্যক্তির কষ্টের মধ্যে না দেখে তিনি তা স্থাপন করেন মানুষের বেদনার পটভূমিতে। তার উপন্যাসের কোনো কোনো চরিত্র এখানে ফের হাজির হয়, তবে তাতে আমাদের একঘেয়ে লাগে না, বরং চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার উত্তাপ বোধ করি এবং ঐসব মানুষের গভীর ভেতর জগৎ আমাদের চোখে উন্মোচিত হয়। | ছোটোগল্পের প্রচলিত ও ধরাবাধা ছক তাঁর অনুসন্ধান প্রকাশের জন্যে যথেষ্ট বিবেচিত হয় না, প্রকরণ ভেঙে তিনি বেরিয়ে পড়েন নতুন ও অনিশ্চিত পথের দিকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটেমাটি খুঁজতে যাওয়ার একটি অভিযানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে একটি গল্পে, প্রথমে এটিকে একটি সাদামাটা প্রতিবেদন বলে ভুল হতে পারে । কিন্তু পড়তে পড়তেই কয়েকজন লোককে পেয়ে যাই যারা কেবল ঐ গ্রামের মানুষ নয়, নিরাপত্তার অভাব, গ্লানি ও অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা দাবি করে গল্পের চরিত্রের মর্যাদা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বপুরুষের ভিটে খোঁজ করতে গিয়ে লেখক এদের দেখেন এবং এদের আসন্ন-গৃহত্যাগের সম্ভাবনায় দেখতে পারেন নিজের ভিটেমাটি ত্যাগ করে আসার অভিজ্ঞতা। কিন্তু নিজে তিনি আড়ালেই রয়ে যান। এমনকি যেসব চরিত্র সৃষ্টি করেন তারাও কেবল কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকে না। দেশের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি—সবকিছুর বিশ্লেষণ ধরা পড়ে তাদের তৎপরতা ও এমনকি কেবল নীরব অবস্থানের ভেতরেও। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কায়েসকে মুগ্ধ করেছেন বললে মোটেই ঠিক বলা হয় না, বরং তার অস্থিরতা এই শিল্পীর কল্যাণে রূপ পায় বাঁচার প্রেরণায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি পাঠ করেছিলেন সৃজনশীল পাঠকের উত্তেজনা ও উদ্বেগ নিয়ে। কেবল নিজে পড়ে ক্ষান্ত হননি, কোন লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কীভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাও দেখতে চেয়েছিলেন বলে তাঁর প্রিয় লেখকের ওপর একটি রচনা সংকলন সম্পাদনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, চিঠির পর চিঠি ও তাগাদার পর তাগাদা দিয়ে তাদের অনেকের লেখা জোগাড় করেন এবং নিজেও একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় লেখার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই কাজটি শেষ করার আগেই তিনি নিজেই শেষ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

রথীন্দ্র ঘটক চৌধুরীকে নিয়ে লেখা তার বইটিকে কেবল একটি গবেষণা বই বললে সত্যের ধারেকাছেও যাওয়া যায় না। এই বইয়ের সব তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন পরম নিষ্ঠার সঙ্গে, এজন্যে বিপুল পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু এই বস্তুনিষ্ঠ কাজের মধ্যে প্রবাহিত রয়েছে তার মানুষকে পর্যবেক্ষণ করার গভীর প্রবণতা। রথীন্দ্র ঘটক খুব পরিচিত লেখক নন বলেই কায়েস তাঁর গভীর সংবেদনশীল ব্যক্তিত্বকে উপস্থিত করার কঠিন দায়িত্বটি গ্রহণ করেন।

গল্প-উপন্যাস লেখা, প্রিয় লেখকের ওপর প্রবন্ধের সংকলন সম্পাদনা, অপরিচিত লেখকের ভেতর সংবেদনশীল ব্যক্তিত্বের উন্মোচন, অনিয়মিত হলেও সাময়িকীতে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা, সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকা——সবই তাঁর সৃজনশীল অনুসন্ধানের অবিচ্ছিন্ন অংশ।

এই শিল্পীর আত্মহত্যা কি কেবল আকস্মিকভাবে নিজেকে প্রত্যাহত করার স্পৃহার ফল? তার প্রিয় কবির সেই বহুপঠিত কবিতার লোকটি আর তিনি কি এক ব্যক্তি? মেনে নেওয়া মুশকিল।


কাল রাতে—ফাগুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হলো তার সাধ;
জীবনানন্দ দাশ আট বছর আগের একদিন

কিন্তু ফাগুনের তখনো ঢের বাকি। বসন্তকালের রাত্রির অন্ধকার নয়; তখন ঘােরল বিকাল, জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিন সেদিন যতক্ষণ পারে আকাশ জুড়ে চড়া রোদ ঝেড়েছে। ঈদের একদিন পর পবিত্র কোরবানির গোরুখাসির রক্ত দীননাথ সেন রোডের এখানে ওখানে শুখিয়ে কালচে হয়ে এসেছে, নিহত জীবজন্তুর নাড়িভুড়ি ছড়িয়ে রয়েছে গোটা সতীশ সরকার রোড় জুড়ে, তার গন্ধে দম-বন্ধ-করা গরম বাতাস। এরই মধ্যে তিনতলা বাড়ির ছাদে চিলেকোঠার ফ্ল্যাটে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে পড়েন কায়েস আহমেদ। একটু-আগে-ডুবে-যাওয়া পঞ্চমীর চাঁদের স্মৃতিতে কোমল ও স্নিগ্ধ অন্ধকারে শেষনিশ্বাসটা টেনে নেওয়ার সুযোগ কায়েস আহমেদ নেননি। কোমল ও মিষ্টি, নিরাপদ ও অনায়াস, সরল ও স্নিগ্ধ কোনো ব্যাপারে কায়েস আহমেদ স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না। নিজের তৈরি প্রকরণটিতে অভ্যস্ত হতে-না-হতে তিনি অন্য পথের সন্ধান করতেন। কায়েস আহমেদ সব সময়েই ছিলেন নতুন লেখক। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন নতুন লেখকের প্রেরণা ও কষ্ট এবং নতুন লেখকের উদ্বেগ ও অতৃপ্তি নিয়ে। মানুষের গভীর ভেতরটাকে খুঁজে দেখার জন্যেই একটির পর একটি রাস্তায় তাঁর ক্লান্তিহীন পদসঞ্চার। তাঁর পায়ের নিচে বিরতিহীন ভূমিকম্প, তাই তাঁর এই অবিরত ছুটে চলা। এইসব রাস্তাই তার পছন্দের। ধীর ও শান্ত, সন্তুষ্ট ও নিস্তরঙ্গ সমতল তাকে কখনোই কাছে টানতে পারে না।

ব্যক্তিগত জীবনেও কোনো ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকা তার ধাতে ছিলো না । প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ব্যাপারে জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্মান শ্রেণীতে ঢুকেছিলেন ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে। প্রথম বর্ষের পরীক্ষাগুলোতে খুব ভালো ফল করার আভাস দেখালেও, কিংবা হয়তো এই কারণেই, দ্বিতীয় বর্ষে উঠেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবাংলার হুগলি জেলার বড়তাজপুর গ্রামে, ঐ গ্রামের বিখ্যাত শেখ পরিবারের ছেলে। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত, তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতেন না।

তিনি উপার্জন করতে নামেন এসএসসি পাশ করার পরই, অল্প কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছিলেন, এরপর কেবল শিক্ষকতাই করেছেন। ঢাকার একটি প্রথম শ্রেণীর স্কুল তাকে যেচে চাকরি দেয়, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেখানেই কাজ করে গেছেন। ডিগ্রি ছিলো না বলে সেখানেও যে-কোনো মুহূর্তে কর্মচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। বন্ধুদের অনেক অনুরোধেও ডিগ্রি পরীক্ষা দিতে বসেননি। মনে হয়, অনিশ্চিত অবস্থা তিনি ভালোবাসতেন।

১৯৬৯ সালে কায়েসের পিতা শেখ কামালউদ্দিন আহমদের মৃত্যু হয় তাদের গ্রামে। ঐ সময় গ্রামে যাবার জন্যে কায়েস একবার চেষ্টা করেছিলেন, পাসপোর্ট করতে গিয়ে দেখা গেলো যে, তিনি যে পাকিস্তানি নাগরিক তার কোনো প্রমাণ নেই ! ঝামেলা বাড়লো। গণ-আন্দোলনের ধাক্কা সামলাতে পুলিশ ব্যতিব্যস্ত ছিলো বলে কায়েসকে বিপদে ফেলার সময় পায়নি।

১৯৭১ সালে কায়েস আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে যান। এ-বছর অনেকটা সময় কাটিয়েছেন নিজের গ্রামে মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে। মায়ের ভালোবাসায় বেশিদিন থাকা বোধহয় তার স্বভাবে কুলায়নি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ঢাকায় ফিরে এলেন, নিজের গ্রামে আর কোনোদিন ফিরে যাননি। বড়তাজপুর গ্রামে তাদের পুরনো নোনা-ধরা বাড়ির সামনে শেফালি গাছের নিচে মোড়ায় বসে ছেলের জন্যে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মায়ের চোখে ছানি পড়ে গেলো—এই ছবিটা ভেবে কায়েস অস্থির হয়ে পড়তেন। কিন্তু মায়ের আঁচলের নিচে কটা দিন থেকে দুই চোখ ভরে ঘুমিয়ে আসার ইচ্ছা করা তার স্বভাবের বাইরে। ভালোবেসে বিয়ে করলেন। আত্মবিশ্বাস ছিলো প্রবল, দৃঢ় ধারণা ছিলো যে প্রেম দিয়ে, যত্ন দিয়ে সেবা দিয়ে স্ত্রীর মানসিক রোগ সারিয়ে তুলতে পারবেন। প্রায় দশটি বছর একনিষ্ঠভাবে স্ত্রীর সেবা করে গেছেন, যত্ন করলেন তাঁকে মায়ের মতো, বাপের মতো চোখে-চোখে রাখলেন। কতরকম চিকিৎসা করলেন। কারো কাছে কোনো সাহায্য চাননি, কাউকে জানতেও দিতে চাননি নিজের সমস্যার কথা।

নিজের পর্যবেক্ষণ, ধারণা, আদর্শ, বিশ্বাস—এসবের কোনো সাহিত্যিক কি অসাহিত্যিক আলাদা চেহারা ছিলো না তার কাছে। কি লেখা, কি পেশা, কি গৃহ সব জায়গায় তিনি ছিলেন একজন অভিন্ন মানুষ। সাহিত্যচর্চা করে সামাজিক সুবিধা আদায়ের বিন্দুমাত্র চেষ্টাও কোনোদিন করেননি। এককালে সাংবাদিকতা করেছিলেন, সেই সময়ের যোগাযোগ ব্যক্তিগত কাজে লাগানো তার রুচির বাইরে। তার মাপের লেখক বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাননি, আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে এই গ্লানি বহন করতে হবে সারাজীবন ধরে। আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন কেবল বাঙলাদেশ লেখক শিবিরের হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার। এই পুরস্কারের অর্থমূল্য সামান্য, লেখক শিবিরের সঙ্গে তিনি জড়িতও ছিলেন না কোনোদিন। কিন্তু সংগঠনটির প্রাতিষ্ঠানিকতা-বিরোধিতায় তার নিরঙ্কুশ আস্থা ছিলো বলেই পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। আবার প্রকাশকের তাগাদা সত্ত্বেও বিপুল অর্থমূল্যের পুরস্কারের জন্য বই জমা দিতে অস্বীকার করেছেন, কারণ পুরস্কার প্রদানকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃতি ও তাঁর স্বভাব সম্পূর্ণভাবে পরস্পরবিরোধী। দারিদ্র্যপীড়িত লেখকের এই প্রত্যাখ্যান আমরা যেন ভুলে না যাই।

তিনি প্রত্যেকটি পদক্ষেপ ফেলেছেন নিজের সিদ্ধান্ত অনুসারে। ১৯৯২ সালের ১৪ জুন যে শেষ কাজটি করলেন তাও সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত অনুসারে। কারো কাছে অভিযোগ করেননি, কারো করুণা প্রার্থনা করেননি। মানুষকে জানবার জন্যে, মানুষকে অনুসন্ধান করার জন্যে, নিজেকে নিয়ে হলেও নিরীক্ষা করতে তাঁকে অনেক চড়া দাম দিতে হয়েছে। দারিদ্র্য, পারিবারিক দুর্যোগ, বিচ্ছিন্নতা, বিরামহীন উদ্বেগ—সবই বহন করতে হয়েছে একা। অনুসন্ধান হলো একই সঙ্গে তার প্রবণতা এবং দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ফল যা পেয়েছেন তা তার জন্যে সুখের নয়, যা দেখেছেন তার অনেকটাই, বলতে গেলে বেশির ভাগই অনুমোদন করতে পারেননি। অনুসন্ধান তাই তার প্রতিবাদও বটে। প্রতিবাদ তো আর ইচ্ছাপূরণের আবদার নয়, মস্ত মস্ত কাঠের পুতুল বানিয়ে তার মাথায় সূর্যোদয়ের ছবি লেখার নাবালক তৎপরতা নয়, সমাজ ও মানুষের জটিলতা, এই জটিলতায় অসহায় ও ছোট-হয়ে-পড়া মানুষকে দেখা ও দেখানোই হলো তার প্রতিবাদ জ্ঞাপন। তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যু কি তার অনুসন্ধান অব্যাহত রাখার আর প্রতিবাদ জানাবার চরম সংকল্পের সোচ্চার প্রকাশ?

কায়েস আহমেদ রচনাসমগ্র
ভূমিকা
ঢাকা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় পরিচয়ের সৃষ্টি | রেহমান সোবহান | অনুবাদ : আশফাক স্বপন

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় পরিচয়ের সৃষ্টি
রেহমান সোবহান

অনুবাদ : আশফাক স্বপন

ছয় দফা কার্যক্রম

বাংলাদেশের জাতীয়তার অভ্যুদয় একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঘটে।হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং মওলানা ভাসানীর মতো ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।তবে বাঙালিদের মধ্যে জাতীয় চেতনাসৃষ্টির প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবার জন্য যে রাজনৈতিক উদ্যমের প্রয়োজন ছিল, সেটি বঙ্গবন্ধুর অবদান।১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচির সূচনা থেকে মার্চ ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ – এই নিয়ামক দুটি বছরে অনন্য ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ একটি নির্বাচনী অভিযানের মধ্য দিয়ে, বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার মাধ্যমে যে জাতীয় পরিচয় সৃষ্টি হয়, বঙ্গবন্ধু তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

পাকিস্তানের দুটি প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ছয় দফা কার্যক্রম বাঙালিদের জন্য স্বতন্ত্র ভবিষ্যৎ রচনার সাংবিধানিক পূর্বশর্ত প্রদান করে।এই প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে একজন বড় মাপের বাঙালি রাজনৈতিক নেতা স্বীকার করলেন যে বাংলাদেশের মানুষের জন্য, এমনকি একটি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনেও, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক সহাবস্থান রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা, নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব এবং সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পদের কর্তৃত্ব – এই সব কিছুর ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ হলেই পাকিস্তানের দুটি প্রদেশ একটা রাষ্ট্রের অধীনে টিকে থাকতে পারে।পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা ত্যাগ করায় অনীহা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠল।ফলে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে ছয় দফা ঘোষণা করার সময় দেখা গেল যে শুধু ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোও সেটা প্রত্যাখ্যান করল, কারণ তারাও শাসকশ্রেণির অংশ। এই শাসকশ্রেণির দৃষ্টিতে ছয় দফার দাবির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) মানুষের স্বায়ত্তশাসনের দাবি অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়ে গেল। ফলে ছয় দফা ঘিরে যে রাজনৈতিক আন্দোলন, তাকে দমন করবার প্রচেষ্টা এককভাবে বাঙালিদের ওপর এসে পড়ল। আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বসহ বঙ্গবন্ধুকে ১৯৬৬ সালের জুন-জুলাই মাসে গ্রেপ্তার করা হলো, তাঁদের দুই বছরেরও অধিক সময় ধরে কারারুদ্ধ রাখা হলো। অবশেষে পাকিস্তানের উভয় প্রদেশে রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব খানের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীরা মুক্তিলাভ করেন।

বর্ণবাদ প্রসঙ্গে: নীল ডিগ্রাসি টাইসন | অনুবাদ আশফাক স্বপন


বর্ণবাদ প্রসঙ্গে: নীল ডিগ্রাসি টাইসন 
অনুবাদ আশফাক স্বপন

বর্ণবাদী শাদাদের কালোদের প্রতি তাচ্ছিল্য, ক্ষোভ, ঘৃণা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মস্ত রাজনৈতিক পুঁজি। কালোদের কথা উঠলেই ওরা বলে: আরে দুরবস্থা হবে না কেন? লেখাপড়া করে না, ঠিকমত সংসার করে না, গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা পয়দা করে, ঠিকমত বাচ্চা মানুষ করে না, চুরি-চামারি, খুন-খারাপি করে। তারপর শুধু সরকারী সাহায্যের জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর, নাহলে অত্যাচারের ইতিহাসের পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটে। অলস অপদার্থের দল! হ্যা, অতি লজ্জার কথা – অনেক বাঙালি অভিবাসীরাও একথা বলে।

আচ্ছা, ধরা যাক একজন কালো মানুষ সমাজের সব নিয়ম মেনে চলল। মধ্যবিত্ত ঘরে মানুষ হলো। প্রচণ্ড পরিশ্রমী, মেধাবী। এমনই মেধাবী যে সে আজ আমেরিকার অন্যতম শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের অধ্যাপক। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ব্রতে এমনই সফল যে ঘরে ঘরে লোকে তার চেহারা টিভিতে দেখে। তার তো হেনস্তা হবার কথা নয়, তাই না?

কিন্তু সেও বর্ণবাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বিশ্ববিখ্যাত মহাকাশ পদার্থবিজ্ঞানী প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীল ডিগ্রাস টাইসন-এর কাছে শুনুন তার সারা জীবনের বিষময় অভিজ্ঞতার কথা।

(লেখাটা ভালো লাগলে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব Riton Khan-এর। ও-ই আমাকে ইংরেজি লেখাটা পাঠায়। অনুবাদের জন্য অষ্টপ্রহর ও আমার পেছনে চীনা জোকের মত লেগে থাকে।

আমার চামড়ার রঙ নিয়ে চিন্তাভাবনা
নীল ডিগ্রাস টাইসন
৩ জুন ২০২০
অনুবাদ আশফাক স্বপন

মূল রচনার লিঙ্ক (ইংরেজি)

বহুদিন আগে পদার্থবিজ্ঞানের এক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সর্বশেষ নৈশভোজের পড়ে থাকা ওয়াইন পান করতে করতে আমরা গোটা বারোজন আলাদা একটা জটলায় বিজ্ঞানের খটোমটো অথচ মজার মজার ব্যাপার নিয়ে তর্ক শুরু করলাম। আচ্ছা, সুপারম্যানের পিঠে চাদর বাঁধতে হয় কেন? ডায়েট পেপসিভরা টিনের কৌটো পানিতে ভাসে, কিন্তু চিনিভরা পেপসির কৌটো ডোবে কেন? আচ্ছা, কল্পবিজ্ঞানের জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল স্টার ট্রেক (জ্যোতিষ্ক বিহার)-এ যে পরিবহকযন্ত্র মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহুদূর নিয়ে যায়, সেটা আসলে কীভাবে কাজ করে? সন্ধ্যা গড়াতে লাগল। গাড়ি দুর্ঘটনায় ভরবেগ প্রতিস্থাপনের আড্ডার ঠিক পরপরই আমাদের মধ্যে একজন গাড়ি চালাবার সময় তাকে পুলিশ ধরে কী করেছিল সেই ঘটনার উল্লেখ করল। পুলিশ তাকে তার স্পোর্টস গাড়ি থেকে নামার নির্দেশ দিয়ে, তার শরীর, গাড়ির ভেতর এবং জিনিসপত্র রাখার স্থান তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করল। তারপর মোটা অঙ্কের জরিমানা ধার্য করে তাকে বাড়ি পাঠাল। কী অপরাধে তাকে থামানো হয়েছিল? স্থানীয় গতিসীমার ২০ মাইলের বেশি দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিল সে। অনেক চেষ্টা করেও আমরা তার জন্য তেমন একটা সমবেদনার উদ্রেক করতে পারলাম না।

সেই রাতে আমার সহকর্মী আইনরক্ষাকারী সংস্থার সাথে তার আরো মোলাকাতের গল্প করেছিল, তবে তার প্রথম গল্পটি আমাদের মধ্যে একটার পর একটা লাগাতার গল্পের ধারা শুরু করে দিল। একে একে আমরা সবাই পুলিশ আমাদের কখন কখন থামিয়েছে তার একাধিক ঘটনার কথা বলতে শুরু করলাম। কোন ঘটনাতেই যে খুব বলপ্রয়োগ করা হয়েছে বা জান নিয়ে টানাটানি পড়ে গেছে তা নয়, যদিও তার হাত ধরে একটু এগুলেই এমন বহুচর্চিত ঘটনায় আসা যায় যেখানে সত্যি জানমালের ক্ষতি হয়েছে। আমার এক সহকর্মীকে অতিরিক্ত আস্তে গাড়ি চালাবার জন্য আটকানো হয়েছিল। হেমন্তে নিউ ইংল্যান্ডের এক শহরে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সে ঘণ্টায় ৫ মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছিল। আরেকজনকে পুলিশ বেশী তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাবার জন্য ধরেছিল। অবশ্য সে গতিসীমার চাইতে মাত্র ৫ মাইল বেশি বেগে চালাচ্ছিল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ কোন জরিমানা না করেই ছেড়ে দেয়। আরেকজন সহকর্মীকে গভীর রাতে জগিং করার জন্য পুলিশ থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

আমার নিজের বেলায় গোটা বারো এধরনের অভিজ্ঞতার রয়েছে। একবার নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যে একটা সেতুর তলা দিয়ে যাবার সময় পাশের লেইনে সঙ্কেত না দিয়ে যাবার জন্য আমাকে পুলিশ আটকায়। গাড়ির পেছনে দাড় করিয়ে, পুলিশের গাড়ির কড়া আলো আমার মুখে ফেলে আমাকে দশ মিনিট ধরে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। এটা আপনার গাড়ি? হ্যা। পাশে বসা মহিলাটি কে? আমার স্ত্রী। কোথার থেকে আসছেন? আমার বাবা-মার বাসা থেকে। কোথায় যাচ্ছেন? বাড়ি। কী করেন? আমি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ পদার্থবিজ্ঞানী। আপনার গাড়ির পেছনে কী আছে? একটা বাড়তি টায়ার, আর তেলচিটচিটে কিছু ফেলনা টুকিটাকি। পুলিশ আমায় বলল যে আমাকে আটকাবার ‘আসল কারণ’ আমার ১৭ বছর পুরনো ফোর্ড গাড়ির তুলনায় তার নম্বর প্লেটটা অনেক বেশি নতুন আর চকচকে। গাড়ি কিম্বা নম্বর প্লেট কোনটাই চোরাই নয় সেটা পুলিশ অফিসার নিশ্চিত করল আর কি।

অন্যান্য ঘটনার মধ্যে একবার স্নাতোকোত্তর কলেজের নতুন অফিসে বাড়ি থেকে পদার্থবিদ্যার পাঠ্যবই নেবার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ আমাকে আটকায়। পদার্থবিদ্যা ভবনের প্রবেশপথে আমাকে আটকে আমি এখানে কী করছি, এ নিয়ে নানান সন্দেহপূর্ণ প্রশ্ন করে। তখন রাত ১১:৩০। গাড়ির পেছনে খোলা বাক্সভর্তি স্নাতকোত্তর গণিত আর পদার্থবিদ্যার পাঠ্যবই। সেই বইগুলো আমি ভবনের ভেতর নিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, এইরকম একটা পরিস্থিতি কীভাবে পুলিশ প্রশিক্ষণের ভিডিওতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সম্ভব।

এই নিয়ে ঘণ্টা দুই আমাদের আড্ডা চলল। রাতে বিদায় নেবার আগে এই সব ঘটনায় কোন জায়গাটাতে মিল রয়েছে আমরা সেটার খোঁজ করলাম। আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের গাড়ি চালাই – কারোটা পুরনো, কারো নতুন, কারো অতি সাধারণ, কারও দামী বিদেশী গাড়ি। পুলিশ কখনো দিনে থামিয়েছে, কখনো রাতে। একটা একটা করে আইনের সাথে মোলাকাতের ঘটনা আলাদা করে বিবেচনা করলে সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। আধুনিক যুগে সবার জন্য নিরাপদ সমাজ নিশ্চিত করার জন্য আমাদের খানিকটা স্বাধীনতা তো ছাড়তে হবেই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে, আপনার এই ধারণা হবেই, যে পুলিশ পদার্থবিদদের ওপর একহাত নিতে বদ্ধপরিকর। কারণ আমাদের সবার মধ্যে ঐ একটা বিষয়েরই মিল। গাড়ি থামিয়ে তল্লাশির এই গল্পগুলোতে একটা কথা পরিষ্কার – এগুলো হাল্কা মেজাজে চর্চিত অনন্য ঘটনা নয়। এধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। আমাদের প্রত্যেকের দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি – পিএইচ ডি – থাকা সত্ত্বেও এই সব উচ্চশিক্ষিত বিজ্ঞানীর দল কি করে বারবার পুলিশি অনুসন্ধানের খপ্পরে পড়ছে? হয়তো আমাদের চামড়ার রঙ এর জন্য দায়ী। আমি যেই সম্মেলনে যোগ দিয়েছি, সেটা জাতীয় কৃষ্ণাঙ্গ পদার্থবিদ সমিতির ২৩তম অধিবেশন। আমরা মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাবার দোষে দোষী নই। আমরা হয়তো বা এমন সব অপরাধে অভিযুক্ত, যে সব অপরাধ আমাদের জানামতে কোন দণ্ডবিধিতে নেই – যেমন কালো মানুষ হয়ে গাড়ি চালানো, বা কালো মানুষ হয়ে হাঁটা, এবং অবশ্যই, স্রেফ কালো মানুষ হওয়া।

আমাদের কাউকেই পিটিয়ে সংজ্ঞাহীন করা হয়নি। কাউকে গুলিবিদ্ধও করা হয়নি। তবে পুলিশের সাথে মোলাকাত কখন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসে? গড়পরতায় আমেরিকায় পুলিশ প্রতিবছর ১০০জন নিরস্ত্র কালো মানুষ হত্যা করে। আমাদের চক্রে ওদের মধ্যে কে কে শরীক হতে ব্যর্থ হয়েছে? আমার তো গভীর সন্দেহ হয় আমাদের কয়েক ঘণ্টা যেই প্রসঙ্গ নিয়ে আড্ডা হলো এমনটা আর কোন নীতিনিষ্ঠ ভদ্র জনগোষ্ঠীতে অত্যন্ত বিরল।

আমি যখন এই প্রবন্ধটি লিখছি, তখন নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যানহাটানে আমার জানালার সামনে দিয়ে মিছিলে ১০,০০০ আন্দোলনকারী শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ মুখর করে এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে লুটপাট হয়েছে, সেই সাথে কিছুটা সহিংসতার কারণে গত কয়েক দিনের রাত ১১টার বদলে সান্ধ্য আইন আজ রাত ৮টায় এগিয়ে আনা হয়েছে। মিছিলে সবচেয়ে বেশি যে পোস্টারটা দেখলাম সেটা হলো ‘কৃষ্ণপ্রাণ মূল্যবান’ (Black Lives Matter). অন্য পোস্টারে শুধুমাত্র জর্জ ফ্লয়েড-এর নাম। জর্জ ফ্লয়েডকে হাতকড়া পড়িয়ে মাথা নীচের দিকে দিয়ে মাটিতে শুইয়ে পুলিশ তার ঘাড় হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছিল। পুলিশ অফিসারটি তার শরীরের ওজনের অন্তত অর্ধেক ভার দিয়ে ঘাড় চেপে বসেছিল। ফলে তার মৃত্যু ঘটে। এ এক অদ্ভুত ভাগ্যের পরিহাস যে আমেরিকান ফুটবল তারকা কলিন কেপারনিকও মাটিতে হাঁটু চেপে বসেছিলেন, সেটা ফুটবল খেলা শুরু হবার আগে মার্কিন জাতীয় সঙ্গীত বাজবার সময়ে। সেটা ছিল পুলিশের হাতে কালো মানুষের ভয়াবহ দুর্গতির প্রতি সহমর্মিতা ও উদ্বেগ প্রকাশ। (একটি সংবাদ মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করা হয় যে ও জাতীয় সঙ্গীতের প্রতিবাদ করছিল।) একটি জাতীয় সমস্যার প্রতি তার নিরব উদ্বেগের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের সারা খেলার মৌসুমে উত্তপ্ত ক্ষোভ প্রকাশিত হয়, ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে কোন দল তাকে চুক্তিবদ্ধ করতে অস্বীকার করায় ফুটবলার হিসেবে তার জীবিকা পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে হাঁটু গেড়ে বসার থেকে এখন ঘাড়ে হাঁটু গেড়ে খুন করায় পৌঁছেছি।

যেভাবে আমাদের শহরের রাজপথে রাজপথে বিষাক্ত পদার্থ, কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে, ধাক্কাধাক্কি ও ধ্বস্তাধ্বস্তি করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ও সাংবাদিকদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়েছে (যেখানে পুলিশের উচিত ছিল যারা লুটপাট করছে তাদের ধরপাকড় করা), তাতে মনে হয় যেন আন্দোলনকারীরা এমন কিছু করছিল যেটা হয় বেআইনি অথবা আমেরিকা-বিরোধী। এ সম্বন্ধে আমাদের মার্কিন সংবিধানের কিছু বলবার আছে।

মার্কিন সংসদ এমন কোন আইন পাশ করবে না ... যাতে সংবাদ মাধ্যম, অথবা মানুষের শান্তিপূর্ণভাবে একত্র হওয়া, বা সরকারের কাছে অভিযোগের প্রতিকারের জন্য আবেদন করা ... এসবের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়।

এটা কোন সংশোধনী? মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনী। সুতরাং এদেশের যারা ভিত্তি স্থাপন করেছে, তাদের জোরালো অভিমত ছিল যে অভিযোগের প্রতিকারের জন্য প্রতিবাদ করার অধিকার দেওয়াটা অত্যন্ত আমেরিকান একটি কাজ। যদি আপনি পুলিশ হন, তাহলে এক মুহূর্তের জন্য ভেবে দেখুন – যে দেশের সংবিধানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সমর্থন রয়েছে তা কি অত্যাশ্চর্য দেশ!

আমরা আমাদের পুলিশ অফিসারদের থেকে কী আশা করি? শান্তি রক্ষা করা আর খারাপ লোকগুলোকে ধরা, এই তো? সেই সাথে প্রয়োজনে মারণাস্ত্র প্রয়োগের ক্ষমতাও থাকবে। তার জন্য কখন ও কীভাবে সেটা প্রয়োগ করবে (বা করবে না) তার যথাযথ প্রশিক্ষণ আবশ্যক। মিনিয়াপোলিস পুলিশ একাডেমির ‘নিবিড়’ প্রশিক্ষণের সময়কাল মাত্র ছয় মাস।

অথচ কোন নামকরা রান্না শেখার স্কুলেও পেস্ট্রি বাবুর্চির সনদ পেতে আট মাস প্রশিক্ষণ নিতে হয়। ক্রোয়াসো রুটি নিখুঁত বানাবার জন্য কোন ছাড় সম্ভব নয়। সুতরাং পুলিশ শিক্ষার্থীরা হয়ত অফিসার হবার আগে আরেকটুখানি বেশি সময় প্রশিক্ষণ পেলে লাভবান হবে।

১৯৯১ সালে লস এঞ্জেলেসের চারজন পুলিশ অফিসার ২৫ বছর বয়স্ক রডনি কিং-কে প্রথমে বিদ্যুতস্পৃষ্ট করে, তারপর মাটিতে শায়িত অবস্থায় পঞ্চাশ বারের বেশি লাঠি দিয়ে মারে। সেই ১৯৯০ দশকের ঝাপসা ভিডিও সংবাদ মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। যে কোন দর্শক দেখে স্তম্ভিত, মর্মাহত হয়।

আমি কিন্তু বিন্দুমাত্র স্তম্ভিত হইনি।

আমার চারপাশের পৃথিবী সম্বন্ধে আমি যা জানি, তার ওপর নির্ভর করে প্রথম যে চিন্তাটা মাথায় এল তা হলো: ‘অবশেষে এসব ঘটনা একটা ভিডিওতে ধরা পড়েছে।’ তারপর ভাবলাম: ‘হয়ত এবার তাহলে এর একটা বিহিত হবে।’ হ্যা, ঠিক তাই ভেবেছি। কেন? সেই ছেলেবেলা থেকে প্রতি মাসে, কখনো প্রতি সপ্তাহে আমার আর আমার ভাইবোনদের বাবা-মা আমাদের পুলিশের গুলি এড়াবার জন্য কী করা আবশ্যক তার নিয়মকানুন শেখাতেন।

‘পুলিশ থামালে সে যেন সব সময় তোমার দুই হাত দেখতে পায়, সেটা নিশ্চিত করবে।’

‘হঠাৎ নড়াচড়া করবেনা।’

‘আগাম পুলিশকে না জানিয়ে কোন কিছু বের করার জন্য পকেটে হাত দেবে না।’

‘যদি নড়তেই হয়, আগে পুলিশকে বলে নেবে কী করছ।’

আমি তখন ইস্কুলে উদীয়মান বিজ্ঞানী, মহাবিশ্ব সম্বন্ধে যত কিছু জানার আছে সব কিছু জানার চেষ্টায় মগ্ন। আমার গায়ের চামড়ার কী রঙ সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই – মহাবিশ্ব নিয়ে ভাবনার সময় সেটা খুব প্রাসঙ্গিক নয় কিনা। অথচ বাড়ির সদর দরজা পেরুলেই আমি সন্দেহভাজন, সম্ভাব্য অপরাধী। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ইদানিং যাকে বলা হয় ‘শাদা মানুষের সন্দেহ’ – যেখানে নিরীহ কালো মানুষ কোন অপরাধ করছে এই সন্দেহে ভীত শাদা লোকে পুলিশ ডাকে। এত কাণ্ডের মধ্যে আমরা কীভাবে বিকশিত হই সে এক তাজ্জব ব্যাপার।

কী হারে এই হেনস্থা ঘটেছে? আমার সারাজীবন প্রতি সপ্তাহে এক থেকে পাঁচটি গাত্রবর্ণ সম্পর্কিত ঘটনা ঘটেছে। আমাদের এই সংগ্রামের কথা খোলাখুলিভাবে না হলেও নিশ্চয়ই মনে মনে শাদা মানুষ জানত। নাহলে কেন সেই কুখ্যাত বচন, ‘আমি মুক্ত, শাদা, এবং আমার বয়স ২১’ -এই কথাটার সৃষ্টি হয়েছে? পুরনো কত ছায়াছবিতে কথাটা ব্যবহৃত হয়েছে। কথাটা অত্যন্ত আপত্তিকর। কিন্তু আমেরিকায় কথাটা সত্যিও বটে। আজ ‘শাদা অগ্রাধিকার’-এর অপবাদ যতই অস্বীকার করা হোক না, ঐ সময় সেটা খোলাখুলিভাবে সগর্বে ঘোষণা করা হতো।

রডনি কিং-এর ঘটনার সাথে জড়িত লস এঞ্জেলেস-এর যে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা হয়, সেটাকে অনেক সময় পুলিশের পিটুনির প্রতিক্রিয়া বলে ভাবা হয়। কিন্তু না। পিটুনির পর লস এঞ্জেলেস ১৩ মাস শান্ত ছিল। আদালতে ক্ষমতার অপব্যবহারের অপরাধ প্রমাণের জন্য ঐ ভিডিওটাই মোক্ষম প্রমাণ, এই ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত ছিল। আমিও ছিলাম। কিন্তু বাস্তবে তো সেটা ঘটেনি। সেই পিটুনির ঘটনা নয়, বরঞ্চ সেই ঘটনায় জড়িত চারজন পুলিশের বেকসুর খালাস হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসাবে দাঙ্গা বাঁধে। আসলে দাঙ্গা অসহায় হতাশার সর্বশেষ আর্তনাদ ছাড়া আর কি?

স্পাইক লি-এর ১৯৮৯ সালের ছবি ‘Do the Right Thing’ (‘ঠিক কাজটি করুন’) - এই ছবিতে নিউ ইয়র্ক শহরের ব্রুকলিনে ১৯৮০-এর দশকে শাদা পুলিশ বনাম কালো মানুষের মধ্যে উত্তেজনা মূল বিষয়। ছবিটির শেষে ছয়জন মানুষের পরিবারের প্রতি ছবিটি উৎসর্গ করার কথা ঘোষিত হয়। এরা হল: এলেনর বাম্পার্স (৬৬ বছর), মাইকেল গ্রিফিথ (২৩ বছর), এডমান্ড পেরি (১৭ বছর), ইভন স্মলউড (২৮ বছর) ও মাইকেল স্টুয়ার্ট। সবাই কালো। একজনকে উন্মত্ত শাদা জনতা খুন করেছে। বাকিরা সবাই নিরস্ত্র ছিল। হয় পুলিশের গুলিতে নতুবা ওদের জিম্মায় মারা গিয়েছে। ছবিটি তৈরির আগে ১০ বছরের মধ্যে খোদ নিউ ইয়র্ক শহরেই এই সব মৃত্যু ঘটেছে। পুলিশি কারণে এই সব মৃত্যুর জন্য কেউ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়নি। পুলিশি হত্যার ৯৯% ক্ষেত্রে এই কথা সত্যি।

এই সব ঘটনা সম্বন্ধে আমরা জানতে পেরেছি কারণ প্রতিটি ঘটনার শেষে কারো মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু তারপরও সেই সময় এসব শুধুমাত্র স্থানীয় সংবাদ ছিল। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম: তাহলে কি এটা শুধুমাত্র নিউ ইয়র্ক শহরের সমস্যা? যে কোন স্থানে পুলিশের সাথে জড়িত কোন মৃত্যুর কত গুণ নিরস্ত্র মানুষকে পুলিশ গুলি করে কিন্তু তাদের মৃত্যু হয় না? অথবা অন্যায়ভাবে তারা আহত হয়, পঙ্গু হয়? এইসব ঘটনা তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় সংবাদেও স্থান পায় না। তবে আপনি সেখানে থাকলে ঠিক জানতে পারতেন। আমরা সবাই জানতাম। কে জানে এই তথ্যের মূল্য কতটুকু, তবে মার্কিন দেশের সবচাইতে বড় ৬০টি শহরের মধ্যে নিউ ইয়র্ক শহরে জনপ্রতি পুলিশি হত্যার হার সব চাইতে কম। এ কি পুলিশ একাডেমিতে বাড়তি দুই মাস প্রশিক্ষণের ফল?

ভিডিও প্রমাণ সত্ত্বেও এই ধরনের ঘটনার ফলে আইন ব্যবস্থার ওপর আমাদের আস্থার অবক্ষয় ঘটতে ঘটতে তলানিতে এসে ঠেকেছে, আর সেই কারণেই প্রতিবাদের ৎসুনামিতে পৃথিবী কেঁপে উঠেছে। এই অন্যায়ের যারা শিকার, তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে মিছিলে মিছিলে নানা শহরের রাজপথ ভরে গিয়েছে। যেখানে এইরকম আচরণের জন্য কারাবাসের ঝুঁকি নেই – যা থাকলে হয়ত এসব ঠেকানো যেত – সেখানে নিজে নিজেই এইরকম আচরণ থামতে হবে।

কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে যে পুলিশের হাতে নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি গাত্রবর্ণনির্বিশেষে সবার বেলাতেই মোটামুটি এক। বেশ। কিন্তু আপনার যে বর্ণ, সেই বর্ণের মানুষকে যদি পুলিশ ১০গুণ বেশি থামায়, তাহলে আপনার বর্ণের মানুষের মৃত্যুর হারও দশগুণ হবে। সুতরাং শাদা পক্ষপাতের দিকটাকে প্রথমে শূন্যের কোঠায় আনতে হব। তারপরও নিরস্ত্র মানুষকে – শাদা মানুষসহ - অপরাধী সন্দেহে পুলিশের হত্যার ব্যাপারটি রয়ে যায়।

আমি মেলা বকবক করি, নানা জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াই। কিন্তু এই যে দুর্গম বাধার দুস্তরতম পথ পেরোতে গিয়ে কত অজস্র ঘটনার সাক্ষী হলাম, এসব নিয়ে তেমন মুখ খুলিনা। কেন? কারণ সারাজীবন এইসব ঘটনা আমি আরো সাফল্যের দিকে এগিয়ে চলার প্রেরণার উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছি। হ্যা, সমাজের প্রত্যাখ্যান – যা আজ ক্ষুদ্র আক্রমণ হিসেবে অভিহিত হবে - তাকে আমি অর্জনের চালিকাশক্তিতে পরিণত করেছি। আমার বাবা ছিলেন ১৯৫০ আর ১৯৬০ দশকে কালোদের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী, তাঁর থেকেই এটা শিখেছি।

এক অর্থে আমি যে আজ যেখানে এসেছি, তার জন্য দায়ী অজস্র মানুষ, যারা তাদের আচরণ অথবা নিষ্ক্রিয়তা দিয়ে আমাকে পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত দিয়েছিল যে আমি কোনদিন ঠিক এখানে এসে পৌঁছুতে পারবনা। কিন্তু আপনার যদি সেরকম মানসিক শক্তির উৎস না থাকে? তখন আপনার পরিণতি কি হবে? প্রান্তিক, ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী – এদের মধ্যে নারী, সমকামী, শাদা ভিন্ন অন্য বর্ণের মানুষ রয়েছে - এদের মধ্যে এমন কত মানুষ আছে যারা অনুপ্রেরণার অভাবে হাল ছেড়ে দেবার ফলে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছুতে পারেনি।

আজ কি সেদিনের চেয়ে অবস্থার উন্নতি হয়েছে? তা হয়েছে। তবে এই বিচারের মানদণ্ডটি একটু অদ্ভুত। কয়েক দশক আগে পুলিশ নিরস্ত্র কালো মানুষকে মারধর করলে বা মেরে ফেললে সেটা হত স্থানীয় সংবাদ। আজ দেশের যেখানেই এমন ঘটুক সেটা জাতীয় সংবাদ, এমনকি শীর্ষ সংবাদ হয়েছে।

এখন কথা হচ্ছে এই অবস্থা পরিবর্তনের উপায় কি? নানা সংগঠন নিশ্চিতভাবে পুলিশের সংস্কারের ব্যাপারে তাদের দাবি দাওয়া পেশ করবে। আমার নিজেরও একটা তালিকা আছে, যেটা বিশেষজ্ঞ নীতি-নির্ধারকদের বিবেচনার জন্য নিবেদন করছি।

পুলিশ প্রশিক্ষণ একাডেমিগুলোতে কয়েক মাস শিক্ষার্থীদের বহুবর্ণের সমাজ সম্বন্ধে সচেতনতা, সংবেদনশীলতা ভালোভাবে শেখানো হোক – যাতে পুলিশ মারাত্মক শক্তি প্রয়োগ করা থেকে বিরত হতে শেখে।

প্রত্যেক পুলিশ অফিসারের চিন্তাভাবনায় ভেদবুদ্ধি বা পক্ষপাত আছে কিনা, সেটা পুলিশ একাডেমির গ্রহণযোগ্যতার ঘোষিত মানদণ্ড অনুযায়ী যাচাই করতে হবে। একথা সত্যি আমাদের সবার কমবেশি পক্ষপাত রয়েছে। তবে আমাদের প্রায় কারোরই ওপর অন্য কারো বাঁচা-মরা নির্ভর করেনা।

প্রতিবাদের সময় জানমাল ও সম্পত্তি রক্ষা করুন। যদি আপনি অহিংস প্রতিবাদীদের আক্রমণ করেন, তাহলে আপনি মার্কিন মূল্যবোধের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। পুলিশ যদি প্রতিবাদকারীদের ধরপাকড় না করে যারা লুটপাট করে তাদের ধরত, তাহলে আর সান্ধ্য আইনের প্রয়োজন হতো না।

যদি সহকর্মী পুলিশ অফিসার অনৈতিক বা মাত্রাতিরিক্ত সহিংস আচরণ করে, আর আপনি তার প্রত্যক্ষদর্শী হন, অনুগ্রহ করে তাকে থামান। কেউ না কেউ এটার ভিডিও ধারণ করবে, এবং ফলে আপনারা যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম সেই বিষয়ে আমাদের বাকি সবার আস্থা সুদঢ় হবে। এই রকম পরিস্থিতিতে আপনারা পরস্পরকে কতটুকু রক্ষা করছেন তার চাইতে আপনাদের প্রতি আমাদের কতখানি আস্থা আছে সেটা সুশীল সমাজের কাছে বেশি জরুরি।

মিনিয়াপোলিস পুলিশ বিভাগের জন্য একটা অভূতপূর্ব পরামর্শ – দায়িত্বে থাকাকালীন মৃত্যু ঘটলে পুলিশকে যেমন আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বিদায় জানান, জর্জ ফ্লয়েডকে সেভাবে বিদায় জানালে কেমন হয়? সেই সাথে শপথ নিন আর কখনো এইরকম মৃত্যু ঘটবে না।

আর সবার শেষে একটা কথা: যখন কালো কিশোরদের দেখেন, তাদের আপনি কী মনে করেন, সেটা না ভেবে তার বদলে তারা কী হতে পারে, সেই কথাটা একটু ভাবার চেষ্টা করুন।

বিনীত নিবেদন
নীল ডিগ্রাস টাইসন – এখনো আশাবাদী হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টায়
নিউ ইয়র্ক সিটি

যুক্তরাষ্ট্রে শতাধিক বছরের বর্ণবাদের বিষময় ফল - আশফাক স্বপন

পরের বার জ্বল্বে আগুন!

যুক্তরাষ্ট্রে শতাধিক বছরের বর্ণবাদের বিষময় ফল

আশফাক স্বপন

দ্য ডেইলি স্টার। ৫ জুন ২০২০

‘ঈশ্বর নূহ নবীকে রংধনুর সংকেত দিয়েছেন। পরের বার পানি নয়, জ্বলবে আগুন!’

গৃহযুদ্ধপূর্ব আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ ভক্তিমূলক গান

ভয়ার্ত বিশ্ব অবাক হয়ে দেখছে, সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে যেন আগুন লেগেছে। পুলিশের জঘন্য একটি বর্ণবাদী হত্যাকাণ্ড ছিল স্ফুলিঙ্গ – সেখানে থেকে দাবানলের মতো প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছ যুক্তরাষ্ট্রের ১৪০টি শহরে বিশাল মিছিল রাস্তায় নেমেছে। দাঙ্গা, লুটপাট, শহরে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের অত্যাচার, বড় বড় শহরগুলোতে রাতে সান্ধ্য আইন – সব একসাথে ঘটছে। কেন্দ্রীয় সরকার সে্নাবাহিনী নামিয়ে উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

আচ্ছা, আমরা কোন দেশে আছে? মাঝে মাঝে মনে হয় এমন এক নামহীন গোত্রহীন দেশে বসবাস করছি যেখানে স্বৈরাচারী শাসকের গদি কেঁপে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার এর মধ্যে কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল ছত্রভঙ্গ করিয়েছেন, যাতে তিনি গীর্জায় গিয়ে হাতে বাইবেল নিয়ে লোকদেখানো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন। সঙ্গত কারণে গীর্জার লোকজন এই অসভ্যতার তীব্র নিন্দা করেছেন।

জেমস বল্ডউইন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের একজন তীক্ষধী, নির্মম বিশ্লেষক। তিনি ১৯৬৭ সালে রচিত বই ‘এর পরের বার জ্বলবে আগুন’-এ (The Fire Next Time) বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সময় এসেছে দেশটির মূল মহাপাপ – এইদেশে আসার পর থেকে আফ্রিকান আমেরিকানদের নির্যাতন – তার ফলে যে বিষময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সুরাহার উদ্যোগ নেওয়া।

তিনি লেখেন, ‘এখানে, ওখানে, যে কোনখানেই হোক,’ বর্ণবাদ ‘যুক্তরাষ্ট্রের সকল উন্নয়ন প্রচেষ্টা হয় কলুষিত করে, নয়তো খর্ব করে। মানুষের ক্ষেত্রে, বা ব্যক্তিগতভাবে গাত্রবর্ণের কোন অস্তিত্ব নেই – এর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। কিন্তু এই তফাতটা পাশ্চাত্যের উপলব্ধি করা এমনই কঠিন যে আজো পাশ্চাত্য সেই তফাতটা চিনতে পারে না।’

বল্ডউইন কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

‘আমরা যদি জান বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে না পড়ি, তাহলে বাইবেলের কাহিনির বরাত দিয়ে ক্রীতদাসের গানে যে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারিত হয়েছে, সেটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হবে: ঈশ্বর নূহ নবীকে রংধনুর সংকেত দিয়েছেন। পরের বার পানি নয়, জ্বলবে আগুন!’

আমেরিকায় শাদা-কালো মানুষের সম্পর্ক জটিল – তার ভালো মন্দ দুই দিকই আছে। কিছু কিছু বিষয়ে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে, আবার কিছু ব্যাপারে আফ্রিকান আমেরিকানদের অবস্থা ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ।

জিম ক্রো নামক ভয়াবহ বর্ণবাদী আইন বহু বছর হলো গত হয়েছে। কালো-শাদা মেলামেশায় আজ বিন্দুমাত্র নিষেধ নেই। এক সময় দক্ষিণে কালোদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল, তারও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালে প্রথম কালো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে।

তারপরও আফ্রিকান আমেরিকানরা ভীষণ পিছিয়ে রয়েছে। বাড়ি মালিকানা হোক, ব্যাপক হারে কারাবাস হোক, স্বাস্থ্যের অবস্থা হোক – নানান ক্ষেত্রে আফ্রিকান আমেরিকানদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খুব খারাপ।

এর ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। ১৯৪০ দশকে আমেরিকার ঐতিহাসিক সোশাল সিকিউরিটি আইন পাশ হয়। এই আইন খেটে খাওয়া মানুষের অবসর জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আইনটি পাশ করার সময় দক্ষিণের বর্ণবাদী ডেমোক্র্যাট দলের নেতারা গৃহকর্মী আর কৃষিকর্মীদের এই আইনের আওতার বাইরে রাখেন। এদের বেশির ভাগ কালো মানুষ। আবার গৃহঋণ দেওয়ার ব্যাপারে ঐতিহাসিকভাবে কালোদের সাথে সাংঘাতিক বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। ফলে এদেশে সম্পদ সৃষ্টির সবচাইতে মৌলিক পথ – বাড়ির মালিকানা – কালোদের জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়।

মিনিয়াপোলিস শহরে ২৫ মার্চ জর্জ ফ্লয়েডকে পুলিশের হত্যা করার ঘটনা সাম্প্রতিক প্রতিবাদের ঝড় উস্কে দেয়। এর আগে সম্প্রতি আরো দুজন আফ্রিকান আমেরিকানকে সন্দেহজনক কারণে হত্যা করা হয়। মার্চ মাসে কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের লুইভিল শহরে পুলিশ মাদক উদ্ধার অভিযানে ব্রিওনা টেইলরের এপার্টমেন্টে প্রবেশ করে তাকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। তার বাড়িতে কোন মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় নাই। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কিছুই হয় নি। তারপর জোর প্রতিবাদের ফলে কর্তৃপক্ষ হত্যাকাণ্ড অনুসন্ধান শুরু করে।

ফেব্রুয়ারি মাসে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চলে একজন শাদা প্রাক্তন পুলিশ আর তার ছেলে আহমাড আরবারিকে ধাওয়া করে। তারপর তার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তির পর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দুই মাস পর্যন্ত কেউ এব্যাপারে কিছু করেনি। জাতীয় পর্যায়ে সংবাদপত্র হৈচৈ করার পর কর্তৃপক্ষ বাপ-বেটাকে গ্রেফতার করে।

ন্যায়বিচারের জন্য বিশাল বিশাল প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়েছে, এ আর আশ্চর্য কি।

পরিস্থিতি খুব বেদনাদায়ক হলেও কোথাও কোথাও ক্ষীণ আশার আলো দেখা যাচ্ছে। মোটের ওপর প্রতিবাদ মিছিল শান্তিপূর্ণ। সব মিছিলে শাদা আমেরিকান – এরা বেশির ভাগ অল্পবয়স্ক – এর উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আশা জাগায়। নিউ ইয়র্ক শহরে পুলিশ প্রধান টেরেন্স মনাহান জনসমক্ষে এক হাঁটু গেড়ে বসেছেন। এটি আমেরিকায় কালোদের ওপর পুলিশি অত্যাচারের প্রতীকী প্রতিবাদ, যা সচরাচর কালো লোকে করে থাকে। একইভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন অরেগন অঙ্গরাজ্যের পোর্টল্যান্ডের পুলিশ প্রধান, ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্টা ক্রুজ ও নাপা শহরের পুলিশ প্রধান।

তবে প্রতিবাদের একটা অন্ধকার দিকও রয়েছে। মার্কিন দেশের ইতিহাসে ব্যাপক বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদ অনেক সময় জ্বালাও-পোড়াও সহিংসতায় পর্যবসিত হয়।

এব্যাপারে একটি ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান: ১৯৯২ সালে দক্ষিণ-কেন্দ্রীয় লস এঞ্জেলেসে যেই দাঙ্গা হয়, সেখানে কোরিয়ান আমেরিকান ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার। পরিশ্রমী, কোনমতে-টিকে-থাকা অভিবাসীদের কয়েক দশকের হাড়ভাঙা খাটুনিতে তৈরি সাধের ছোট ব্যবসাগুলোর সর্বনাশ হয়।

আমার নিজের মত হচ্ছে যারা এসব লুটপাট আর অগ্নিসংযোগে অংশ নেই এরা সব বদয়ায়েশ আর গুণ্ডা – প্রতিবাদের কারণ নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নাই।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে সঙ্গত কারণে রাগে যখন মানুষ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয় তখন শান্তি বজায় রাখা কঠিন – কিন্তু সেটা করতে পারলে তাতে মস্ত সুবিধা। মার্টিন লুথার কিং-এর কথা ধরা যাক। কালোদের নাগরিক অধিকারের সংগ্রামে তিনি আরো হিংস্র, বর্ণবাদী প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করেছেন, অথচ সব সময় সম্পূর্ণ অহিংস ছিলেন। অনেকে এজন্য তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে, বলেছে তিনি দুর্বল। অবশেষে ওঁরই বিজয় হয়েছে, কারণ ওঁর অহিংসার ফলে বর্ণবাদী প্রতিপক্ষ কালোদের আন্দোলনকে গালমন্দ করার আরো একটি অজুহাত থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

আজও অবস্থার তারতম্য হয়নি। অগ্নিসংযোগ, লুটপাটে আজকের আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়ার এতটুকু সুরাহা হবে না, বরঞ্চ তার থেকে মানুষের দৃষ্টি সরে যাবে, তাতে তাদের প্রতিপক্ষ আহ্লাদিত হবে। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে এই বিষয়ে একটা কঠিন শিক্ষামূলক উদাহরণ রয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ যখন সহিংস রূপ নেয়, তখন শাদা মধ্যবিত্ত মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে। তার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে রিপাবলিকান দলের দুই গভর্ণর রিচার্ড নিক্সন আর রোনাল্ড রেগান আইন শৃঙ্খলার দাবিকে মূলমন্ত্র করে দীর্ঘদিনের রক্ষণশীল রাজনীতির আধিপত্যের সূচনা করেন।

জানি, আমার কথায় কোন কোন জঙ্গি প্রতিবাদী মুখ বাঁকাবেন। তাচ্ছিল্যের সাথে প্রশ্ন করবেন: তুমি কে বাপু আমাদের জ্ঞান দিতে এসেছ?

হক কথা।

আমার কথায় কর্ণপাত করবেন না। এবার এমন একজনের কথা বলছি, যার এবিষয়ে মত দেবার নৈতিক অধিকার প্রশ্নাতীত। ইনি মিনিয়াপোলিসে নিহত আফ্রিকান আমেরিকান ব্যক্তিটির ভাই।

যে রাস্তার মোড়ে তার বড় ভাই মারা গিয়েছেন, সেখানে দাড়িয়ে টেরেন্স ফ্লয়েড সম্প্রতি সমর্থকদের বলেন: ‘আমিই যদি এখানে এসে জিনিসপত্র ভাঙচুর না করি, পাড়া লণ্ডভণ্ড না করি, তাহলে আপনারা সবাই কি করছেন? কিসসু না! কারণ এসব কাজ আমার ভাইকে আর ফিরিয়ে আনবে না।

‘তার চাইতে আসুন, একটু অন্যভাবে কাজ করি । এমন চিন্তা মন থেকে দূর করুন যে আমাদের প্রতিবাদে কিছু যায় আসে না। ভোট দিন। কারণ আমরা সংখ্যায় অনেক। আসুন, সহিংসতা বাদ দিয়ে আমাদের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাই।’

এবার শুনলেন তো? যত খুশি প্রতিবাদ করুন। কিন্তু সেই সাথে সংগঠিত হোন। ভোট দিন।

মনে রাখবেন, একদিনে সব পাল্টাবে না, সময় লাগবে। অনুপ্রেরণার জন্য মার্টিন লুথার কিং-এর এই কথাটা মনের রাখুন: ‘জগতে নৈতিকতার সঞ্চারপথ দীর্ঘ হতে পারে, কিন্তু তার গন্তব্য সুবিচার।’ এটি প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রিয় বচন। ওবামার মতের গুরুত্ব যথেষ্ট – মার্কিন রাজনীতিতে কি করে জিততে হয়, এই ব্যাপারে তার কিঞ্চিত হাতযশ আছে কিনা।

Dailystar এর লিঙ্ক

মনের আঙিনা থেকে পত্র - জেমস বল্ডউইন - অনুবাদ: আশফাক স্বপন

আজ সারা আমেরিকায় আগুন জ্বলছে কেন?

আসিতেছে শুভদিন
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।
- কাজী নজরুল ইসলাম



আমি আটলান্টায় থাকি। কাল CNN সদর দফতরের সামনে সহিংস প্রতিবাদে পুলিশেরর গাড়ি পুড়েছে, দোকান লুট হয়েছে। মেয়র হাত জোড় করে নগরবাসীকে বাড়ি ফিরতে বলেছে। আজ শহরে সান্ধ্য আইন চালু।

সারা আমেরিকা রাগে কাঁপছে। শহরে শহরে বিক্ষোভ, কত স্থানে আগুন জ্বলছে। একাধিক শহরে সান্ধ্য আইন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নগর প্রশাসন হিমসিম খাচ্ছে।

মিনিয়াপোলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক আফ্রিকান আমেরিকান ব্যক্তিকে হাতকড়া পরাবার পরও পুলিশ তাকে মাটিতে ফেলে গলায় হাঁটু চেপে জনসমক্ষে হত্যা করে। এতে সারাদেশে ক্রুদ্ধ প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছে তা যেন আর থামতে চায় না।

বর্ণবাদী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিবাদ এই প্রথম নয়। আমি তখন ক্যালিফোর্নিয়ায়। ১৯৯২ সালে মে মাসে নির্দয়ভাবে আফ্রিকান আমেরিকান রডনি কিঙকে প্রহার করার পরও মামলায় চারজন পুলিশ বেকসুর খালাস হবার পর সাউথ সেন্ট্রাল লস এঞ্জেলেসে প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে। তিনদিনের ভয়াবহ প্রতিবাদ, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটে ৬৩ জন মারা যায় আর ১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়।

ইদানিং বারবার খবর আসছে, পুলিশ নিরস্ত্র আফ্রিকান আমেরিকানদের হত্যা করছে। অনেক সময় তাদের বিচার হয় না, বিচারে হলেও শাস্তি হয় না। সম্প্রতি যেই জর্জিয়াতে আমি থাকি, সেখানে আফ্রিকান আমেরিকান তরুণ আমড আরবারিকে চোর সন্দেহে ধাওয়া করে সাদা পিতা-পুত্র তাকে গুলি করে খুন করে, অথচ আড়াই মাস তাদের গায়ে আঁচড়টি পড়েনি। মার্চ মাসে কেন্টাকির লুইভিল শহরে পুলিশ এ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে আফ্রিকান আমেরিকান জরুরি সেবাকর্মী ব্রিওনা টেইলরকে গুলি করে হত্যা করে।

দেশ অস্থির, জনতার ক্রদ্ধ। এর কারণ বুঝতে হলে এদেশে কালোদের ওপর পুলিশী নির্যাতনের পেছনে আমেরিকার দীর্ঘদিনের কলঙ্কময় বর্ণবাদী নিপীড়নের ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে হবে। এই অত্যাচারে ভুক্তভোগী আফ্রিকান আমেরিকান সমাজের এক ক্ষুরধার বিশ্লেষণী লেখক জেমস বল্ডউইন। ১৯৬২ সালে নিউ ইয়র্কার সাময়িকীতে তার একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ ছাপা হয়। কুড়ি হাজার শব্দের বিশাল এই প্রবন্ধটি প্রায় একটি ছোট্ট পুস্তিকার সমান। সেখানে সামাজিক বিশ্লেষণের সাথে সাথে নানান বর্ণনা ও স্মৃতিচারণ রয়েছে। তার থেকে অল্প খানিকটা চুম্বক অংশ বাংলায় অনুবাদ করে নিবেদন করছি।

ষাটের দশকে এদেশে আফ্রিকান আমেরিকানদের ওপর যে ভয়ানক বর্ণবাদী স্বেচ্ছাচারের বর্ণনা বল্ডউইন করেছেন, আজ নানা দিক থেকে আমেরিকায় অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে এই উন্নতিতে ভয়াবহ ফাঁকও রয়ে গেছে। প্রায় ৬০ বছর আগে লেখা প্রবন্ধটি পড়লে পাঠক বার বার চমকে উঠবেন। মনে হবে বল্ডউইন-এর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর যেন আজকের পরিস্থিতি বর্ণনা করছে। (নিগ্রো শব্দটা এখন ভদ্রসমাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও যে সময়ে বল্ডউইন লিখেছেন, তখন সাদা কালো সকলেই আফ্রিকান আমেরিকানদের নিগ্রো বলে অভিহিত করত।)



মনের আঙিনা থেকে পত্র (অংশবিশেষ)
জেমস বল্ডউইন


দ্য নিউ ইয়র্কার। ১৭ নভেম্বর, ১৯৬২
অনুবাদ: আশফাক স্বপন

মূল রচনা
Letters from a region of my mind
By James Baldwin
The New Yorker | November 17, 1962
মূল রচনার লিঙ্ক

এই বিষম দুরবস্থার পরিবর্তন যে সম্ভব নয় বুঝতে সেটা বুঝতে তেমন বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। প্রতিটি কর্মদিবসে সারাক্ষণ বিনা কারণে লাঞ্ছনা আর বিপদের মুখোমুখি হতে হতে মানুষ যদি ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সেজন্য তেমন স্পর্শকাতর হবারও প্রয়োজন নেই। এই লাঞ্ছনা শুধু খেটে খাওয়া মানুষকে ভোগ করতে হয় না। আমার যখন ১৩ বছর বয়স, তখন একদিন আমি নিউইয়র্ক-এর ফিফথ এভিনিউ পার হয় লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছি। রাস্তার মাঝখানে পুলিশ। আমি পাশ দিয়ে যাবার সময় বিড়বিড় করে বলল, ‘এখানে মরতে এসেছিস কেন, নিগার? তোদের পাড়ায় থাকতে পারিস না?’

তাই ত্রাস সৃষ্টির জন্য যে কোন একটা উপায় বড্ড প্রয়োজন। একথা সম্পূর্ণ পরিষ্কার যে পুলিশ আপনাকে পেটাবে, গারদে পুরবে, যদি সে এই সব কাজ করে পার পেয়ে যায়। তারা নিজেদের প্রতি যেমন আচরণ কামনা করে, সভ্যতার বা খ্রীষ্টীয় প্রেমের দোহাই দিলেও তারা আপনার সাথে সেই রকম আচরণ করবে, তার সম্ভাবনা নেই। শুধুমাত্র যদি আপনার জোর পালটা আক্রমণের ক্ষমতা থাকে, তাহলেই তার ভয়ে ওরা সভ্য আচরণ করবে, বা ভালোমানুষির ভাণ করবে (তাই সই)। আমিতো খুব বেশি নিগ্রো চিনি না যারা চায় সাদারা তাকে গ্রহণ করুক। সাদাদের ভালোবাসা চাইবার তো প্রশ্নই ওঠেনা। ওদের চাওয়া সামান্যই – এই ধরণীতে তাদের ক্ষণস্থায়ী উপস্থিতির সময়টুকু যেন সর্বক্ষণ সাদাদের শারীরিক আক্রমণ থেকে তারা নিষ্কৃতি পায়।

সাদারা সামাজিক শিষ্টতার রীতিনীতি মেনে চলে বলে দাবি করে। কিন্তু সাদাদের জগতে বসবাস করে নিগ্রোসমাজের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার ফলে তাদের মাঝে এই দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা সৃষ্টি সম্ভব নয়। নিগ্রোদের নিজের অবস্থাই তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করে যে সাদা লোকে এইসব রীতি মেনে চলেনা।

সাদা লোকে কালো মানুষের স্বাধীনতা চুরি করেছে, তারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এই আত্মসাতের সুবিধা ভোগ করছে। তাদের কোনরকমের নৈতিক গ্রহণযোগ্যতাই নেই। তাদের পক্ষে হাকিম, জুরি, বন্দুক, আইন রয়েছে – অর্থাৎ সব ক্ষমতাই তাদের। কিন্তু এই ক্ষমতা অপরাধীর ক্ষমতা। একে ভয় করা যায়, শ্রদ্ধা করা যায় না।

সাদাদের সমাজে নীতিকথার বুলি কপচানো হয়। তবে সেসব অনুসরণ না করাটা কালোদের দমন করবার আরেকটা ফন্দি।

আমি বজ্রকঠিন পণ করেছিলাম– আমি নিজেই উপলব্ধি করিনি কতো কঠোর সেই পণ – ঘেটো নামের এই বর্ণবিভাজিত আবাসনের ঘেরাটোপের সাথে কোনদিন আমি আপস করবনা। দরকার হলে জাহান্নামে যাব, তবুও কোন সাদা লোক আমার ওপর থুথু মারবে, সেটা মানবো না। এই প্রজাতন্ত্রে আমার জন্য যে ‘জায়গা’ বরাদ্দ করা হয়েছে আমি কিছুতেই সেটা মেনে নেবনা। এই দেশের সাদা লোক আমার পরিচয় নির্ধারণ করে আমার সম্ভাবনাকে খর্ব করবে, সে আমি কিছুতেই হতে দেবনা।

জন্মলগ্ন থেকে নিগ্রোরদের এদেশে – আর কোন দেশে নিগ্রোর অস্তিত্ব নেই – নিজেদের ঘৃণা করতে শেখানো হয়। পৃথিবীটা সাদা আর ওরা কালো। সাদা লোকের হাতে ক্ষমতা, তার অর্থ ওরা কালো লোকের চাইতে শ্রেয় (মৌলিকভাবে শ্রেয়, ঈশ্বরের এমনটাই নির্দেশ কিনা), এবং পৃথিবীর এই ভিন্নতা সম্বন্ধে সজাগ করবার, সেটা উপলব্ধি করবার এবং সেটাকে ভয় করবার অজস্র উপায় রয়েছে।

আমাদের ওপর যে নির্যাতন হয়, তার প্রকৃতি, আমাদের যেই বিশেষধরনের জটিল ঝুঁকির সামাল দিতে হয়, এসবকিছু হয়তো আমাদের – গণিকা, দালাল, জোচ্চর, গীর্জার উপাসক, বাচ্চা – সবাইকে একসূত্রে বেঁধেছে। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এই সীমার মধ্যেই আমরা পরস্পরের সাথে এক ধরনের মুক্তি অর্জন করেছি যা প্রায় প্রেমের কাছাকাছি।

এই মুক্তির ঈঙ্গিত পাই কিছু ভক্তিমূলক গস্পেল গানে বা জ্যাজ সঙ্গীতে। জ্যাজ সঙ্গীতের পুরোটা জুড়ে, বিশেষ করে বেদনবিধুর ব্লুজ সঙ্গীতে কী যেন একটা তীক্ষ্ণ, তীর্যক, ব্যঙ্গাত্মক সুর আছে, আধিপত্যের ছাপ আছে, সেটা যেন খানিকটা শাঁখের করাতের মতো ধারাল। সাদা আমেরিকানরা ভাবে আনন্দের গানে শুধুই আনন্দ, আর দুঃখের গান শুধুই দুঃখের। অদ্ভুত ব্যাপার হলো বেশির ভাগ সাদা আমেরিকানরা গায়ও সেইভাবে। উভয়ক্ষেত্রেই শুনতে এমন ভীষণরকমের ফাঁকা আর অন্তঃসারশূন্য লাগে, যে বোধহীনতার কোন অতল থেকে তাদের প্রাণহীন সুর উঠে আসে সে কথা ভেবে ভেবে আমি হয়রান হয়ে যাই।

উপলব্ধির যেই গভীরতা থেকে এরকম তীর্যক শক্তিময়তা উঠে আসে সেটা সাদা আমেরিকানরা বোঝে না। ওরা সন্দেহ করে এই শক্তি জৈবিক, তারা সেটার হদিশ পায়না বলে আতঙ্কিত হয়। ‘জৈবিক’ কথাটা কিন্তু আদিরসে উত্তেজিত কালো নারী বা সুঠামদেহী কালো পুরুষদের বোঝানো হচ্ছে না। আমি যার কথা বলছি সেটা আরো অনেক সরল। জৈবিক তাড়না বলতে আমি বোঝাচ্ছি নিজের সহজাত প্রাণশক্তিকে সমীহ করা, তাকে নিয়ে, জীবনকে নিয়ে, উল্লসিত হওয়া। এ হলো ভালোবাসা থেকে শুরু করে সবাইকে নিয়ে ভোজন করা পর্যন্ত মানুষের প্রতিটি কাজে সপ্রাণ উপস্থিতি রক্ষা করা।

সাদা খ্রীষ্টানরা ইতিহাসের কিছু গোড়ার কথা ভুলে গেছেন। তারা ভুলে গেছেন, যেই ধর্ম তাদের ন্যায়পরায়ণতা ও ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা – ‘ঈশ্বর আমার পক্ষে’ বলে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী নেতা ডক্টর ভেরভোর্ড ঘোষণা করেছেন – সেটা যে পাথুরে স্থান থেকে এসেছে, তার নাম মধ্যপ্রাচ্য। তখনও মানুষের বর্ণভেদ আবিষ্কৃত হয়নি। খ্রীষ্টীয় ধর্মব্যবস্থার পত্তনের জন্য রোমের আদেশে যীশুকে মৃত্যুদণ্ডিত করার প্রয়োজন হয়। ঈষৎ দুর্নামগ্রস্ত, রোদেপোড়া হিব্রু যীশুখ্রীষ্ট, যার নামে এই ধর্ম, সেই খ্রীষ্টীয় ধর্মব্যবস্থার আসল স্থপতি কিন্তু আরেক জন। তিনি নীতিবাগীশ, নির্মম ধর্মান্ধ সেন্ট পল।

সাদা মানুষ যখন আফ্রিকায় আসে, তখন সাদা মানুষের হাতে বাইবেল, আর আফ্রিকান মানুষের কব্জায় জমি। কিন্তু এখন সাদা মানুষকে তার অনিচ্ছায়, কখনো রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমে জমি থেকে উৎখাত করা হচ্ছে। আর আফ্রিকান এখন সেই বাইবেল হয় আত্মস্থ করার চেষ্টা করছে অথবা যেটুকু গলাধঃকরণ করেছে সেটা উগরে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

আমেরিকায় সাদা আমেরিকানরা পরস্পরের প্রতি যেমন আচরণ করে, কালো মানুষের প্রতি সেরকম আচরণ করেনা। সাদা মানুষ যখন কালো মানুষের মুখোমুখি হয়, বিশেষ করে কালো মানুষটি যদি অসহায় হয়, তাহলে ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটে।

কালের থাবা বড় কঠিন। সে এক সময়ে ঠিকই রাজত্বের নাগাল পায়, তাকে ধ্বংস করে। রাজত্বের শাসন আর নীতির মূলমন্ত্রে কাল তার তীক্ষ্ণ দাঁত বসিয়ে তার কাটাছেঁড়া করে। কালের ব্যবধানে সেই সব মূলমন্ত্রের অসারতা প্রমাণ হয়, সেইসব মূলমন্ত্র তখন মুখ থুবড়ে পরে। এই তো, খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, রোমে গীর্জার পাদ্রীরা একটা অসহায় কালো দেশে হানাদার আক্রমণে পাঠাবার সময় তরুণ ইতালীয় সেনাদের আশীর্বাদ করেছেন। সেই ঘটনার আগ পর্যন্ত ঐ দেশটি নিজেকে কালো বলেই ভাবত না।

কিন্তু তারপর বেশ কিছু কাল অতিবাহিত হয়েছে, এবং সেই সময়ে খ্রীষ্টান জগৎ যে নৈতিকভাবে দেউলিয়া আর রাজনৈতিকভাবে অস্থির সেটা প্রমাণিত হয়েছে। যখন একটা খ্রীষ্টান জাত একটা জঘন্য হিংস্র তাণ্ডবে মত্ত হয়, যেমন তৃতীয় রাইখে জার্মানীর নাৎসিরা, তখন ‘খ্রীষ্টান’ এবং ‘সভ্য’ কথাগুলো শুনতে অদ্ভুত লাগে। বিশেষ করে যাদের সভ্য বা খ্রীষ্টান কোনটাই বিবেচনা করা হয় না, তাদের কানে ঐ কথাগুলো বেখাপ্পা শোনায়। পূর্বপুরুষের পরিচয়টাই পাপ, সেই কারণে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র – ঈশ্বরের মন্দিরে – এমন সুসংবদ্ধভাবে, এমন ভয়ঙ্করভাবে, এত দীর্ঘসময় ধরে প্রাণসংহার করা হয়, যে এই আলোকিত যুগের আগে আর অন্য কোন যুগে এমন ভয়াবহ নরমেধযজ্ঞ সংঘটন ও নথিবদ্ধ করা দূরে থাক, সেটা কল্পনাই করা যায়নি।

আমার নিজের অভিমত হলো তৃতীয় রাইখের ফলে শুধুমাত্র প্রযুক্তি ছাড়া খ্রীষ্টানদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নটি চিরতরের জন্য অবান্তর হয়ে গেছে। জার্মানির ইহুদি হত্যাযজ্ঞ সাদা লোককে স্তম্ভিত করেছে, আজও করে। তারা ভাবতেই পারেনি তাদের পক্ষে এমন আচরণ সম্ভব। কিন্তু কালো মানুষ স্তম্ভিত হয়েছিল কি? অন্তত যেভাবে সাদারা হয়েছিল? আমার সেবিষয়ে গভীর সন্দেহ রয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিগ্রোদের সাথে যে আচরণ করা হয়, আমার মতে সেটা আমেরিকার সাথে নিগ্রোর সম্পর্কের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে -হয়তো একটু বেশি সরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে – বলতে হয়, একটা আশার মৃত্যু ঘটে, সাদা আমেরিকানদের প্রতি শ্রদ্ধা আরো খানিকটা মুছে যায়।

কল্পনা করুন আপনি এমন একজন মানুষ যে তার দেশের জন্য উর্দি পরেছে, তাকে রক্ষায় আপনার মৃত্যু ঘটতে পারে। তার সহযোদ্ধা আর ঊর্ধতন অফিসাররা তাকে ‘নিগার বলে ডাকে। তাকে প্রায় অবধারিতভাবে সবচাইতে নিকৃষ্ট, কুৎসিত, কঠিন, বাজে কাজগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আপনাকে কল্পনা করতে হবে এত কিছু সহ্য করার পর, দেশে ফেরার পর এই নাগরিকের বরাতে কি জোটে। সে কালো চামড়া নিয়ে বর্ণবিভাজিত বাসে চড়ে, বিভিন্ন স্থানে ‘সাদা’ ‘কালো’ সাইনবোর্ড, বিশেষে করে ‘সাদা ভদ্রমহিলা’ আর ‘কালো মহিলা’ সাইনবোর্ড স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে।

এই সমাজ সম্পূর্ণভাবে বৈরিভাবাপন্ন। তার স্বভাবই হলো আপনাকে পদদলিত করবে। ঠিক যেমন আগে বহু মানুষকে করেছে, এখনো প্রতিদিন বহু লোককে করছে। তখন কোন একটা অপমান কি সত্যি ঘটেছে, নাকি সবটাই আপনার কল্পনা, সেটার তফাৎ বোঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।

যেমন ধরুন আমার জন্য ফ্ল্যাটের দারোয়ান আর পুলিশ সব্বাই এক। আমার এদের সাথে আচরণের মূলসূত্র হলো ওরা আমাকে আতঙ্কিত করার আগে আমি ওদের আতঙ্কিত করব। কারো কারো প্রতি নিঃসন্দেহে আমি অবিচার করছি, কিন্তু আমি নাচার। এই সব মানুষের কাছে এদের ঊর্দির চাইতে যে মানবিকতা বড় হতে পারে, সেটা ধরে নেওয়া আমার জন্য বড্ড বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সাদা মানুষ কি গাত্রবর্ণের চাইতে মানবিকতাকে প্রাধান্য দেয়? বেশির ভাগ নিগ্রো এটা ধরে নেবার মত বড় ঝুঁকি নিতে রাজি না।

মোদ্দা কথা হলো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে, মানুষ হিসেবে কালো মানুষের সম্বন্ধে সত্য কথাটা তার কাছ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে, অন্যায়ভাবে গোপন রাখা হয়েছে। একজন কালো মানুষ যখন সাদা সমাজের সংজ্ঞা মানতে অস্বীকার করে, তখন সাদা সমাজের ক্ষমতার ভিত্তি কেঁপে ওঠে। ফলে কালো মানুষকে খর্ব করার কোন সুযোগ হাতছাড়া করা হয় না।

আজ তো এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে পৃথিবীতে সাদা মানুষ সংখ্যালঘু। এত ভীষণ রকমের সংখ্যালঘু যে পুরো সাদা সমাজের ধারণাটাই কল্পিত মনে হয়। তাদের শাসনের আশাও আঁকড়ে থাকা সম্ভব নয়। যদি তাই হয়, চোরাগোপ্তা চাতূর্য আর ভয়াবহ রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে তারা যে প্রাধান্য অর্জন করেছে তারা দাবি করে তাতে ঈশ্বরের আশীর্বাদ রয়েছে। কিন্তু আসলে সেটা যদি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়ে থাকে? তাই যদি হয়, তাহলে যেই তরবারি এতদিন তারা অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, সেটা আজ নির্মমভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে।

আমেরিকার নিগ্রো দেশটির এক অনন্য সৃষ্টি। তার কোন পূর্বসূরী নেই, তার সাথে তুলনীয় এমন কিছু আর কোথাও নেই।

এটাতো সত্যি কথা যে প্রতিটি আমেরিকান নিগ্রোর নাম মূলত সে যেই সাদা লোকের সম্পত্তি ছিল, তার নাম। আমার নাম বল্ডউইন, কারণ বল্ডউইন নামে এক সাদা খ্রীষ্টানের কাছে হয় আমার আফ্রিকান গোষ্ঠী আমাকে বিক্রি করেছিল, নতুবা আমাকে অপহরণ করার পর সে আমায় পেয়েছে। সে আমাকে ক্রুশের কাছে কুর্নিশ করতে বাধ্য করেছিল। আমি দৃশ্যত ও আইনত একটা সাদা প্রোটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বী দেশে ক্রীতদাসের বংশধর। এই হলো আমেরিকান নিগ্রো হবার তাৎপর্য – এই হলো তার পরিচয়। একজন অপহৃত বিধর্মী, যাকে পশুর মত বিক্রি করা হয়, তার সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়, যাকে আমেরিকার সংবিধানে এক সময় ‘তিন-পঞ্চমাংশ’ মানুষ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, এবং সুপ্রীম কোর্টের ড্রেড স্কট মামলার রায় অনুযায়ী যার এমন কোন নাগরিক অধিকার ছিলনা যেটা সম্মান করতে কোন সাদা মানুষ বাধ্য।

এখন কথা হচ্ছে, আমেরিকার রাজনৈতিক আর সামাজিক কাঠামোর খোল নলচে পালটে তাকে ঢেলে সাজানো ছাড়া নিগ্রোর পরিস্থিতিতে সত্যিকার পরিবর্তন আনার কোনরকম সম্ভাবনা নেই। আবার এটাও পরিষ্কার যে সাদা আমেরিকানদের শুধু যে এসব পরিবর্তন আনার কোন ইচ্ছা নেই তাই নয়, মোটের ওপর তারা এই বিষয়ে এমন মানসিক জড়তায় আচ্ছন্ন যে তারা এই পরিবর্তন কল্পনা করতেও অক্ষম। এখানে উল্লেক্ষ্য যে সাদা আমেরিকানদের সদিচ্ছার প্রতি নিগ্রোর নিজেরও আর কোন আস্থা নাই। অবশ্য কস্মিনকালেও ছিল কি?

কাউকে মুক্ত করে দিলেই তাকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। নিগ্রোর ব্যাপারে এই কথাতা খাটে। আমেরিকার প্রজাতন্ত্র এই কাজটি করবার মতো যথেষ্ট মানসিক প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারেনি। সাদা আমেরিকানরা নিগ্রোদের উন্নয়নে যে সব কাজ করে সন্তুষ্টি লাভ করে, তাকে আজকাল লোকদেখানো চাল বলে খারিজ করা হয়। পাকাপোক্ত উদাহরণ হিসেবে ১৯৫৪ সালের সুপ্রীম কোর্টের রায়ের কথা বলা যায়। এই রায়ে স্কুলশিক্ষায় বর্ণবাদী বিভাজন নিষিদ্ধ করা হয়, এবং সেইজন্য আমেরিকানরা গর্ব অনুভব করে। সাদা আমেরিকানরা ভাবে এই রায় আন্তরিক মতবদলের প্রমাণ, যদিও তার বিপক্ষে বিশাল প্রমাণ রয়েছে।

সাদা লোকের শুধু একটা জিনিসই আছে যেটা কালো মানুষের প্রয়োজন, বা তাদের চাওয়া উচিত – সেটা হলো ক্ষমতা। কেউ চিরদিনের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনা।

আবারো বলছি: সাদা মানুষের নিজের মুক্তির জন্য যে মূল্য দিতে হবে সেটা হলো কালো মানুষের মুক্তি – সম্পূর্ণ মুক্তি। সেই মুক্তি আসতে হবে শহরে, শহরতলীতে, আইনের দৃষ্টিতে, চেতনায়।

সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা সবাই মিলিতভাবে একটি জাতি গড়তে চাইলে, আমরা, কালো আর সাদা মানুষ – আমাদের পরস্পরকে গভীরভাবে প্রয়োজন। অর্থাৎ যদি আমরা সত্যি পুরুষ আর নারী হিসেবে আমাদের পরিচয়, মানসিক পরিণতি অর্জন করতে চাই। তবে একটি মিলিত জাতিসত্ত্বা সৃষ্টি অবিশ্বাস্যরকমের কঠিন কাজ।

এই যে নিগ্রোর অতীত – দড়ি, আগুন, অত্যাচার, পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা, শিশুহত্যা, ধর্ষণ, মৃত্যূ, লাঞ্ছনা, অহোরাত্রি ত্রাস - সে এমন ত্রাস যা মজ্জার গভীর পর্যন্ত চলে যায়; তার নিজ জীবনের মূল্য সম্বন্ধে সংশয় হয়, কারণ চারপাশে সবাই সেটার মূল্য অস্বীকার করে; তার নারী, স্বজন, সন্তান, যাদের তার রক্ষা করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু যাদের সে রক্ষা করতে পারেনি - তাদের জন্য বেদনা; ক্রোধ ঘৃণায় মাথায় খুন চেপে যায়, সাদা মানুষের প্রতি এমন গভীর ঘৃণা জন্মায় যে সেই ঘৃণা উলটে তার ও তার নিজের মানুষের ওপর এসে পড়ে, যার ফলে সবরকমের ভালোবাসা, বিশ্বাস, আনন্দ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই অতীত, যেখানে একটা মানবিক পরিচয়, মানবিক কর্তৃত্ব অর্জন, তার বিকাশ, সেটাকে নিশ্চিত করার এক সীমাহীন সংগ্রাম। এই অতীত – যার ভয়াবহতা সত্ত্বেও এতে কী যেন একটা সৌন্দর্য আছে। তবে দুঃখ কষ্ট সম্বন্ধে আমি কোন মোহকে প্রশ্রয় দিতে চাইনা।

যেই মানুষকে মানব নৃশংসতার লেলিহান আগুনের শিখার ভেতর থেকে তার ব্যক্তিত্ব, তার পরিচয়কে দিনের পর দিন ছিনিয়ে বের করে আনতে হয়, সে এই যাত্রায় রক্ষা পাক বা না পাক, সে নিজের সম্বন্ধে, মানবজীবন সম্বন্ধে এমন কিছু আবিষ্কার করে যেটা পৃথিবীর কোন ইস্কুল, কোন গীর্জা শেখাতে পারে না। সে নিজের ওপর কর্তৃত্ব অর্জন করেছে, যেটা আর কিছুতেই আলগা হবে না।

এই মানুষগুলো নিয়ে আমার অনেক গর্ব। সেটা তাদের গাত্রবর্ণের জন্য নয়, তাদের বুদ্ধিমত্তা, তাদের চারিত্রিক বলিষ্ঠতার জন্য, তাদের সত্ত্বার সৌন্দর্যের জন্য। জাতিরও তাদের নিয়ে গর্ব করা উচিত, কিন্তু হায়, খুব বেশি মানুষ তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও জানে না। এই অজ্ঞতার কারণ হচ্ছে মার্কিন জীবনে এসব মানুষের যে ভূমিকা ছিল – এবং আছে – তাতে আমেরিকা সম্বন্ধে আমেরিকানরা যা জানবে, সেকথা তারা শুনতে চায় না।

সাদা আমেরিকানরা নিজেদের সম্বন্ধে নানারকম কল্পকথা আঁকড়ে থাকে – তারা বিশ্বাস করে যে তাদের পূর্বপুরুষেরা সব মুক্তিকামী বীর, তাদের জন্ম পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ দেশে, আমেরিকানরা যুদ্ধে অদম্য, শান্তির সময় বিজ্ঞ, আমেরিকানরা মেক্সিকান, বা আদিবাসী বা অধস্তন মানুষ বা আর সব পড়শিদের সাথে সব সময় ন্যায্য আচরণ করেছে, আমেরিকান পুরুষ পৃথিবীর সবচাইতে সহজ-সরল আর পৌরুষদীপ্ত, আমেরিকান মেয়েরা সবচাইতে নির্মল। আমেরিকান নিগ্রোদের মস্ত সুবিধা হলো তারা কখনই এসব গালগল্পে বিশ্বাস করেনি।

সাদা মানুষের মাঝে আমি এমন একটা গোয়ার্তুমি আর অজ্ঞতা দেখি তাতে প্রতিহি্ংসা অবশ্যম্ভাবী মনে হয়। এই প্রতিহিংসা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের ওপর নির্ভর করে না, তাদের দ্বারা সংগঠিতও নয়। কোন পুলিশ বাহিনি বা সেনাবাহিনীর সাধ্য নাই একে ঠেকাবার। এটা হলো ইতিহাসের প্রতিহিংসা – এর উৎস সেই ধ্রুব সত্য যেটা স্বীকার করে আমরা বলি: ‘যা ওপরে যায়, তা ঠিক আবার নীচে নেমে আসে।’

আজ আমরা সেই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।

যদি আমরা – আমি তুলনামূলকভাবে সচেতন সাদা আর কালোদের কথা বলছি, যাদের প্রেমিকের মতো একের অন্যের মধ্যে পূর্ণ সচেতনতা সঞ্চারিত করতে হবে – তারা যদি নিজ দায়িত্বপালনে পিছপা না হই, তাহলে সংখ্যায় অঙ্গুলিমেয় হলেও আমরা হয়তো এই বর্ণবাদী দুঃস্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারব, আমাদের জাতিকে দাড় করাতে পারব, পৃথিবীর ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারব। আর আমরা যদি আজ জান বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে না পড়ি, তাহলে বাইবেল থেকে আহরিত এক ক্রীতদাসের গানের যেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, সেটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হবে। সেই গানের চরণের মূল কথা, মানব জাতি যখন প্রথমবার ভুল করেছিল তখন ঈশ্বর মহাপ্লাবন দিয়ে শাস্তি দিয়েছিল আর নূহ নবীকে নির্দেশ দিয়েছিল বিশাল এক জাহাজ বানিয়ে তাতে আশ্রয় নিতে। এবার আর পানি আসবে না। সেই চরণের কথা: ‘নূহ নবীকে ঈশ্বর রঙধনুর সঙ্কেত দিয়েছিলেন/ পরের বার আর পানি নয়, আগুন ঝরবে!’

বিশ্বমহামারির বিস্ময়: নারীর শাসন (সেরা) - আশফাক স্বপন


ফেসবুকের মেয়ে বন্ধুরা, এই লেখাটি তোমাদের উদ্দেশ্যেও উৎসর্গ করা হয়েছে! দেখা যাচ্ছে, করোনা মহামারি মোকাবেলায় যেসব দেশ এগিয়ে, তার অনেকগুলোর নেতৃত্বে নারী। তাহলে কি নারীর নেতৃত্ব শ্রেয়? এই প্রসঙ্গে আমার অভিমত। The Daily Star-এ প্রকাশিত ইংরেজী প্রবন্ধে লিঙ্ক নীচে। পাঠকদের সুবিধার্থে বাংলা অনুবাদ নীচে নিবেদন করলাম।

বিশ্বমহামারির বিস্ময়: নারীর শাসন (সেরা)
নারীর উপযুক্ত মর্যাদাদানে সকলের কল্যাণ

আশফাক স্বপন

ডেইলি স্টার। ৩০ মে, ২০২০

আমাদের জীবদ্দশায় এত বড় স্বাস্থ্য সঙ্কট আমরা দেখিনি। সারা পৃথিবীর আজ টালমাটাল অবস্থা। তার মধ্যে এই করোনা মহামারির মোকাবেলায় অঙ্গুলিমেয় কিছু দেশ বেশ সফল হয়েছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে: ‘ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি অথবা স্পেনের চাইতে আঙ্গেলা মার্কেলের নেতৃত্বে জার্মানিতে মৃত্যুর হার অনেক কম। ফিনল্যান্ডে প্রতিটি দলের নেতৃত্বে মহিলা, এমন চারটি দলের জোট সরকারে চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন। মাত্র ৩৪ বছর বয়স তার। পাশের দেশ সুইডেনের তুলনায় তার দেশে করোনায় মৃত্যুর হার শতকরা ১০ ভাগেরও কম। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট ৎসাই ইং-ওয়েন-এর নেতৃত্বে করোনা সংক্রমণের পরীক্ষা, তার গতিবিধি অনুসরণ করে সংক্রমিত ব্যক্তিদের আলাদা করা – এই নিয়ে দেশটির ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ অভিযান। দেশ সম্পূর্ণ লকডাউন না করে এটি সারা পৃথিবীতে সফলতম ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ অভিযানের একটি।’

নিউ জিল্যান্ডের দুর্দান্ত প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্টা আর্ডার্নের কথা ভুললে চলবে না।

লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ: ‘মাত্র ৩৯ বছর বয়স্কা নিউ জিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রী আর্ডার্ন পুরো লকডাউনের সময়টা যেন সমগ্র দেশবাসীর হাতে হাত ধরে গভীর সহানুভূতির সাথে ‘বাড়িতে থাকুন, জীবন বাঁচান’ ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন, প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলনে নির্বিবাদী ভঙ্গিতে মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন।’

‘নিউ জিল্যান্ডের মানুষ যেন পড়শিদের দেখভাল করে, দুর্বলকে রক্ষা করে, আর বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবে যেন হাসিমুখে ব্যক্তিগত ত্যাগে সম্মত হয়, এই বিষয়গুলোর ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। এতে তার ভক্তের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে।’

সেই সাথে এতে হাতেনাতে অবিশ্বাস্য ফল পাওয়া গেছে। নিউ জিল্যান্ডের ৪৮ লক্ষ মানুষের মধ্যে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা শুনলে চমকে উঠতে হয়। মাত্র ২২ জন। নতুন সংক্রমণের সংখ্যা এখন শূন্যের কোঠায়।

একটা জিনিস লক্ষ করছেন? ওপরের সবকটা নেত্রীই নারী।

এবার করোনা প্রতিরোধে কোন দেশগুলোর অবস্থা সবচাইতে খারাপ, তার দিকে নজর দেওয়া যাক। যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসেব অনুযায়ী ২৭ মার্চ যে দেশগুলোতে সবচাইতে বেশি করোনা সংক্রমণ ঘটেছে, তার মধ্যে শীর্ষে যথাক্রম যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল আর রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা শুনে আঁতকে উঠতে হয়। ১৬.৭ লক্ষ। নিকটতম দেশ ব্রাজিলের চার গুণ। ব্রাজিলে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ৪ লক্ষ ছুঁই ছুঁই। রাশিয়াও খুব পিছিয়ে নেই।

এই দেশগুলোর নেতৃত্বে কারা? যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, প্রেসিডেন্ট জায়ির বোলসোনারো আর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের মধ্যে এমন উগ্র, উদ্ধত পৌরুষের নজির খুঁজে পাওয়া ভার।

ট্রাম্প জনসমক্ষে করোনা চিকিৎসায় বিষাক্ত জীবাণুনাশক সেবনের পরামর্শ দিয়েছেন। (পরে বলেন, সবটাই নাকি ব্যঙ্গ!) করোনার জন্য যে ওষুধ বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে বাতিল করে দিয়েছেন বোলসোনারো সেই হাইড্রোক্লোরোকিউন খাচ্ছেন বলে জানান। যাদের তাতে আপত্তি, তাদের প্রতি তাচ্ছিল্যভরে বলেছেন – তাদের ইচ্ছা হলে তারা সোডাভর্তি কোমল পানীয় পান করতে পারে।

এককালের হলিউড তারকা জা জা গাবর একবার রসিকতা করে বলেছেন: ‘উদ্ধত পৌরুষের লম্ফঝম্পই সার, ভেতরে ঠনঠন।’

এই করোনা মহামারির মোকাবেলায় বহু নেত্রীর ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল।

দ্য এ্যাটলান্টিক সাময়িকীতে হেলেন লুইস লিখেছেন: ‘আইসল্যান্ডের কাটরিন জ্যাকব্‌স্‌ডটির বিনামূল্যে সারা দেশের নাগরিকদের করোনা পরীক্ষার প্রস্তাব দিয়েছেন। নরওয়ের এর্না সোলবার্গ শুধু শিশুদের জন্য একটা সংবাদ সম্মেলন ডেকে বাচ্চাদের বলেন, শোন, তোমরা যদি ভয় পাও তাতে একদম ঘাবড়াবে না। এটা মোটেও অন্যায় কিছু নয়।’

তবে একে শ্রেফ উদ্ধত পৌরুষ বনাম মমতাময়ী নারীর দ্বন্দ্ব ভাবলে সেটা কিন্তু অতিসরলীকরণ হয়ে যাবে। রাজনৈতিক সামাজিক বাস্তবতা আরো জটিল, অতো সোজা-সাপ্টা নয়। যেমন মন-মানসিকতায় নিউ জিল্যান্ডের আর্ডার্নের অনেক মিল কানাডার পুরুষ নেতা জাস্টিন ট্রডোর সাথে। যুক্তরাষ্ট্রে মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাট সমর্থক মহিলা গভর্নর গ্রেচেন হুইটমারের রিপাবলিকান মহিলা গভর্নর – যেমন আলাবামার কে আইভি বা সাউথ ডাকোটার ক্রিস্টি নোম – এদের চাইতে বরং ডেমোক্র্যাট সমর্থক পুরুষ গভর্নর – যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার গ্যাভিন নিউসোম বা নিউ ইয়র্কের এ্যান্ড্রু কুওমো – এদের সাথে মিল অনেক বেশি। আর চীনের কড়া একনায়ক শাসক শি জিনপি পুরুষ হলে কী হবে –করোনা মহামারি মোকাবেলায় গোড়ার দিকে ভয়ঙ্কর হোঁচট খেলেও পরে যেভাবে ঐ বিশাল দেশটাকে করোনার শনির গ্রাস থেকে বের করে এনেছেন তাতে সারা বিশ্ব তাজ্জব বনে গেছে।

আমাদের নারী নেত্রী আর পুরুষ নেতার বাছবিচার অতিক্রম করে আরো গভীরে গিয়ে সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটা উপলব্ধি করতে হবে। নেত্রীরা যে সব সময় নেতাদের চাইতে শ্রেয়, আসল কথা সেটা নয়।। আসল কথা হলো যেই জাতি নারী নেতৃত্বকে সাদরে গ্রহণ করে সেই জাতিটা শ্রেয়।

নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক ক্যাথলিন গার্সন দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘যে রাজনৈতিক আবহে সরকারে আস্থা ও সমর্থন তুলনামুলকভাবে বেশি, যেখানে নারী পুরুষে তেমন ভেদাভেদ নেই,’ সেখানে নারী নেত্রীদের নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা বেশি। ঐ আবহের ফলেই ‘আপনি একধাপ এগিয়ে গেলেন।’

দ্য আটলান্টিক সাময়িকীতে হেলেন লুইস লেখেন: ‘যে দেশ একনায়ক নির্বাচিত করে – অথবা ভুয়ো নির্বাচনের পর একনায়ক ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে – সেই দেশের এমনিতেই অবস্থা সুবিধার নয়।’

লুইস আরো লেখেন: ‘সুতরাং ঐ বস্তাপচা লিঙ্গবাদী বুলি উলটে দিয়ে কিছু লাভ নেই। শত শত বছর ধরে এই মন্ত্র আউড়ানো হয়েছে যে পুরুষমানুষের প্রকৃতি তাকে নেতৃত্বের জন্য আরো উত্তমভাবে প্রস্তুত করেছে। আজ হঠাৎ করে তার উল্টোটা সত্যি হয়ে যায়নি। নারী নেতৃত্বের কারণে সুশাসন আসেনি। বরঞ্চ সুশাসনের গুণে নারী নেতৃত্ব বিকশিত হয়েছে।’

বৃহত্তর পরিসরে সমাজের ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। সমাজে নারীর কদর কতখানি, সেটা দিয়ে সেই সমাজ কতখানি আলোকিত তার পরিচয় পাওয়া যায়।

সবচাইতে যেটা অবাক কাণ্ড তা হলো আজও আমাদের এতটা পথ বাকি। কিছু দেশ নিজেদের খুব উন্নত মনে করে, কিন্তু তাদের অনেক দূর পথ বাকি। যুক্তরাষ্ট্র এখনো প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্টের অপেক্ষা করছে। দেশের সেনেট-এ প্রতি চারজনে মাত্র একজন মহিলা সেনেটর। অর্থনৈতিক আয়তনের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ কুড়িটি দেশের সংগঠন জি-২০। সেখানে সবেধন নীলমণি আঙ্গেলা মার্কেল একমাত্র মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান।

দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্তা আরো খারাপ। ধর্মীয় গোঁড়ামির ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন যে পিতৃতান্ত্রিকতা আর নারীবিদ্বেষ লালিত হয়েছে, তার ভারি বোঝা আজও আমাদের টানতে হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে এই ব্যাপারে ধর্মভেদে বিশেষ তারতম্য নাই – সব ধর্মেই গোঁড়ামি মানেই যে করে হোক নারীকে শৃঙ্খলিত রাখার চেষ্টা। আমাদের অঞ্চলের নারী রাষ্ট্রপ্রধান নিয়ে আমাদের আত্মপ্রসাদ অর্থহীন, কারণ এর ষোল আনাই ফাঁকি। (অধিকাংশ নারী রাষ্ট্রনায়কদের রাজনৈতিক সাফল্য পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত – সে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী হোক, বাংলাদেশের শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়াই হোক, পাকিস্তানের বেনজীর ভুট্টোই হোক, আর শ্রীলঙ্কার সিরিমা বন্দরনায়েকেই হোক।)

নারী-পুরুষের সমতার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক সময় পড়শি দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে – সেটা খুব আশার কথা। তবে আমাদের কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের এখনও অনেক, অনেক কাজ বাকি।

আমাদের কবে যে বোধোদয় হবে! আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে জাতির অর্ধেকের মধ্যে যে সুপ্ত সম্ভাবনা, তাকে পূর্ণভাবে বিকশিত হবার উদার, অবারিত সুযোগদান করলে তাতে লাভ আমাদের সকলের – বস্তুগতভাবে, নীতিগতভাবেও।

নারীর সম্পূর্ণ মুক্তি আসতে সময় লাগতে পারে, কিন্তু একদিন না একদিন সেই মুক্তি আসবেই। নারীপুরুষ নির্বিশেষে সেই দিনটি সবার জন্য এক নতুন স্বর্ণালী অধ্যায়ের সূচনা করবে।

(অজস্র ভালোবাসা, আনন্দ আর ভরসা দিয়ে যেসব নারী আমার জীবনকে আলোকিত করেছেন, এই ছোট্ট প্রবন্ধটি তাদের সবাইকে উৎসর্গ করলাম। এঁদের মধ্যে আছেন: ঢাকায় আমার আদরের ছোট দুই বোন আলপনা আর কল্পনা – রূপে, গুণে সাফল্যে তারা তাদের বাউণ্ডুলে ভাইয়াকে বহু আগে অতিক্রম করেছে, তবে ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা তাদের একবিন্দু কমেনি; আমার প্রয়াত মা, যার ঊষ্ণ হৃদয় ছিল অফুরন্ত স্নেহের উৎস; আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অবিসংবাদিত অভিভাবক আমার বড়ো খালা – যার রক্তচক্ষু আর কড়া শাসনের আড়ালে লুকানো ছিল মমতার গাঢ় প্রস্রবণ; মেলবোর্ণে আমার অতি আদরের খালাত বোন আপুমণি, যিনি এখনো আমার আরেকটি স্নেহময়ী মায়ের মতো, শুধু তফাত এই যে তার থেকে সারাজীবন ভালোবাসাই পেয়েছি, কোনদিন বকুনি খেলাম না; হিউস্টন আর নিউজার্সির ভুরহিস শহরে আমার দুই বন্ধুপত্নী, আমার প্রতি যাদের গভীর মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অপূর্ব সব রান্নায়। এছাড়া আরো অনেকে আছে, স্থানাভাবে যাদের নাম উল্লেখ সম্ভব নয়।

তোমাদের কাছে আমি হাতে কলমে মেয়েদের ভালোবাসতে শিখেছি, শ্রদ্ধা করতে শিখেছি, সমীহ করতে শিখেছি। তোমাদের কাছে আমি নারীর সমতা ও সম্মানের অবিচ্ছেদ্দ্য অধিকারকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করতে শিখেছি। তোমাদের জন্য আজ আমি একজন আলোকিত পুরুষ হতে শিখেছি।)

ভূমিপুত্র - পারভীন সুলতানা [ছোটগল্প]

ভূমিপুত্র
পারভীন সুলতানা।


আজ অমাবশ্যা। সমস্ত আলো শিকার করে নিয়ে গেছে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ।রাত এখানে র্নিজন,অচঞ্চল। স্থলচর আমরা কয়জন এখন জলের কাছাকাছি। গাঙচরা বিলে জয়নাল ভাই,উসমান আর আবেদ আলীর সাথে মাছ মারা কিস্তি নাওয়ের গলুইয়ে বসে ওদের নিরলস র্কমকাণ্ড দেখি । এরা মাছ ধরার সময় কথা কয় না। যেন ধ্যান রত মুনি-ঋষি! বর্ষার শুরু কেবল। আজ সারাদিন মনের সুখে বৃষ্টি হয়েছে। আবেদ আলীর ভাষ্য, তাজা পানির গন্ধে মাছের নিশা দরে! নয়া পানিতে ঝাঁক ঝাঁক নবজাতক নিয়ে ভ্রমণরত শোল জননীর উপর জয়নাল ভাইয়ের র্নিদয় কোঁচের নিশানা ফসকায় না। বৈঠাতে উসমান। বড় জ্যাঠার ছেলে।আবেদ আলীর কাজ কেবল র্টচ মারা। ও আমাদের বছুরে কামলা হলেও সর্ম্পকটা প্রায় ইয়ার দোস্তের মতো। অপ্রাসঙ্গিক আলোয় উসমানের ঘাড় শিকারি বকের মতো একটুখানি বাঁকতে দেখি কেবল। বিলম্বিত র্বষায় পানি এখনও কোমর সমান হয়নি। নৌকার তলে আউসের চারা । মাঝে মঝে অস্পস্ট ক্রিচ্স্স্ শব্দ হয় কী হয় না! শোল বড় তেজিলা মাছ! কোঁচ থেকে তুলে এর বন্দোবস্তু করতে এরা বিরতি নেয়। র্টচ টিপতে টিপতে আবেদ আলীর পেট ফোলা র্তজনি চেপ্টে গেছে। অনেক্ষণ পর শুক্লপক্ষ স্ব মেজাজে ফিরে যায়। অন্ধকারে উসমান পকেট থেকে বেনসন বের করে। বয়সে আমার চেয়ে মাস ছয়েকের বড়। যদিও এইসব ছোট-বড় আমরা মানি না। উপহার হিসেবে ওকে আমিই দিয়েছি। লাইটারে আগুনের যোগান দিতে না দিতেই নিবিড় অন্ধাকার নেমে আসে। আঁঠালো এ অন্ধকারকে আরো মজবুত করে তোলে বিদ্যুতের অনুপস্থিতি। পল্লী বিদ্যুৎ থাকলেও প্রায়ই অদৃশ্য এখানে! কাছেই বিলের পাশ ঘেষা পাকা রাস্তা। এবার বর্ষা সিডিউল ট্রেন মিস করেছে। লাস্ট ট্রিপের লোকাল ধরে আসছে বোধ হয়! আষাঢ়ের আজ সাত। হাওড়ের পানি এখনও কোমর ছাড়ায়নি! কালো বোরখা পরা নিপাট অন্ধকার ফুটো করে দেয় বিলের পাশের পাকা রাস্তায় দৌড়ে আসা একটা ট্রাক। হেড লাইটের উজ্জ্বল আলো মসৃণ আঁধার ফালা ফালা করে তুললে আমাদের পলাতক ছায়ারা কিছুক্ষণের জন্য ফিরে আসে। কায়ার ঘেরটোপে বন্দি আমরা আবার ভুস করে জেগে উঠি। তবে বেশিক্ষণ সঙ্গ দেয় না পিছলে যাওয়া ভৌতিক আলো। বাহনটি অদৃশ্য হতেই রাত তার আগের অবয়বে ফেরে। বৈচিত্রহীন অন্ধকার কিন্তু রাতপাখির নিঃসঙ্গ রোদন, পোকার ডাক,বিলে ঘাই দেয়া মাছের সংলাপ, গাছ-গাছালিতে জড়ানো-মড়ানো লতা-পাতার বনজ গন্ধের ওপর খবরদারি করতে পারে না। নাওএর তলানির সাথে ঘষা খাওয়া পানির টলল্ টলল্ শ্রুতিমধুর গান শুনতে শুনতে মন বেভুলা হয় দুর অতীতে।কিছু আব্বার মুখে শোনা, কিছু আমার শৈশবে দেখা।

জলো বিল,নিরলস বয়ে চলা কংসঘেষা নদীর গলাগলি ধরা আমার বাপ-দাদার গ্রাম চিরাং। দাদা জাহাবক্স তালুকদারের বেশুমার জোত-জমি।বিশাল সয়-সম্পত্তির মালিক হলেও দাদা কী তার ছেলেরা ঠেঙের উপর ঠেঙ তুলে বসে থাকতো না। ধুম কাজের দিনে বাড়ির কায়-কামলার সাথে তারাও খাটতো সমান তালে । রোয়া লাগানো,জমিতে লাঙল দেয়া এসব কায়িক শ্রমে আলসেমি ছিলো না কোন । আব্বাদের ছয় ভাই-তিন বোনের মধ্যে একজনেরই মন ছিলো উচাটন! আব্বার সব চেয়ে ছোট ভাই চানফর আলী গাথক,নিজেই গান বানায়,নিজেই গায়। গানের দলের সাথে কই কই ঘুরে বেড়ায়! সুনাম গঞ্জ, নিকলি,মিঠামইন,খালিয়াজুড়ি! বাড়ি ফিরলে হাটবার ছাড়া সেও হাওরে চাষের জমিনে পড়ে থাকে। মনফর জ্যাঠার ঝোঁক ব্যবসায় । বাজারে জ্যাঠার থান কাপড়ের বড় দোকান। বাড়ির লাগোয়া বিছানে আবার আনাজপাতির চাষ করতো। এটা ছিলো তার হাউশ! । এদের সবার প্রাণ ভোমরা যেন মাটির অতলে গোঁজা! এতো বড় বাড়ির মধ্যে খালি আব্বারই লেখা-পড়ার শখ জাগে। হ্যাঁ, এ বাড়ির রেসালামতে এইটারে শখই বলা লাগে! ধান-ফান, সরিষা-তিসি,আলু- মরিচের আবাদ করার ইচ্ছা পিছলে কেমনে কেমনে যে আমার আব্বার ইস্কুলে যাওয়ার মন লাগে! সেটা বোধ হয় দাদার বাড়িতে লজিং থাকা প্রাইমারি স্কুলের ইসমাইল স্যারের সুবাদে। লজিং মাস্টারের বাড়ি ২০/৩০ মাইল উজানে। সেদিনের হিসাবে এই পথের দূরত্ব অনেক বেশী বৈকি! নাই রাস্তা-ঘাট,নাই যান-বাহন। বর্ষাকালে নাও-নৌকাই ভরসা। লজিং মাস্টার নিয়া আমার কিচ্ছা না,কিচ্ছা আব্বারে নিয়া। চৌদ্দগুষ্টির মধ্যে পড়ালেখা না থাকলে কী! আব্বা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তেলেসমাতি দেখানো শুরু করে। শুধু ক্লাসে প্রথম হয়ে না ; মেট্রিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে স্টেন্ড করে (পঞ্চম) তালুকদার বাড়ির মধ্যে একটা ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটায়। আব্বা আরো লেখা-পড়া করার জন্য টাউনে পাড়ি জমায়। বাপের টাকা-পয়সার অভাব নাই আর পুত্রের র্ধৈয্যের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্নাস ,এমএ শেষ করে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। অনার্স পড়ার সময়ই আব্বার শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়। গাঁয়ের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আম্মাও গ্রাম ভালোবাসেন। আব্বা সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। বদলির চাকরি। আগের মতো হুটহাট বাড়ি যাওয়া কমে যায়। তবে বার্ষিক পরীক্ষার পর স্কুলের র্দীঘ ছুটিতে গ্রামে যাওয়া ছিলো আমাদের জন্য উৎসব।

সড়ক উঁচা করে এর মধ্যে রাস্তাঘাট হয়েছে।তবু ভাটির দেশ বলে কথা! বাড়ি অবধি গাড়ি যায় না। চৈতার হাওরের কাছে নেমে বাড়ি যাবার বাকিটা পথ হাঁটতে হয়। পথে ফসলি মাঠেই দেখা হয়ে যায় জ্যাঠা,কাকাদের সাথে। ওদের পরিশ্রমী পিঠের নানামাত্রিক ঘামের রেখা আমার শিশু হৃদয়ে গভীর হয়ে দেবে থাকে।সে সব তরল জলকণা আমার বুকে সযতনে লিখে দেয় ‘ভূমিপুত্র’ শব্দটা। বাড়ির দিনগুলো খড়ের গাদায় লুটোপুটি করে,ছিপ দিয়ে মাছ ধরে, গাছের ফল-পাকুর খেয়ে ব্যাখ্যাতিত আনন্দে ফুরুৎ করে শেষ হয়ে যেতো! দিন তো পায়ে পায়ে হাঁটে না, দৌড়ায়! বড় হওয়ার পর গ্রাম প্রীতি ক্রমশ ফিকে হয়ে আসতে থাকে। নগরের চটকদার জীবন গ্রামের সবুজ আকর্ষণ কেড়ে নেয়ায় ঘোর তৎপর হয়ে ওঠে। আম্মাও শহরে গোছানো সংসারের ছককাটা ফ্রেমে ঢুকে পড়ে। ঢাকা এক রকম আমাদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠে। ইস্ত্রি করা মসৃন আভিজাত্য ধান ক্ষেতের ইঁদুরের মতো ঢুকে পড়ে আমাদের গিরস্ত ঘরে। কেবল আমার বোধের কোথায় যেন মাটির নেশা রয়ে যায়! টবের অনুর্বর মৃত্তিকায় নানাজাতের গাছ লাগাই। অচেনা লাল মাটিতে অভিমানি গাছ বাড়ে না। বিরক্ত হয়ে হাল ছাড়ি।

ভাইজান উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকা উড়াল দেয়; বড় আপাও বিয়ের পর কানাডা পাড়ি জমায়। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আমি ময়মনসিংহ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে পিওর অ্যাগ্রিকালচারে ভর্তি হই। ব্রহ্মপুত্র নদ, বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে থাকা চারপাশের দৃশ্যমান গ্রামগুলো আমার ভেতরের ভূমিপুত্রকে খুঁচিয়ে তোলে। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে ক্যাম্পাসের জমিতে হাল-চাষ করতে করতে আমার পিঠেও র্পূবপুরুষের মতো শ্রমক্লান্ত ঘাম জমে। ওদের আদলে তর্জনির পেট দিয়ে কপালের ঘাম ঝরাই।ক্লান্তির সাথে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ বোধ করি। ফসলের জমি তৈরি,আবাদের সঠিক পদ্ধতি,পর্যাপ্ত ফসল ফলানোর থিউরি খুব নতুন লাগে না আমার কাছে।বেশি ফলনের জন্য সারি বেঁধে ধানের চারা লাগানো,পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের জন্য মাটিকে মিহি তুলতুলে করে তোলা, পানির যোগান দেয়া চাচা-জ্যাঠাদের কাছে দেখা এসব আমার শৈশবের পাঠ । এখন বাসে ময়মনসিংহ থেকে বাড়ি যাওয়া যেন এক দৌড়ের পথ!। যোগাযোগের নড়বড়ে সাঁকোটা মেরামতে তৎপর হই। সত্যি বলতে কী, দাদা-দাদি মারা যাবার পর আব্বাও গাঁয়ে যাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে...।উসমানের শিকারি চোখ ঘুরতে আসা এক বে-ভুলা কালা বাউসের পিঠ ক্কচাৎ শব্দে গেঁথে নিলে আমার স্মৃতি ভ্রমনে আবেদ আলীর উল্লাস ঢুকে পড়ে। বিড়ি টানার উছিলায় সবাই গাল-গল্পে মাতি। -তাইলে তুমি ঠিক করছো বিদেশ চইলাই যাইবা? আবেদ আলী সকাল থেকে এ নিয়ে ৬/৭ বারের মতো জিগেশ করেছে কথাটা।যতোবার আমি জানাই হ্যাঁ,চইলাই যাইতাছি ;ততোবার হতাশায় ওর লম্বা থুতনি আরো লম্বা হয়ে যায়। ফজরের আজানের আগে আগে বাড়ি ফিরি আমরা। ঘুমের ওজনে কেউ কারো দিকে তাকাতে পারি না।

এক আজানে ঘুমিয়ে আরেক আজানে ঘুম থেকে জেগে দেখি আলো ঝলমলে দুপুর। ক্ষিধায় পেট জ্বলছে। সকাল থেকে পেটে কোন দানা-পানি পড়েনি। জ্যাঠি ভাত বেড়ে আমাকে ডাকে- এলা খাইতো আয়া ফরো, বহুত মাছ ধরা অইছে! আমি হাত ধুতে ধুতে জানতে চাই জয়নাল,উসমান আর আবেদ আলী খেয়েছে কী না। -হেরা এক গড়ান ঘুমানি শেষ কইরা কুমবালা উঠ্যা রায়ের বাজারো গেছে গা! জ্যোঠির কথায় মনে পড়ে, আরে আজকে না হাটবার!

হাটবার আমার একটা পছন্দের দিন। আশ-পাশের পুরা এলাকার পরিস্কার একটা নকশা পাওয়া যায় হাটে গেলে। রায়ের বাজারের হাট অনেক বড় হাট! কত জিনিস বেচা-কেনা হয়! শুধু কী কেনা বেচা! গায়েন আর কবিয়ালরা আসে। আসে কিচ্ছা গাথকের দল। আরো কত রকমের পসরা বসে! মিঠাই এর দোকানই বসে নানা কিসিমের। গজা, তিলের খাজা, আঙ্গুর ভাজা, তিলুয়া। আর রসগোল্লা,কালোজাম, ছানার মিষ্টির কথা বাদই থাক। বিশাল মাছের আরত দেখার মতো। সেই মোহন গঞ্জ, ইটনা, মিঠামইন থেকে জাউল্লারা মাছ নিয়ে আসে। ভাত খেতে খেতে খেয়াল করি জ্যাঠি আঁচলে চোখ মুছছে। আমি এ অশ্রুর কারণ জানি তাই আর জিগেশ করি না। বরং খেয়ে অন্যদিন যেখানে বসে আরো একটু গল্প করি; আজ হাত ধোয়া শেষ করে সোজা উঠে ছাদে চলে যাই। এও এক গপ্পো, আব্বা নিয়মিত না এলেও বাড়িতে পাকা তিনতলা বিল্ডিং তুলে রেখেছে। তাঁর উপ সচীব হওয়ার গরীমা এখানে এভাবে টাঙ্গিয়ে রেখেছেন তিনি। আগে আমাদের বাড়িটাকে ‘তালুকদার ’বাড়ি নামে চিনতো সবাই,এখন ডাকে তিনতলা বাড়ি। ইটের প্রাণহীন কাঠামো বংশের পরিচয় উপরে নেয়ার পায়তারা জুড়েছে। অনিয়মিত হলেও বেশ আগে থেকেই এখানে কারেন্ট চলে এসেছে। ফলে সবুজের বিস্তারে একখণ্ড নগরের অপ্রাসঙ্গিক জবরদস্তি! বাড়িটাকে দূর থেকে লক্ষ করলে গ্রামের সবুজের মাঝখানে কেমন বেমানান লাগে।

ছাদে দাঁড়িয়ে প্রিয় বেনসন ধরাই। সড়ক ধরে যাওয়া লোকজন দেখি। বেশির ভাগের গন্তব্য হাট। মাথায় আনাজ-তরকারি , হাতে ঝুলানো হাসটা,মুরগিটা। হাটে বেচবে। এ দৃশ্যও অচিরে লোপ পেয়ে যাবে। ভাটির রিমোট এলাকা হলে কী! দালাল আর ফড়িয়াদের লম্বা হাত এখান র্পযন্ত পৌঁছে গেছে। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে এরা এলাকার সেরা জিনিসগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যায় শহরের পেটমোটা লোভিদের জন্য। যাদের বিন্দুমাত্র মায়া নাই ,ভালোবাসা নাই আপ্রাণ ভুলে যাওয়া গাঁয়ের মাটি ও মানুষের প্রতি। র্বষার আকাশে মেঘের খঞ্জনি বেজে ওঠে । মেঘের সাঁজোয়া বাহিনী দলবল নিয়ে নামার পায়তারা করছে। বিকেল মোহময় হয়ে উঠলে আমার যুবক হৃদয়ে আয়েশার স্মৃতি উজিয়ে ওঠে। কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দ্বিতীয় র্বষ থেকে মধুর আনন্দে প্রেমের গাঁটছড়া বাঁধি আমরা। কথা হয় পাশ করার পর গ্রামে থাকবো। স্বপ্নে নয়, বাস্তবের মৃত্তিকায়। ফাইনালের পর কথা না রেখে আয়েশা উড়াল দিলো জাপান। বুক টনটন করলেও এক রোখার মতো আমি রোজ তাকে ভুলে যেতে থাকি। কিন্তু প্রেম ভোলা সহজ কথা ! একটা মচমচে হুল্লুরে রাস্তায় তাকাই।সামনের সড়কে হৈহৈ করে ফিরছে হাটুরে দল। এদের কয়েকজনের হাতে মানুষ সমান বিশাল এক বোয়াল। মাছটা দেখার মতো বটে। ওদের দলে ভিড়ে যায় কৌতূহলী আমুদে লোকজন। দূরে দেখা যায় চানফর চাচার গাথক দলটাকে। ওরা হাটবার এলে বিনে পয়সায় গান ফেরি করে। ঠোঁটে বহন করে নিয়ে আসা সুরকে প্রান্তরে প্রান্তরে ছড়িয়ে অপার আনন্দে মাতে গায়েনরা ।
ও বন্ধুরে পরান বন্ধু আমার
তুমারো বিচ্ছেদে কান্দি
অন্তরে পাষানও বান্ধি
তেও পিরিতির কমেনা গো ধার...।
গানের বেভুলা কষ্টের বাণী আর মীরের মসৃণ মুন্সিয়ানা ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয় আমাকে। এক বেবুঝ মায়া আরো মাটি সংলগ্ন করে আমাকে! আব্বার খুব ইচ্ছা আমি অস্ট্রেলিয়া গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি র্অজন করি। যাবার আয়োজনও সম্পন্ন প্রায়। সবাই তাই জানে। শুধু আমি জানি যে, কোথাও যাচ্ছি না আমি। কোন দেশ এমন আপনতা দেবে আমাকে! চানফর চাচার গায়েন দলের মতো এমন মিঠাস গান কোন দেশের গাথকরা শোনাবে এমন চেনা দরদি গলায়! কোথায় হাটুরেদের দল স্রেফ একটা মাছ কিনে এমন আনন্দ আয়োজনে মাতে!

থানা কৃষি অফিসারের পোস্টে পরীক্ষা দিয়েছি। চাকরি হবে জানি। কোন দিন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হইনি । আমিতো আব্বারই ছেলে! পরিকল্পনা করে কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়েছিলাম। শৈশবে দেখা মগ্ন কৃষকের সেই সব পাঠ সযতনে কে কখন আমার কলবের ভেতর সিলগালা মেরে দিলো নিজেও জানি না। গ্রামের সবুজ,ফসলি মাঠ যেন আমার ইবাদতের জায়নামায হয়ে ওঠে! ফসলের সূরা পড়ে বাতাস আমাকে ফুঁ দিলে যেন জিকির ওঠে আমার পরানে!

স্বপ্ন দেখি বাপের ঘর-ভিটায় সংসার পাতার। নয়া টিনের ঘর তুলবো। টিনের চালে আষাঢ়ের বৃষ্টি নামবে ঝম ঝম। বকুল আর কদমের ফুল ফুটবে বেশুমার। এ বাড়িটাকে সবাই আগের মতো ‘তালুকদার বাড়ি’ ডাকবে।বিশাল উঠানে ধান মাড়াইয়ের আয়োজনে কামলারা বেসুরে গলায় চানফর চাচার ফসলি গান গাওয়ার সময় আমার পুত্রও সে গানে গলা মিলাবে।
ও বন্ধু পরান বন্ধুরে আমার...।
উডান ভরা ধান যে বেশুমার
কই যে গেলা ঠিকানা নাই তুমার
তেও পিরিতির কমেনা যে ধার
বাবিজানে ঢেঁকিতে দেয় পার
ও বন্ধু পরান বন্ধুরে আমার।
জাহাবক্স তালুকদারের মাঠ মাঠ জমিন। সেখানে সবুজ ফসলের কাব্য বুনবে তার উত্তর ভূমিপুত্র। আব্বা পড়াশোনা শিখে নকল সাহেব বনে গেছে ; আমি সন্তান হিসেবে তার প্রায়শ্চিত্য করার জন্য অপার আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করি।
প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট