প্রবাসীর কোনো দেশ থাকে না! - আয়নামতি
বাইরে রাগী বালকের মত ফুঁসছে দারুণ দুপুর।
কিছু বায়না করে না পাওয়া বালকের রাগ সামাল দিতে মায়ের হাসিমুখের উপস্হিতি যেমন বালকের রাগ মুছে নেয়, সেভাবে ঠান্ডা বিকেল এসে দাঁড়ায় সময় গড়িয়ে, রোদের রাগ মুছে যায়।
এ সময়টাতে অনেকেই কাজ শেষে বাড়ি ফেরে। আমিও ফিরে আসি শেষ বিকেলের রোদ গায়ে মেখে। ঘরে ফেরার এই সময়ে আমার কেন জানি মনটা কেঁদে ওঠে। আশৈশব যে ঘরে ফিরেছি খেলা শেষে, ক্লাসশেষে, সে ঘরে আর ফেরা হয়না বলেই মনটা কাঁদে, সে আমি বিলক্ষণ জানি। এও জানি, সে ঘরে আমার কোনোদিন ফিরে যাওয়া হবে না। এখন আমি অন্য দেশের চেনা-অচেনায় মিশানো এক ঘরে থাকি। আমার মধ্যে সহজেই অন্যকে আপন ভাববার বিরল গুণটি নেই বলেই কিনা জানিনা, আমি না পারি এ ঘরকে নিজের ভাবতে, না পারি এই দেশটাকে আপন করতে। তবুও প্রতিবার ঘরে ফিরে নিজেকে শুনিয়ে বলি, 'দিস ইজ হোম।'
বহুদূরের লাল সবুজ পতাকাটি অবিকল একটা সবুজ টিয়া পাখির লাল ঠোঁট হয়ে আমাকে লক্ষ্য করেই যেন গেয়ে ওঠে, ‘এবার তোর আপন দেশে আয়।’ ঘর ছাড়া মানুষেরা ঘরে ফেরার আকুতি বয়ে বেড়ায়। তাদের এক পা যেন উঠেই থাকে আশৈশব পরিচিত গণ্ডিতে সেটি রাখবার জন্য।
“বুকে হাওয়া ঘুরে ওঠে শূন্যতা আনে। কে যেন জানতে চায় দেশ কোনখানে?”
অকারণে মনে পড়ে যায় অদ্ভূত সেই সিনেমার কথা ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান!’ কিন্তু ঐ দলে তো পড়িনা আমি। আমি আসলে ঠিক কোন দলে পড়ি তবে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি। অফিসের এক গোড়া বর্ণ বিদ্বেষী সহকর্মী মাঝে মাঝেই স্পষ্ট ভাবে জানান দেন, এদেশটার অধিকার কেবল তাদের, অভিবাসীদের নয়।
এহেন আচরণের মোক্ষম জবাব দেয়া যায় ইতিহাসের চোখে আঙ্গুল দিয়ে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যাপারটা হালকা তামাশায় মোড় নেয় শেষ পর্যন্ত। আড্ডা শেষে ওর স্বদেশী বন্ধুরা স্বভাব সুলভ সুশীল ব্যবহারে ক্ষমা প্রার্থনা করে নেয় লোকটার হয়ে। সে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য খুঁইয়ে বসা মানুষ, সেটা আর দশজনের মতো আমারও জানা। তবুও ভেতরে ভেতরে আমাদের প্রতি কারো ঘৃণা টের পাই, ভদ্রতা বশে তাকে পাশ কাটাই ঠিকই। কিন্তু বুকের ভেতর থেকে তার রেশটুকু পুরোপুরি মিটিয়ে ফেলতে পারিনা। একটা অক্ষম রাগ বুকের মধ্যে পুষেই রাখি।
কিছু মানুষের কুটিল ইচ্ছার কাটাকুটিতে যদি এই পৃথিবীর মানচিত্রের বুকে এত এত আঁচড় না পরতো, বিভেদের সীমানা টেনে, দেগে দিয়ে যদি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তুলে দেওয়া না হতো। তবে কেমন হতো সেই একক পৃথিবীর মানচিত্র? ভাবতে ইচ্ছে করে সে কথা। অচেনা সেই মানুষটির মতো অবাক র্নিলিপ্ততায় বলে দিতে পারতাম আমিও তবে, ‘জানিনা কোন দ্রাঘিমায় আমার দেশ।’ আশ্চর্য মেঘদলের পাশাপাশি তবে হয়ত ভালোবাসাবাসিটাও আশ্চর্য সুন্দরই থাকতো এক মানুষের প্রতি অন্য মানুষের। কিন্তু সেটা হবার নয়। তাই সহকর্মীর অবান্তর কিন্তু কার্যকরী খোঁচা বুকের গভীরে অপমান হয়েই জেগে থাকে। অক্ষম রাগে ফুঁসতে থাকে……….
” রোজ আমি চেটে খাই লজ্জা ও ঘৃণা, কে জানে আমার কোন দেশ আছে কিনা!”
আছে বৈকি, আমারও একটা দেশ আছে। একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তবে সে স্বাধীনতা কেবল কাগজে কলমে। আসলে সেও আমারই মতো অসহায়। রোজ রোজ সেই স্বাধীন দেশটাকে আমারই মতো লজ্জা আর ঘৃণা চেটে নিতে হয় নানান ছুতোয়। নিজের সন্তানসম এক দঙ্গল বুভুক্ষু নিয়ম করে তাকে অপমানে অপমানে বিদ্ধ করে। লাল সবুজ পতাকার আবির্ভাবের মহান রক্তক্ষয়ী ইতিহাসকে বিকৃত করে।
দেশের কী অনুভূতি আছে? সে কী বুকের ভেতর আমারই মতো করে কষ্টগুলো পুষে রাখে? নাকি অসহায় মাটির তৈরি দেবতার মতো কেবলই দেখে যেতে শিখেছে? কেঁদে যেতে শিখেছে? দেশ নাকি মায়ের মতো? তবে? তবে সন্তান হয়ে আমরা কিভাবে পারি তাকে অপমানে বিদ্ধ করতে! আমরা কেবলি অবয়ব পেয়েছি হয়ত, মানুষ হতে পারিনি। নইলে কী উপায়ে সম্ভব হয় সন্তান দ্বারা মায়ের অপমান?
প্রশ্ন আসতেই পারে, এত যে বড় বড় কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছো, তুমি কোন কাজে লাগছো দেশের? এবেলায় মুখে কুলুপ! এবেলা ভীষণ রকম চুপ। আমি ভীষণ রকম স্বার্থপর ভাবে কেবল নিজেই সুখী থাকতে ভালোবাসি। আমার কী আসে যায় দেশের কথা ভেবে! দেশের নানা সংকট-সংগ্রামে আমি তো বুক চিতিয়ে রাজপথে গিয়ে দাঁড়াই না। যাঁরা বুক দিয়ে দেশের সংকট সংগ্রামে দাঁড়িয়েছেন, দাঁড়ান, সাড়ে তিন হাত মাটির অধিকার টুকু চেয়ে নিয়ে দেশটা তাঁদের নামেই দিয়ে দিলাম। দেশ নিয়ে আমার ভাববার অধিকার নাই। ভাবতেও চাই না। কাঙ্গাল মন যেন কোনো ভাবেই মুখ ফসকে বলে না ওঠে, ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ সেদিকে কড়া পাহাড়া বসিয়ে দিলাম। নাহ্ আর ভাববো না দেশ নিয়ে…. দেশ আমাকে খাওয়ায় না পরায়! দেশ আমার কথা ভাবে নিশিদিন? আমি তো তার কাছে কেউ নই আর। কেবল মুখ ফুটে ঐ সহকর্মীর মতো বলেনা কেউ, এদেশ তোমার নয়। কারণ দেশে গেলে আমি ঠিক তেমন অভ্যর্থনাই পাই, যেমন পেয়ে থাকে একজন ভীনদেশী আগন্তুক। আমার উপস্হিতির উদ্দেশ্যে বহুদিন পর দেখা হওয়া প্রায় সবার মুখের প্রথম বুলিই থাকে, ‘কবে এলে? ফিরছো কবে?’ স্বদেশীদের কাছে এখন আমি যেন কেবলই শীতের পাখি। মেয়াদ ফুরোলেই ফেরার পালা তাই। বুকের ভেতরের অসহায় মানুষটা মনে মনে বিড়বিড় করে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের ব্যর্থ প্রয়াস চালায় তবুও…..
“আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পালে স্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা -
সারা দেশে।”
বাচ্চা ছেলের অভিমান নিয়েই তাই দূরে আছি, সুখেই আছি। আমার কোন দেশ নাই, এই বোধকে দানা পানি দেই যত্ন করে।
তবুও তাতানো দুপুর গড়িয়ে একটা শান্ত বিকেলকে বুকে নিয়ে যখন গোধূলি বিষন্ন রাজকীয়তায় শিশিরের শব্দে নেমে আসতে থাকে,
বুকের ভেতর কাঙ্গালপনা কেন এভাবে ছলকে ওঠে! কেন ছন্নছাড়ার মতো তার জানতে ইচ্ছে করে-
“কতদিন বুকে মাখনি স্বদেশ?
বহুদিন হলো মরে বেঁচে থাকা
এই শূন্যতা হলোনা তো শেষ!"
----------------------------------------------------------------------------------
লেখাটা প্রিয় Gita Das দিদিকে উৎসর্গ করলেম।