জলচোর - অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়


জলচোর - অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

মেয়ে দুটো যায় কোথায়? কে জানে কোথায় যায়। তামাটে অন্ধকারে বিবর্ণ মেয়ে দুটো হেঁটে যায়। কেউ কোনও প্রশ্ন করে না। তবে যখন-তখন মানুষজন সুযোগ পেলেই তাড়া করে। থাকে খালপাড়ের বস্তিতে। বস্তি উচ্ছেদ হবার কথা। বস্তি উচ্ছেদ হলে কোথায় যে যাবে!
কী হবে অত সব ভেবে। কেউ কারও জন্য ভাবে না। যে যার তালে আছে। কিশোরী মেয়েটি বড়ো হতে হতে এই সার বুঝেছে। কেউ চেনে না, কোথায় থাকে, কী খায়। কেউ জানে না বললে ঠিক বলা হবে না—সহদেব জানে। বন অফিসের গৌরাঙ্গ চেনে, আরও অনেকে। সারাদিন রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে যা হয়। ন্যাড়া মাথা, ফ্রক গায়, লম্বা এক কিশোরী আর তার কনিষ্ঠ বোন কাজল, কাজলের হাত ধরে সাঁজ লাগার আগে গাছপালার ছায়ায় তারা দুন্ঠজনেই আকাশে তারা খুঁজে বেড়ায়।
আকাশে তারা খুঁজে পেলেই তারা হাঁটে।

অন্ধকার তাদের বড়ো প্রিয়। অন্ধকারে মিশে গেলে কেউ টেরই পায় না, শিল্পা আর কাজল বাবুদের বাগান থেকে অথবা বাবুদের কিছু উচ্ছিষ্ট খাবার, যদি কেউ দয়া করে হাতে দেয়, সহজেই কোঁচড়ে লুকিয়ে বস্তির ঝুপড়িতে ঢুকে যেতে পারে। সারা শহরের দেয়ালে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে অজস্র ভোটের প্রচারপত্র উড়ছে—অন্ধকারে সেই সব প্রচারপত্র সহজেই বস্তার ভিতর ঢুকিয়ে দিতে পারে আর আড়ালে এই সব চুরিচামারি-সহ জলের জন্যও সকাল-বিকেল লাইন দেয় তারা।
শেষ পর্যন্ত খালপাড়ের বস্তি উচ্ছেদ হয়। কাজল আর শিল্পাকে নিয়ে তার বাবা-মা খালের ও-পাড়ে আস্তানা খোঁজে। আস্তানা পেয়েও যায়। বাড়িউলির একটাই শর্ত, কাজলের মাকে কাগজকুড়ানি হলে চলবে না। কাজলের বাবাকেও নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি করলে বস্তিতে ঢুকতে দেওয়া হবে না। আর কী করা, সেই শর্তেই রাজি। বাড়িউলি শাসায়, এটা বাবা খালপাড়ের বস্তি পাওনি, এটা হানাপাড়ার বস্তি। লাইনের কলে জল আসে, ইলেকট্রিকে বাতি জ্বলে—হুসহাস অট্টসুহাস হয়ে যাও ক্ষতি নেই—আসলে খোলা নর্দমার অন্ধকারে মলমূত্র ত্যাগের যথেষ্ট সুবন্দোবস্ত আছে। এত সুবিধে কি খালপাড়ের বস্তিতে আছে।
শিল্পার বাবা বিজয় মাথা নাড়ে, তা ঠিক।
কাজলের মা মালিনীও মাথা নাড়ে—মাসিমা ঠিক বলেছেন, জঙ্গল ছাড়া খালপাড়ের বস্তিতে কোনও আব্রু ছিল না। আমার মেয়ে দুটোকে কাগজকুড়ানির বেটি কয়, গাইল্যায়, শিল্পা তো বড়ো হয়েছে, কাগজকুড়ানির বেটি বললেই সে হেস্তনেস্ত করে ছাড়ে। বড়ো চণ্ড রাগ, একদম বুঝদার না। যেখানে সেখানে জঙ্গলে ঢুকে কম্ম সারতে হয়।
টালির ঘর, পাকা মেঝে, সুইচ টিপলে আলো, শুধু কল টিপলে জল পাওয়া যায় না। বস্তি এলাকাতে একটি মাত্র টিউকল, কবে থেকে খারাপ হয়ে পড়ে আছে। বস্তির ঘরগুলিতে লাইনের কল থেকে জল আসে। জলের চাপ খুবই কম, ফলে জলের খুব আকাল। তায় আবার চৈত্র-বৈশাখের রোদের তেজ—তাপে ভাপে সব পুড়ে যাচ্ছে।
সকাল থেকে লাইনের কলে মারকাটার ভিড়, ঘটি বাটি জেরিক্যান প্লাস্টিকের বালতি যার যা আছে হাজির—তারপর কে আগে কে পরে, কার লাইনে কে ঢুকে গেছে এই নিয়ে বচসা, মারামারি ভাঙচুর—নিত্য এই এক আগুনজ্বলা গ্রীষ্মে দাবদাহের মতো সবাই জ্বলছে।
শিল্পা, কাজল দুই বোন খুব খুশি, কারণ তারা আর কাগজকুড়ানির বেটি নয়। এখানে উঠে এসে তাদের ইজ্জত বেড়েছে, তার মা-বাবা বিজয় আর মালিনী সকালে বের হয়ে যায়, রাত করে ফেরে। নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি করে তারা কাগজ কুড়ায় দেখলে কে বলবে! ছুতার মিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, যোগাড়ে, প্লাম্বার মিস্ত্রিদের এই বস্তিটায় শিল্পা আর কাজলকে কাগজকুড়ানির বেটি বলে কেউ হাঁক দেয় না। শুধু জলের আকাল ছাড়া বস্তিটা বড়োই সুবন্দোবস্ত হয়ে আছে তাদের কাছে। বাবা-মাও কোনও এক পুকুরে ডুব দিয়ে আসে, তারাও চলে যায় হেঁটে হেঁটে—বালির পুকুরে ডুব দিয়ে আসে—কিন্তু উপার্জন বাড়ে না। একটা ঘরের ভাড়া দিতেই উপার্জনের সব টাকা প্রায় উড়ে যায়।
খালপাড়ের বস্তিতে লুকিয়ে চুরিয়ে কিংবা হাতসাফাইয়ের উপার্জন থেকেও তারা বঞ্চিত। খালপাড়ের গাছপালার পাহারাদার গৌরাঙ্গদার সঙ্গেও আর দেখা হয় না, দেখা হলেই, এই শিল্পা আয়। শোন। চা বিস্কুট খাবি? চিনাবাদাম খাবি? ফুলুরি খাবি! কাজল ছুটে পালাত। —দিদি যাস না, লোকটা ভালো না—তোর গায়ে পায়ে হাত দেবে। ক্ষুধার তাড়নায় শিল্পা বেচাল, গায়ে পায়ে হাত দিলে কিংবা ফ্রকের নীচে, সে যে আরামই পায়। তবে বস্তি এলাকাতে কিংবা দূরের কিছু এলাকায় জল পৌঁছে দিলে, জেরিক্যান পিছু আট আনা এক টাকা উপার্জন হয়। এই এক কৌশল, কিন্তু রাস্তার কলে বাড়িউলি সব সময় একটা নল লাগিয়ে রাখে। প্রভাব প্রতিপত্তি থাকলে সব হয়।
জল চাই, জল জল করে দুই বোন হন্যে হয়ে ঘুরছে—খালপাড় হয়ে বৈশাখীর ঘেরা পাড়ে কল আছে, কিন্তু সেখানে দু বোনের এই প্রখর রোদে যাওয়াই কঠিন, তবে তারা ছুটে যায়, কারণ তারা ছুটে না গেলে অত দূরে জলের নাগাল পায় না, তারপর সারিসারি জলের লাইন তো আছেই। কী যে করে। সর্বত্র জলের হাহাকার।
আর এ-সময়েই কাজল ডাকল, দিদি রে।
শিল্পা বলল, কী?
ওই দ্যাখ। জলের ট্যাংকি!
কার?
বাবুদের।
তাদের ঘর পার হয়ে, কিছুটা বনজঙ্গল পার হয়ে গেলে পাঁচিল। হলুদ রঙের বাবুদের বাড়ি। একতলার ছাদে জলের ট্যাংকি। ট্যাংকি থেকে সোজা বাবুদের কলতলায় পাইপ—কল খুলে দিলে জলের ছড়াছড়ি।

তারকবাবু বাড়ি ফেরার পথে দুধের ডিপো থেকে দু-প্যাকেট দুধ নেন। সঙ্গে থাকে দিনরাতের কাজের লোক সরজু। আজ খেয়াঘাটের সহদেবকে বলেছিলেন, দুধের প্যাকেট সে যেন তুলে রাখে। অনেকটা আজ হেঁটেছেন। সকালে সময় পান না বলে বিকেলে, এই সল্ট লেক এলাকায় খেয়া পার হয়ে চলে আসেন। তারপর হাঁটেন। যতদূর খুশি হাঁটা যায়। এই শহরটায় মানুষজন কম। গাড়িঘোড়ার উৎপাত কম। দুর্ঘটনার ভয় কম। প্রশস্ত রাস্তা ধরে নির্বিঘ্নে হাঁটা যায়। খেয়াঘাটে হাঁটার শুরু ফুটব্রিজে শেষ। এভাবে দু-বার হাঁটলেই দুক্রোশ হয়ে যাবার কথা। হিসাবের বাইরে কিছুটা বেশি রাস্তা হেঁটে ফেরার সময় মনে হল, আজ একটু তাঁর বেশ দেরিই হয়ে গেছে। বেশ রাত হয়ে গেছে।
খেয়াঘাটে ফিরে দুধের প্যাকেট সহদেবের কাছ থেকে নেবার সময়ই দেখলেন, সেই ন্যাড়া মাথার মেয়ে দুটো চুটিয়ে ঝগড়া করছে। চারপাশে জনমজুরের ভিড়। খাল সংস্কার হচ্ছে—ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি উঠছে। দু-পাড়ে মাটির পাহাড়।
এই শিল্পা, পয়সা দিলি না? সহদেব চেঁচাচ্ছে।
আমাদের পয়সা লাগে না। শিল্পার নির্বিকার জবাব।
পয়সা লাগে না! দাঁড়া দেখাচ্ছি।
সহদেব এ-পাশে বসে সাঁকো পারাপারের পয়সা নিতে নিতে বলল, দেখলেন বাবু, মেয়েটার কী তেজ!
তেজের কী দেখলে, কবে পয়সা দিয়েছি বলো! পয়সা দেব না। শিল্পা দৌড়ে চলে যাচ্ছিল। সহদেব খাঁচা থেকে নেমে একলাফে মেয়েটার হাত ধরে ফেলল।
সাঁকো পার হতে গেলে চার আনা পয়সা লাগে। মেয়ে দুটো ঠায় দাঁড়িয়ে পয়সা নিয়ে অবলীলায় ঝগড়া করছে। —হাত ধরলে কেন, গায়ে হাত দিলে কেন?
তারকবাবু বললেন, দাও, প্যাকেট দাও। দেরি হয়ে গেছে। বাড়ির লোক চিন্তা করবে।
ততক্ষণে আরও সব লোকজন জমা হয়ে গেছে। এরা ঘাটেরই লোক। পয়সা তোলে। মেয়ে দুটো পয়সা দিচ্ছে না, অথচ যথেষ্ট রোয়াব।
আমি তোর হাতে হাত দিয়েছি? সহদেবের কেমন মিনমিনে গলা।
দিয়েছ তো।
এত ইজ্জত কাগজকুড়ানির মেয়ের! আজ তোদের দুটোকেই বেঁধে রাখব, দাঁড়া।
কাগজকুড়ানির মেয়ে, তো তোমার বাপের কী! আমরা কাগজকুড়ানির মেয়ে! তুমি কী! মেথর ডোম মুচি। হাত ছাড়ো বলছি। গাছের মরা ডাল, কুকুর বেড়ালে পেস্যাব করে তোমার মুখে।
তারকবাবু মেয়ে দুটোকে চেনেন, তার একতলা বাড়ির পাশে ইদানীং একটা ছোট্ট বস্তি গজিয়ে উঠছে। বস্তিতে মেয়ে দুটো নতুন আমদানি। লাইনের কলে জল এলে হাতে জেরিক্যান না হয় বালতি—লাইন দিয়ে সকাল বিকাল দাঁড়িয়ে থাকে।
তোর মা বাবা তো কাগজ কুড়াত, এত ইজ্জত থাকলে পয়সা না দিয়ে সাঁকো পার হতেছিস ক্যানে?
বলছি না, পয়সা আমাদের লাগে না। কবে পয়সা নিয়েছ বলো?
তা ঠিক। সহদেব মনে করতে পারে মালিনী সুঠাম সুন্দরী না হলেও গায়ে গতরে যে কোনও পুরুষকেই লোভে ফেলে দেবার মতো। মালিনী থাকত বাপের সঙ্গে। বুড়োর কাশির ব্যামো। বাবুদের বাড়ি কাজ করে তখন মালিনী বুড়ো বাবাকে খাওয়াত। দু-দুবার বাবুরা তাকে গর্ভবতী করেছে। শিল্পা, কাজল আরও দু-তিনটে—তবে বাঁচল না, মরে গেল। বিজয় বাউণ্ডুলে মানুষ। ছেঁড়া চটের বিশাল ব্যাগটা মাথায় করে সে চলে আসত, এবং পয়সা কড়ি দিয়ে মালিনীকে হাত করেছিল—তারপর দুন্ঠজনেই কাগজকুড়ানির কাজে লেগে গেল।
মালিনীর সুবিধা অসুবিধায় সে নিজেও তাকে পয়সা দিত—সেই পয়সা গায়ে গতরে উশুল করা ছাড়া তার উপায়ও ছিল না। দেশে বউ ছেলে মেয়ে পড়ে থাকলে, সেই বা যায় কোথায়।
সেই এক অষ্ট প্যাঁচ।
তারকবাবু দেখলেন, এখানে আর তাঁর থাকা ঠিক হবে না। তিনি বললেন, আমি যাচ্ছি সহদেব।
না বাবু আপনি থাকেন। মেয়েটো আমাকে ফাঁসাতে চায়।
ফাঁসাতে! বলো গায়ে হাত দিলে কেন! আমার ইজ্জত নিলে কেন।
সহদেব ঠিক জানে না, মেয়েটা কার— মালিনীর চোখ দুটো বড়োই টানে তাকে। সেও তো মালিনীকে এককালে যথেষ্ট ভোগ করেছে। এই মেয়ে দুটো কার?
তারকবাবু বললেন, ছেড়ে দাও। আমি ওদের পয়সা দিয়ে দিচ্ছি।
কারণ তারকবাবু বুঝতে পারছেন, মেয়ে দুটোর পক্ষেও মানুষজন কথা বলছে।
না সহদেবদা, তোমার এটা উচিত কাজ হয়নি। তুমি কিন্তু ফেসে যাবে। আজকালকার আইন তো জানো না।

রাখ রাখ, আইন আমার দ্যাখা আছে। ওর মায়ের বেলায় আইন ছিল কোথায়! পয়সা না দিয়ে পালাচ্ছে ছুটে গিয়ে ধরেছি!
কেন ধরেছ? মেয়েটার চোখে যে ধার উঠে গেছে জানো না? ধার উঠে গেলে, মেয়েরা কী চায় পুরুষ কী চায় বোঝো না! এই, কোথায় যাবি চলে যা তোরা।
শিল্পা অনড়।
চোখমুখ শিল্পার জ্বলছে।
আমি কাগজকুড়ানির মেয়ে। জানো, আমরা খালের ওপারে বাসা ভাড়া নিয়েছি।
তখনই তারকবাবু বললেন, আমি তোদের চিনি। তোরা জলের জেরিক্যান হাতে ছোটাছুটি করিস। তোর বাবা কী করে? পাশের বস্তিতে তোরা থাকিস।
ও মা, তুমি সেই বাবু! তোমাকে চিনতেই পারিনি, এই কাজল বাবুকে প্রণাম কর, সে নিজেও সাস্টাঙ্গে তারকবাবুকে প্রণাম করতে এলে তিনি পা সরিয়ে নিচ্ছিলেন—আরে তোরা করছিস কী! ঠিক আছে, ঠিক আছে!
কাজল বলল, ক্যারে দিদি।
তুই কি রে। একতলা বাড়ির বাবু। মনে নেই জানালা থেকে বাবু তাড়া দিচ্ছিলেন, এই তোরা কে রে? জঙ্গলে ঘাপটি মেরে কী করছিস! হাতে জলের পাইপ কেন?
কাজল বুঝতে পেরে কেমন বড়ো বড়ো চোখ করে দেখল বাবুকে। বাবু কি টের পেয়েছে, ইদানীং তারা বাবুর লাইনের কলে প্লাস্টিকের পাইপ গুঁজে দেয়। টের পেলেই সর্বনাশ। বাবুর জলের ট্যাঙ্ক থেকে কলতলায় পাইপ নেমে এসেছে এটা প্রথম কাজলই টের পায়।
দিদিরে! কাজল চেঁচাল।
ফের কাজলের চেঁচামেচি—জল, জল, কত জল!
রাস্তার কল থেকে পাইপ গুঁজে কিংবা পাশের জমির মধ্যেও আছে জলের লাইন, এক কোণায় ইটের ঘর তুলে বাবুদের ড্রাইভার মহসিন কাকা বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে, সময়ে অসময়ে সুযোগ পেলে সেখানেও জলের পাইপ লাগিয়ে নিতে পারে তারা, তবে এই খরায় খা খা করছে সব, জলের চাপ নেই, মহসিন কাকার কল কিছুটা উঁচু জায়গায় বলে জলের চাপও কম—তবু কাকিমা ভালো মানুষ বলে, তাদের ডাক-খোঁজ করে—এই কাজল, এই শিল্পা, পাইপ লাগিয়ে দে তাড়াতাড়ি, জল কিন্তু চলে যাবে। এত জল দিয়ে তোরা কী করিস?
আর যা হয়, লাগিয়ে দিতে দিতেই শেষ। জেরিক্যান ভরে না, তার পর এই সারাদিন ধরে জল নিয়ে মারামারি চলে। তারা দুন্ঠবোন জেরিক্যান নিয়ে দূরে দূরেও চলে যেত, মাথায় করে জল নিয়ে আসত—তারপর কাজলের জলের ট্যাঙ্ক আবিষ্কার—সে যে কত বড়ো বিপাক থেকে রক্ষা, শুধু তারা দুন্ঠবোনই জানে।

এই এলাকাটা মানুষজন এত গিজগিজ করবে, তারকবাবু কস্মিনকালেও ভাবেননি। তাঁর বাড়ির পেছনে লাইনবন্দি কাঁচা-পাকা ইটের ঘর, ঝুপড়িও আছে। সরকারের খাস জমি হলে যা হয়। পার্টিরও মদত আছে। গরিবগুরবো মানুষ যাবে কোথায়। কাজেই তাঁর পেছনের বাড়িউলি সোহাগী বলতে গেলে পার্টির মদতে কাঁচা-পাকা ঘর তুলছে, আর ভাড়া বসিয়ে রোজগার বাড়াচ্ছে। সোহাগীর নিজেরও যথেষ্ট অভাব অনটনের সংসার। তারও দোষ দেওয়া যায় না। গু-মুতের গন্ধে তিনি নিজেও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। জলনিকাশি ড্রেনে গু-মুত ধুয়ে দিলে কেউ টেরও পায় না, চট দিয়ে অথবা পলিথিন ঘেরা এই মলমূত্র ত্যাগের ঝুপড়িগুলোর মানুষদের মলমূত্র কোথায় যায়! শুধু পরিবেশ দূষণ ছাড়া এদের আর কোনও অপরাধ আছে বলেও তিনি মনে করেন না।
আবার সহদেবেরও দোষ দেওয়া যায় না, ঘাটের ডাক নিতে সরকারের ঘরে পয়সা জমা দিতে হয়। পারানির কড়ি দিয়ে সরকারের পয়সা উসুল করতে হয়। সহদেব তার ভাই-বেরাদর মিলে মালিকের হয়ে ঘাট সামলায়। পয়সা উপার্জন না হলে সে-ই বা মালিককে কী দেয়, আর মাগ-ছেলে নিয়ে সংসারই বা করে কী করে!
সংসার এই এক অষ্টপ্যাচে মাতাল। ছেড়ে দাও। হুজ্জুত করে কিছু হবে না গরিব মানুষ, কোথায় যাবে!
তারকবাবুকে সহদেব সমীহ করে। তারকবাবু তার একতলার বাড়িতে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, নামযশ আছে—অসুখেবিসুখে সহদেবকে তাঁর কাছে আসতেই হয়।
না বাবু, আজ ছাড়ছি না। আমি ডোম, মুচি, মেথর। আরে তোরা কী। দিল তো তুলে। পারেনি রুখতে। খালের ধারে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকলি, কাগজ কুড়িয়ে বেড়ালি, খালের পাড়ে যতদূর দেখা যায়, ঝুপড়ি উঠছে তো উঠছেই। কেউ বাধা দিচ্ছে না। পুলিশ মাসোহারা পেলে কে আর বাধা দেবে বলুন! ওর বাপকে পইপই করে বলেছি, বিজয় এইসা দিন নেহি রহেগা। মেয়ে দুটোকে হতে দেখলাম, বড়ো হতে দেখলাম, খাল কাটা শুরু হল, উচ্ছেদ হয়ে কোথায় যে চলে গেল! আজ দেখি তেনারা হেলেদুলে নগর ভ্রমণে বের হয়েছেন! সাঁজ লেগে গেছে বাবু—তোরা কোথায় যাবি বল! সোমত্ত মেয়ে—
শিল্পা চিৎকার করছে, যেখানে খুশি যাব, তোমার ঘিলু ফাটে কেন। তুমি আমাদের কে? কাগজকুড়ুনির মেয়ে বলে গাল পাড়লে কেন? আমার গায়ে হাত দিলে কেন?
সহদেব বলল, ডাক্তারবাবু দেখছেন, মেয়ে দুটোর কী চোপা। আপনি সাক্ষী। আপনার সামনে সব ঘটেছে। বলুন পয়সা না দিলে কেউ ছাড়ে! আমাকে আইনের ভয় দেখাচ্ছে।
শিল্পা বলল, ভগবানের দিব্যি, কবে সাঁকো পার হতে তুমি পয়সা নিয়েছ বলো? বলো কেন আমার গায়ে হাত দিলে!
পয়সা নিইনি, কেন নিইনি জানিস না। তোর মাকে ডেকে আন। খালপাড় হয়ে তোদের পাখনা গজিয়েছে। ইজ্জত বেড়েছে। কাগজ কুড়ানির মেয়ে বললে গায়ে এখন ফোসকা পড়ে। হ্যাঁ এত বেইমান তোরা! আপদে-বিপদে কে দেখত তোদের বল! কত অকথা কুকথা বললি, লোকে মজা দেখছে—খালের এ পাড়ে ছিলি, নিজের মানুষ ভাবতাম। ও পাড়ে উঠে গেলি নিজের মানুষ কেন ভাবব বল!
মজা দেখবে না! তুমি কি ভালোমানুষ, বলো, তুমি ভালোমানুষ! পয়সা মাগনা দিয়েছ না! মা আমাকে সব বলেছে।
সহদেব চুপসে গেল।
তারকবাবু ভিড়টাকে বললেন, বাবারা আপনারা যান, কিছু হয়নি। সহদেবকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি—পয়সা না দিলে তার তো রাগ হবেই। পয়সা না দিয়ে পালালে তাকে ছুটে গিয়ে ধরলে দোষের না। তার তো হিসাবের কড়ি, সরকারের ঘরে জমা, মালিকের ঘরে জমা, পুলিশের কাছে জমা, এত জমার পরে এরা চার-পাঁচজন ভাগে আর কত পায় বলুন বাবারা! তারকবাবু ভাবছেন—শিল্পা শত হলেও কিশোরী, গায়ে গতরে কলাগাছ, গায়ে হাত দিলে অ্যাটেম্পট টু রেপ-ও হয়ে যেতে পারে। এই শিল্পা, তোর গায়ে সহদেব হাত দিয়েছে?
আজ্ঞে না বাবু।
সহদেব যেন পারলে তারকবাবুর পায়ে গড়িয়ে পড়ে। দিনকাল খারাপ—তারকবাবু জানেন, এই সেদিন তার এক কাছের মানুষ দেবীপদ বাসা ছাড়ছে না বলে বাড়িউলি সোজা থানায়— অ্যাটেম্পট টু রেপ বলে ডাইরি— পুলিশকে পয়সা খাওয়ালে যা হয় দেবীপদকে আটক করে সোজা আদালতের কাঠগড়ায়— আট দিনের হাজতবাসের পর ছাড়া পেয়েছে। বাড়িতে অশান্তি, দেবীপদ ছাড়া পেয়ে নির্বাক হয়ে গেছে। সারাদিন অন্ধকার ঘরে বসে থাকে—কারও সঙ্গে কথা বলে না।
তারকবাবু বেশ ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, তবে যে তুই বললি গায়ে হাতে দিয়েছে!
বলব না। সবার সামনে আমার ইজ্জত নিলে আমার রাগ হয় না। আমাকে কাগজ কুড়ানির মেয়ে বলে গাইল্যায়! আমার রাগ হয় না বাবু!

চারপাশে জলের যতই হাহাকার থাকুক, তারকবাবুর বাড়িতে সবসময় জল। লাইনের জল তো আছেই— বাড়িতে ডাবল সিলিন্ডারের মোটর ফিট করা টিউকলও আছে। বাড়িটায় মানুষজন মেলা, লাইনে জল নেই তো টিউকল চালিয়ে জল তুলে ফ্যালো রিজার্ভারে।
পৈতৃক বাড়িতেই তারকবাবু থাকেন, একসময় বাজারের মুদিখানায় বসতেন, ভাইপোরা লায়েক হয়ে গেলে তিনি আর সেদিকে যান না। সংসারে তিনি একা মানুষ, তবে কী যে হয়, সংসারের সুবিধা অসুবিধার সঙ্গে তিনিই জড়িয়ে গেছেন। ভাইপো ভাইঝিরা তাঁর অভিভাবকত্বেই মানুষ। দাদা বৌঠানও বেঁচে নেই, ছোটো ভাই মৃদুলকে বছর দুই হল দোকানেই জুড়ে দিয়েছেন, তার কথা ছাড়া এ-বাড়ির কুটোগাছটিও কেউ নাড়তে সাহস পায় না।
একতলা বাড়িটায় মেলা ঘর, দুটো বাথরুম, জল চাই—কত যে জল লাগে— দোকানের কাজের লোকেরাও থাকে, তার ডিসপেনসারিতে যে ছেলেটা কাজ করে, পুরিয়া বানায়—এবং তাঁর নির্দেশ মতো ওষুধ দেয়, সেও থাকে। সুতরাং সেই বাড়ির কেউ যদি সকাল বেলাতেই এসে খবর দেয়, কাকা চাবিটা দাও, রিজার্ভারে জল নেই। এক্ষুনি টিউকল থেকে জল তুলতে হবে। সাতটা না বাজলে লাইনে জল আসবে না।
বাড়িটায় জলের খুব অপচয় হয় বলে, তিনি টিউকলের চাবিটি নিজের কাছে রাখেন। হিসাব করে বিকেলের দিকে টিউকল থেকে জল তোলেন। লাইনের জলে রিজার্ভার যাতে ভর্তি থাকে, সে-জন্যই এই সতর্কতা। তা ছাড়া রোজ পনেরো বিশ মিনিটের জন্য টিউকল থেকে জল না তুললেও চলে না—অব্যবহারে টিউকলটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
সবে ঘুম থেকে উঠেছেন তিনি। ভাইঝি বীথি এসে হাজির। সেই খুব সকালে ওঠে, কারণ তাকে বাস-ট্রেন ঠেঙিয়ে সকালে কলেজ করতে হয়। বছর দুই ধরে সেখানে সে পার্টটাইম করছে। দুন্ঠবারের বার বীথি স্লেট ও পেয়ে গেছে। শিগগিরই ফুল টাইম চাকরি হয়ে যাবে। খুবই মেধাবী এবং পরিশ্রমী, আর ঠিক তখনই তিনি কেন যে সেই কিশোরী মেয়েটির মুখ সামনে ভেসে উঠতে দেখলেন— কাজলের হাত ধরে শিল্পা জঙ্গলের দিকে ছুটছে। হাতে সেই লম্বা প্লাস্টিকের পাইপ, তারা জল খুঁজে বেড়াচ্ছে।
জল নেই কেন? তারকবাবু যেন ভারি বিড়ম্বনায় পড়ে গেছেন।
বীথি বলল, যা বাড়ি, কে কোথায় কল খুলে রেখেছে। চাবিটা শিগগির দাও, আমার লেট হয়ে যাবে।
তা হতে পারে, রান্নাঘর, বাথরুম, ডাইনিং স্পেস, বারান্দায় সর্বত্র বেসিনের ছড়াছড়ি। কার গোয়াল, কে বা দেয় ধোঁয়া। এজমালি সংসারে যে রকমটা হয় আর কি!
কেউ কল খুলে রাখতেই পারে। সারা রাত ধরে জল পড়লে রিজার্ভারে আর জল থাকে কী করে?
বীথিকে চাবিটা দিয়ে তিনি সব বেসিনের কল ঘুরিয়ে দেখলেন, না সবই ঠিক আছে, কোনও কলই খোলা নেই—সব কলই বন্ধ। বিকালে রোজই ফুলট্যাংকি করে রাখেন, কালও রেখেছিলেন, ছাদে ইটের গাঁথনি দিয়ে বিশাল রিজার্ভার, একবার সকালে ভরে রাখলে যত লোকই থাকুক সারাদিন অপর্যাপ্ত জল। অধিকন্তু দোষায় বলেই বিকেলে জল তোলেন ফের। যা জলের হাহাকার চলছে, কখন কী ঘটবে, জল নেই, মাটির নীচেও জল নেই—জল না থাকলে যে কী অপরিসীম কষ্ট, বস্তির মেয়ে দুটোকে দেখে টের পেয়েছেন।
সবই ঠিক আছে, তবু এত জল গেল কোথায়। কোনও কলেরই মুখ খোলা নেই। নীচের রিজার্ভারও খালি। বাড়ির পেছনের দিকেও একটা জলের কল আছে, অবসর সময়ে তিনি একটি ফুলের বাগানও তৈরি করেছেন, নানা জাতের ফুল, পাইপ লাগিয়ে সরজু বাগানে জল দেয়। ঠিকা কাজের মেয়েটিও বাইরের কলটি কাঁড়ি কাঁড়ি বাসন ধোওয়ার জন্য ব্যবহার করে— ছাদ থেকে সোজা একটি পাইপ নামানো আছে— ট্যাংক থেকে জল নিলে পাইপের মুখে জলের চাপ বাড়ে, তারপর বাড়ির নালা-নর্দমা সাফ রাখার জন্য প্রচুর জলের দরকার হয়।
জল না থাকলে কী অশান্তি সৃষ্টি হয় তাও তিনি জানেন। এত জলের সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও জল নিয়ে ত্রাসে আছেন বলেই বাধ্য হয়ে ডাবল সিলিন্ডারের দুশো ফুটের একটি নতুন কল আট-দশ বছর আগে করে রেখেছেন। একশ ফুটের কলটি তুলে দুশো ফুটের নতুন কল বসিয়ে নিশ্চিন্তই ছিলেন— তবে যা অবস্থা যে ভাবে চারপাশে হাইরাইজ ফ্ল্যাটবাড়ি হচ্ছে, তাতে করে শেষ পর্যন্ত দুশো ফুটের জলের লেয়ারটিও যে ঠিকঠাক থাকবে বলা যাচ্ছে না। গভীরতম গভীর নলকূপ বসিয়ে যদি জল না মেলে কী যে হবে—আসলে তারকবাবু এই সব দুশ্চিন্তায় প্রায়শই ভোগেন। চৈত্র-বৈশাখে জলের আকাল এমনিতেই থাকে, কিন্তু এবারে যেন হাহাকার একটু বেশি মাত্রায়। ভালোয় ভালোয় বর্ষা নামলে ভাববেন, দুশো ফুটের কলটিকে চারশো ফুটের লেয়ারে ঢুকিয়ে দেবেন।
তারপর!
তারপর আটশ ফুটের লেয়ারে।
তারপর?
কোথাও জল পাওয়া যাচ্ছে না।
তারপর, তারপর কী হবে!
বাড়ির মানুষজন বুঝবে না। জল অপচয় করলে আখেরে আর জলই পাওয়া যাবে না। জল নিয়ে সবাইকে পস্তাতে হবে।
বাড়িটায় তিনি কিছুক্ষণ হম্বিতম্বি করে বেড়ালেন—এক বালতি জলে স্নান সারতে হবে, এমনও ফরমান জারি করলেন, তবু কেন যে দ্বিধায় আছেন, কাল বিকেলে ট্যাংক ভর্তি করে রেখেছেন, অথচ সকালে খালি।
ফের মেয়ে দুটোর মুখ ভেসে উঠল, হাতে জেরিক্যান। হাতে, কলে নল লাগিয়ে জল তোলার পাইপ, যদি তাঁর ট্যাঙ্ক থেকে তারা জল চুরি করে, করতেই পারে—কলতলার দিকে যদি রাতে ট্যাংকের পাইপের মুখে নল ঢুকিয়ে কল ছেড়ে দেয়—তবে হড়হড় করে জল সব নেমে যাবে, তিন-চার মিনিটে বালতি, জেরিক্যান ভরে যাবে, এক বালতি জল যদি বস্তিতে এক টাকায় বিক্রি হয়, তবে মেয়ে দুটোর অনেক পয়সা হয়ে যায়—সারাদিন জলের ধান্ধায় যে কেন ঘোরে, এতক্ষণে যেন সব টের পেলেন।
কলতলার শেষ দিকটায় তাঁর পাঁচিল—পাঁচিলে সারি সারি পেরেক পোঁতা, চোরের উপদ্রব থেকে বাড়িটাকে রক্ষা করার জন্যই এত বেশি সতর্কতা—ইতিমধ্যে পাঁচিলের এক জায়গায় কাঠ কিংবা ইট দিয়ে পিটিয়ে পেরেক সব সমান্তরাল করে রেখে গেছে কেউ। এই বাড়িটা এমন যে, ঢুকে গেলে বের হবার রাস্তা থাকে না, চোরেদের বুদ্ধির দৌড় তাঁর চেয়ে বেশি, পাঁচিলের প্লাস্টার খসিয়ে মেরামতেরও দরকার ছিল, হবে হচ্ছে করে বছরখানেক পার হয়ে গেল—সেই জায়গাটা দিয়েই শিল্পা ঢুকছে, কোনও গাছের ডালে কিংবা পেয়ারা গাছও আছে একটা, তার উপর উঠে কলতলায় ঢুকে মধ্যরাতে কল থেকে জল চুরি করা খুবই সহজ। —তিনি হেঁটে গিয়ে সব দেখলেন, তারপর পাঁচিলের উপর দুটো আলগা ইট রেখে দিলেন, অন্ধকারে কেউ ঢুকলেই হাতে লেগে ইট পড়ে গেলে জখম হবে, অথবা শানের উপর ইটের শব্দে তিনি জেগে যাবেন—এমনই সব ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলেন—জল চুরি বন্ধ না করলে, সকালে আবার ট্যাংক খালি।

হলও তাই, তবে দু-দিন পরে। ইটের জায়গায় ইট ঠিকই আছে, মেয়ে দুটোর উপর তিনি ক্ষেপে যাচ্ছিলেন। কাগজ কুড়ানির মেয়ে বলায় কী তেজ। সহদেবকে ফাঁসাতে পর্যন্ত চেয়েছিল, মেয়েদের গায়ে হাত দিলে পুরুষমানুষের যে হাজতবাস হয় সে খবরও শিল্পা রাখে বোধ হয়।
জোর করে মেয়েমানুষের গায়ে হাত দিলে অ্যাটেস্পট টু রেপ হয়ে যায় শিল্পা মণি পিসির টিভি থেকে জেনে ফেলেছে বোধ হয়।
পাড়ায় চায়ের দোকান মণির সঙ্গে যে শিল্পার সবিশেষে ভাব আছে তারকবাবু তা টের পেয়েছেন।
তোর সঙ্গে আলাপ হল কী করে? এইতো সেদিন বস্তিতে উঠে এল। মণিকে কথায় কথায় মেয়ে দুটো সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন।
বা রে, ওর বাবা-মা আমার দোকানে চা খায়—আমার দোকানে জল সাপ্লাই করে। রাতে সুযোগ পেলে দুন্ঠ বোন গিয়ে আমার ঝুপড়িতে বসে থাকে, টিভি দ্যাখে। আমি তো সব জানি।
ওর বাবা মা কাগজ কুড়ায়?
তা জানিনে। বলে না কিছু। আমার ব্যাটার গায়ে কী সব—
তোর ছেলের জামা খোল। আরে সারা গায়ে ঘা। এত পাঁচড়া! বস, ওষুধ দিচ্ছি।
তা হলে সহদেব মিছে কথা বলেনি। মেয়ে দুটোকে রেখে বাবা-মা বের হয়ে যায়। স্নান মণির বাড়িতেই হয়তো তারা সারে—এই বস্তিতে যখন ঢোকে, কেউ টেরই পায় না, শিল্পার বাবা-মা সারাদিন কাগজ কুড়ায়। এই বস্তিতে উঠে আসায় শিল্পা মনে করে তাদের মান সম্মান বেড়েছে। কেউ জানেই না, তারা কাগজকুড়ানির মেয়ে। উচ্ছেদ হওয়া খালপাড়ের আস্তানায় একরকম, আর বস্তিতে বাসা ভাড়া নিলে তাদের কাগতাড়ুয়া বলে এমন সাহস কার! শিল্পা নিজেও দু-চার টাকা উপার্জনের ধান্দায় আছে। জল বেচে টাকা হয়, ওই বস্তিতে উঠে এসে টের পেয়েছে।
মাঝে মাঝে ট্যাংক সকালে খালি করে দিলে কার না রাগ হয়! এত ইজ্জত তোর, কাগজ কুড়ালে ইজ্জত যায়! জল চুরি করলে ইজ্জত যায় না, না! দাঁড়া মজা দেখাচ্ছি। কারণ তারকবাবু রাতে পাহারা দিয়েও ধরতে পারছেন না । কলেরই মুখ বন্ধ করে দিতে পারেন, কিন্তু জমাদার এসে জল পাবে কোথায়, বাগানেই বা সরজু জল দেবে কী করে!
তিনি তবু সরজুকে বললেন, প্লাম্বার মিস্ত্রি ডেকে কলটা খুলে ফেল। দেখি জল চুরি যায় কী করে!
সরজু আমতা আমতা করে বলল, বাবু, খুলে ফেললে বাসনকোসন ধোওয়ার জল পাবে কোথায়, জমাদার জল পাবে কোথায়?
লাইনের জলে যেটুকু হয় হবে। তুই খুলে দে। ট্যাংকের পাইপের মুখ সিল করে দে। দেখি হারামজাদি মেয়ে দুটো জল পায় কোথায়।
হলও তাই। সরজু মিস্ত্রি এসে কলপাড়ের ট্যাংকের পাইপ সিল করে দিয়ে গেল। জল চুরির আতঙ্কে তারকবাবুর অনিহা রোগ—কলের মুখ খুলে ফেলায়, পাইপের মুখ সিল করে দেওয়ায় এখন তিনি মনে মনে ফুরফুরে জ্যোৎস্নায় বিচরণ করেন, বোঝ এবার—হলে কী হবে বিকালবেলায় হাঁটতে বের হলে বোঝেন সত্যি জলের আকাল কত—লাইন দিয়ে সারি সারি পেতলের কলসি, প্লাস্টিকের বালতি, মেটে হাঁড়ি, পলিথিনের জেরিক্যান মানুষজন, ভিড় বচসা মারামারি—চুল ধরে টানাটানি—তার উপর চারদিন হয়ে গেল ডিপটিউবেলের মোটর খারাপ হয়ে গেছে বলে লাইনেও জল নেই—মেরামতির কাজে এসে বড়ো মিস্ত্রির জবান, জল নেই, সার। লাও ইবারে ঠ্যালা বোঝো!
জল নেই। ফেরার সময় দেখেন কাজলের হাত ধরে শিল্পা এই ত্রিসন্ধ্যায় কোথায় রওনা হয়েছে। চুল উসখো খুসকো, ফ্রক ছেঁড়া কপাল ফোলা, হাতে ব্যান্ডেজ, জলের লাইনে মারামারি করে শেষে এই দুর্দশা—কেমন মায়া হল তাঁর। কী রে হাতে কী হয়েছে।
মেরেছে।
কারা?
বাবুরা।
কেন মারল?
জল চুরি করি বলে।
তোরা জল চুরি করিস।
করব না, দেখুন না বাবু কী হয় আপনাদের। তেষ্টায় আমাদের মরণ, আপনাদেরও মরণ হবে একদিন। কেউ বাদ যাবে না।
তোরা যাবি কোথায়? সাঁজ লেগে গেছে। ওলাওঠা দেবীর কাছে। শীতলা মন্দিরে যাব।
শিল্পা বলল, তিনি আমাদের ঠাকুর-দেবতা। খিদে পেলে খেতে দেয়, জল লাগলে জল দেয়, যা চাই দিয়ে দেয়। দেবীর এক কথা, এত তার খাবে কে! সে একলা খেলে চলবে কেন—সবাইকে দিয়ে থুয়ে, মানুষজন বাঁচিয়ে না রাখলে দেবী যে একা হয়ে যাবে! আমরা দেবীকে পাখি প্রজাপতি ধরে দি! দেবী এতেই খুশি।
কোথাকার কোন দেবী, তার কথায় তারকবাবুর কেমন হুঁশ ফিরে এল। সবাইকে বাঁচিয়ে না রাখলে, মানুষ নিজেও তো বাঁচে না। সবাইকে দিতে না পারলেও এ দুটো মেয়ের জলের তেষ্টা তিনি সহজেই নিবারণ করতে পারেন—
তিনি ডাকলেন, এই শোন।
কে শোনে কার কথা! দৌড় দৌড়। মেয়ে দুটো মুহূর্তে খালপাড়ের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আজও ফিরতে তারকবাবুর রাত হয়েছে। কেন যে মনে হল শীতলামন্দির ঘুরে যাবেন। অনেকদিন যাওয়া হয়নি। শত হলেও ওলাওঠার দেবী, দেবদেবীকে মান্য করতে হয়। আর মেয়ে দুটো যদি সেখানে যায়—জীবনের নানা কুহকে ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে হাঁটছেন, মেয়ে দুটোর কীই বা দোষ। কারা শিল্পার হাত ভেঙে দিয়েছে, ওরা নিমেষে পালালই বা কোথায়! খালের দুন্ঠধাকে বনজঙ্গলে, তাকে দেখলে শিল্পা কাজল আরও গভীর জঙ্গলে ঢুকে যেতে পারে—যদি মনে করে তিনি তাদেরই খুঁজে বেড়াচ্ছেন। জলচোর তারা। ধরে নিয়ে যদি বেঁধে রাখেন, কিংবা ঠ্যাং ভেঙে দেন।
আর তখনই দেখলেন, বনজঙ্গলের অভ্যন্তরে একটি জরাজীর্ণ টিনের চালার সামনে কাজল হাঁটু গেড়ে বসে। মন্দিরটি ধসে পড়েছে। দেবদেবীর প্রতি মানুষের যথেষ্ট অবহেলা—খালের মাটি তোলা হচ্ছে, মাটির অভ্যন্তর থেকে দেবীর মুখ যেন গজিয়ে উঠছে—খাল সংস্কার হলে এমনই যেন হবার কথা।
মাটির ঢিবিতে দাঁড়িয়ে কাজলকে বলছে শিল্পা—
বলো, মা আমাদের কী দোষ! আমার দিদির হাত ভেঙে দিয়েছে। ওদের তুমি শাস্তি দাও মা।
কাজল দিদির হয়ে নালিশ জানাবার সময় বলল, মা আমরা আর জন্মে যেন কাগজকুড়ানির মেয়ে হয়ে না জন্মাই। মা আমরা যেন আর জন্মে দুধেভাতে থাকি। আমাদের মা-বাবাকে দ্যাখো। মা বৃষ্টি দাও। গাছপালা মানুষজন সব পুড়ে যাচ্ছে মা। গাছপালা সব জলে ভিজিয়ে দাও। জল না থাকলে যে প্রাণ বাঁচে না মা। পাখি প্রজাপতিরা জল না পেলে মরে যাবে মা।
বল কাজল, তোর দিদির যেন সুন্দর একটা বর হয়। পরিবার পরিজন নিয়ে যেন সুখে ডালভাত খেতে পায়।

শিল্পা যা যা বর চাইল, কাজল তার হয়ে সব বর মেপে নিল দেবীর কাছে।
তারকবাবু অবাক। শিল্পা নিজে কিছু চাইছে না—কাজলকে দিয়ে বলাচ্ছে। তিনি প্রায় যমদূতের মতো কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, কী রে শিল্পা কাজলকে দিয়ে দেবীর কাছে বলাচ্ছিস, তুই নিজে বলতে পারছিস না।
শিল্পা কেঁদে ফেলল, আমিও ভালো না বাবু, আমি লুভি, পেটুকে, খালপাড়ের বাবু আছে না, গৌরাঙ্গদা, সে বাদাম ছোলা খাইয়ে শরীরে আমার কি খুঁজে বেড়াত—আমি বাবু আরাম পেতাম। দেবী কেন আমাকে বর দেবেন—আমি অশুচি না! আমি বর চাইলে দেবী রাগ করবে। ঠাকুর-দেবতা ছাড়া আমাদের যে কেউ নেই বাবু।

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট