সৃষ্টিশীলতার স্বরূপ অন্বেষণ - জেমস বল্ডউইন | অনুবাদ - আশফাক স্বপন

সৃষ্টিশীলতার স্বরূপ অন্বেষণ - জেমস বল্ডউইন
অনুবাদ - আশফাক স্বপন



ইতিহাস বলে শিল্পীদের জীবদ্দশায় শুধু গালমন্দ জোটে, তারপর যখন তারা দেহত্যাগ করে চিরবিদায় নিয়ে সকল সামাজিক উদ্বেগের অবসান ঘটায়, শুধু তখনই প্রশংসা কুড়ায়।

 বেশির ভাগ মানুষ একাকীত্ব এড়াতে চায় – কিন্তু একাকীত্বের সক্রিয় সাধনাই একজন শিল্পীর মৌলিক লক্ষণ। সম্ভবত আর সব মানুষের সাথে এখানেই তার বড় তফাৎ। বিপন্ন অবস্থায় সব মানুষই যে আসলে একা, এই কথাটা বহুব্যবহারে অর্থহীন গতানুগতিক আপ্তবাক্যে পর্যবসিত হয়েছে। কারণ কথাটা আমরা মুখে খুব বলি, কিন্তু চাক্ষুস প্রমাণ উপস্থিত করার পরও খুব একটা মান্য করিনা। আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ আমাদের একাকীত্বের বাস্তবতা সম্বন্ধে খুব একটা চিন্তা করতে আগ্রহী নন, কারণ এবিষয়ে বেশি ভাবলে মানব সংসার স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। অবশ্য একথা সত্যি যে সংসারে নানা অত্যাবশ্যকীয় কাজ – অপরিচ্ছন্ন জলাশয় পরিষ্কার, নগর স্থাপনা, খনিজ সম্পদ উদ্ধার, শিশুর আহারের ব্যবস্থা, ইত্যাদি– এসবের কোনটাই একা করা সম্ভব  নয়। তবে বহির্জগতকে নিয়ন্ত্রণে আনাই মানুষের একমাত্র কাজ নয়। তার স্কন্ধে আরেকটি গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে – তাকে নিজ চেতনার দুর্ভেদ্য বুনো অন্তর্জগতটাকেও বুঝতে, জানতে হবে। শিল্পীর দায়িত্ব এই অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চল আলোকিত করা, এই বিশাল ঘন বনাঞ্চলে আত্মোপলব্ধির প্রশস্ত পথরচনা করা। কেন? যাতে আমাদের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের যজ্ঞে আমরা আসল উদ্দেশ্যের কথাটা ভুলে না যাই। সেই উদ্দেশ্য হলো আমাদের এই পৃথিবীটাকে মানুষের বসবাসের জন্য আরেকটু সুন্দর, সহনীয় করে তোলা।

একাকীত্ব মানে কিন্তু পারাগাঁয়ে গিয়ে কোন খাল বিলের পাশে বসে প্রকৃতিবন্দনায় বিভোর হওয়া নয়। আমি যে একাকীত্বের কথা বলছি, সেই একাকীত্ব অনেকটা জন্ম বা মৃত্যুর সময়কালীন একাকীত্বের মতো। এ হলো সেই ভয়ঙ্কর একাকীত্ব যার ইঙ্গিত ঝিলিক দিয়ে ওঠে কোন কষ্ট-জর্জরিত মানুষের চোখে, যার কষ্ট নিরসনে আমরা অপারগ। অথবা এ যেন প্রেমের একাকীত্ব। প্রেম এমনই এক অজ্ঞেয় রহস্যময় শক্তি – কত লোকই না তার গুণগান গেয়েছে, আরো কত লোক অভিশম্পাত করেছে, কিন্তু মানুষ না পেরেছে তাকে বুঝতে, না পেরেছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে।

শিল্পীর মানসিক অবস্থাটাকে আমি যে এইভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছি তার কারণ কিন্তু শিল্পীর জন্য অনুকম্পা সৃষ্টির জন্য নয় (খোদা না করুন!)। আমার উদ্দেশ্য এই কথাটা বোঝানো যে আর সব মানুষের এবং শিল্পীর মানসিক অবস্থান খুব কাছাকাছি। আমি চাইছি এই সত্যটি স্পষ্ট করে তুলতে।  জন্ম, দুঃখ-কষ্ট, প্রেম, মৃত্যু – এই প্রতিটি অবস্থাই অত্যন্ত গুরুতর পরিস্থিতি। শুধু গুরুতর নয়, সর্বজনীন, এদের এড়ানো আমাদের সাধ্যাতীত। আমরা সবই জানি, কিন্তু জানতে চাই না। এই ভয়ঙ্কর সত্যোপলব্ধি থেকে পালাবার জন্য আমরা নানান অলীক ধারণার শরণ নেই, শিল্পীর কাজ সেই সব চিন্তার অসারতা সর্বসমক্ষে উপস্থিত করা।

কেউ যদি কখনো প্রেমে পড়ে – তখন যে জিনিসটা সে খুব ভালভাবে উপলব্ধি করে তা হলো যেই মুখটা মানুষ কক্ষণো দেখতে পায় না তা হলো তার নিজের মুখ। আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকা – বা আপনার ভাই, কিম্বা শত্রু – আপনার চেহারা দেখবে, এবং এই চেহারার অভিব্যক্তিতে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের কর্ম, অনুভূতি এসব একধরনের তাড়নাপ্রসূত। আমরা আমাদের কৃতকর্মের জন্য দায়ী বটে, কিন্তু কেন কিছু করলাম সেটা কদাচিৎ বুঝতে পারি। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে নিজেদের আরো ভাল করে বুঝতে পারলে আমরা নিজেদের এতটা জখম করতাম না।

সাধে কি আর সর্বকালে সকল সমাজ শিল্পীর পেছনে লাগে? শিল্পীর স্বভাবটা যে বড্ড বেয়াড়া – তার কাজই হলো স্থবির সমাজে শান্তিভঙ্গ করা। ভবিষ্যতের সমাজেও যে শিল্পীর অবস্থার বিশেষ উন্নতি হবে এমন ভরসা পাই না। আসলে সমাজের মূল উদ্দেশ্য কী? আমাদের অন্তর্জগত আর বহির্জগতের নানা উচ্ছৃংখল প্রবণতাকে শাসনে আনা, তার বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, যাতে জীবন সহনীয় হয়, মানবজাতি রক্ষা পায়।

আরেকটি বিষয় অবধারিত। তা হলো যখন একটা পরম্পরা তৈরি হয়, তখন সাধারণভাবে মানুষ ধরে নেবে যে এই পরম্পরা অনাদিকাল থেকে চলে এসেছে। তখন কিছুতেই তারা এর থেকে বিচ্যুতি মেনে নেবে না, হয়তো কল্পনাই করতে পারবে না। যে পরম্পরায় তাদের আত্মপরিচয় তৈরি হয়েছে, সেটা ছাড়া তারা কীভাবে বাঁচবে? সুতরাং তাদের পরম্পরা ত্যাগ করতে বলা হলে তারা আতঙ্কিত হয়ে উঠবে। আমার মনে হয় এই আতঙ্কের বহিঃপ্রকাশ আমরা পৃথিবীর সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি – সে আমাদের নিউ অর্লিন্সের রাজপথেই হোক আর আলজেরিয়ার বীভৎস যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক। মানুষের মনোজগতে উচ্চতর উপলব্ধির ফলে তার মানসিক উত্তরণ ঘটবে – এটাই আমাদের একমাত্র আশা। তাতে যদি মানুষের ধ্বংসযজ্ঞ নিরসন হয়।

সমাজের অন্যান্য বিদ্বজ্জন – রাজনীতিবিদ, আইনপ্রণেতা, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, ইত্যাদি – এদের থেকে শিল্পী আলাদা। কারণ সে নিজেই তার মনের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, এবং অনুচ্চারিত হলেও কিছু কঠোর নীতি মেনে চলে। সর্বোপরি শিল্পী মানবমনের রহস্য উন্মোচনের দায়িত্বপালনে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে, এমন যে কোন ভাবনাকে পরিত্যাজ্য মনে করে। সমাজ কিন্তু কিছু কিছু জিনিস সত্য বলে মেনে নেয়, কিন্তু শিল্পী জানে দৃশ্যমান সত্যের গভীরে আরেকটি সত্য লুকিয়ে রয়েছে – আমাদের কর্ম আর অর্জনের পেছনে নানান অজ্ঞাত বিষয় নিহিত। সমাজকে ধরে নিতে হয় তার গঠন চিরস্থায়ী ও মজবুত, কিন্তু শিল্পী বিলক্ষণ জানে, এবং সকলকে এই কথা জানাতে দায়বদ্ধ, যে ইহজগতে চিরস্থায়ী বলে কিছু নেই। কিছু কিছু জিনিস মেনে না নিয়ে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা, বা একটি শিশুকে শিক্ষাদান করা বা একটি গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। শিল্পীর পক্ষে কোন কিছুই মেনে নেয়া সম্ভব নয়, এবং সেটা উচিতও নয়। তার কাজ হলো প্রতিটি উত্তরের গভীরে প্রবেশ করে তার ভেতর যেই প্রশ্ন লুকানো আছে, সেটা বের করে আনা।

শিল্পীদের নিয়ে বড্ড বেশি বাগাড়াম্বর হয়ে যাচ্ছে, তাই না? ইতিহাস বলে শিল্পীদের জীবদ্দশায় শুধু গালমন্দ জোটে, তারপর যখন তারা দেহত্যাগ করে চিরবিদায় নিয়ে সকল সামাজিক উদ্বেগের অবসান ঘটায়, শুধু তখনই প্রশংসা কুড়ায়। কিন্তু ভেবে দেখুন – এই যে দেরিতে শিল্পীরা সমাজে সম্মানিত হয়, এতে কিন্তু আমার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয়। আমি যেই কথাটা পরিষ্কার করে বোঝাতে চাইছি, তা হলো সমাজের প্রতি শিল্পীর দায়িত্বের প্রকৃতিটা কি? এই দায়িত্বের একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো সমাজের সাথে শিল্পীর লড়াই কখনো শেষ করা চলবে না। এই লড়াই সমাজ ও শিল্পী উভয়ের জন্য অপরিহার্য। বাইরে থেকে যেমনই দেখাক আর আমাদের মনে যেই আশাই থাক,  বাস্তব সত্য হলো এই যে সমাজের সবকিছুই নিয়ত পরিবর্তনশী্ল। জাতি বা ব্যক্তি হিসেবে আমরা কতখানি পরিণত, তার বড় পরীক্ষা হলো আমরা এই পরিবর্তনের সাথে কত স্বচ্ছন্দে খাপ খাওয়াতে পারি, একে আমাদের শ্রীবৃদ্ধিতে কতখানি কাজে লাগাতে পারি।

যদি কেউ এধরনের ভাবনা চিন্তা করতে বাধ্য হয় – যেমন ধরা যাক, কেউ যদি কখনো প্রেমে পড়ে – তখন যে জিনিসটা সে খুব ভালভাবে উপলব্ধি করে তা হলো যেই মুখটা মানুষ কক্ষণো দেখতে পায় না তা হলো তার নিজের মুখ। আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকা – বা আপনার ভাই, কিম্বা শত্রু – আপনার চেহারা দেখবে, এবং এই চেহারার অভিব্যক্তিতে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের কর্ম, অনুভূতি এসব একধরনের তাড়নাপ্রসূত। আমরা আমাদের কৃতকর্মের জন্য দায়ী বটে, কিন্তু কেন কিছু করলাম সেটা কদাচিৎ বুঝতে পারি। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে নিজেদের আরো ভাল করে বুঝতে পারলে আমরা নিজেদের এতটা জখম করতাম না। কিন্তু আমাদের চেতনা এবং সেই সম্বন্ধে যথার্থ আত্মসচেতনতার মাঝে এক দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর রয়েছে। কত কিছুই যে আমরা জানতে চাই না! আমরা সামাজিক আদাম-প্রদানে মত্ত হই কারণ এছাড়া আমরা বাঁচতে পারিনা। কিন্তু সামাজিক জীব হতে হলে আমাদের আরো বহু কিছু পরিহার করা জরুরি। অথচ আমরা সবাই খুব ভয়ে ভয়ে থাকি, কারণ আমাদের ভেতরে কিছু কিছু প্রবণতা রয়েছে যেটা আমাদের ভঙ্গুর নিরাপত্তার প্রতি সার্বক্ষণিক হুমকি। কিন্তু সেই প্রবণতাগুলো তো রয়েই যায়, কোন ইচ্ছাশক্তির বলে তো আমরা সেসব তাড়াতে পারিনা। আমাদের একটাই রাস্তা, এই প্রবণতাগুলোর সাথে বোঝাপড়া করে চলতে শেখা। কিন্তু সেই শিক্ষা তখনই সম্ভব যখন আমরা নিজেদের কাছে নিজেদের সম্বন্ধে সত্য কথা বলতে শিখব। আমাদের সত্যিকারের স্বভাব কিন্তু বরাবরই আমাদের কাঙ্খিত স্বভাব থেকে ভিন্ন। মানবসমাজের প্রচেষ্টা হলো এই দুই বাস্তবতার মধ্যে মেলবন্ধন রচনা করে এক ধরনের সমঝোতা তৈরি করা। যেসব মানুষকে আমরা সবচাইতে বেশি শ্রদ্ধা করি – এবং কখনো কখনো সবচাইতে ভয়ও পাই – তারা এই কঠিন, নাজুক প্রচেষ্টায় গভীরভাবে নিমগ্ন। এইসব শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি বহু কঠোর কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছে, তাই মানুষের কাছে তাদের শ্রদ্ধার আসনটি পাকা। যে জাতি এইসব মানুষকে সন্দেহ করা, একঘরে করা বা আহত করার প্রয়োজন অনুভব করে না, সেই জাতিই সর্বোৎকৃষ্ট। এইসব মানুষের কথাই আমি ক্ষাণিকক্ষণ আগে বলছিলাম – এরা চলে গেলে এদের আমরা সম্মান করি, কারণ মনের গভীরে আমরা জানি – এদের ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না।

সাধে কি আর সর্বকালে সকল সমাজ শিল্পীর পেছনে লাগে? শিল্পীর স্বভাবটা যে বড্ড বেয়াড়া – তার কাজই হলো স্থবির সমাজে শান্তিভঙ্গ করা। ভবিষ্যতের সমাজেও যে শিল্পীর অবস্থার বিশেষ উন্নতি হবে এমন ভরসা পাই না। আসলে সমাজের মূল উদ্দেশ্য কী? আমাদের অন্তর্জগত আর বহির্জগতের নানা উচ্ছৃংখল প্রবণতাকে শাসনে আনা, তার বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, যাতে জীবন সহনীয় হয়, মানবজাতি রক্ষা পায়। 

পৃথিবীর যে কোন জায়গা থেকে মার্কিন দেশের শিল্পী হওয়র ঝুঁকি যে বেশি, তা নয়। তবে মার্কিন দেশে শিল্পী হবার কিছু নিজস্ব ঝুঁকি রয়েছে। এই ঝুঁকি আমাদের ইতিহাসপ্রসূত। কি সেই ঝুঁকি? এই মহাদেশটি জয় করতে গিয়ে দেখা গেল যে ঐ যে শিল্পীর একাকীত্বের কথা আমি বলছিলাম, যে একাকীত্বের ফলে মানুষ উপলব্ধি করে যে জীবন দুঃখ-কষ্টে ভরা আর সেকারণেই অপূর্বসুন্দর, সেই একাকীত্ববোধের চর্চা এই মার্কিন দেশে করতে দেওয়া হলো না। যে সব উদীয়মান দেশ ধীরে ধীরে আপনার অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে ব্যাপৃত, এর প্রতিটি দেশেই যে এরূপ নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে, নানা ভাবে সেটা আগামী ৫০ বছরে সেটা প্রমাণিত হবে, এবিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এই মহাদেশ এখন আমাদের করায়ত্ত, কিন্তু আমাদের স্বভাব আর সংশয় কিন্তু আজও বিরাজমান। মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে নিজেকে বদলে নেয়, অবদমিত করে, এবং নিজের অন্তর্গত উচ্ছৃংখল অস্থিরতাকে স্বীকার করার বেলায় নিজের সাথে ছলনা করে – জাতি হিসেবেও আমরা আমাদের ইতিহাসের অশুভ শক্তি স্বীকার করার বেলায় চাতুরির আশ্রয় নিয়েছি, সত্য গোপন করেছি, এমনকি নিজের সাথে প্রতারণা করেছি। মানুষের বেলায় আমরা একটা কথা জানি – যার নিজের অতীতকে স্বীকার করবার সৎসাহস নেই, সে আজীবন সেই অতীতের খাঁচায় বন্দী রয়ে যাবে। সে তার অনাবিষ্কৃত অতীতের কারাগারে এমনই বন্দী যে রীতিমতো চলৎশক্তিরহিত। জাতির ব্যাপারেও এই কথাটা সত্য। আমরা বুঝতে পারি এই রকম অনড় অবস্থায় একজন মানুষ তার শক্তি বা দুর্বলতা কতখানি, সেটা নির্ণয় করতে পারে না, এমনকি কোনটা যে কী এটা চিহ্নিত করতে ভুল করে। আমার মনে হয়, আমরা তাই করছি। পশ্চিমা বিশ্বে আমরা সবচেয়ে পরাক্রান্ত দেশ, কিন্তু সেটা কী কারণে হয়েছে সেটা কিন্তু আমরা যা ভাবি তা নয়। আমাদের শক্তির উৎস আমাদের এমন একটা দুর্লভ সুযোগলাভ যেটা আর কোন দেশ পায় নি – তা হলো আমরা বর্ণ, শ্রেণী, গোত্র সম্বন্ধে সব মান্ধাতার আমলের ধারণা ছুঁড়ে ফেলে সেটাকে অতিক্রম করবার একটা সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু তার জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে – নির্মোহ দৃষ্টিতে সুদূর অতীতে দৃষ্টিপাত করে দেখতে হবে আমাদের যাত্রাপথের সূচনা কীভাবে হলো। আমাদের পথপরিপক্রমার চরিত্র কি সেটা নির্ভীকভাবে যাচাই করতে হবে। একজন শিল্পীর কাছে সেই যাত্রাপথের স্বরূপটি সবচাইতে পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হয় এই যাত্রায় যেসব ব্যক্তি তৈরি হয়েছে তাদের স্বভাবে। সমাজ কখনো বুঝতে পারে না, কিন্তু শিল্পীর সাথে তার সমাজের লড়াই আসলে প্রেমিকের লড়াই। যথার্থ শিল্পীর কাজটাও অনেকটা প্রেমিকের মতোই – সে প্রেমাস্পদকে নিজেকে চিনতে শেখায়। সেই চেনাটাই চেতনার মুক্তিকে অর্থবহ করে তোলে।

লেখক পরিচিতঃ
জেমস বল্ডউইনঃ
জেমস বল্ডউইন একজন আমেরিকান লেখক এবং সামাজিক সমালোচক ছিলেন। নোটস অব এ ন্যাটিভ সান (১৯৫৫) এ সংগৃহীত তাঁর রচনাগুলি পশ্চিমা সমাজে জাতিগত, যৌন ও শ্রেণিগত বৈষম্যের স্পষ্টতাত্ত্বিক, অযৌক্তিক চিন্তাধারা আবিষ্কার করে, বিশেষ করে বিশশতকের মাঝামাঝি আমেরিকাতে। বল্ডউইন এর কিছু রচনা বইয়ের মতই দৈর্ঘ্য, উদাহরণস্বরূপ 'দ্য ফায়ার নেক্সট টাইম (১৯৬৩)', 'নো নেম ইন দ্য স্ট্রিট (১৯৭২)', এবং 'দ্য ডেভিল ফাইডস ওয়ার্ক (১৯৭৬)'। তার একটি অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি 'রিমেম্বার দিস হাউজ' অবলম্বনে ডকুমেন্টারি ফিল্ম আই অ্যাম নট ইউর নিগ্রো একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল।

আশফাক স্বপনঃ
আশফাক স্বপন ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী উপমহাদেশীয় সংবাদ মাধ্যমে সাংবাদিকতা করছেন। বর্তমানে ঢাকার Daily Star পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। তার লেখা বাংলাদেশের  প্রথম আলো, সমকাল, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, পাকিস্তানের Dawn, ভারতের Times of India ও Statesman পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আটলান্টায় থাকেন।

1 comment:

  1. অসাধারণ লেখা। আজকের জন্যও বড়ই জরুরী যারা শিল্পকর্ম করেন বোলে গরবে বুক ফোলান তাদের জেমস বল্ডউইন পথ দেখাতে পারেন।

    ReplyDelete

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট