ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ - পর্ব ০১ - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ - পর্ব ০১



বার্লিনের ভাঙা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমার বারবার একটাই প্রশ্ন মনে হচ্ছিল, এত কষ্ট করে যে দেওয়াল ভাঙা হচ্ছে, সেই কঠিন, হিংস্র দেওয়াল আদৌ কেন গাঁথা হয়েছিল? লোহা ও কংক্রিট মিশিয়ে এমনই সুদৃঢ়ভাবে গড়া হয়েছিল এই প্রাচীর, যেন তা শত-শত বৎসর দুর্ভেদ্য হয়ে থাকবে। সেই দেওয়ালের অদূরে পরপর গম্বুজ, তার ওপরে চব্বিশ ঘণ্টা মারাত্মক অস্ত্র হাতে প্রহরীরা। দুই দেশের সীমান্তের দেওয়াল নয়, একটা শহরের মাঝখান দিয়ে মাইলের পর মাইল দেওয়াল, যার দু-দিকে একই জাতির মানুষ, এক ভাষা, এক খাদ্যরুচি, এক রকম পরিচ্ছদ, একই শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী, তবু দেওয়াল গেঁথে তাদের পৃথক রাখার চেষ্টা। যারা দেওয়াল গেঁথেছিল, তারা কি জানত না, কঠোর নিষেধ মানুষ বেশি করে ভাঙতে চায়, যে-কোনও বাধা উল্লঙ্ঘন করার প্রবৃত্তি মানুষের জন্মগত।

দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা হল দুই জার্মানিকে। একদিকে সমাজতন্ত্র, অন্যদিকে ধনতন্ত্র। সমাজতন্ত্রী নেতাদের কাছে ধনতন্ত্র অতি কুৎসিত, দুর্গন্ধময়। নিছক ভোগ্যপণ্যের আড়ম্বর দেখিয়ে চোখ ধাঁধানো। ইতিহাসের ভবিষ্যৎ গতি সমাজতন্ত্রের দিকে, মানুষের সুখ, স্বপ্ন, শান্তি সেই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত। বেশ তো, মানুষকে তা বোঝালে মানুষ নিজের ভালো নিশ্চয়ই বুঝবে। কিন্তু কেউ যদি না বুঝতে চায়, তা হলে কি তার ঘাড় ধরে, হাত-পায়ে শিকল বেঁধে কিংবা বুকের সামনে বন্দুক উঁচিয়ে বোঝাতে হবে? কেউ যদি পূর্ব ছেড়ে পশ্চিমে যেতে চায়, তাকে গুলি মেরে ঝাঁঝরা করে দিতে হবে? নিজের বাসস্থান নির্বাচনের স্বাধীনতাও মানুষের থাকবে না।

দেওয়াল গাঁথার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিশ্চিত মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষ, যাঁরা নেতৃত্ব পদের অধিকারী, দেশের আপামর জনসাধারণের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন তাঁরা বোধ করেননি। তাঁরা মনে করেছিলেন, দেশের সব মানুষের মঙ্গলের দায়িত্ব তাঁদের হাতে। সেই মঙ্গল জোর করে মানুষের গলায় গিলিয়ে দিতেও তাঁদের আপত্তি নেই।

সব দেওয়ালেরই কোথাও না কোথাও একটা ছিদ্র থাকে। সেই ছিদ্র ক্রমশ বড় হয়। দেওয়ালের ওপাশে কী আছে, তা জানার জন্য মানুষের কৌতূহল ছটফট করে। ১৯৬১ সালে এই দেওয়াল তোলার পর পুরো একটা প্রজন্ম পার হয়ে গেছে। তবু তো পূর্ব দিকের সেই মঙ্গলের প্রচার মানুষ মানল না। সমস্ত দমননীতি ব্যর্থ করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হুড়মুড় করে এদিকে চলে এল। মানুষের গড়া দেওয়াল মানুষই ভাঙল।

বাল্যকালে পাঠ্যবইতে রুসো'র একটি উদ্ধৃতি পড়েছিলাম, 'মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত।' এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত ও তীব্রভাবে মানুষের ইতিহাস বুঝি আর ব্যক্ত করা যায় না। মানুষ মানুষেরই কাছে পরাধীন। মানুষ তৈরি করেছে বিচার ব্যবস্থা, কিন্তু মানুষই মানুষের প্রতি সবচেয়ে অবিচার করে। মানুষের মেধায় এত যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অস্ত্রের নির্মাণ, তার প্রয়োগ শুধু মানুষকেই ধ্বংস করার জন্য। জীবজগতে সবাই স্বার্থপর, তবু মানুষ ভালোবাসা শব্দটি নিয়ে গর্ব করে, অথচ মানুষের ইতিহাস হত্যালীলায় ক্লেদাক্ত। এককভাবে কিছু-কিছু মানুষ শুভ্র, সুন্দর, উদার হতে পারে, কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে মানুষের নিষ্ঠুরতা হিংস্রতম পশুর চেয়েও সাংঘাতিক। একটি সিংহের সঙ্গে অন্য সিংহের যতই প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাক, কেউ কারুকে হত্যা করে না, এমনকি একটা পিঁপড়েও স্বজাতীয় অন্য পিঁপড়েকে মারে না। বাঘ যখন হরিণ শিকার করে তখন অন্য কোনও বাঘ তাতে জোর করে ভাগ বসাতে আসে না, কিন্তু সুসভ্য হিসেবে চিহ্নিত যে মানুষ, সে-ই শুধু অন্য মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়।

মানুষের তথাকথিত সভ্যতার বয়েস বড়জোর আট ন' হাজার বছর। মানুষ ছাড়া আর সমস্ত প্রাণীকেই প্রতিদিন খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়। যাযাবর মানবজাতি যেদিন থেকে শস্য উৎপাদন ও খাদ্য সংগ্রহ করতে শিখল, সেই দিন থেকেই ঘর বাঁধার প্রশ্ন এল। খাদ্যচিন্তার সমাধান হতেই এল অন্য চিন্তা। কিছু মানুষকে ফসল উৎপাদন ও পশুপালনে নিযুক্ত রেখে বাকি মানুষেরা তা ভোগ করার অধিকার আদায় করে নিতে লাগল। খাদ্য উৎপাদনের জন্য যাদের শ্রম ও সময় ব্যয় করতে হয় না, তারাই গড়ে তুলল গ্রাম, নগর, রাজ্য। একের ওপর অনের প্রভুত্ব, সবচেয়ে যে শক্তিশালী, সে দলপতি কিংবা রাজা। টোটেমগুলির বদলে দেব-দেবী, সর্বোপরি এক অলীক, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। নানারকম ভয়ের কাহিনি প্রচার করে আদায় করা হল ভক্তি। রাজারা নিজেদের আসন অটুট রাখার জন্য রটিয়ে দিল যে তারা ঈশ্বর নির্বাচিত। এই সভ্যতার উন্মেষ থেকে এতকাল পর্যন্ত একনায়কতন্ত্রই চলে আসছে। গ্রিসের মতন কোনও কোনও জায়গায় গণতন্ত্র নিয়ে সামান্য পরীক্ষা হয়েছে বটে, কিন্তু সেখান থেকেই উঠে এসেছে আবার কোনও স্বৈরাচারী। সাধারণ মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনও দিনই কোনও মূল্য ছিল না, শাসক শক্তির সামান্য অঙ্গুলি হেলনের ওপর তার উত্থান-পতন নির্ভরশীল।

মাত্র দুশো বছর আগে, ফরাসি বিপ্লবের পরই বোঝা গিয়েছিল রাজতন্ত্রের শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে। সে বিপ্লব সার্থক হয়নি, নেপোলিয়ান জনগণের মাথার ওপর আবার একটা সিংহাসন চাপিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু অসংগঠিত, নেতৃত্বহীন, স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানেও যে রাজার মাথার মুকুট বালির মতন ঝুরঝুরে হয়ে যেতে পারে, সেনাবাহিনীর এক অংশ ঘুরিয়ে নিতে পারে বন্দুকের মুখ, তা একবার প্রমাণিত হতেই ধরে নেওয়া গেল যে বিশ্বের রাজা-রানিদের আর পুতুল হয়ে যেতে বেশি দেরি নেই।

অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ায় ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে বেরিয়ে পড়ল দিগ্বিজয়ে। গোটা প্রাচ্য দেশে ও আফ্রিকায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা স্থাপন করতে লাগল উপনিবেশ, এইসব ঘুমন্ত অঞ্চল থেকে তারা লুণ্ঠন করতে লাগল বিপুল সম্পদ। কিন্তু ইউরোপের চিন্তাবিদরা বুঝে গিয়েছিলেন যে এরকম একতরফা শোষণের অবসান হতে বাধ্য অচিরকালের মধ্যেই। অ্যাডলফ তিয়ের এবং ফ্রাঁসোয়া গিজো'র মতন ফরাসি ঐতিহাসিকরা শ্রেণিভেদ ও শ্রেণিসংগ্রামের কথা লিখলেন। সব সমাজেই মোটামুটি দুটি শ্রেণি আছে, শোষক ও শোষিত, এবং এদের মধ্যে সংগ্রাম বাধবেই। কার্ল মার্কস এঁদের থেকেই শ্রেণিবিভাজনের চিন্তাটা গ্রহণ করে আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন, সংগ্রামের মাধ্যমে শ্রেণি লোপ করাই সমাজ বিবর্তনের প্রধান পথ।

উপনিবেশগুলির মধ্যে আমেরিকা প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং রাজশক্তিকে পরাজিত করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখানে শ্রেণিসংগ্রাম হল না বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হল। জনসাধারণের নির্বাচিত সরকার। এই ব্যবস্থাটা টিঁকে যাওয়ায় গণতন্ত্রের ধারণাটা দারুন জনপ্রিয়তা পেল, একশো বছরের মধ্যে পৃথিবীর প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা।

তবু প্রশ্ন ওঠে, গণতন্ত্রে সত্যিই কি দেশের সাধারণ মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছে অনুযায়ী সরকার পরিচালিত হয়? ভোটের মাধ্যমে যাঁদের প্রতিনিধি করে পাঠানো হয় কেন্দ্রে, তাঁরা কি সত্যিই ভোটদাতাদের প্রতিনিধিত্ব করেন? এক একটা দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও হালচাল তো রাজা-রাজড়াদেরই মতন। তাঁরা সশস্ত্র প্রহরী পরিবৃত হয়ে থাকেন প্রাসাদে। অন্য দেশে গেলে তাদের জন্য পাতা হয় লাল কার্পেট, কামান গর্জনের বাজে খরচ হয়। (একমাত্র ব্যতিক্রম হো চি মিন, যিনি থাকতেন অতি সাধারণ এক গৃহে, অন্যদেশে এসে লাল কার্পেট সরিয়ে নিতে বলেছিলেন।) একজন রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছে করলে জনসাধারণের মতামত না নিয়েই অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারেন। গণতন্ত্রে কেউ-কেউ বিশাল ধনী হয়, বহু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে যায়, তা রোধ করার কোনও পথ নেই। বলা হয় যে, গণতন্ত্রের একটা রক্ষাকবচ আছে, মন্ত্রীমণ্ডলী যতদিন খুশি গদি আঁকড়ে থাকতে পারে না, পাঁচ বছর পরে তাদের সরিয়ে ফেলা যায়। তাদেরও মনে-মনে সেই চিন্তা থাকে বলে তারা একেবারে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু এর মধ্যেও অনেক ফাঁক আছে। দেশের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষেরই ভোটাধিকার আছে, ভোট বাক্সে তারা সেই অধিকার প্রয়োগ করে, গরিষ্ঠ সংখ্যক ভোটদাতার ইচ্ছে অনুযায়ী সরকার গঠিত হয়, এই নীতি কাগজে-কলমে সত্য, বাস্তবে সত্য নয়। টাকা খরচ করে ভোট কেনা যায়, গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়ে প্রকৃত ভোটদাতাদের দূরে সরিয়ে রাখা যায়। আমেরিকা একটি গণতান্ত্রিক দেশ বটে, কিন্তু কোটিপতি ছাড়া কেউ সে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। এবং কোটিপতিরা অন্য কোটিপতিদের স্বার্থ আগে দেখবে, এ আর এমন নতুন কথা কী? আর আমাদের মতন দেশে শতকরা ষাটজন মানুষ নিরক্ষর ও দরিদ্র, তারা জানেও না রাজধানীর অবস্থান কোথায়। অনেককাল আগে জর্জ বানার্ড শ গণতন্ত্রের ছিদ্রের কথা বলেছিলেন এই ভাবে, একটি কেন্দ্রে ভোটদাতার সংখ্যা যদি হয় দশ জন, আর সেখানে যদি প্রার্থী থাকে চারজন, তাদের মধ্যে কেউ পেল একটি ভোট, কেউ পেল দুটি, কেউ পেল তিনটি, আর যে চারটি পেল সে নির্বাচিত হয়ে গেল, যদিও ছ-জন মানুষই তাকে চায়নি। এটা তিনি বলেছিলেন ইংল্যান্ডের কথা ভেবে, এখন অবস্থাটা অনেক বদলেছে। আমাদের মতন দেশে, এখন দুই শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ভোটযুদ্ধে অবতরণ করলেও টাকা ও লাঠির খেলা অবশ্যম্ভাবী। আবার কোনও-কোনও দেশে ভোটদাতা ভয়ের চোটে বাড়ির বাইরে পা-ই দেয় না, অথচ ভোট-বাক্স ভরে যায়।

মার্কস-এর শ্রেণিহীন সমাজের আদর্শ নিয়ে লেনিন যখন রাশিয়ায় বিপ্লব ঘটালেন তখন সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল সেদিকে। ফরাসী দেশে কমিউন ব্যর্থ হলেও কমিউনিজম শব্দটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। ফরাসি বিপ্লব সে দেশে সার্থক না হলেও সাম্য-মৈত্রী স্বাধীনতার আদর্শ কিছুটা অন্যভাবে রূপায়িত হল সোভিয়েত ইউনিয়নে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও অনেকেরই মনে হল, মনুষ্যসমাজের ইতিহাসে গণতন্ত্রের পরবর্তী অবধারিত ধাপ এই সমাজতন্ত্র। কেউ অন্যের শ্রম নিয়ে মুনাফা করবে না, ব্যক্তি স্বার্থ মুছে যাবে, উৎপন্ন ফসল ও দ্রব্যের সম বন্টন হবে, সকলেই সমান শিক্ষা, আহার, বাসস্থান ও চিকিৎসার সুযোগ পাবে। এর চেয়ে আদর্শ ব্যবস্থা আর কী হতে পারে। এত যুগ-যুগান্তর পর সত্যিই মানুষের মুক্তির একটা উপায় দেখা গেল। এ যে স্বপ্নের সার্থকতা।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছড়িয়ে গেল পূর্ব ইউরোপের অনেকগুলি দেশে। তারপর চিনে। ধনতান্ত্রিক দেশগুলি আতঙ্কিত হয়ে উঠল, সমাজতন্ত্রের এই অগ্রগতি রোধ করার জন্য তারা বানাতে লাগল সাংঘাতিক সব অস্ত্রশস্ত্র, সোভিয়েত ইউনিয়নও চুপ করে বসে রইল না, শুরু হল কুৎসিত এক অস্ত্র প্রতিযোগিতা। অস্ত্রের পাহাড় জমতে-জমতে এমন একটা অবস্থা হল যে দু-পক্ষই ইচ্ছে করলে পরস্পরকে ধ্বংস করে দিতে পারে। প্রকৃত যুদ্ধ হল না, চলতে লাগল ঠান্ডা যুদ্ধ, তার জন্য খরচ হতে লাগল হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা। মানুষের ইতিহাসে বিনা যুদ্ধে এমন অর্থব্যয়ের মূর্খামি আর কখনও ঘটেনি।

এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিন ও মার্কিন দেশের কর্ণধারদের প্রায়ই মোলাকাত হয়, তাঁরা হেসে-হেসে করমর্দন করেন। পারস্পরিক আক্রমণের আর কোনও প্রশ্নই যেন এখন নেই। তবু কি তাঁদের মনে হয় না, মাঝখানের এতগুলি বছরের রেষারেষিতে তাঁরা মনুষ্য সমাজকে কতটা পিছিয়ে দিলেন? মানুষের কত সম্পদের অপচয় হয়েছে ব্যর্থ অস্ত্রে?

মাঝখানের এতগুলি বছর।



হিটলারের আত্মহত্যা কিংবা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঠিক সতেরো দিন পর জার্মানি বিনা-শর্তে আত্মসমর্পণ করে মিত্রশক্তি বাহিনীর কাছে। জার্মান জাতি সারা পৃথিবীতে প্রভুত্ব করবে, এই স্বপ্নে তাদের মাতিয়ে তুলেছিল হিটলার। কিন্তু পরাজয়ের পর জার্মান রাষ্ট্রের অস্তিত্বই মুছে গেল। আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটাকে ভাগাভাগি করে নিজেদের দখলে রাখল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিত্র শক্তির কেউ আর কারু মিত্র নয়, তাদের মধ্যে মতভেদ প্রকট।

চার বছর বাদে, আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্সের অধিকৃত অংশে প্রতিষ্ঠিত হল একটি নতুন রাষ্ট্র, ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি, রাজধানী হল বন। তার এক মাসের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলীকৃত অংশে জন্ম নিল জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক, রাজধানী হল দ্বিখণ্ডিত বার্লিন শহরের একটি অংশে। বার্লিনের অপর অংশে পশ্চিমি ত্রিশক্তির সৈন্যবাহিনী বসে রইল তাঁবু গেড়ে। একই সংস্কৃতি ও ভাষার উত্তরাধিকারী জার্মানরা দু'ভাগ হয়ে গেল পরের ইচ্ছায়।

১৯৫২ সালে স্টালিন একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন বটে যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকার শর্ত আরোপ করে দুই জার্মানিকে এক করা যেতে পারে, কিন্তু আমেরিকা তাতে রাজি হল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জন্য পশ্চিম জার্মানিতে তাদের একটি ঘাঁটির খুবই প্রয়োজন, কেন-না, এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন একবার আচমকা বার্লিন ব্লকেড করে পশ্চিম বার্লিনের সৈন্য ও সাধারণ মানুষদের না খাইয়ে রাখার উপক্রম করেছিল, তখন বিমানে খাদ্য সরবরাহ করতে হয়েছিল দিনের পর দিন।

এক জাতি দু-ভাগ হয়ে গেল, দুটি আলাদা রাষ্ট্র। ভারতবর্ষও দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল প্রভুদের ইচ্ছেয়, কিন্তু তার মূলে ছিল অন্তঃকলহ। আমাদের দেশের নেতা বা জনপ্রতিনিধিরা এক যোগে গলা মিলিয়ে বলতে পারেননি যে, না, আমরা দেশ-বিভাগ মানব না। হিটলারের পাপে জার্মানি তখন অপরাধবোধে নতশির। তাদের কিছুই বলার মতন মুখ ছিল না।

পশ্চিম জার্মানি হল। পশ্চিমি শক্তির তল্পিবাহক, পূর্ব জার্মানি গ্রহণ করল সমাজতন্ত্র। পশ্চিম জার্মানিকে প্রথম কয়েক বছর নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হল উদ্বাস্তু সমস্যা। পোল্যান্ড এবং কাছাকাছি অন্যান্য দেশে যত জার্মান ছিল, তারা বিতাড়িত হয়ে ফিরে আসতে লাগল। ভাগাভাগির পর পূর্ব জার্মানি থেকেও দলে-দলে লোক চলে আসতে শুরু করল পশ্চিমে। অবশ্য এই সব উদ্বাস্তুরা দেশ গড়ার কাজে সাহায্যও করেছে। এরা প্রায় সকলেই দক্ষ শ্রমিক বা প্রযুক্তিবিদ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যখন সক্ষম পুরুষ মানুষেরই প্রচণ্ড অভাব, তখন এইসব সুশিক্ষিত কর্মীরা দেশের বোঝার বদলে সম্পদ হিসেবেই গণ্য হল। প্রায় একটি ধ্বংসস্তূপ থেকে কীভাবে আবার জার্মানরা দেশটাকে গড়ে তুলল, তা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও শক্ত। আমরা অবহেলা ও ঔদাসীন্যে এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে গত পঁয়তাল্লিশ বছরে কলকাতা শহরটার অবস্থা কত যে খারাপ হয়ে গেছে, তা আমরা গ্রাহ্যও করি না। ফ্রাংকফুর্ট শহরটা যুদ্ধের সময় নব্বইভাগই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেই ছবি আমি দেখেছি, আজ সেই আধুনিক শহরটি দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। শুধু জার্মানি নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ইত্যাদি দেশের অনেক শহরেরই পুনর্জন্ম হয়েছে।

পাশাপাশি বর্ধিত হতে লাগল একই জার্মান জাতির দুটি দেশ। এটা এমন কিছু অভিনব ঘটনা নয়। ইতিহাসের বিচারে মাত্র সেদিন, অর্থাৎ একশো কুড়ি বছর আগেও জার্মানি ছিল টুকরো-টুকরো কতকগুলি রাজ্য, ফ্রান্স ইংল্যান্ডের তুলনায় কোনও শক্তি হিসেবে গণ্যই হত না। মধ্য ইউরোপের তাঁবেদার ছিল তখন অস্ট্রিয়া। ভিয়েনার নির্দেশে জার্মান সামন্তরা ওঠা-বসা করত। প্রাসিয়ার প্রধানমন্ত্রী অটো ফন বিসমার্ক-এর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বেই জার্মান জাতীয়তাবোধ দানা বাঁধে। বিসমার্ক ছিলেন প্যারিসে প্রাসিয়ার রাষ্ট্রদূত, তাঁকে ডেকে এনে যখন প্রধানমন্ত্রী করা হয়, তখন অনেকে চমকে উঠেছিল। কিন্তু অস্ট্রিয়াকে পর্যুদস্ত করার পর বিসমার্ক জার্মান জাতিকে সংঘবদ্ধ করে যে সামরিক শক্তি গড়ে তোলেন, তারই প্রতিক্রিয়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, পরবর্তীকালে হিটলারের অভ্যুত্থান ও আর একটি বিশ্বযুদ্ধ। চূড়ান্ত পরাজয়ের পর বিজয়ী সম্মিলিত বাহিনী জার্মানিকে সম্পূর্ণ শক্তিহীন করে দিতে চেয়েছিল, তার ফলে জার্মানি যে আবার টুকরো-টুকরো হয়ে যায়নি, তাই-ই যথেষ্ট, মাত্র দুটি ভাগে বিভক্ত হল।

একদিকে ধনতন্ত্র, অন্যদিকে সমাজতন্ত্র। একদিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাড়াবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতিযোগিতা, বাজারি অর্থনীতি, লোভ, হিংসা, ভোগ্যপণ্যের নির্লজ্জ বিজ্ঞাপন, উৎপাদনভিক্তিক শ্রম, পুনরুত্থিত জাতীয়তাবাদ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, আত্মহত্যা ও যৌন অধিকারের চূড়ান্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা। অন্যদিকে মুনাফা ও পুঁজিবাদের বিলোপ, সমস্ত কল-কারখানার রাষ্ট্রীয়করণ, কৃষি ব্যবস্থায় সমবায়। প্রতিটি মানুষের শ্রম শুধু নিজের স্বার্থে নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য, তার বিনিময়ে রাষ্ট্র প্রতিটি মানুষকে দেবে জীবিকা ও বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সমান সুযোগ। পশ্চিমের মানুষ ছন্নছাড়া, সবসময় দৌড়চ্ছে, তবু নিঃসঙ্গ। পূর্বের মানুষ সংঘবদ্ধ ও সমাজের অংশ, ব্যক্তি স্বাধীনতার চেয়েও সমাজ-বাস্তবতা তার কাছে বড়।

পশ্চিমের তুলনায় পূর্বের ব্যবস্থা নিশ্চিত অনেক বেশি সমর্থনযোগ্য, ইতিহাসের এক ধাপ অগ্রবর্তী, আমাদের মতন গরিব দেশের চক্ষে স্বপ্নের মতন। পশ্চিম জার্মানি ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে পশ্চিমি শক্তির পক্ষচ্ছায়া পেয়েছে। পূর্ব জার্মানিও অসহায় নয়, শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অভিভাবক। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি তার আত্মীয়। তা ছাড়াও পৃথিবীর অনেক ধনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক দেশের বহু সংখ্যক মানুষ এই সমাজতন্ত্রের পক্ষপাতী। এখন এই দুই জার্মানি কে কতখানি এগোতে পারে, তা রুদ্ধশ্বাসে পর্যবেক্ষণ করা ছিল গত চল্লিশ বছরের ইতিহাসে একটি প্রধান বিষয়।

পশ্চিম জার্মানি গোড়ার দিকে কিছু সুযোগ পেয়েছে। আমেরিকার কাছ থেকে মার্শাল প্ল্যানে সাহায্য পেয়েছে চার বিলিয়ান ডলার, ওদিকে পূর্ব জার্মানি যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দিয়েছে দশ বিলিয়ান ডলার। পশ্চিম পেয়েছে অনেক দক্ষ কর্মী, পূর্বকে অনেক কলকারখানা নতুন করে গড়তে হয়েছে। পশ্চিম বিদেশিদেরও সাহায্য নিয়েছে যথেচ্ছভাবে। এমনকি আরব দেশ, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের অনেকেও সেখানে কাজ পায়, সেই তুলনায় পূর্বে বিদেশিদের সংখ্যা নগণ্য। পূর্ব জার্মানিকে কয়েক বছরের মধ্যেই শ্রমিক অসন্তোষের মুখে পড়তে হয়েছিল, তা দমন করার জন্য সোভিয়েত সৈন্য ডাকতে হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্য তারপর যুদ্ধঋণ মুকুব করে দেয় এবং পূর্ব জার্মানির অর্থনীতি আস্তে আস্তে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সমাজতন্ত্র পূর্ব জার্মানির ওপরে একেবারে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বিষয়ও নয়। একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যায় যে স্যাক্সনি এবং থুরিঙ্গিয়া অনেককাল আগে থেকেই সমাজতন্ত্রীবাদীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। পূর্বের অন্তর্ভুক্ত প্রাক্তন প্রাসিয়া এক সময় রাশিয়ার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে। রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবে বার্লিনের বুদ্ধিজীবীরা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। স্পার্টাকাশ লিগ কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বসূরি। সুতরাং সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূর্ব জার্মানিতে বিকশিত হওয়াই স্বাভাবিক ছিল।

একটা মজার ব্যাপার এই যে, জার্মানি ভেঙে দুটি আলাদা রাষ্ট্র হলেও পশ্চিম জার্মানি এই বাস্তবতাকে কোনওদিনই স্বীকার করতে চায়নি। পশ্চিমের সংবিধানে পূর্বের পৃথক অস্তিত্বটাকে মানাই হয়নি, সেখানে অখণ্ড জার্মান রাষ্ট্রের ধারণাটাকেই আঁকড়ে রাখা হয়েছিল। সারা পৃথিবী জানে যে জার্মানি নামে দুটি দেশ, শুধু পশ্চিম জার্মানিই যেন তা জানে না। পূর্ব জার্মানি যাতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক স্বীকৃতি না পায় তার জন্য পশ্চিম জার্মানি অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে, একে-একে ধনতান্ত্রিক দেশগুলিও জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিককে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে এবং ৭৩ সালে জি ডি আর রাষ্ট্রসংঘেও স্থান পায়।

দুই জার্মানি ও বার্লিনের মাঝখান দিয়ে কাঁটা তার ও শক্ত দেওয়াল গাঁথা হয়, মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে একই ঐতিহ্যের দুই শরিক এগোতে থাকে। কে কতটা এগোল, তা সঠিকভাবে বোঝা শক্ত ছিল। ষাটের দশকে ধ্বংস স্তূপ থেকে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে পশ্চিম জার্মানি অর্থনৈতিক উন্নতির যেন ম্যাজিক দেখাল। ধনতান্ত্রিক দেশের খবরাখবর জানতে অসুবিধে নেই, আমরা সেইসব খবর বেশি পাই। ওদিকে জাপান, এদিকে পশ্চিম জার্মানি আমেরিকার সঙ্গে টক্কর দিতে লাগল। বিশ্বের বাজার, আশির দশকে পশ্চিম জার্মানির কারেন্সি অতিশয় শক্ত ও নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য হল। পূর্ব জার্মানির ব্যাবসা প্রধানত পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে, তার অর্থনৈতিক বুনিয়াদ কতটা দৃঢ় হল তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না। এক দল বলে ওরা কিছুই উন্নতি করতে পারছে না, অন্য দল বলে ওসব ধনতান্ত্রিক নোংরা দেশগুলির অপপ্রচার, সি আই এ-র চক্রান্ত ইত্যাদি। প্রচার, অপপ্রচার, দাবি ও পালটা দাবির ধূম্রজাল সরিয়ে দেখা যায় যে পূর্ব জার্মানিরও উন্নতি হয়েছে যথেষ্ট। মাঝারি শিল্পের উৎপাদন হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। অবশ্য কৃষি উৎপাদন শতকরা ১১ ভাগ মাত্র। তবু পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির তুলনায় পূর্ব জার্মানির অবস্থা ভালোই বলতে হবে। পোল্যান্ড-হাঙ্গেরি-বুলগেরিয়ার চেয়ে পূর্ব জার্মানির পার ক্যাপিটা ন্যাশনাল ইনকাম দ্বিগুণ। রুমানিয়া-যুগোশ্লাভিয়ার তিনগুণ। কিন্তু পশ্চিম জার্মানির অর্ধেক। পশ্চিমের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে পূর্ব খণ্ড পিছিয়ে পড়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ যেন দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই হঠাৎ ধনী হয়ে গেল, অন্য ভাই গরিব রয়ে গেল।

গরিবেরও তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ থাকে। ধনতন্ত্রের বিলাস, ভোগবাদ, অপরের শ্রমে, মুনাফা ও ঐশ্বর্যের অস্থিরতার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পূর্ব জার্মানির ধীর, শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়াই তো স্বাভাবিক ছিল। কারণ, তাদের সামনে রয়েছে সমাজতন্ত্রের অনেক উন্নত আদর্শ, তাদের জীবিকা ও শিক্ষা-চিকিৎসার সমান সুযোগ দিতে রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। জীবনের এই সব ব্যাপারের নিরাপত্তা পেলেও মানুষ বিষম প্রতিযোগিতাময় অবস্থার মধ্যে ফিরে যেতে চাইবে কেন? এই শতাব্দীর শেষ দশকের প্রাক্কালে এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। মানুষ কী চায়?

রাজতন্ত্রের অবসানের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল, মানুষ গণতন্ত্রকে আবার চিনে নেওয়ার পর তার চেতনায় গণতন্ত্র একটা স্থায়ী আসন পেয়ে গেল। অনেক দেশে এখনও স্বৈরতন্ত্র রয়েছে। অনেক দেশে গণতন্ত্রের নামে গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যভিচার ঘটানো হচ্ছে। তবু সাধারণ মানুষের মন থেকে গণতান্ত্রিক আদর্শ আর কোনওদিন মুছে যাবে না। এমনকী স্বৈরাচারীরাও মিথ্যে হোক, ধাপ্পা হোক, গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা উচ্চারণ করে। কিছু কিছু দিতে বাধ্যও হয়। সেইরকমই সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ, চিন ও লাতিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইতিহাস তাকে স্বীকার করে নিয়েছে। সমাজতন্ত্র যে একটি আদর্শ ধারণা তা বিশ্বের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষই বিশ্বাস করে। এমনকি যেসব ধনতান্ত্রিক দেশ সমাজতন্ত্রের শত্রু হিসেবে পরিগণিত, সেইসব দেশেও ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সমাজতন্ত্রের কিছু কিছু ধারণা ঢুকে পড়েছে, কিছু কিছু ব্যবস্থাও সেইসব রাষ্ট্র গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। সেইসব দেশে শোষণ আছে, প্রতিযোগিতা আছে, ধনী ও মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত শ্রেণিবিভাগ আছে, আবার বেকার ভাতাও প্রবর্তিত হয়েছে, বুড়ো-বুড়িদের ভার নেয় রাষ্ট্র, দরিদ্রের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়। অর্থাৎ কোনও ধনতান্ত্রিক দেশই এখন আর সে দেশের কোনও মানুষকে চরম বঞ্চনা ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় না, মোটামুটি বেঁচে থাকার সুযোগ দিয়ে বলে, বাকি উন্নতির জন্য তুমি লড়ে যাও। সেই মোটামুটি সুযোগটাও আমাদের মতন গরিব দেশের মানুষের কাছে অনেকখানি আর সমাজতান্ত্রিক দেশের অনেক মানুষের সমান-সমান।

কার্ল মার্কস ধনতন্ত্রের সমালোচনা করেছিলেন এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামো এঁকে গিয়েছিলেন। সেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একটা আদর্শ হিসেবে ধরলেও সেই রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, তা কখনও স্পষ্ট হয়নি। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি, সর্বহারাদের হাতে ক্ষমতা যায়নি, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে পার্টির বুদ্ধিজীবী ও ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর হাতে। সেই গোষ্ঠী-মানুষ কী চায়, এই প্রশ্নে বারবার ভুল করছে।

মানুষ কী চায়? মানুষকে যদি বলা যায়, তোমাকে জীবিকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে না। পরিবারের খাওয়া-পরার চিন্তা করতে হবে না, মাথা গোঁজবার ঠাঁই তুমি পাবে, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থাও রাষ্ট্র করে দেবে, তা হলে মানুষ এর বেশি আর কী চাইবে? সমস্ত জাগতিক দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে সে সমাজ গড়ার জন্য সম্পূর্ণ শ্রম ও উদ্যম দেবে, এটাই তো স্বাভাবিক, তবু তা হয় না কেন? সেই মানুষকে যদি বলা যায়, তোমাকে খেতে-পরতে দেওয়া হবে বটে, কিন্তু তুমি কী বই পড়বে, কী সিনেমা বা টি ভি প্রোগ্রাম দেখবে, তা আমি ঠিক করে দেব, বেশিদূর ভ্রমণের স্বাধীনতা তুমি পাবে না বাপু, বিদেশিদের সঙ্গে গালগল্প কোরো না, এসব অমান্য করলে কিন্তু তোমায় পুলিশে ধরবে। তাহলে কি সে তা মাথা পেতে মেনে নেবে? কতদিন মানবে? চেকোশ্লোকিয়ার বাতিশ্লাভা শহরে গিয়ে আমি এক বৃদ্ধের করুণ বিলাপ শুনেছিলাম। ও দেশের চেক দিকের বড় শহর প্রাগ, আর শ্লোভাক দিকের বড় শহর বাতিশ্লাভা। এক সময় ওই শহরের খুব রমরমা ছিল, এখন নিষ্প্রভ। প্রাগ-এর তুলনায় বাতিশ্লাভা বেশ মলিন। তা নিয়ে চেকদের বিরুদ্ধে শ্লোভাকদের বেশ ক্ষোভ আছে। যাই হোক, এক বৃদ্ধ দিগন্তের দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন, ওই যে ছোট ছোট পাহাড় দেখছ; ওর ওপাশেই ভিয়েনা শহর। এককালে আমরা সকালবেলা ট্রামে চেপে ভিয়েনা চলে যেতাম। সেখানে বিয়ার খেতাম, কনসার্ট শুনতাম, বাড়ি ফিরে আসতাম মাঝরাতে। সরকারের কতকগুলো গর্ধভ সীমানায় পাহারা বসিয়ে এখন আর আমাদের ভিয়েনা যেতে দেয় না। সেই বৃদ্ধের বিলাপ শুনে মনে হয়েছিল, তাঁকে খেতে পরতে দিয়ে একটা বড়সড়ো খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়েছে।

প্রাগ শহরে গিয়েছিলাম, একটি বইয়ের দোকানে গিয়ে খোঁজ করেছিলাম ফ্রানৎস কাফকার কয়েকটি বইয়ের। আমাদের সঙ্গিনী গাইডটি বেশ সাহসের সঙ্গে চেঁচিয়ে বলেছিল, জানো না, এই শুয়োরের বাচ্চারা আমাদের কাফকা পড়তে দেয় না! আমি হতবাক! ফ্রানস কাফকা চেকোশ্লোভাকিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত লেখক, প্রাগ শহরে তাঁর মূর্তি আছে। অথচ তাঁর রচনা সে দেশের লোককে পড়তে দেওয়া হয় না! এই সিদ্ধান্ত কারা নেয়? সেদিনই লেখক সমিতির এক সভায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে আমি ফস করে জিগ্যেস করলাম, তোমাদের দেশে কাফকার বই পাওয়া যায় না কেন? ওঁদের এক মুখপাত্র, বেশ হোমরা চোমরা চেহারা, পার্টির উচ্চ পদাধিকারী মনে হয়, বললেন কে বলেছে পাওয়া যায় না, যায় তো! আমি নাছোড়-বান্দার মতো বললাম, দোকানে খোঁজ করেছি, তারা বলল, নেই, কুড়ি বছর ধরে নেই! ভদ্রলোক জোর দিয়ে বললেন, নেই মানে আউট অফ প্রিন্ট! নিষেধ কিছু নেই। এটা একটা ডাহা মিথ্যে কথা! কুড়ি বছর ধরে কোনও প্রধান লেখকের সমস্ত রচনা আউট অফ প্রিন্ট থাকতে পারে? নিষিদ্ধ করার চেয়েও এই মিথ্যেটা আরও বেশি অন্যায়। সাধে কি আর সেখানে ক্ষমতাসীন পার্টির ওপর সাধারণ মানুষের এত ক্রোধ জমে ছিল!

দুই দেশের চলাচলের মধ্যে বিধিনিষেধ জারি করেছিল পূব জার্মানি এক-তরফাভাবে। ধনতন্ত্রের নষ্টামি ও ভোগ্যপণ্যের প্রলোভন যাতে এদিকে না আসতে পারে তাই পূর্ব দিকের এই কড়াকড়ি। পশ্চিম কিন্তু সব সময় পূর্বের মানুষদের স্বাগত জানিয়েছে। সমাজতন্ত্রের চেতনা এসে এদিককার ধনতন্ত্রকে বিষিয়ে দিতে পারে, এ ভয় তারা পায়নি। এটা একটা অদ্ভুত ব্যবস্থা। বার্লিনের দেওয়াল যারা আগে দেখেছে, তারা সবাই জানে পশ্চিম দিকে কোনও বিধিনিষেধ নেই। পুলিশ-মিলিটারি নেই, যার খুশি দেওয়ালের কাছে আসতে পারে, কত লোক সেই দেওয়ালে ছবি এঁকেছে, কাব্য রচনা করেছে, অনেক দুঃখের বাণী লিপিবদ্ধ করেছে! আর দেওয়ালের পূর্ব দিকে ধারে কাছে কেউ আসতে পারবে না, কিছু দূর অন্তর অন্তর গম্বুজের ওপর মেশিনগান হাতে প্রহরী, হিংস্র কুকুর ছাড়া রয়েছে নীচে, পূর্ব থেকে কেউ পালাতে চাইলেই মরবে। তবু বহু লোক প্রাণ তুচ্ছ করে পালিয়ে এসেছে। তারপর একদিন তারা দল বেঁধে দেওয়াল ভাঙতে এল।

বিনা যুদ্ধে দুই প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মিলন বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে একটা বিরাট ঘটনা। আমি ভুক্তভোগী, দেশবিভাগের ক্ষত আমার বুকে এখনও দগদগ করে। তাই একই জাতির দুটি অংশ আবার স্বেচ্ছায় পুনর্মিলিত হতে যাচ্ছে, এই ঐতিহাসিক দৃশ্যটির সাক্ষী থাকবার জন্যই আমি অক্টোবরের তিন তারিখে বার্লিন গিয়েছিলাম।



এককালে অবিভক্ত বার্লিন শহরের প্রতীক ছিল বিশাল, জমকালো ব্রান্ডেনবুগ গেট। এখানেই উন্টার ডেন লিনডেন একটি ভুবনবিখ্যাত সুদৃশ্য রাস্তা। অদূরেই রাইখস্ট্যাগ প্রাসাদ, যা এক সময়ে ছিল জার্মানির পার্লামেন্ট, দলবল নিয়ে এর মধ্যে আগুন লাগিয়ে দেবার ছুতোয় বিরোধীপক্ষকে ঘায়েল করে হিটলার একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়। পটসডামের প্লাতস ছিল একটি ব্যস্ত চৌরাস্তা, সেখানেই মাটির নীচে তৈরি হয় গুপ্ত বুংকার। এই অঞ্চল থেকেই হিটলার বিশ্বব্যাপী মারণযজ্ঞ চালিয়েছিল। মিত্র বাহিনীর ট্যাংকগুলি যখন গোলাগুলি ছুড়তে-ছুড়তে রাস্তায় এসে পড়েছিল, তখন মাটির নীচে হিটলার নিজের মাথায় গুলি চালায়।

এই অঞ্চলটি বিশ্ব ইতিহাসের পানিপথ!

আবার এখানেই সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে, বাতাসে একটুও বারুদের গন্ধ না ছড়িয়ে দুই জার্মানির মিলন-উৎসব হল। বিনা যুদ্ধে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মতন দুই প্রবল প্রতিপক্ষ হাত মেলালো। এটাও বিশ্ব ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ঘটনা।

বারুদের গন্ধ একেবারে ছিল না বলাটা ঠিক হল না। ছিল, তবে তা গোলাগুলির নয়। বাজির। দু-তারিখ রাত্রি ঠিক বারোটার পর বাজি ফাটতে লাগল, আকাশে উড়ল শত-শত বর্ণাঢ্য হাউই। বিমান থেকে বোমা বর্ষণের বদলে মাটি থেকে উত্থিত হাউইগুলির ঝলমলে রঙে আকাশ রাঙিয়ে দেওয়ায় কত তফাত! একই জায়গা, একই মনুষ্যজাতি, কখনও হিংসায় পরস্পরের দিকে অস্ত্র হেনেছে, কখনও বন্ধুত্বে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছে।

সন্ধে থেকেই এখানে সমবেত হয়েছিল কয়েক লক্ষ মানুষ। কথা ছিল প্রেসিডেন্ট বুশ, মিখাইল গর্বাচভ, মার্গারিট থ্যাচার প্রমুখ রাষ্ট্রনায়ক-নায়িকারা উপস্থিত থাকবেন এই মিলন-উৎসবে, কিন্তু এর মধ্যে ইরাকের সাদ্দাম হুসেন মধ্যপ্রাচ্যে কুয়ায়েতি কাণ্ডটি ঘটাবার পর সবাই বিচলিত ও ব্যস্ত, তাঁরা আসতে পারেননি কেউ। অবশ্য এই রাত্তিরে নেতাদের বক্তৃতারও তেমন গুরুত্ব নেই, দু-দিকের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত হাত মেলানোই বড় কথা, মাঝখানের বিভেদের দেওয়াল ভাঙার সঙ্গে-সঙ্গেই তো মিলনপর্ব শুরু হয়ে গেছে। মধ্যরাত্রি পার হওয়া মাত্র সমস্ত গির্জায় গির্জায় বেজে উঠল, ঘণ্টা, কনসার্ট হলে ধ্বনিত হল বিটোফেনের নাইনথ সিমফনি, আকাশে ভাসল আলোর মালা। সঙ্গীত ও আলোর মধ্যেই ঘোষিত হল জার্মান জাতির পুনর্জন্মের বার্তা।

এমনও আশঙ্কা ছিল যে এই উৎসবের মধ্যে আকস্মিক কোনও হামলায় আনন্দের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। সকলেই যে মনে-প্রাণে এই মিলন মেনে নিয়েছে এমন তো নয়, এমন হতে পারে না। সমাজতন্ত্রের ভাবধারায় যারা সত্যিকারের দীক্ষিত তাদের ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রতি বদ্ধমূল ঘৃণা থাকতেই পারে। কিংবা পূর্ব দিকে যারা ক্ষমতার মৌরসীপাট্টায় ছিল, তাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ক্ষোভ হঠাৎ বিস্ফোরিত হতেই পারে। আবার এদিকের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যারা সচ্ছল, তাদেরও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি রয়েছে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য। অনেকেই মিলনের সমর্থক নয়। কিন্তু জার্মানির অন্যান্য শহরে দু-একটা ছোটখাটো গোলমাল হলেও বার্লিনের মূল উৎসব নিরুপদ্রবেই শেষ হল, অনেক রাত পর্যন্ত বাজি পুড়িয়ে, বিয়ার পান করে ও সমবেত গান গেয়ে ভোরের দিকে সবাই শুতে গেল, ঘুমোল পরের দিন অনেক বেলা পর্যন্ত। ৩রা অক্টোবর জাতীয় ছুটির দিন ঘোষিত হয়েছে।

জার্মানরা ছুটির দিনে সাধারণত বাড়ি থেকে বেরুতেই চায় না। কিন্তু বিকেলের দিকে আমরা ট্যাক্সি নিয়ে ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের দিকে এগোতে গিয়ে পদে-পদে থামতে হল। দারুণ ট্র্যাফিক জ্যাম, খানিক বাদে ট্যাক্সি ড্রাইভারই বলল, এরকমভাবে যেতে গেলে তোমাদের অনেক পয়সা খরচ হয়ে যাবে, এর চেয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়াই ভালো।

হাঁটতে-হাঁটতে খানিক দূর যাওয়ার পর দেখলাম, মানুষের ভিড় এতই বেশি যে পুলিশ আর কোনও গাড়িকে সামনের দিকে যেতেই দিচ্ছে না। এখনও অনেকটা পথ। আমি ও বাদল বসু আগে বার্লিনে এলেও রাস্তা-ঘাট তেমন চিনি না। অনেককাল বার্লিন প্রবাসী পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের সংক্ষিপ্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল চেক পয়েন্ট চার্লির দিকে। চার বছর আগে এই সীমান্তদ্বার দিয়ে আমরা কয়েকজন পূর্ব বার্লিনে গিয়েছিলাম, সেবার সমরেশ বসুও সঙ্গে ছিলেন। ভারতের সঙ্গে পূর্ব জার্মানির সুসম্পর্ক থাকা সত্বেও ওই চেক পয়েন্ট চার্লি পার হতে আমাদের অনেক বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়েছিল, প্রহরীদের উৎকট গাম্ভীর্যমাখা মুখ, শিকারি কুকুরদের বুক কাঁপানো হুঙ্কার, জালে ঘেরা সরু পথ দিয়ে অনেকটা হাঁটতে বাধ্য করা, একটা ঘরের মধ্যে খামোকা বসিয়ে রাখা। সমরেশ বসু অসুস্থ ছিলেন, বারবার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলছিলেন, কেন, কেন এরা মানুষকে এত অবিশ্বাস করে!

আজ সেইসব অপ্রয়োজনীয় সতর্কতা, পাহারা, অস্ত্রধারী সৈনিকদের এলাহি ব্যবস্থা কোন হাওয়ায় উড়ে গেছে। দেওয়াল ভাঙা, কাঁটা তারের বেড়া এখানে সেখানে গোটানো, শিকারি কুকুরগুলো কিনে নিয়ে গেছে বিভিন্ন দেশের ধনী কুকুর-প্রেমিকেরা। একটা ফাঁকা চুঙ্গি ঘরে বসে তিনটি বাচ্চা ছেলে মিলিটারি-মিলিটারি খেলছে। আমাদের দেখে তারা বলে উঠল, হল্ট। পাসপোর্ট! তারপর খিলখিল করে হেসে এ-ওর গায়ে গড়াতে লাগল। এই সরল সুন্দর বাচ্চাদের মুখগুলো দেখে চারবছর আগেকার সেই রক্ত চক্ষু প্রহরীদের মুখের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করি।

পথে-পথে জনারণ্য, অনেকে ছোট ছেলেমেয়েদের হাত ধরে এনেছে, যাতে তারাও এই ঐতিহাসিক ঘটনার অংশীদার হতে পারে। ফুটপাথে বসে গেছে অজস্র অস্থায়ী দোকান, সেখানে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের সুভেনির, প্রাক্তন পূর্ব জার্মানির প্রহরীদের টুপি, ইনসিগনিয়া, বার্লিন দেওয়ালের টুকরো। এই দেওয়ালের টুকরো স্মারক হিসেবে রেখে দিতে অনেকেই চায়। কিছু কিছু অত্যুৎসাহী তরুণ-তরুণী নিজেরাই হাতুড়ি -খন্তা এনে দেওয়াল ভাঙছে। তখনই আমরা দেখলাম, কী শক্ত করে তৈরি করা হয়েছিল এই দেওয়াল। ভেতরে-ভেতরে লোহা বসানো রি-ইনফোর্সড কংক্রিট। দড়াম-দড়াম করে হাতুড়ির ঘায়েও একটা চল্টাও উঠছে না। যারা এই দেওয়াল বানিয়েছিল, তারা ভেবেছিল, এই বিভেদের প্রাচীর চিরস্থায়ী হবে। দেওয়ালের এক দিকটা বর্ণহীন, সেখানে কারুর হাত ছোঁয়াবার অধিকার ছিল না, অন্যদিকে নানারকম রঙিন ছবি ও কবিতা। দেখা যাচ্ছে ছবি ও কবিতাই জয়ী হল।

এক জায়গায় সেই উঁচু প্রাচীরের ওপর উঠে এক জোড়া যুবক-যুবতী গান গাইছে। মাত্র বছর খানেক আগেও ওইভাবে পাঁচিলের ওপর বসলে তাদের গুলি খেয়ে মরতে হত। এখন অনেক মানুষ তাদের গান শুনে হাততালি দিচ্ছে।

যেখানে সেখানে বসে গেছে এরকম গানের দল। লোকসঙ্গীতে সমসাময়িক ঘটনার উল্লেখ। এ যেন জয়দেব-কেঁদুলির মেলা।

এই সীমানা-ভাঙা মানুষের উচ্ছ্বাস আনন্দ দেখে আমার ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে যায় দুই বাংলার মাঝখানের গভীর বিভেদের রেখার কথা। মনে তো পড়বেই। কলকাতা থেকে পশ্চিমবাংলার সীমানা পর্যন্ত রাস্তাটির নাম আজও যশোর রোড। ওপারের রাস্তাটির নামও যশোর রোড। এ যেন আমাদের উন্টার ডেন লিনডেন। দুই ভিয়েতনাম এক হয়ে গেছে, দুই কোরিয়া মিলনের আলোচনা চালাচ্ছে। আর আমাদের দুই বাংলা? 'হায় ধর্ম, এ কী সুকঠোর দণ্ড তব!'

চেক পয়েন্ট চার্লির একটি প্রবেশপথের কাছে প্রচুর পুলিশের সমাবেশ, আশেপাশের উঁচু বাড়িগুলির প্রতিটি জানলায় নারী-পুরুষরা দূরের কী যেন দেখছে। মাইক্রোফোনে বারবার কিছু ঘোষণা করা হচ্ছে, পঙ্কজ আমাদের বুঝিয়ে দিল যে, একটা মিছিল আসছে, তাই সাবধান করে দিচ্ছে পুলিশ। পথচারীদের সরে যেতে বলছে।

অনেকে ছুটোছুটি করতে লাগল, কিন্তু একটা মিছিল এলে ভয় পেয়ে পালাতে হবে কেন? পাশে দাঁড়িয়ে দেখা যায় না। মিছিলটা সম্মিলিত বামপন্থীদের, তাদের মধ্যে উগ্রপন্থী, নৈরাজ্যবাদী ও আরও অনেক রকম দল আছে, তারা গোলাগুলি ছুড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে। তা ছাড়া, এই বার্লিনেই আছে নিও-নাতসি দল, তারা বামপন্থীদের সাংঘাতিক বিরোধী, তারাও হঠাৎ এসে আক্রমণ করতে পারে এই মিছিল।

আমরা প্রথমে একটা মাঠের মধ্যে সরে গিয়েও আবার কৌতূহল দমন করতে না পেরে ফিরে এলাম রাস্তার ধারে। মিছিলটি বেশ বড়, অন্তত দশ-পনেরো হাজার লোক তো হবেই। নানারকম ফেস্টুন ও প্লাকার্ড, পোশাকও বিচিত্র, অনেকের মুখোশ পরা, কেউ-কেউ কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকেছে, যাতে তাদের চিনতে না পারা যায়। মিছিলের দু'পাশে হাঁটছে প্রায় সমান সংখ্যক পুলিশ, অস্ত্রধারী, কিন্তু নত মুখ, তারা মিছিলে কোনও বাধা দেবে না, বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতেও দেবে না। শেষ পর্যন্ত কোনও সংঘর্ষ হল না।

মিছিলের উচ্চ কণ্ঠে স্লোগান দুই জার্মানির মিলনের বিরুদ্ধে। ভোগ্যপণ্য ও ধনতন্ত্রের চাকচিক্যের মোহে পূর্ব জার্মানির এই আত্মসমর্পণ ঠিক হয়নি।

বামপন্থীদের এই প্রতিবাদ মিছিলে কয়েক হাজার মানুষ যোগ দিয়েছে বটে, কিন্তু ঘরে-ঘরে আরও লক্ষ-লক্ষ মানুষের মনে এই রকম সংশয় রয়েছে। এত দ্রুত সব ঘটনা ঘটে যাওয়ায় অনেকেরই খানিকটা ভ্যাবাচাকা অবস্থা। পূর্ব জার্মানির শাসকদলের বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষ প্রথমে রাস্তায় নেমেছিল, তারা চেয়েছিল শাসক শ্রেণির অপসারণ, দুই জার্মানির মিলনের ধ্বনি তখনও ওঠেনি। ক্রমশ আবেগ উত্তাল হয়ে উঠল, প্রহরীদের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে হাজার-হাজার মানুষ ছুটে গিয়ে বার্লিনের দেওয়াল ভাঙতে লাগল। একটুখানি ভাঙা গর্ত দিয়ে বহু লোক চলে এল পশ্চিমে, সেখানেও তারা কোনও বাধা পেল না, বরং পেল উষ্ণ অভ্যর্থনা, হাতখরচ হিসেবে পশ্চিম জার্মানির দুর্লভ মুদ্রা এবং আশ্রয় ও জীবিকার আশ্বাস। প্রথম দিকে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির বিশেষ কেউ পূর্ব থেকে পশ্চিমে আসেনি, এসেছে দলে-দলে শ্রমিক শ্রেণি। শ্রমিকরাই সমাজতন্ত্রের মেরুদণ্ড, অথচ শ্রমিকরাই যদি এই ব্যবস্থা ছেড়ে অন্য ব্যবস্থার দিকে আকৃষ্ট হয়, তাহলে আর সমাজতন্ত্র টিঁকিয়ে রাখা যাবে কী করে? পোল্যান্ডে লেক ভালেনসার নেতৃত্বে আন্দোলনই সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিল যে, শ্রমিকরাও এই ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ।

পশ্চিম জার্মানিতে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ এই মিলনকে স্বাগত জানিয়েছে বটে, আবার অনেকে ভিন্নমতও পোষণ করেছে। গুন্টার গ্রাস-এর মতন কিছু কিছু লেখক-বুদ্ধজীবী বলেছেন, এত তাড়াহুড়ো করে দুই জার্মানির মিলনের প্রয়োজন ছিল না।

সত্যি কথা বলতে কী, ঐতিহাসিক তেসরা অক্টোবরে সারা জার্মানিতে যত বিরাট উৎসব ও আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখা যাবে বলে আশা করা গিয়েছিল, ততটা দেখা যায়নি। বার্লিনে বড় আকারের উৎসব-আড়ম্বর হয়েছে বটে, কিন্তু জার্মানির অন্যান্য শহরে কিছু পটকা ফেটেছে, বাজি পুড়েছে, কিছু গান-বাজনা হয়েছে মাত্র, তেমন কিছু উদ্দামতা ছিল না। সব মিলিয়ে বরং যেন একটা নির্লিপ্ত ভাব।

এর একটা কারণ, গত নভেম্বরে যখন দেওয়াল ভাঙতে শুরু করল, দলে দলে লোক এদিকে আসত লাগল, দু-দিকের যাতায়াতে আর কোনও বাধা রইল না, তখনই বোঝা গিয়েছিল, দুই জার্মানিকে আর আলাদা করে রাখা যাবে না। দুই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরও মাঝখানে সীমানা থাকে, সেই সীমানা নিয়ে ঝগড়াও হয়, যেমন হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চিনের, হাঙ্গেরির সঙ্গে রুমানিয়ার। মাঝখানে কোনও সীমানা থাকবে না, অথচ একটি সমাজতান্ত্রিক ও একটি ধনতান্ত্রিক দেশের সহাবস্থান হবে, পৃথিবী এখনও এর যোগ্য হয়ে ওঠেনি।

অর্থাৎ দুই জার্মানির মিলন দেওয়াল ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, তেসরা অক্টোবর তার চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হল মাত্র। সাধারণ মানুষের মাতামাতি এই কয়েক মাসে অনেকটা কমে এসেছে, মনে অন্য প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি মারছে।

হির্সবার্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের স্ত্রী ট্রুডবার্টাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, দুই জার্মানির মিলনে আপনি খুশি? তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, এত কালের বিচ্ছেদটাই ছিল অস্বাভাবিক, এই মিলনের বাসনা প্রত্যেক জার্মানের মনের মধ্যে ছিল। ফ্রাংকফুর্ট আমাদের বাংলাদেশি বন্ধু ইউসুফের স্ত্রী ক্লাউডিয়াকে ওই একই প্রশ্ন করতে সেও বলেছিল, জার্মানরা একই জাতি, একই ভাষা, তবু তারা দুটো আলাদা দেশের নাগরিক হয়ে কেন থাকবে? সে সদ্য তরুণী, সে দারুণভাবে জার্মান! এ ছাড়াও বিভিন্ন শহরে কিছু সাধারণ জার্মানদের কথাবার্তা শুনে বুঝেছি, সীমানা মুছে যাওয়ায় তারা আনন্দিত। এটা যেন তাদেরই জয়। তবু কিছু কিছু সংশয় তাদের মনে এখন উঁকি ঝুঁকি মারছে। আবেগ ও উচ্ছ্বাস কেটে গেলে কিছু কিছু বাস্তব সত্য মনে পড়ে। পশ্চিম জার্মানি অর্থনৈতিকভাবে খুবই শক্তিশালী দেশ, বিশ্বের প্রধান তিনটি দেশের অন্যতম, তবু এত বড় একটা বোঝা ঘাড়ে নিয়ে কি সামলাতে পারবে? এখানকার নাগরিকরা এতদিন যতখানি আরামে-বিলাসে ছিল, তার কিছু কিছু তো ছাড়তে হবে বটেই। ট্যাক্সের বোঝা চাপবে, এর মধ্যেই কিছু কিছু জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। পশ্চিমের তুলনায় পূর্বের কলকারখানাগুলি অনুন্নত। সেগুলির আধুনিকীকরণ প্রয়োজন, কাজ দিতে হবে প্রচুর বেকারকে। পশ্চিম জার্মানিতে বহু সংখ্যক বিদেশি শ্রমিক ও কর্মী রয়েছে, তুর্কি, ইতালিয়ান, ভারতীয়-বাংলাদেশি-পাকিস্তানিও। তাদের নিয়ে কী হবে, এবার কি তাড়িয়ে দিতে হবে এই হাজার-হাজার মানুষকে?

পূর্বের লোকদের মধ্যেও বাঁধ ভাঙার প্রাথমিক আনন্দ ও জোয়ার কিছুটা স্তিমিত হওয়ার পর তাদের মনেও প্রশ্ন জাগে। পুনর্মিলিত দেশে তাদের অবস্থাটা ঠিক কীরকম হবে। বিরাট ধনীর বাড়িতে গরিব আত্মীয়ের আশ্রয় নেওয়ার মতন? এরা আশ্রয় দিচ্ছে, হাত খরচ দিচ্ছে, এরপর কাজের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে, কিন্তু তার মধ্যে কী খানিকটা দয়া-দাক্ষিণ্যের ভাব নেই? পশ্চিমের বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, পূর্বের লোকেরা কাজ করতে জানে না, অলস।

যেখানেই পূর্ব-পশ্চিমের ভাগাভাগির প্রশ্ন আসে, সেখানেই একটা যেন দো-টানার ভাব থাকে। পূর্ব ও পশ্চিম পরস্পরকে ঠিক যেন গ্রহণ করতে পারে না, আবার বর্জনও করতে পারে না, আকর্ষণ-বিকর্ষণের খেলা চলতে থাকে। মানুষের ইতিহাসেই বারবার দেখা যায় পূর্ব-পশ্চিমের এই দ্বন্দ্ব ও টান। তার কারণ, আমার ধারণা, প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যেও থাকে পূর্ব-পশ্চিম, উদয় ও অস্তের বৈপরীত্য।

গরিবেরও আত্মমর্যাদা বোধ থাকে। সব গরিব কখনও ধনী আত্মীয়দের দিকে লোলুপ হয়ে ছুটে যায় না। সমাজতান্ত্রিক দেশের মানুষের সেরকম আত্মমর্যাদা বোধ থাকাই স্বাভাবিক। তবু পূর্ব থেকে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ দেওয়াল ভেঙে পশ্চিমের দিকে যেতে চাইল কেন? শুধু ভোগ্যপণ্য আর ধনতন্ত্রের চাকচিক্যের লোভে? ধনতন্ত্র ও গণতন্ত্রের চেয়েও সমাজতন্ত্র নিঃসন্দেহে আদর্শ হিসেবে উচ্চতর। আমি এখনও তা বিশ্বাস করি। তবু সেই আদর্শের ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না কেন?

মানুষ আদর্শ চিবিয়ে খায় না। আদর্শের জন্য অনেকে প্রাণ পর্যন্ত দেয়, সাধারণ মানুষও কিছু কিছু আত্মত্যাগ করতে রাজি থাকে। একটা সমাজ ব্যবস্থার যখন পালাবদল ঘটে তখন কিছু কিছু বিপর্যয় দেখা দিতে বাধ্য। উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, সাধারণ মানুষকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। কিন্তু কতদিন? পাঁচ বছর, দশ বছর? পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে নিশ্চয়ই নয়। পুরো একটা প্রজন্ম শেষ হয়ে গেল। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পালাবদলের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কথা অত মনে রাখে না। তারা দেখে যে যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান যদি সব দুর্যোগ সামলে নিয়ে এত সচ্ছল হতে পারে, তা হলে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি পারবে না কেন? সমাজতান্ত্রিক দেশে বিধি-নিষেধের কঠিন বন্ধন, অথচ ওসব দেশের মানুষ খোলামেলা। এই মুক্তির টানে এবং পেটের টানেই দেওয়াল ভেঙেছে।

শুধু ভোগ্য পণ্য, অর্থাৎ গাড়ি, ফ্রিজ, টিভি, চকলেট, মদের লোভ নয়, সমাজতান্ত্রিক দেশের মানুষদের প্রতিদিনের মূল খাদ্যেও টান পড়েছিল। মাংস আছে তো রুটি নেই, রুটি আছে তো মাখন নেই। দুধ নেই। শাক-সবজি ফল-মূল নেই, কফি নেই। এই নেই-এর তালিকা এক-একটা দেশে আরও সুদীর্ঘ। রুমানিয়ায় টয়লেট পেপার পর্যন্ত পাওয়া যায় না। ইলেকট্রিসিটি অকুলান, প্রচণ্ড ঠান্ডায় লোকে ঘর গরম করতে পারেনি। মাংস, রুটি, আলু, মাখন, আর দুধ, এইগুলি ইউরোপীয়দের প্রধান খাদ্য, এতেও টান পড়লে কত বছর তারা আদর্শ আঁকড়ে থাকবে?

সমাজতান্ত্রিক দেশের মানুষ গরিব হয়ে থাকবে, যুগের পর যুগ কৃচ্ছ্রসাধন করবে। এমন কথা মার্কসবাদে কোথাও নেই। বরং এই ব্যবস্থায় সব মানুষের সচ্ছল, সুখী থাকার কথা। তবু কোনও গলদে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির উৎপাদন কমে গেল, সাধারণ মানুষকে নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসগুলিও দিতে পারল না সরকার? অথচ অন্যদিকে ইউরোপের যেসব দেশ এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, ধনতন্ত্র-গণতন্ত্র আঁকড়ে আছে, তারা দিব্যি ফুলে ফেঁপে উঠল কী করে? সেসব দেশে সব জিনিসই অঢেল।

আমার একটা কথা ভেবে আশ্চর্য লাগে। অনেক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মার্কসবাদে বিশ্বাসী এবং সমাজতন্ত্রের সমর্থক। অনেক তাত্বিক ও অধ্যাপক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নানারকম ব্যাখ্যা করেছেন এবং শিষ্য-প্রশিষ্য পরম্পরায় তা প্রচার করে আসছেন। তাঁরা বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও শ্রদ্ধেয়, কিন্তু আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্র সমর্থনীয় হলেও তার রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়োগে যে অনেক ছিদ্র দেখা যাচ্ছে, সেসব দেশে যে অনেক বছর ধরেই নানা রকম অব্যবস্থা ও অনটন চলছে, সে সম্পর্কে তাঁরা কখনও কিছু বলেননি কেন? জানতেন না, কিংবা জেনেশুনেও সত্য গোপন করেছেন? এতরকম সেমিনারে তাঁরা ওই রকম সব দেশে যান। তাঁদের চোখে পড়েনি? নিছক প্রচার পুস্তিকার ওপর নির্ভর না করে ওইসব দেশের প্রকৃত অবস্থা জানার আগ্রহ তাদের হয়নি? একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি বছরখানেক আগে আমাকে আফসোসের সুরে বলেছিলেন, মস্কোয় মাংস পাওয়া যায় না, সোসালিজম টিঁকবে কী করে? আমি অবাক। তিনি অন্তত পঞ্চাশবার মস্কো গেছেন। সেখানে যে প্রায়ই মাংস পাওয়া যায় না, কখনও মাংস এলে দোকানের সামনে লম্বা লাইন পড়ে, তা কি তিনি জানতেন না? গর্বাচভ পেরেস্ত্রোইকা ঘোষণা করার পর তিনি মুখ খুলেছেন? সমাজতন্ত্রের সমর্থন করেও তার বাস্তব প্রয়োগের দোষত্রুটির বিচার-বিশ্লেষণ করা যেত না? সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধীরা এর যত না ক্ষতি করেছে, সম্ভবত তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করেছে এর সমর্থক ও শাসকদের মিথ্যাচার ও গোপনীয়তা। সত্যকে কিছুতেই বেশিদিন চেপে রাখা যায় না। গর্বাচভ বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী মানুষ, তিনি তা বুঝতে পেরেই বিক্ষুব্ধ মানুষদের বিরুদ্ধে অস্ত্র সংবরণ করেছেন, খুলে দিয়েছেন দ্বার।



বিভক্ত অবস্থায় পূর্ব বার্লিন আমি একবার দেখেছি। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমের তুলনায় সমাজতান্ত্রিক পূর্বের জাঁকজমক কম ছিল, কিন্তু একটা নিরলঙ্কার সৌন্দর্য চোখ টেনেছিল। পশ্চিমের এক-একটি শহর এত বেশি ঝকঝকে তকতকে, এত বেশি নিখুঁত যে এক-এক সময় বেশ একঘেয়ে লাগে। যেমন ফ্রাংকফুর্ট শহর, যাতায়াতের সবরকম সুবিধে আছে, পৃথিবীর যে-কোনও খাবার পাওয়া যায়, সমস্ত রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন, তবু মুগ্ধ হওয়ার মতন কিছু নেই। সেই তুলনায় পূর্ব বার্লিনের একটা চরিত্র আছে, এবং প্রাচীন শহরের অংশ হিসেবে দ্রষ্টব্য অনেক। মহাযুদ্ধের পর ভাগাভাগির সময়ে সোভিয়েত অংশেই বেশিরভাগ মিউজিয়াম, পুরোনো গির্জা ইত্যাদি পড়েছে। চমৎকার গাছপালা দিয়ে সাজানো বিশ্ববিখ্যাত উন্টার ডেন লিনডেন রাস্তার দুপাশে বিশাল সব বারোক-রোকোকো ধরনের প্রাসাদ। এবং তৈরি হয়েছে প্রচুর নতুন বাড়ি, বিরাট বিরাট হাউজিং কমপ্লেক্স। দেশের প্রতিটি নাগরিককে জীবিকার ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে বাসস্থান দিতেও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা ভারতীয়, আমরা ভারতের গ্রামের মানুষের অবস্থা জানি, শহরের ফুটপাথের অজস্র সংসার দেখেছি, আমাদের কাছে এই প্রতিশ্রুতি, সমস্ত মানুষের জন্য জীবিকা ও পাকা বাড়িতে মাথা গোঁজার মতন স্থান, এই দুটি জিনিসই তো সার্থকতার চরম। এই জন্যই তো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য আমাদের বিপ্লবের স্বপ্ন।

অবশ্য সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলি দেশের সর্বত্র এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছে কি না সে বিষয়ে অনেক পরস্পরবিরোধী কথা শোনা যায়। একই ফ্ল্যাটে দু-তিনটি পরিবারকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিংবা জীবিকার ক্ষেত্রে যোগ্যতার মূল্য দেওয়া হয় না ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ে কোনও মন্তব্য করার অধিকার আমার নেই। আমি নিজের চোখে যা দেখেছি কিংবা পারিপার্শ্বিক দেখে যেটুকু বুঝেছি, তার বাইরে যেতে চাই না।

পূর্ব বার্লিনে, সোভিয়েত ইউনিয়নে, যুগোশ্লাভিয়ায় আমি সরকারের বানানো ফ্ল্যাটে গিয়েছি কয়েকটি পরিবারের কাছে। বাড়িগুলো আহামরি কিছু না, আমাদের দেশের সরকারি বাড়ির মতনই সস্তা দায়সারা বলে মনে হয়। লিফটের চেহারা বেশ খারাপ, হয় খুব ছোট, দু-তিনজনের বেশি একসঙ্গে ওঠাই যায় না, অথবা রডগুলো ঘট-ঘটাং শব্দ করে কাঁপে, রক্ষণাবেক্ষণে অমনোযোগ। ফ্ল্যাটের ঘরগুলো খুপরি খুপরি। তবু আমি অভিযোগের কিছু দেখিনি, আমার ভারতীয় চোখে শহুরে বস্তি কিংবা গ্রামের ফুটোফাটা কুঁড়ে-ঘরগুলির তুলনায় ওই সব ফ্ল্যাট অনেকগুণ ভালো!

পশ্চিম বার্লিন ও পূর্ব বার্লিনে গেলে ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের চেহারার বেশ একটা তুলনামূলক রূপ দেখার সুযোগ পাওয়া যেত। পশ্চিম থেকে পূর্বে গেলে মনে হয়নি যে এরা খুব দুঃখ-কষ্টে আছে, মনে হত সব কিছুই তো ঠিকঠাক চলছে, তবু কিছু মানুষ দেওয়াল টপকে ওদিকে যেতে চায় কেন? পশ্চিমের লোকরা অবশ্য বলত, পূর্ব বার্লিন হচ্ছে সমাজতন্ত্রের শো পিস, সীমানার ওপারেই বড় বড় বাড়ি তুলেছে, আর সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে, টুরিস্টদের দেখাবার জন্য। আর পূর্বের কিছু কিছু লোক বলেছে, পশ্চিমের দোকানগুলো কনজিউমার গুডসে ভরতি। ওসব আমাদের না পেলেও চলবে।

এবারে ঠিক করলাম, সদ্য ভূতর্পূব জার্মানির অন্য একটা শহর দেখতে হবে। ফ্রাংকফুর্ট থেকে বার্লিন পর্যন্ত যে টানা সড়ক, তারই এক পাশে একটি শহর আইসেনাখ। এক দুপুরে বাবুল আর জামি নামে বাংলাদেশি দুই তরুণ বন্ধুর সঙ্গে আমি আর বাদল রওনা দিলাম সেদিকে। বাবুল আর জামি দুজনেই এদেশে আছে এক যুগের বেশি সময়।

এই পথ ধরে বার্লিনের দিকে যেতে গেলে খানিকটা পূর্ব জার্মান ছিটমহল পার হতে হত। অর্থাৎ সেই কাঁটাতারের বেড়া, চেক পোস্ট, ওয়াচ টাওয়ার, গোমড়ামুখো রক্ষী। এখন সেই এলাকাটা জনশূন্য, চেক পোস্ট খাঁ-খাঁ করছে, কাঁটাতারের বেড়াটেড়া অনেকটাই উপড়ে ফেলা হয়েছে। একটা ওয়াচ টাওয়ারের গায়ে আলকাতরা দিয়ে বড় বড় অক্ষরে জার্মান ভাষায় কী যেন লেখা। আমি জিগ্যেস করলাম, ওখানে কী লিখেছে? জামি অনুবাদ করে দিল, দোজখের কুত্তা।

সীমান্ত রক্ষীদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল, ওই দুটি শব্দেই তা বোঝা যায়।

রাস্তা দিয়ে যে-সব গাড়ি যাচ্ছে, তার কোন কোনটা পূর্ব জার্মানির মানুষের, তা জামি অনায়াসে বলে দিতে পারে। সে গাড়িগুলোর চেহারা ছোট ছোট, টু স্ট্রোক ইঞ্জিন, পশ্চিমি মজবুত গাড়িগুলির পাশে সেগুলোকে খেলনা-খেলনা মনে হয়। তবু সেগুলোকে বলা যেতে পারে সস্তা জনতা গাড়ি। সীমান্ত খুলে যাওয়ার পরই পূর্ব জার্মানির অনেক লোক পশ্চিমে এসে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনতে শুরু করেছে।

বাবুল বলল, ফ্রাংকফুর্টের রাস্তায় মানুষদের দেখেও আমি বলে দিতে পারি, কারা কারা পূর্ব জার্মানি থেকে এসেছে।

এটা খুবই অবাক হওয়ার মতনই কথা। আমরা শুধু চেহারা দেখে কে ইংরেজ, কে ফরাসি আর কে জার্মান বুঝতে পারি না। আর জার্মানদের মধ্যেই কে পূর্বে থাকে আর কে পশ্চিমে, তা কী করে বলা সম্ভব?

বাবুল বলল, প্রথম তো জুতো দেখলেই চেনা যায়। ছেঁড়াছেঁাড়া, পুরোনো জুতো, তা ছাড়া পোশাকের মধ্যেও এমন একটা কিছু আছে...

মূল রাস্তা ছেড়ে আমরা বাঁক নিলাম আইসেনাখ শহরের দিকে। একটু পরেই আমাদের গাড়িটা লাফাতে লাগল। ভাঙাচোরা রাস্তা, অনেকটা কলকাতা-কলকাতা ভাব। দু'পাশের বাড়িগুলির চেহারা মলিন, অনেক দিন রং করা হয়নি, এখানে সেখানে কিছু আবর্জনা জমে আছে, আমাদের বেশ পরিচিত লাগে।

আইসেনাখ শহরটি কিন্তু ইতিহাস বিখ্যাত। প্রাচীন এই শহরটিতে দ্রষ্টব্য স্থান আছে অনেক, রোমান আমলের ওয়ার্টবুর্গ দুর্গ, তার পেছনেই থুরিঙ্গিয়া অরণ্য। প্রখ্যাত খ্রিস্টিয় সংস্কারক মার্টিন লুথারের নাম এই শহরটির সঙ্গে জড়িত, এখানে তিনি কিছুদিন নির্বাসিত ছিলেন, সেই সময়ই তিনি বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট অনুবাদ করেন গ্রিক থেকে জার্মান ভাষায়, আধুনিক জার্মান গদ্যের বিকাশ হয় সেই অনুবাদ থেকে।

এখানেই জন্মেছিলেন সঙ্গীত কমপোজার বাখ। রিচার্ড ভাগনারও তাঁর একটি বিখ্যাত অপেরা রচনা করেছিলেন এখানে। আর একটি তথ্যও উল্লেখযোগ্য, ১৮৯৮ সালে এই শহরে তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম মোটর গাড়ি। তবে, এখন এখানে যে ছোট ছোট গাড়ি তৈরি হয়, তা পৃথিবীর অনেক দেশের গাড়ির সঙ্গেই পাল্লা দিতে পারে না।

বিকেল গড়িয়ে গেছে বলে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি আমাদের ঘুরে দেখা হল না। আমরা এসে পৌঁছলাম একটা প্রশস্ত চত্বরে, যেখানে একটি অস্থায়ী বাজার বসেছে।

বাজার ঘুরে দেখলে সমাজের স্বাস্থ্য খানিকটা আন্দাজ করা যায়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে পশ্চিমি কনজিউমার গুডসের বিরুদ্ধে একটা প্রচার সব সময় চলেছে, কিন্তু তাদের দেশে যে তরি-তরকারি, মাংস ও ফলমূলের যথেষ্ট অনটন, তা স্বীকার করা হয়নি। আমি অনেকগুলি সমাজতান্ত্রিক দেশের বড়-বড় শহরের বাজার ঘুরে দেখেছি। সেইসব বাজারের তুলনায় আমাদের দেশের যে-কোনও বাজারে অনেক বেশি জিনিস পাওয়া যায়। বুলগেরিয়ার সোফিয়া শহরের বাজারে দেখেছি, মাংসের দোকানের মতন ফুলকপির দোকানের সামনেও লাইন, সেই লাইনে যত লোক দাঁড়িয়ে আছে, দোকানে তত ফুলকপি নেই। কিয়েভ শহরে দেখেছি, একজন লোক শশা হাতে নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, একটি বৃদ্ধা তাকে জিগ্যেস করলেন, শশা কোথায় পাওয়া যাচ্ছে, তারপর সেই দিকে ছুটে গেলেন। শশা জিনিসটাও যে এমন লোভনীয় বা দুর্লভ হতে পারে, তা সেদিনই প্রথম জানলাম। শুধু চিনের কোনও কোনও বাজারে তরিতরকারি ফলমূল যথেষ্ট দেখেছি।

আইসেনাখের বাজারটিতেও বিশেষ কিছুই নেই। আগে একটা সরকারি বাজার ছিল, এখন কিছু কিছু লোক তাদের গাড়ির পেছনের ডালা খুলে কিংবা ছোট তাঁবু খাটিয়ে জিনিসপত্র সাজিয়ে ব্যক্তিগত দোকান খুলে বসেছে। কেউ কেউ কাছাকাছি পশ্চিমি শহর থেকে চকচকে খেলনা, জুতো, হাল ফ্যাশানের পোশাক আর নানারকম ফলমূল কিনে এনে বিক্রি করছে এখানে। এখানে যাদের হাতে একটু পয়সা আছে, সবাই পশ্চিমে বাজার করতে যায়। পশ্চিম বার্লিনে পঙ্কজের স্ত্রী মাধুরী আমাকে বলেছিল, গত কয়েক মাস তার বাচ্চা মেয়ের জন্য দুধের জোগাড় করা খুব মুশকিল হয়ে পড়েছিল। বার্লিনের দেওয়াল ভাঙার পর দলে-দলে পূর্বের মানুষ, বিশেষ করে পোল্যান্ডের লোকেরা এসে প্রচুর জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেত নিজেদের দেশে ব্যাবসা করার জন্য। পোলান্ডে দুধের খুব অনটন, তাই তারা সব দুধ কিনে নিয়ে যেত। পোলান্ডে সেই জন্যই তখন ডলারের ব্ল্যাক মার্কেট তুঙ্গে।

এখানকার বাজারে অনেক জায়গায় কলা বিক্রি হচ্ছে। এত কলা কেন? আমাদের সঙ্গীরা বলল, আহা, ওরা যে অনেকদিন কলা খায়নি!

কলা নিয়ে পশ্চিম বার্লিনে একটা মজার গল্প চালু আছে। এটাকে গল্প হিসেবেই গণ্য করা উচিত।

পাঁচিল তোলার পর পূর্ব ও পশ্চিমের দুটো বাড়ি একেবারে মুখোমুখি। দুটি বাড়িতেই একটি করে বাচ্চা মেয়ে থাকে, তারা জানলা দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে। একদিন পশ্চিমের মেয়েটি একটি ইলেকট্রনিক খেলনা দেখিয়ে বলল, এই, তোদের এটা আছে? পূর্বের মেয়েটি একটা সুন্দর পুতুল তুলে ধরে বলল, ওটা না থাকলে কী হয়, আমাদের এত সুন্দর পুতুল আছে। পশ্চিমের মেয়েটি এক জোড়া নতুন জুতো দেখিয়ে বলল, তোর আছে? পূর্বের মেয়েটি একটা কারুকার্য করা লেসের স্কার্ফ দেখিয়ে বলল, তোর এটা আছে? এইভাবে দুটি মেয়েই নানারকম জিনিস তুলে তুলে দেখাতে লাগল। এক সময় পশ্চিমের মেয়েটি একটা পাকা কলা তুলে দেখিয়ে বলল, তোর কলা আছে? পূর্বের মেয়েটি কখনও কলা চোখেই দেখিনি। কলার বদলে অন্য কোনও ফলও দেখাবার মতন তাদের বাড়িতে নেই। সে তখন কাঁদো-কাঁদো হয়ে মাকে জিগ্যেস করল, মা, আমাদের কলা নেই কেন? মা বললেন, আমাদের কলা নেই তাতে কী হয়েছে, আমাদের কমিউজিনম আছে! পূর্বের মেয়েটি সে কথা জানাতেই পশ্চিমি মেয়েটি একটু দমে গেল। কমিউনিজম কী তা সে জানে না, বাড়িতে তার মা-বাবা কেউ নেই তখন, জিগ্যেসও করতে পারছে না। কিন্তু সে পশ্চিমি কনজিউমার সোসাইটির মেয়ে তো, সে জানে, পয়সা থাকলে সব কিছুই কেনা যায়। তাই সে বলল, ঠিক আছে, আমার বাবাকে বলব, আমার জন্যও কমিউনিজম কিনে দেবে? তখন পূর্বের মেয়েটির মা মেয়েকে বলল, তুই ওকে বলে দে, ও যদি কমিউনিজম কেনে, তা হলে কিন্তু আর কলা পাবে না!

বাজারের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা ধরে আমরা হাঁটতে লাগলাম। দু'পাশে দোকানপাট, এটাই এ শহরের প্রধান বাণিজ্য এলাকা। যে-কোনও পশ্চিমি শহরের তুলনায় দোকানগুলির দৈন্যদশা অতি প্রকট। আমাদের চোখেই এটা ধরা পড়ে। বাবুল ও জামির মতে, এটাকে জার্মান শহর বলে চেনাই যায় না। কোনও দোকানের অনেকগুলো তাক খালি, এমন দোকান পশ্চিম জার্মানিতে কল্পনাও করা যায় না।

এক সময় সবই ছিল সরকারি দোকান, এখনও অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস হয়নি, পালাবদল সবে শুরু হয়েছে, অনেক সরকারি দোকান রয়ে গেছে, পাশাপাশি কিছু ব্যক্তিগত ব্যাবসাও শুরু হয়েছে। অনেক দোকানপাট ভেঙেচুরে নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে, মনে হয় পশ্চিমি ব্যবসায়ীরা সেখানে শাখা খুলছে। মিস্তিরিরা খাটাখাটুনি করছে পূর্ণ উদ্যমে। সরকারি দোকানগুলি নিষ্প্রভ, তার পাশেই কোনও ব্যক্তিগত মালিকানার দোকানে লোকজন বেশি।

চিনে গিয়েও এ জিনিস দেখেছি। মাও সে তুং-এর আমলের চিনে সমস্ত দোকানই ছিল সরকারি, হোটেল-রেস্তোরাঁ, জামা-কাপড়ের দোকান, সেলুন, খবরের কাগজের স্টল, ট্যাক্সি ইত্যাদি সবই। এখন কিছু-কিছু ব্যক্তিগত ব্যাবসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তার ফলে, পাশাপাশি একটা বিরাট সরকারি দোকান ও এক দম্পতির পরিচালনায় ছোট দোকানের তফাতটা বোঝা যায়। সরকারি দোকানের কর্মচারীরা যে-যার নিজের জায়গায় অলস ভঙ্গিতে বসে আছে, খদ্দেররা এলে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন তাদের দয়া করছে, উঠে গিয়ে একটা জিনিস আনতে হলে তারা বরাত দিচ্ছে অন্য একজনের ওপর। আর পাশের ছোট্ট দোকানটিতে স্বামী-স্ত্রী রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দের ডাকছে, কারু একটা জিনিস পছন্দ না হলে তাকে আর পাঁচটা জিনিস দেখাচ্ছে, একটু দাম কমিয়ে দিচ্ছে। সেই দোকানেই ভিড় বেশি।

বেইজিং শহরে একটা মজার কথা শুনেছিলাম। বেশ কয়েকজনের কাছে জেনেছি যে চিনের শিক্ষিত মেয়েরাও এখন বিয়ের পাত্র হিসেবে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে একজন নাপিত কিংবা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বেশি পছন্দ করে। অবাক হওয়ার মতন ঘটনা নয়! এর কারণ এই যে, কিছু কিছু সেলুন ও ট্যাক্সিকে ব্যক্তিগত মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের ধরাবাঁধা মাইনে, পরামানিক বা ট্যাক্সি চালকরা যত খাটবে তত বেশি রোজগার করবে, তারা এখন রীতিমতন ধনী।

আমাদের সঙ্গে একটি সুন্দরী তরুণী আগাগোড়া ছিল গাইড হিসেবে। তার চুলের খুব বাহার। আমি তাকে জিগ্যেস করেছিলাম, তুমি কোন দোকানে চুল কাটতে যাও, সরকারি, না প্রাইভেট? মেয়েটি চিন্তা না করেই উত্তর দিয়েছিল, প্রাইভেট। আমি আরও জানতে চেয়েছিলাম, কেন, সেখানে কি সস্তা? মেয়েটি বলেছিল, না, সস্তা নয়, কিন্তু প্রাইভেট সেলুনে ঢুকলেই মালিক আগ্রহের সঙ্গে হেসে কথা বলে, ব্যক্তিগত যত্ন নেয়।

আমি নিজের চোখে দেখেছি, কলকাতার মতনই, মস্কো শহরের কিছু কিছু ট্যাক্সি ড্রাইভারকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেও মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। সেই ড্রাইভার সরকারের কাছ থেকে মাস মাইনে পাবে, কত যাত্রী সে তুলল বা না তুলল, তাতে কিছু আসে যায় না, সুতরাং সে যাত্রীদের অবহেলা দেখাতেই পারে। কলকাতার কারণটা অবশ্য আলাদা, এখানে কেউ আইন মানে না, ট্যাক্সি ড্রাইভাররা একজনের বদলে পাঁচ-ছ'জন যাত্রী তুলে বেশি লাভ করতে চায়। মস্কোতে এক সন্ধ্যায় যখন আমরা চেষ্টা করেও ট্যাক্সি পাচ্ছি না, তখন একটি প্রাইভেট গাড়ির চালক আমাদের পৌঁছে দিতে চাইল। বিনা পয়সার লিফট নয়, দশ রুবলের বিনিময়ে। এবং ওই দশ রুবল পাবে বলে সে ঠিকানা খুঁজে সযত্নে আমাদের নামিয়ে দিল নির্দিষ্ট বাড়ির দরজায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই, সরকারি চাকরির নিরাপত্তা পেলেই মানুষ কাজে ঢিলে দিতে চায় কেন? অথচ সেই একই লোক যদি নিজস্ব ব্যাবসা খোলে, তাহলে দিন রাত খাটাখাটনি করে। একজন চাষি নিজের ক্ষেতের ফসল ফলাবার জন্য উদয়াস্ত শরীরের ঘাম ঝরায়, আর সেই চাষিই যখন দশজনের সমবায়ের অন্তর্গত হয়, তখন যথেষ্ট শ্রম দেয় না। মানুষ কি পরিশ্রম করে শুধু ব্যক্তিগত লোভ ও লাভের জন্য? সবাই মিলে একটা কিছু উৎপন্ন করে তারপর সবাই মিলে সমান ভাগ করাই তো উচ্চ আদর্শ। এই আদর্শকে কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে, তবু সমবায় গড়লে সকলের শ্রমের আন্তরিকতা কমে যায় কেন?

এই সূত্র ধরে আরও একটা প্রশ্ন আসে। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে যে সকলে মিলে সমান ভাগ করে নেওয়ার আদর্শ, তার জন্য কি মানুষকে তৈরি করা হয়েছে? নাকি তাড়াহুড়ো করে ওপর থেকে ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখায়, যারা সমাজ ব্যবস্থা বদলের জন্য মানুষকে ডাক দেয়, যারা সেই সংগ্রামের নেতৃত্বে থাকে, তারাও কি ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থ ঈর্ষা, প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে? তারা এসব পারেনি বলেই কি আদর্শ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলি তাসের প্রাসাদের মতন ভেঙে পড়ল?



দুই জার্মানি এক হওয়ার মূলে হাঙ্গেরির একটা বিরাট ভূমিকা আছে। সব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই পশ্চিমি দেশগুলির সীমান্তে কঠিন প্রহরায় কাঁটা তারের বেড়া ছিল, এতকাল তারই নাম ছিল 'আয়রন কারটেইন'। হাঙ্গেরিই প্রথম স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অর্গল খুলে দেয় গত বসন্তে। তার জন্যই পূর্ব জার্মানির হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ হাঙ্গেরিতে ঢুকে পড়ে, অস্ট্রিয়া ঘুরে পশ্চিম জার্মানিতে চলে আসতে থাকে।

সাম্প্রতিক সমাজতান্ত্রিক পালাবদলের ইতিহাসে হাঙ্গেরির কাহিনি একেবারে আলাদা ধরনের। হাঙ্গেরিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টিই বিশ্বে প্রথম, যারা কোনও বড় রকম আন্দোলন কিংবা চাপের মুখে না পড়েও আত্মসমালোচনা করেছে। নিজেদের দোষ-ত্রুটি স্বীকার করেছে এবং জোর জবরদস্তির শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনে স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছে।

জার্মানি থেকে আমরা চলে এলাম হাঙ্গেরিতে।

ফ্রাংকফুর্টের বিশ্ব বইমেলা সাঙ্গ হয়ে গেছে, এর পরে বাদল ও আমি কয়েকটি দেশ বেড়াবার কথা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। ইউরোপে আমাদের দুই ভ্রমণসঙ্গী ভাস্কর দত্ত ও অসীম রায়। এর আগে আমরা এক সঙ্গে অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছি। এবারেও খবর পেয়ে ওরা দু'জন ছুটি নিয়ে চলে এল হাঙ্গেরিতে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। অসীম অনেক কিছু জানে শোনে, তার স্বভাবটা সাবধানি ধরনের। আর ভাস্কর অতিশয় এলোমেলো ও বেপরোয়া। এই দুই পরস্পরবিরোধী চরিত্রের জন্য আমাদের ভ্রমণ-আড্ডা খুব জমে যায়।

বুডাপেস্ট এয়ারপোর্টে আমাদের রাঁদেভু। বাদল ও আমি ফ্রাংকফুর্ট থেকে। অসীম ও ভাস্করের প্যারিস ও লন্ডন থেকে আলাদা ফ্লাইটে পৌঁছবার কথা। বাদল ও আমি যথা সময়ে পৌঁছে গেলাম, ভাস্করের আরও আগে পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তার দেখা নেই। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, লন্ডনের ফ্লাইট এসে গেছে বটে, কিন্তু সেটা অন্য এয়ারপোর্টে। সেটা এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। প্যারিসে যেমন ওর্লি আর শার্ল দ্যগল নামে দুটি এয়ারপোর্ট আছে, এখানেও সেইরকম। তা হলে ভাস্করের সঙ্গে যোগাযোগ হবে কী করে? একটুক্ষণ চিন্তা করার পর আমি ইনফরমেশন কাউন্টারে গিয়ে অনুরোধ করলাম, শহরের অন্য এয়ারপোর্টটিতে টেলিফোন করে সেখানে একটা ঘোষণা করিয়ে দিতে পারবেন? লন্ডন থেকে আগত যাত্রী ভাস্কর দত্তকে জানিয়ে দিতে হবে যে অন্য এয়ারপোর্টে তার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।

প্রথমত ইংরিজিতে এই কথাটা বোঝাতেই অনেকটা সময় লেগে গেল। আগেই জেনে এসেছিলাম হাঙ্গেরিতে ইংরাজি ভাষা প্রায় চলে না। কিন্তু এয়ারপোর্টেও ইংরেজি জানা কর্মী থাকবে না! ইনফরমেশন কাউন্টারের এক তরুণী ডেকে আনল অন্য একজনকে, যে আবার আর একজনকে, তৃতীয়জন আমার কথা বুঝল বটে, কিন্তু এই অনুরোধ তার উদ্ভট মনে হল। অনেক পীড়াপিড়ি করার পর সে বেজার মুখে টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ ধরে থাকার পর দায়সারা ভাবে জানাল যে অন্য এয়ারপোর্টে এ নামে কোনও যাত্রী নেই।

কথাটা আমার বিশ্বাস হল না। কিন্তু আর কিছু করার উপায় নেই। আমরা রাত্তিরে কোথায় থাকব তা ভাস্কর জানে না, এই অচেনা শহরে একবার যোগাযোগ হারিয়ে ফেললে খোঁজ পাওয়া খুব মুশকিল হবে। তবু আমার মনে হল, ভাস্কর কিছু একটা ব্যবস্থা করবেই। অসীম পৌঁছে গেল প্যারিস থেকে আমাদেরই এয়ারপোর্টে, যথা সময়ে। তারও খানিক বাদে ভাস্কর এল বীরের ভঙ্গিতে, প্রথমে দুই এয়ারপোর্টের ব্যাপারটা সেও বুঝতে পারেনি বটে, তারপর সে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। এই শহরের অনেক কিছুর হদিশ জেনে নিয়েছে এর মধ্যে।

ট্যাক্সি ড্রাইভারটি অত্যন্ত ভদ্র। এর পরের কয়েকটি দিন আমরা বুডাপেস্ট শহরে যতবার ট্যাক্সি নিয়েছি, প্রত্যেক ড্রাইভারের ব্যবহার ভালো, কেউ ঠকাবার চেষ্টা করেনি, কেউ বেশি পথ ঘুরিয়ে নিয়ে যায়নি। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডগুলিতে অপেক্ষমাণ ট্যাক্সির ড্রাইভার বই পড়ে সময় কাটায়, একজনের হাতে দেখেছি টমাস মান-এর 'ম্যাজিক মাউন্টেন', আর একজনের হাতে এফ ডালি'র লেখা 'রিট অ্যান্ড রিভোল্ট ইন হাঙ্গেরি'। অধিকাংশ ড্রাইভার উচ্চশিক্ষিত। পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে একজন ট্যাক্সি চালকের পরিচয় জেনেছিলাম, তিনি নিউক্লিয়ার ফিজিকস-এর ডক্টরেট। ট্যাক্সি ড্রাইভার বলতেই যে বিশেষ শ্রেণির কথা আমাদের মনে আসে, তাদের সঙ্গে এদের কোনও মিলই নেই। উচ্চশিক্ষিতদের ট্যাক্সি চালাবার মতন স্বাধীন পেশা গ্রহণ করার প্রধান কারণ, সরকারি চাকরির তুলনায় এতে উপার্জন অনেক বেশি। যদিও এতে শিক্ষার অপচয় হয়। ট্যাক্সি চালাবার জন্য নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর জ্ঞানের কোনও প্রয়োজন নেই।

ভিসা পাওয়ার জন্য আজকাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচিত্র সব নিয়ম। আমরা চারজনেই বঙ্গ সন্তান, কিন্তু ভাস্কর ও অসীম যেহেতু হার্ড কারেন্সির দেশ থেকে আসছে, তাই তাদের ভিসা পেতে কোনও অসুবিধে নেই। আর আমাকে আর বাদলকে দামি হোটেল বুক করার শর্তে ভিসা যোগাড় করতে হয়েছে। অসীম প্যারিস থেকেই ফোন করে একটা থাকার জায়গা ঠিক করে এসেছে, বাদল ও আমাকে নির্দিষ্ট হোটেলে নামিয়ে সে ভাস্করকে নিয়ে চলে গেল।

নাম রয়াল গ্র্যান্ড হোটেল। এটাকে অনায়াসে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন বলা যেতে পারে। অতি সাধারণ হোটেল, অযত্নের ছাপ সর্বত্র, ডাবল বেডেড রুম হলেও আমাদের দেওয়া হয়েছে ছোট্ট একটি ঘর, বিকট বিছানা, বাথরুমে নড়াচড়া করার জায়গা নেই। এরই ভাড়া প্রায় একশো ডলার। নিয়ম রক্ষার জন্য কোনও মতে সেখানে এক রাত কাটিয়ে সকালেই বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে আমরা দুজনে যোগ দিলাম অসীমদের সঙ্গে। ওদের থাকার জায়গাটি চমৎকার। ওরা এক বুড়ির অ্যাপার্টমেন্টে পেয়িং গেস্ট হয়েছে। বেশ বড় বড় দুটি ঘর, আলাদা একটি প্রকাণ্ড বসবার ঘর, পুরোনো আমলের সোফাসেট দিয়ে সাজানো, ঘর গরম করার জন্য অ্যান্টিক চিমনি। সব মিলিয়ে একটা ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম আছে। দু'জন অতিরিক্ত অতিথি পেয়ে বৃদ্ধা খুব খুশি। কারণ ভাড়া দেওয়া হবে মাথাপিছু। সত্তরের ওপর বয়েস। এককালে বেশ সুশ্রী ছিলেন, আমাদের মায়ের বয়সি, আমাদের সঙ্গে তিনি সস্নেহ ব্যবহার করতে লাগলেন সর্বক্ষণ। আমরা যাতে আরামে থাকতে পারি, আমরা যাতে শহরে পথ না হারিয়ে সব কিছু ঠিকঠাক দেখতে পারি, সেজন্য তাঁর আগ্রহের অন্ত নেই। কিন্তু মুশকিল এই তিনি ইংরেজি কিছুই বোঝেন না, অসীম ফরাসি চালাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল।

হাঙ্গেরিয়ান ভাষার সঙ্গে শুধু আমাদের কেন, অধিকাংশ ইউরোপিয়ানেরই কোনও পরিচয় নেই। ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই, ফিনোউগ্রিক-এর অন্তর্গত এই ভাষার খানিকটা আত্মীয়তা আছে ফিনিশ আর এস্তোনিয়ান ভাষার সঙ্গে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের লোকেরা বলে, হাঙ্গেরিয়ান ভাষা শুধু হাঙ্গেরিয়ানরাই বোঝে। যদিও এটা বেশ ধনী ভাষা। সাধারণ হাঙ্গেরিয়ানরা ইংরিজি না জানলেও, অস্ট্রিয়া-জার্মানির সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে, অনেকে কিছু কিছু জার্মান বোঝে। অসীম কিছুদিন জার্মানিতে কাজ করেছিল, তাই একটু একটু জার্মান জানে, ক্রিয়াপদহীন বাক্য দিয়ে বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও পুরো অসুবিধে ঘুচল না। আমরা বাকি তিনজন আকারে-ইঙ্গিতে ও বাংলায় কথা বলা শুরু করতে দেখা গেল মোটামুটি কাজ চলে যাচ্ছে।

একদিন দুপুরে বেশ মজা হল। আমরা অলসভাবে আড্ডা দিচ্ছি, বৃদ্ধা আমাদের বারবার তাড়া দিচ্ছেন বাড়ি থেকে বেরুবার জন্য। অবোধ্য ভাষায় তিনি কী যে বলে যাচ্ছেন কিছুই বুঝি না, আমরা ঘর ভাড়া নিয়েছি, যখন খুশি আসব---যাব এই দুপুরবেলা আমাদের ঘরছাড়া করবার উদ্দেশ্য কী?

অসীম বলল, ট্যুরিস্টরা সক্কালবেলা উঠেই চান-টান করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে সারাদিনের জন্য বেড়িয়ে পড়ে। আর তোমরা ভেতো বাঙালির মতন পাজামা পরে দুপুর একটা পর্যন্ত শুয়ে বসে আড্ডা মেরে যাচ্ছ, এটা বুড়ির সহ্য হচ্ছে না!

ভাস্কর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, বাজে বকো না। আমরা বেড়াতে এসেছি বলে সর্বক্ষণ পায়ে চাকা বেঁধে দৌড়তে হবে নাকি? দেখার জিনিসগুলো তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না!

আমাদের চারজনের মধ্যে অসীমই বৃদ্ধার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছে দুটি কারণে। সে কিছু কিছু জার্মান শব্দ জানে, সকালে উঠেই সে প্যান্ট শার্ট পরে নেয়। আমি আর ভাস্কর বাড়িতে পাজামা পাঞ্জাবি পরেই থাকি আর বাদলের লুঙ্গি না হলে তো চলেই না। এই পোশাকেই আমরা ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসি, সেটা বৃদ্ধার পছন্দ নয়, প্রত্যেক সকালে তিনি আমাদের তিনজনকে ভর্ৎসনা করেন আর অসীমের শার্ট-প্যার্ন্টের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, এলিগাঁস! এলিগাঁস!

ভাস্করের পাঞ্জাবিটা অত্যন্ত সুদৃশ্য কাজ করা, আর পাজামাও ধপধপে ফরসা, সেই পাঞ্জাবি পাজামার তুলনায় সাধারণ শার্ট-প্যান্ট কেন বেশি এলিগ্যান্ট হবে তা বোঝা দুষ্কর। বৃদ্ধা পুরোনো ইউরোপীয় আদব-কায়দায় বিশ্বাসী। কিন্তু তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে এমন এলোমেলোভাবে সব কিছু ছড়ানো যে এখানে আদব-কায়দা মানার প্রশ্নটাও কেমন যেন অদ্ভুত মনে হয়।

সেই দুপুরে আমাদের বাইরে বার করবার জন্য বৃদ্ধা এত বেশি উত্যক্ত করতে লাগলেন যে আমরা বাধ্য হয়েই পোশাক পালটে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের বাড়িওয়ালা কোনও পুরুষ হলে কিংবা অল্পবয়সি মেয়ে হলে ভাস্কর নিশ্চিত তাকে ধমক লাগাত, ইনি মায়ের বয়সি মহিলা বলেই কিছু বলা যায় না। আমরা তাঁকে ডাকি মাদাম। মাদামও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বেরুলেন একটা ছাতা হাতে নিয়ে। রাস্তায় নামার পর তিনি আমাদের একজনের হাত ধরে টানলেন, অর্থাৎ তাঁর পিছু-পিছু যেতে বলছেন। কোথায় নিয়ে যেতে চান তা কিছুই না বুঝে অনুসরণ করলাম। দু'তিনটে বাঁক ঘোরার পর একটা পাহাড়ের গায়ে লম্বা সিঁড়ির কাছে এসে থেমে মাদাম আঙুল দিয়ে ওপরের দিকটা দেখিয়ে দিলেন।

এবার বোঝা গেল। এই বুডা হিলের ওপর রয়েছে ম্যাগডোলেন টাওয়ার। এটা এ শহরে একটি বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান। ম্যাপ দেখে গেলে হয়তে আমাদের অনেক ঘোরাঘুরি করে যেতে হবে। তাই মাদাম আমাদের কিছুটা সংক্ষিপ্ত সিঁড়ি-পথ দেখাতে চাইছিলেন। পেয়িং গেস্ট টুরিস্টদের জন্য এতখানি যত্ন ও ব্যক্তিগত উদ্যম নেওয়ার নজির খুবই দুর্লভ!

বুডাপেস্ট অতীব মনোহর নগর। সবাই জানে যে বুডা আর পেস্ট মানে দুটি আলাদা শহরকে এক সঙ্গে জোড়া হয়েছে। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ড্যানিয়ুব নদী। সেই নদী, যার নাম শুনলেই একটা সঙ্গীতের ঝঙ্কার মনে আসে। নদীর দু দিকের দুটি শহরের বহিরঙ্গের বেশ তফাত। বুডা শহরটি প্রাচীন, ছোট ছোট পাহাড়ের ওপর গথিক ও বারোক স্টাইলের গির্জা ও প্রাসাদ রয়েছে অনেক, রাস্তাগুলো ঢেউ খেলানো। আর পেস্ট একেবারে সমতল, আধুনিক কালের দেশলাইয়ের বাক্স মার্কা বাড়িই বেশি।

আমাদের বাড়িটি নদীর খুব কাছেই। দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার নদী সন্দর্শন হয়। ড্যানিয়ুব এখানে বেশ চওড়া, আমাদের কলকাতার গঙ্গার চেয়ে সামান্য কম হবে। নদীর দু'ধারেই প্রশস্ত, সুসজ্জিত রাস্তা, সেখান দিয়ে শুধু হাঁটতেই ভালো লাগে। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান এমপায়ারের সময় এখানে প্রচুর ধনী ব্যক্তিদের সমাবেশ হয়েছিল। সেই চিহ্ন রয়ে গিয়েছে বড় বড় গির্জা ও বিলাসী হর্ম্যে। আমাদের দিকে নদীর পাড়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে অন্য পারে এক বিশাল নিও গথিক প্রাসাদ। এটা এখানকার পার্লামেন্ট। নদী পারাপারের সময় বহু দূর থেকেও এটা চোখে পড়বেই। এত বড় এবং জমকালো এই পার্লামেন্ট ভবন কিন্তু গণতান্ত্রিক লোকসভা হিসেবে বিশেষ ব্যবহৃত হয়নি।

আয়তন ও লোকসংখ্যায় বুডাপেস্ট শহর কলকাতার থেকে ছোট, কিন্তু কলকাতার গঙ্গায় বালি ব্রিজ ধরে দুটি মাত্র সেতু। তৃতীয় নির্মীয়মান সেতুটি দীর্ঘসূত্রতায় গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে স্থান পেতে চলেছে, অথচ এখানে ড্যানিয়ুবের ওপর আটটি সেতু। এই সব কটিই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকটিকেই আগের মতন পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এসব আমাদের কল্পনাতীত।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হাঙ্গেরি এক দারুণ দো-টানার মধ্যে পড়েছিল। যুদ্ধ যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন হাঙ্গেরি কোন পক্ষ নেবে তা ঠিক করতে পারেনি। হাঙ্গেরির সৈন্য-অস্ত্র যৎসামান্য, অস্ত্রশস্ত্রও অধিকাংশই জার্মানি থেকে আসে। হিটলারের জার্মানির মতন প্রবল প্রতিবেশীকে চটাবার সাধ্য হাঙ্গেরির নেই। তা ছাড়া এখানেও নাতসি চিন্তাধারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে এক শ্রেণির মধ্যে, তারা রাশিয়ার বোলশেভিকদের পছন্দ করে না। স্বদেশের ইহুদিদের প্রতিও বিদ্বেষী, সুতরাং এই শ্রেণি জার্মানদের সমর্থক। আবার বামপন্থী ও মধ্যপন্থীরা হিটলারের নীতি ঘৃণা করে, উল্লেখযোগ্য ইহুদি জনসাধারণও হিটলারবিরোধী। আরও একটি শ্রেণির সমর্থন পশ্চিমি দেশগুলির প্রতি।

কিন্তু হাঙ্গেরির শাসকশ্রেণি ও সেনাপতিদের ধারণা হয়েছিল যে এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না এবং জার্মানিরই জয় হবে। সেইজন্য তারা জার্মানিকে মৌখিক সমর্থন জানিয়ে ভেতরে-ভেতরে পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হাঙ্গেরি গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেছিল কিছুদিন। কিন্তু এই সুবিধাবাদ অচিরেই বুঝে গিয়েছিল হিটলার। বারবার সে হাঙ্গেরিকে যুদ্ধে টানতে লাগল। যুগোশ্লাভিয়া আক্রমণ করার পর নাতসি হাঙ্গেরিকে বলল সৈন্য পাঠাতে। এদিকে যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে হাঙ্গেরি 'চির বন্ধুত্ব' চুক্তি করে বসে আছে। একদিকে চুক্তি পালন, অন্যদিকে হিটলারের চোখ রাঙানি, এর মধ্যে মনঃস্থির করতে না পেরে হাঙ্গেরির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টেলোকি আত্মহত্যা করে বসলেন।

হিটলার যখন সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করে তখন হাঙ্গেরি ভেবেছিল প্রবল জার্মান বাহিনীর কাছে স্টালিনের ফৌজ দু-দশ দিনে বশ্যতা স্বীকার করবে। হাঙ্গেরি অল্প কিছু সৈন্য পাঠিয়ে হিটলারকে খুশি করতে গেল, কিন্তু যুদ্ধ চলতে লাগল দীর্ঘকাল। জার্মানি এবার হাঙ্গেরিকে বাধ্য করাল তার সমস্ত যুদ্ধ উপকরণ এবং সমর্থ ব্যক্তিদের সোভিয়েত ফ্রন্টে লড়াই করতে। অর্থাৎ হাঙ্গেরি এখন পুরোপুরি হিটলার-মুসোলিনির তল্পিবাহক। দেশের সরকার অবশ্য তখনও হিটলারের রোষ থেকে ইহুদি ও বামপন্থীদের রক্ষা করে চলেছিল এবং মনে মনে আশা ছিল, ইংরেজ-আমেরিকানদের যদি এ যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তা হলেই হাঙ্গেরি নাতসিদের পরিত্যাগ করে পশ্চিমি শক্তির সঙ্গে যোগ দেবে। দেশের প্রেসিডেন্ট হার্থি গোপনে বেশ কয়েকবার ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর কাছে খবর পাঠালেন যে তারা হাঙ্গেরির সীমান্তে পৌঁছলেই হাঙ্গেরি বিনা শর্তে আত্মসমর্পন করবে।

কিন্তু যুদ্ধের গতি অনেক জটিল হয়ে গেল। হাঙ্গেরির পশ্চিম সীমান্তে ইঙ্গ-মার্কিন ফৌজ এলই না, বরং পূর্ব সীমান্তে সোভিয়েত বাহিনীর কাছে হাঙ্গরির বাহিনী সাঙ্ঘাতিক মার খেল। হাঙ্গেরির সামরিক শক্তি এমন কিছু আহামরি ছিল না। এই আঘাতে তাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্যসংখ্যা প্রায় নিঃশেষ হবার মতন অবস্থায় পৌঁছোলো। সোভিয়েত বাহিনী এগিয়ে আসছে। হিটলারও প্রেসিডেন্ট হার্থির দু'মুখো নীতি ধরে ফেলেছে। হিটলার হার্থিকে ডাকিয়ে এনে খুব একচোট ধমক দিয়ে দুটি শর্ত দিল। হয় জার্মান ব্যবস্থাপনায় পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে, নয়তো হাঙ্গেরি পুরোপুরি জার্মানির অধিকারে চলে আসবে এবং শত্রু দেশের মতন ব্যবহার পাবে। দ্বিতীয়টি যে কী রকম তা পোল্যান্ডেই দেখা গেছে, সেই মতো প্রেসিডেন্ট মেনে নিল প্রথমটি। এবার জার্মান গেস্টাপোরা এসে সারা দেশে দাপট দেখাতে লাগল। বামপন্থী দলগুলি তছনছ করে নেতাদের গ্রেফতার করল। ইহুদিদের ধরে ধরে পাঠাতে লাগল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প কিংবা গ্যাস চেম্বারে। হাঙ্গেরিয়ানদের কার্যত কোনও স্বাধীনতা রইল না এবং মুক্ত বিশ্বের চোখে তারা নাতসিদের পদলেহী বলে গণ্য হল।

অগ্রসরমাণ সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে জার্মানদের মুখোমুখি লড়াই হয় হাঙ্গেরির ভূমিতে। সে লড়াই বেশিদিন চলেনি। জার্মান-হাঙ্গেরিয়ান যৌথ ফৌজ পিছু হঠতে লাগল। তারপর সোভিয়েত ট্যাংক-বাহিনীর সামনে হাঙ্গেরিয়ানদের ফেলে রেখে এক সময় জার্মানরা পালাল।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরাজিত হাঙ্গেরিয়ানদের মেনে নিতে হল অনেক অপমানজনক শর্ত। দেশের কিছুটা অংশ কেটে দিয়ে দেওয়া হল চেকোশ্লোভাকিয়াকে। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির জন্য তাদের অর্থদণ্ড দেওয়া হল তিরিশ কোটি ডলার। ইচ্ছেমতো সেনাবাহিনী গড়ার আর অধিকার রইল না। এই সব শর্ত ঠিক মতন পালিত হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব মিত্রশক্তির চুক্তি অনুযায়ী বর্তাল দখলদার বিরাট সোভিয়েত বাহিনীর ওপর।

বছরের পর বছর সোভিয়েত বাহিনী যে দেশের বুকে চেপে বসে আছে, সেখানে যে কমিউনিস্ট পার্টিই শাসন ক্ষমতা পেয়ে যাবে, তা খুবই স্বাভাবিক। এর মধ্যে বহু লোক দেশত্যাগী হয়েছে, নাৎসী সংসর্গদোষের জন্য বহু লোককে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে হয়েছে, নিছক সন্দেহে বহু লোক কারারুদ্ধ। বছর চারেক ধরে নানা রকম বিশৃঙ্খলার পর কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ণ ক্ষমতায় এসে গেল। সোভিয়েত সংবিধানের অনুকরণে এখানে জারি হল নতুন সংবিধান, হাঙ্গেরিয়ান রিপাবলিকের নতুন নাম হল হাঙ্গেরিয়ান পিপলস রিপাবলিক।



এক হাঙ্গেরিয়ান লেখক-দম্পতির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল অনেকদিন ধরে। জর্জ সোমলিও এবং তার স্ত্রী আনা। জর্জ নামটি হাঙ্গেরিয়ান উচ্চারণে অনেকটা গিওর্গি হয়ে যায়। টেলিফোন গাইডে জর্জের ঠিকানা পাওয়া গেল, কিন্তু সেখানে এখন সে থাকে না, নতুন ঠিকানা সেই বাড়ির কেউ বলতে চায় না। জর্জ একজন বিখ্যাত কবি এবং সম্পাদক, তার নাম ওদেশে সবাই জানে। আমাদের বাড়িউলি বৃদ্ধাও জানেন। আমাদের সঙ্গে দরকারি কথাবার্তা চালাবার জন্য মাদাম এখন একটি নতুন কায়দা বার করেছেন। একটা খবরের কাগজের অফিসে ফোন করে ফরাসি কিংবা ইংরেজি-জানা কারুকে ধরেন, তারপর আমাদের একজন তার সঙ্গে কথা বলে, সে আবার মাদামকে হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় বুঝিয়ে দেয়। সেইরকমভাবেই মাদাম একজন মহিলা সাংবাদিককে ধরে দিলেন, সেই মেয়েটি জানাল যে, জর্জ কোথায় থাকে তা জানা একটু শক্ত, কারণ ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সদ্য বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তবে সে আমাদের সাহায্য করবার চেষ্টা করবে।

বছর কয়েক আগে অসলো শহরে নরোয়েজিয়ান লেখিকা বিয়র্গ ভিক আমাকে বলেছিল, জর্জ আর আনার খবর জানো? ওদের বিয়েটা বোধহয় টিঁকবে না। খবরটা শুনে আমি খুব অবাক হইনি। আয়ওয়াতে আন্তর্জাতিক লেখক সমাবেশে আমরা অনেকে মাস চারেক ধরে ছিলাম। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, জাপান, মেক্সিকো, ব্রাজিল, পোলান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি বহু দেশের লেখক-লেখিকা ছিলেন, সবচেয়ে বয়ঃজ্যেষ্ঠা ছিলেন চিনের প্রখ্যাত লেখিকা মাদাম ডিং লিং, যিনি ছিলেন মাও সে তুং-এর এক কালের বান্ধবী, তাঁর কাছে চিনের বিপ্লবের অনেক গল্প শুনেছি। আবার অন্যান্য দেশের অনেক তরুণ-তরুণী কবি-ঔপন্যাসিকও ছিলেন। তবে, নানা আলাপ-আলোচনায় ওই হাঙ্গেরিয়ান দম্পতির কথা এসে যেত প্রায়ই। তার কারণ, ওই দুজনই ছিল বিশেষ দ্রষ্টব্য। জর্জ মধ্যবয়স্ক, মোটাসোটা থলথলে চেহারা, মাথার চুল পাতলা, কথাবার্তাতেও চাকচিক্য নেই, আর আনা-র বয়েস তার অর্ধেক, সে অতিশয় রূপসী। আনা জর্জের তৃতীয় তরুণী ভার্যা। আনাকে দেখে আমাদের সকলের ধারণা হয়েছিল, হাঙ্গেরিয়ান মেয়েরা খুব সুন্দর হয়। অনেকে জল্পনা করত, এত বয়েসের তফাত সত্বেও আনা জর্জকে বিয়ে করেছে কেন, শুধু জর্জের খ্যাতির মোহে? আনা নিজেও লেখিকা, সে ছোট গল্প লিখত। আনা একদিন আমাকে বলেছিল, পুরুষ লেখকদের চেহারায় কিছু আসে যায় না কিন্তু কোনও লেখিকা যদি রূপসী হয়, তা হলে সে কিছু কিছু সুবিধে পায় বটে, তার চেয়ে অসুবিধে অনেক বেশি। আনা আমার সঙ্গে প্রায়ই গল্প করত, কারণ ওর ধারণা ছিল, ও সিকি পরিমাণ ভারতীয়। ওর চোখের তারা কালো, পিঠ পর্যন্ত ছাওয়া দীঘল কালো চুল, ও বলত, ওর শরীরে নিশ্চয়ই জিপসিদের রক্ত আছে। হাঙ্গেরিতে জিপসির সংখ্যা প্রচুর এবং অনেকের মতে সেই সব জিপসিরা গেছে ভারতবর্ষ থেকে।

আয়ওয়া ছাড়ার পরেও বছর চারেক বাদে জর্জ ও আনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল বেলজিয়ামে। সেবারেও অনেক গল্প হয়েছিল, তবে আমি লক্ষ করেছিলাম, স্বামীর প্রতি আনার সেই গদগদ ভাবটা নেই, তার মিষ্ট কণ্ঠস্বরে মাঝে মাঝে ঝাল বাক্য বেরিয়ে আসছে।

ওরা দু'জনেই আমাকে অনেকবার হাঙ্গেরিতে আসার জন্য নেমন্তন্ন করেছে, এখন সত্যিই আমি বুডাপেস্টে উপস্থিত হয়েছি, তবু ওদের সঙ্গে দেখা হবে না? কিছুতেই ঠিকানা বা কোনও নাম্বার যোগাড় করা যাচ্ছে না। এটুকু খবর পাওয়া গেল যে জর্জ ও আনার বিচ্ছেদ এখানকার সাহিত্যিক সাংবাদিক মহলের সাম্প্রতিক বেশ একটা মুখরোচক ঘটনা, বিচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে আনা একজন নামকরা চিত্র পরিচালককে বিয়ে করেছে এবং জর্জ খুব মুষড়ে পড়েছে।

মহিলা-সাংবাদিকটি সত্যিই আমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল। একদিন রাত দশটায় টেলিফোন বেজে উঠল, আমাদের মাদাম চেঁচিয়ে উঠলেন, ইংলিশ, ইংলিশ! অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি গিয়ে ফোন তুলতেই শুনতে পেলাম আনার কণ্ঠস্বর।

খানিকটা অপরাধী গলায় প্রচুর ক্ষমা চেয়ে আনা জানাল যে একটু আগে সে আমার খবর পেয়েছে এক সাংবাদিকের কাছ থেকে, কিন্তু কাল ভোরেই তাকে চলে যেতে হচ্ছে প্যারিস, আজ অনেক রাত হয়ে গেছে, আমার সঙ্গে তার দেখা হবে না এ জন্য সে মর্মাহত, কিন্তু কোনও উপায়ও তো নেই। টেলিফোনেই অনেক গল্প হল, দু-তিনবার সে জিগ্যেস করল, তোমাদের খাওয়াদাওয়ার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

পরদিন সন্ধেবেলা ফোন করল জর্জ সোমলিও। সে-ও মহিলা সাংবাদিকটির কাছ থেকে খবর পেয়েছে। সেই সাংবাদিকটির সঙ্গে আমাদের চাক্ষুষ দেখা হয়নি, তার এই নিঃস্বার্থ তৎপরতার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ বোধ করেছি।

খানিক বাদেই চলে এল জর্জ, তাকে নিয়ে আমরা কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় ডিনার খেতে গেলাম। হাঙ্গেরিয়ানরা সাহিত্যপ্রেমিক, রেস্তোরাঁর মালিক ও পরিচারকরাও চিনতে পারল এই বিখ্যাত কবিকে।

বিরহ কিংবা মর্মবেদনায় জর্জ বেশ রোগা হয়ে গেছে, চুলে কালো রং মাখার জন্য তার বয়েস এখন কিছুটা কম দেখায়। আমি অন্য বন্ধুদের আগেই বলে দিয়েছিলাম যে জর্জের কাছে আনার প্রসঙ্গ একেবারেই উল্লেখ করা হবে না। জর্জও প্রায় দু-ঘণ্টা আড্ডার শেষে আমার দিকে চেয়ে বলল—তুমি হয়তো জানো না, আনার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তোমার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল, তুমি তার সঙ্গে আলাদা দেখা করতে পারতে, কিন্তু আমি তার কোনও খোঁজ রাখি না।

রেস্তোরাঁয় বসে জর্জ প্রথমেই একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল, সে এর মধ্যে ইংরিজি প্রায় ভুলে গেছে, ইংরিজিতে কথা বলতে তার অস্বস্তি হয়। হাঙ্গেরিয়ান ছাড়া ফরাসি ভাষায় কথা বলতে সে সাবলীল বোধ করে। তাতে অসুবিধে নেই, আমাদের ফরাসি ভাষী অসীম আছে, কিন্তু আমরা তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারব না। একটা ত্রিপাক্ষিক অনুবাদ-সংলাপ চালাতে হবে?

আস্তে আস্তে অবশ্য ব্যাপারটা সহজ হয়ে এল। জর্জ কখনও ভাঙা ভাঙা ইংরিজি বলে, কখনও ইংরিজি সঠিক শব্দ খুঁজে না পেলে অসীমকে ফরাসিতে জিগ্যেস করে, তখন তার মুখ কুঞ্চিত হয়ে যায়। ইংরিজি সম্পর্কে জর্জের দ্বিধার কারণ আমি বুঝতে পারি। লেখক মাত্রই শব্দের কারবারি, নিজস্ব ধরনের শব্দ ব্যবহারেই তার বৈশিষ্ট্য, শব্দকে নিয়ে সে খেলা করতেও পারে, সেটা মাতৃভাষাতেই সবচেয়ে বেশি সম্ভব। লেখা কিংবা কথা বলার সময় সঠিক শব্দটা খুঁজে না পেলে একজন লেখকের শারীরিক কষ্ট হয়, অপমান বোধ হই। ভুল ভাষা আর যাকেই হোক, কোনও লেখককে মানায় না। তবু আমরা অনেক সময় বাধ্য হই। ইংরেজ-আমেরিকানদের সঙ্গে সব সময় আমাদের এক অসম প্রতিযোগিতায় থাকতে হয়। তারা কথা বলে মাতৃভাষায়, আমরা বলি আয়ত্ত করা ইংরিজিতে। অনেক সময়েই তারা ভাষার মোচড়ে চকিত রসিকতা করে, আমরা তার উত্তর না দিতে পেরে মুখে হাসি মাখিয়ে রাখি।

আড্ডায় ঘুরেফিরে সাম্প্রতিক পালা-বদলের প্রসঙ্গ আসবেই। আমার বন্ধুরা জিগ্যেস করল, হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষ সবাই কি শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন খুশি মনে নিয়েছে?

জর্জ বলল, বেশিরভাগ লোক চেয়েছে বলেই তো পরিবর্তন এসেছে। এখানে তো জোর করে সরকারের পতন ঘটানো হয়নি। একটুও যুদ্ধ বা রক্তপাত হয়নি।

ভাস্কর জিগ্যেস করল, কমুনিস্ট পার্টি কেন ক্ষমতা ছেড়ে দিল সেটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।

জর্জ বলল, আমার ধারণা, সেটা এখন পৃথিবীর সবাই জেনে গেছে। তবু আমি সংক্ষেপে বলছি।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, জর্জ, দেশের সাধারণ মানুষ সরকার পরিবর্তনের জন্য চাপ দিয়েছিল, সেটা বুঝলাম, কিন্তু তোমার মতন বুদ্ধিজীবী-শিল্পীরা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইল কেন? আমি যতদূর জানি অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশের তুলনায় তোমাদের এখানে অনেকটা স্বাধীনতা ছিল, সেন্সরশিপের কড়াকড়ি ছিল না, তোমরা ইচ্ছেমতন বিদেশে যেতে পারতে, তুমি নিজে অনেকবার গেছ, তা হলে তোমার ব্যক্তিগতভাবে কি সরকারের প্রতি কোনও ক্ষোভ ছিল?

জর্জ বলল, আমি বিদেশে গেছি, হয় অন্য দেশের কোনও প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে, কিংবা হাঙ্গেরির সরকারের প্রতিনিধি হয়ে। একমাত্র সেইভাবেই যাওয়া যেত। সাধারণ মানুষের ইচ্ছেমতন বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ ছিল না। এখানে অনেক টুরিস্ট আসে, বাইরের বহু দেশের মানুষ বুডাপেস্ট বেড়াতে আসে, কিন্তু এখনকার মানুষ যেভাবে যখন খুশি বেড়াতে যেতে পারত না। ঠিক যে বাধা দেওয়া হত তা নয়, কিন্তু একটা পরোক্ষ চাপ ছিল, কেউ যেতে চাইলে তাকে অন্য কোনও ছুতোয় হয়রান করা হত। অন্য দেশের লেখক এ দেশে আসে, অথচ হাঙ্গেরিয়ানরা কেন বাইরে যেতে পারবে না, তারা তো কূপমন্ডূক নয়। তাদের মনে ক্ষোভ তো জমবেই।

আমি বললাম, তোমার মতন বুদ্ধিজীবীদের তো সে অসুবিধে ভোগ করতে হয়নি। তোমরা অনেকটাই স্বাধীনতা পেয়েছ। তুমি কি মনে করো না যে ধনতন্ত্র বা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চেয়ে সমাজতন্ত্র অনেক উন্নততর ব্যবস্থা?

জর্জ বলল, আমি সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলাম। একটা আদর্শ হিসেবে। কিন্তু কাগজে-কলমে সেটা যত বড় আদর্শ, কাজে তার অনেক তফাত ঘটে যায়। সমাজতন্ত্রে একদলীয় শাসন ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে ক্ষতিকর। এতে কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা জমে যেতে বাধ্য। একদলীয় শাসনে পার্টি হয়ে যায় সর্বেসর্বা। পার্টির অনুগত না হলে তুমি কোনও ভালো কাজ পাবে না। এর থেকেই আসে করাপশান। এখানে পার্টির নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী ছিল, তার নাম ওয়াকার্স মিলিশিয়া, সাধারণ মানুষ, এমনকি আমরা এদের ভয় পেতাম। প্রত্যেকটা কারখানায়, অফিসে, পার্টির নিজস্ব সেল ছিল, তারা সব লোকের ওপর নজর রাখত, খবরদারি করত, চুকলি কাটত,... এদের জন্য সব সময় আমাদের একটা অস্বস্তির মধ্যে থাকতে হত, এদের প্রতি বেশিরভাগ মানুষের একটা ঘৃণা জন্মে গিয়েছিল। গতবছর আমাদের পার্লামেন্ট তাড়াতাড়িতে কয়েকটা আইন পাশ করে পার্টির এই একচ্ছত্র ক্ষমতা যদি নষ্ট করে না দিত, তা হলে নির্ঘাত বড় রকমের আন্দোলন ও রক্তারক্তি শুরু হয়ে যেত। ওয়ার্কাস মিলিশিয়া ভেঙে দেওয়া হল, অফিস-কারখানায় পার্টি সেলগুলো তুলে দেওয়া হল। কমিউনিস্ট পার্টি এগুলো মেনে নিয়ে খুব বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে। ঠিক সময়ে তারা পার্টির নাম সোসালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির বদলে শুধু সোসালিস্ট পার্টি করেছে। ওয়ার্কাস পার্টি এটা ছিলও না, কোনও সোসালিস্ট দেশেই ওয়ার্কার্স পার্টি হয়নি, ওটা কথার কথা। আমাদের এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের মনোপলি ছেড়ে দিয়ে মাল্টি পার্টি ডেমোক্রেসি মেনে নিয়ে দেশটাকে বাঁচিয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থাও এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে খোলা-বাজার নীতি না নিলে রুমানিয়ার মতন আমাদেরও না খেয়ে থাকতে হত।

ভাস্কর জিগ্যেস করলে, কমিউনিস্ট পার্টি বিনা যুদ্ধে নিজেদের অধিকার ছেড়ে দিল কেন?

জর্জ বলল, পোল্যান্ডের দৃষ্টান্ত দেখে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থা দেখে। অনেকটা অধিকার ছেড়ে দিয়ে তারা পার্টিটাকে বাঁচাল। সাধারণ মানুষ যে ফুঁসছে তা তারা টের পেয়েছিল। না হলে, পার্টির নাম বদলেও তারা সাধারণ মানুষের ক্রোধ থেকে রক্ষা পেত না। সোভিয়েত ট্যাংক এবার তাদের বাঁচাতে আসত না। এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ইমরে পৎসগেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, ছাপ্পান্ন সালের ঘটনা মোটেই প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান ছিল না, সেটা ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ! এটাই তো একটা মস্ত বড় ট্রাজেডি।

অসীম জিগ্যেস করল, ইমরে নেগিকে এখন আর বিশ্বাসঘাতক বলা হচ্ছে না?

জর্জ বলল, সে কথা আমাকে জিগ্যেস করছ কেন, রাস্তার যে-কোনও মানুষের কাছ থেকে জেনে নাও। ছাপ্পান্ন সালের তেইশে অক্টোবর সেই অভ্যুত্থান হয়েছিল, এ বছর সেই দিনটাতে জাতীয় উৎসব হয়েছে। আর ১৬ জুন, একত্রিশ বছর আগে যে দিনটায় ইমরে নেগিকে হত্যা করা হয়েছিল, সেই দিনটির স্মরণে প্রায় তিন লাখ লোক মিছিল করে গিয়ে ইমরে নেগির স্মরণ বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছে। (আমাদের দেশে অনেক মিছিলে বা জনসভায় লাখ লাখ লোক হয়। কিন্তু হাঙ্গেরির মতন ছোট দেশে তিন লাখ লোকের মিছিল একটা অভূতপূর্ব ঘটনা)!

এটাও ইতিহাসের একটা ট্রাজেডি। আজ যাকে বিশ্বাতঘাতক কিংবা শত্রু বলে শাস্তি দেওয়া হয়, এক যুগ বা কয়েক যুগ পরে তাকেই বলা হয় হিরো। যার গলায় পরানো হয়েছিল ফাঁসির দড়ি, তার মূর্তির গলায় পরানো হয় ফুলের মালা। কিংবা, আজ মহান আদর্শবাদী হিসেবে যার নামে জয়ধ্বনি দেওয়া হচ্ছে, পরের যুগের ইতিহাস তাকে অভিহিত করেছে স্বার্থান্ধ খুনি হিসেবে। মানুষই মানুষ সম্পর্কে এরকম ভুল করে। মানুষই ইতিহাস বদলায়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে দুর্দান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে রুখেছিলেন জোসেফ স্টালিন। সর্বকালের ইতিহাসে হিটলার এক নর-দানব বলে গণ্য। খর্বকায়, নিরামিষাশী সেই মানুষটি প্রায় অর্ধেক পৃথিবীতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, অকারণে লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশুকে প্রাণ দিতে হয়েছে তার পাগলামিতে। নেপোলিয়ান রাশিয়া আক্রমণ করেও জিততে পারেনি, হিটলারের বাহিনি ছিল অনেক শক্তিশালী, সেই তুলনায় সীমিত অস্ত্রবল নিয়েও অসীম মনের জোরে স্টালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত দেশের মানুষ হিটলারকে হঠিয়ে দিয়েছে। শুধু বামপন্থীরাই নয়, সমস্ত মুক্ত বিশ্বের মানুষই সেজন্যে ধন্য ধন্য করেছে স্টালিনের নামে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রধান বীরপুরুষ স্টালিন। তাঁকে নিয়ে বীরপূজা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কত কবিতা, কত গান লেখা হয়েছে তাঁর নামে। বাংলাতেও একজন কবি স্টালিনের নাম উচ্চারণ করলেই কত শুভ কাজ হয় তার তালিকা দিতে দিতে লিখেছিলেন, 'স্টালিন, তোমার নামে গর্ভিনীর সুখ-প্রসব হয়।'

সেই স্টালিনের মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকেই তাঁর অন্য একটা পরিচয় প্রকাশিত হতে থাকে। এখন সোভিয়েত ইউনিয়নের ঐতিহাসিকরাই নথিপত্র ঘেঁটে এই তথ্য উদ্ধার করেছেন যে, স্টালিনের নির্দেশে তাঁর নিজের দেশে প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন বা পাঁচ কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। মিথ্যা সন্দেহে কিংবা আক্রোশের বশে। জার্মানির মতন সোভিয়েত ইউনিয়নেও অনেক কনসেনট্রেশান ক্যাম্প ছিল, সেখানে যাদের ভরা হত, তাদের আর সন্ধান পাওয়া যেত না, কয়েকজন বাঙালি বিপ্লবীও রাশিয়ার সেইসব কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে হারিয়ে গেছেন। হিটলারের আক্রমণে সোভিয়েত দেশে দু'কোটি মানুষ নিহত হয়েছে, আর স্টালিন মেরেছেন পাঁচ কোটি স্বদেশবাসীকে। অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে স্টালিনের নিজের দেশেই। সোভিয়েত দেশে আজ আর কেউ ভুলেও স্টালিনের নাম উচ্চারণ করে না।

১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, তা এখানকার কাগজপত্র পড়ে ও বিভিন্ন লোকের কথা শুনে নতুনভাবে জানা গেল। আমরা এতকাল জেনে এসেছিলাম যে প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তে বিপ্লবের ফসল নষ্ট করার জন্যেই হাঙ্গেরিতে একটি প্রতি-বিপ্লবী অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল। এতে মদত দিয়েছিল কিছু কিছু ধনতান্ত্রিক দেশের গুপ্তচররা। এখন হাঙ্গেরিয়ানরা বলছে যে, এই প্রচারটাই সম্পূর্ণ অপপ্রচার। হাঙ্গেরিয়ানদের দেশপ্রেমের প্রতি অপমান। এই অভ্যুত্থান মোটেই কমিউনিজম-বিরোধী ছিল না। এই আন্দোলনের নেতাও ছিলেন মস্কোপন্থী। প্রতিবাদ বা আন্দোলন শুরু হয় পার্টির জুলুমবাজি ও দাদাগিরির বিরুদ্ধে এবং হাঙ্গেরিয়ানদের আত্মমর্যাদা ও পুনরুদ্ধারের জন্য।

এগারো বছর ধরে সোভিয়েত সৈন্যবাহিনী হাঙ্গেরির ভূমিতে বসেছিল। সমাজতন্ত্র দেশাত্মবোধ মুছে দিতে পারেনি কোনওখানেই। হাঙ্গেরিয়ানরা সোভিয়েত বাহিনীকে বিদেশি সৈন্য বলেই মনে করত, এবং কেউই নিজের দেশে বিদেশি সৈন্যের অবস্থিতি সম্মানজনক মনে করে না। ঘাড়ের ওপর ওইরকম একটা শক্তি থাকার ফলে হাঙ্গেরির সরকারও ছিল তার ক্রীড়নক। মস্কোর নির্দেশেই হাঙ্গেরির নেতাদের উত্থান-পতন ঘটত।

ছাপ্পান্ন সালে কয়েকটি পরিবর্তন ঘটে। তিন বছর আগে স্টালিনের মৃত্যু হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশতম কংগ্রেস-এ নিকিতা ত্রুশ্চেভ স্টালিনের পার্সোনালিটি কাল্ট-এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালেন। পোল্যান্ডে সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ শোনা গেল। এ বছরই সোভিয়েত সেনাবাহিনী তাঁবু গোটাতে শুরু করল হাঙ্গেরি থেকে। অনেকেরই ধারণা হল, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে এবার খোলামেলা হাওয়া আসছে। বুডাপেস্ট-এর একদল ছাত্র তাদের দাবিদাওয়া জানাবার জন্য সমবেত হল একটা মিছিলে। পথ চলতি মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিল সেই মিছিলে, সংখ্যা বাড়তে লাগল ক্রমশ সেই বিশাল জনতা কিন্তু সরকারের পতন চায়নি, চেয়েছিল শাসনব্যবস্থার কিছু কিছু সংস্কার। কিন্তু তখন হাঙ্গেরির যিনি কর্তা, সেই জেরো ছিলেন মস্কোর পুতুল, তিনি সেই জনতার দাবিদাওয়া শোনার বদলে ধমক দিলেন, তারপর হুকুম দিলেন গুলি চালাতে।

রক্তপাত শুরু হতেই সেই শান্তিপূর্ণ মিছিল হিংস্র হয়ে উঠল, সেনাবাহিনী এনেও তাদের দমন করা গেল না, বরং হাঙ্গেরিয়ান সৈন্যরা যোগ দিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে, সেনা ব্যারাক থেকে অস্ত্র বিলি হতে লাগল জনসাধারণের মধ্যে। জেরো পালালেন, চতুর্দিকে গজিয়ে উঠল লোকাল কাউন্সিল, জেলখানার দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন রাজবন্দিরা। কৃষকরা তাঁদের বাজেয়াপ্ত জমি আবার দখল করে নিতে শুরু করলেন। বিভিন্ন দলের এক সম্মিলিত সরকারে ফিরিয়ে আনা হল ইমরে নেগি-কে। এই ইমরে নেগি কিছুদিন আগেই ছিলেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী। ইনি বামপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী। বামপন্থা জাতীয়তাবাদীকে স্বীকার করে না এবং জাতীয়তাবাদকে মুছে ফেলার মতন অবস্থা যে পৃথিবীতে আসেনি, তা-ও তারা মানতে চায় না। আজ দেখা যাচ্ছে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেও প্রায় সর্বত্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, প্রত্যেকটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যেও চড়া জাতীয়তাবাদের সুর, এমনকি চিনও প্রবল জাতীয়তাবাদী। জাতীয়তাবাদের বোধ যে কত তীব্র তা বোঝা গিয়েছিল চিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনায়। সীমান্ত যেখানে মুছে যাওয়ার কথা, সেখানে তার বদলে সীমান্ত সংঘর্ষ!

যাই হোক, ইমরে নেগি যখন আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি মস্কোর অধীনতা অস্বীকার করেননি, কিন্তু হাঙ্গেরির শাসনব্যবস্থায় কিছু কিছু সংস্কারের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এ দেশের ওপর জোর করে হেভি ইন্ড্রাস্ট্রি চাপিয়ে দেওয়া তিনি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। চাষিদের জমি কেড়ে নিয়ে জবরদস্তি সমবায়ে যোগ দিতে বাধ্য করা তাঁর মনে হয়েছিল অবাস্তব ব্যবস্থা। জনসাধারণকে কিছু কিছু ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করাও সরকারের দায়িত্ব। আধুনিক জীবনের সরঞ্জাম তো তারা চাইবেই। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিয়ে অন্তরীণ-শিবিরগুলি একেবারে তুলে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এই সবগুলোই ছিল সাধারণ মানুষের দাবি। কিন্তু এই ধরনের কিছু কিছু উদার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যেতেই ইমরে নেগি-কে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর পার্টি মেম্বারশিপও কেড়ে নেওয়া হয়।

একবছর পর বিপ্লবী জনসাধারণ তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনল। নেগি তাঁর সংস্কার ব্যবস্থাগুলি পুনঃপ্রবর্তন করতে চাইলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানালেন পুরো সৈন্যবাহিনী হাঙ্গেরি থেকে সরিয়ে নিতে। একটা কোয়ালিশন গভর্নমেন্টের প্রধান হিসেবে নেগিকে জনসাধারণের দাবিগুলি মেনে নিতে হচ্ছিল।

মস্কো থেকে কয়েকজন কর্তাব্যক্তি এলেন নেগিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠান্ডা করতে। এর মধ্যে নেগি দুটি সাংঘাতিক ঘোষণা করে বসলেন। ওয়ারস চুক্তি থেকে হাঙ্গেরি নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিল। এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে হাঙ্গেরিকে একটি নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে গণ্য করার দাবি জানানো হল। মস্কো হাঙ্গেরির এতটা বাড়াবাড়ি বরদাস্ত করতে রাজি নয়। সোভিয়েত বাহিনী হাঙ্গেরির সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, আবার ট্যাংকগুলির মুখ ঘুরল, সোভিয়েত দেশ থেকে আরও কিছু ট্যাংক এল, আবার ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দে কেঁপে উঠল বুডাপেস্ট। প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গার দিকে ওঁচানো রইল কামানের মুখ।

ছাত্র ও শ্রমিকরা ইতস্তত সংঘর্ষের মধ্যে গেলেও সোভিয়েত ফৌজের তুলনায় তারা কিছুই না। এই সময় গুজব উঠেছিল যে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি হাঙ্গেরির সাহায্যে এগিয়ে আসবে, সোভিয়েত বাহিনীর মোকাবিলা করবে। সে রকম কিছুই ঘটল না। বিদ্রোহ ক্রমশ প্রশমিত হয়ে গেল, বহু শিক্ষিত ব্যক্তি পালাল দেশ ছেড়ে।

ইমরে নেগি প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিলেন বুডাপেস্ট-এর যুগোশ্লাভ দূতাবাসে। সেখান থেকে চলে গেলেন রুমানিয়া। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে গ্রেফতার করে একটা গুপ্ত বিচার অনুষ্ঠিত হল এবং অবিলম্বে গুলি করে মেরে ফেলা হল, একটা প্রতি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর নাম মুছে ফেলা হল হাঙ্গেরির ইতিহাস থেকে।

মাত্র তিনটি দশক অতিক্রান্ত হয়েছে, এখন আবার ইমরে নেগির নামে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তাঁকে এক মহান নেতা হিসেবে। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নেও প্রেসিডেন্ট গরবাচেভ বলেছেন যে, নেগির বিচার ভুল হয়েছিল। তিনি যে সব সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এখন সেগুলিই গ্রহণ করা হচ্ছে!

মুষ্টিমেয় কিছু লোকের ভুল সিদ্ধান্তে ইমরে নেগিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল এবং হাজার হাজার মানুষ বাধ্য হয়েছিল দেশত্যাগ করতে। কী নির্মম, হৃদয়হীন এই সব ভুল।



বুডাপেস্ট শহরটি অতি মনোরম তো বটেই, সমগ্র হাঙ্গেরিই প্রকৃতির শোভায় নয়ন সুখকর। একটা সুন্দর শহরে এমনি এমনি হেঁটে বেড়াতেই ভালো লাগে। যেমন প্যারিস, রোম, সানফ্রান্সিসকো, কিয়েভ, ক্যান্টন। বুডাপেস্ট শহরটিও সেই পর্যায়ের, যদিও এখানে পথের ধারের রেস্তোরাঁ বা দোকানপাটের তেমন বাহুল্য নেই।

নদীর ধার দিয়ে হাঁটলেই বহু দূর থেকেও চোখে পড়ে একটা টিলার ওপরে এক নারী মূর্তি। এটাই এই শহরের স্ট্যাচু অব লিবার্টি। টিলার ওপর রয়েছে একটা পুরোনো দুর্গ, অস্ট্রিয়ান আধিপত্যের স্মৃতি। এর স্থানীয় নাম সিটাডেল্লা। আমরা চার বন্ধু মিলে একদিন উঠে গেলাম সেখানে। দু' হাতে উঁচু করা পাখির পালক, বিশাল পাথরের নারীটি শান্তির প্রতীক। রুচির দিক থেকে এই মূর্তিটিই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এর পাদদেশে এক সশস্ত্র সোভিয়েত সৈনিকের মূর্তিও দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। শিল্প সৃষ্টিতে বাহুল্যের মতন পীড়াদায়ক আর কিছুই নয়। কোনও শিল্পীই গোটা ক্যানভাসটা রেখা দিয়ে ভরিয়ে দেন না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সোভিয়েত বাহিনী যে হাঙ্গেরিকে মুক্ত করে, ওই সৈনিকের মূর্তিটি তার স্মারক। শিল্পের বিচারে মূর্তিটি অপ্রয়োজনীয় তো বটেই, তা ছাড়া ওটা হাঙ্গেরিয়ানদের আত্মাভিমানেও ঘা মারে। ধরে নেওয়া গেল যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে সোভিয়েত বাহিনী এসে জার্মানির কবল থেকে হাঙ্গেরিকে উদ্ধার করে তাদের খুবই উপকার করেছিল, কিন্তু বছরের পর বছর কি তা মনে করিয়ে দিতে হবে? অতি উপকারীর প্রতিও ঘৃণা জন্মে যায়। পরোপকার তখনই মহৎ, যখন তার মধ্যে বিনয় থাকে এবং আত্মপ্রসাদের অভিসন্ধি থাকে না। কোনও রাষ্ট্রনীতিই অবশ্য পরোপকারের ধার ধারে না, স্বার্থের ওপর একটা মিষ্টি মানবতা কিংবা আদর্শের প্রলেপ দেয়।

বুলগেরিয়া এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার বিভিন্ন শহরে আমি দেখেছি, একটা পাহাড় বা উঁচু জায়গা পেলেই সেখানে সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ থেকে একটা শহিদ মিনার বানিয়ে রাখা হয়েছে, যেখানে অ-শিল্পসম্মত এক সোভিয়েত সৈনিকের মূর্তি দণ্ডায়মান, তলায় লেখাও থাকে যে এইসব সৈন্যরা এই দেশ উদ্ধারের জন্য প্রাণ দিয়েছে। স্থানীয় লোকেরা এখন ওইসব মূর্তি নিয়ে হাসাহাসি করে।

হাঙ্গেরির মানুষ অবশ্য শুধু হাসাহাসি করেনি, ছাপান্ন সালের অভ্যুত্থানের সময় সোভিয়েত সৈন্যরা মূর্তিটি উপড়ে ফেলে দিয়েছিল। পরে আবার একটি অবিকল মূর্তি এনে বসানো হয় এবং দিবারাত্র সেটাকে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল।

বাংলাদেশ-যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতা করেছিল ভারতীয় সেনানীরা। পাকিস্তানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছিল আঠারো হাজার ভারতীয় সৈনিক। অবশিষ্ট ভারতীয় সৈনিকদের সরিয়ে আনার আগে ভারত সরকার যে বাংলাদেশে এরকম কোনও বিকট মূর্তি বসিয়ে আসেননি, সে জন্য আমরা স্বস্তি বোধ করি। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কী ছিল তার চুল চেরা বিচার হবে ইতিহাসে, মূর্তি বা স্তম্ভ বানিয়ে বেশি বেশি জাহির করার তো দরকার নেই।

এই সিটাডেল্লার শান্তি মূর্তির সামনে গোটা গোটা বুডাপেস্ট শহরটাকে দেখা যায়। সন্ধের সময় যখন সেতুগুলিতে আলো জ্বলে ওঠে, ঝকঝক করে ড্যানিয়ুব নদী, সেই দৃশ্যটি বুকের মধ্যে গেঁথে যায়।

একদিন আমরা ট্রেনে চেপে গেলাম স্যানতান্দর নামে একটি গ্রামে। বুডাপেস্ট থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে এখানে ড্যানিয়ুব নদী বাঁক নিয়েছে। তার তীরে ছোট্ট একটা গ্রাম। তিনশো বছর আগে তুর্কিদের অত্যাচার থেকে পালিয়ে কিছু সার্বিয়ার ব্যবসায়ী এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর থেকে গ্রামটির চেহারা আর বিশেষ বদলায়নি। যত্ন করে এর পুরোনো রূপটি বজায় রাখা হয়েছে। এখন এখানে প্রচুর শিল্পীর বাস। বলা যায় আর্টিস্টদের একটা কলোনি। এখানে নদীর ধারে চুপচাপ বসে কাটাতেই বেশ লাগে।

হাঙ্গেরিতে এলে বালাতোন হ্রদ তো অবশ্য দ্রষ্টব্য। বিশেষত আমাদের পক্ষে। এই হ্রদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িয়ে আছে।

আমরা একদিন একটা গাড়ি ভাড়া করলাম। ডলারের হিসেব করলে বেশ সস্তাই বলতে হবে। ডলার ভাঙালে এখানকার টাকা ফোরিন্ট পাওয়া যায় প্রচুর। ফোরিন্ট-এর দাম আমাদের টাকার চেয়েও অনেক কম। সেই জন্য খাবার দাবারও বেশ সস্তা মনে হয়। অবশ্য যদি পাওয়া যায়। ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় সব সময় খাবার পাওয়া দুষ্কর। যখন তখন বন্ধ হয়ে যায়। কোথাও বা বিরাট একটা মেনিউ কার্ড দেবে, যাতে চল্লিশ-পঞ্চাশ রকম খাবারের নাম, কিন্তু যেটাই চাওয়া হবে, সেটাই নেই। একটি বা দুটি পদ মাত্র লভ্য। তবে, এর আগে, অন্য কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশে দেখেছি, পরিচারক-পরিচারিকারা মুখ গোমড়া করে বলে যায় নেই, নেই, নেই, নেই! যেন না-থাকাটাই নিয়ম। এখানে পরিচারক-পরিচারিকারা নেই বলতে গিয়ে লাজুক ভাবে হাসে। আমাদের অবশ্য খাওয়াদাওয়া নিয়ে তেমন কিছু অসুবিধে হয়নি। হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ অতি বিখ্যাত, এই মাংসের ঝোল আমাদের জিভেও সুস্বাদু। আর পাওয়া যায় স্নিটজেল। আইসক্রিমের জন্যও হাঙ্গেরির খ্যাতি আছে, সব জায়গায় দেখি আইসক্রিমের দোকানের সামনে টুরিস্টদের লাইন। আমি আর বাদল আইসক্রিম পছন্দ করি না, অসীম খুবই ভালোবাসে, ভাস্করের মিষ্টি খুব প্রিয়। কিন্তু ওর খাওয়া নিষেধ। তবু লুকিয়ে-চুরিয়ে দু-একবার খেয়ে ফেলবেই। আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনেই একটা রেস্তোরাঁয় শুধু মাছের নানারকম প্রিপারেশন পাওয়া যায়, বাইরে সেরকমই লেখা থাকে। কিন্তু আমরা সেখানে মাছ খেতে পারিনি, যখনই যাই, তখনই দোকানপাট বন্ধ।

ব্যক্তিগত মালিকানায় কয়েকটি বেশ বড় বড় রেস্তোরাঁ এখন খোলা হয়েছে, তাতে অনেক কিছুই পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ভিড়ের চোটে ঢোকা যায় না, কিংবা টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

বালাতোন হ্রদে আমাদের গাড়িটি যিনি চালিয়ে নিয়ে যাবেন, তাঁর নাম স্টিফেন। হয়তো উচ্চারণ অন্যরকম, কিন্তু তিনি আমাদের স্টিফেনই বললেন। মোটামুটি ইংরিজি জানেন। কী করে ইংরিজি শিখলেন, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি আমাদের অবাক করে উত্তর দিলেন, ইংরিজি শিখেছি ভারতবর্ষে গিয়ে।

স্টিফেনের বয়েস পঁয়ষট্টির ওপরে, নিরীহ, শান্ত ধরনের মানুষ, এক সময় তিনি ছিলেন ক্রেন অপারেটর, সেই চাকরি নিয়েই গিয়েছিলেন ভারতে, বম্বে এবং গোয়া'র বন্দরে কাজ করেছেন ছ-সাত বছর। এখন অবসর-জীবন। গাড়িটা তাঁর নিজের নয়, মাঝে মাঝে কিছু অতিরিক্ত রোজগারের জন্য তিনি অন্যের গাড়ির ড্রাইভারি করেন। সরকারের কাছ থেকে বার্ধক্য ভাতা পান স্টিফেন, তাতে কোনও রকমে জীবনযাত্রা নির্বাহ হতে পারত। কিন্তু এখন জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় বেশ অসুবিধে হয়। বর্তমান সরকার আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং ভাতা বৃদ্ধির কোনও সম্ভাবনা নেই। স্টিফেনের মুখে চোখে কিন্তু সে জন্য কোনও তিক্ততা বা ক্রোধ নেই, সব কিছুই যেন এক দার্শনিক সুলভ নির্লিপ্ততার সঙ্গে মেনে নিয়েছেন।

বুডাপেস্ট থেকে বালাতোন যেতে ঘণ্টা দু-এক লাগে। মধ্য ইউরোপের সবচেয়ে বড় এই মিষ্টি জলের হ্রদটি ৭৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। ছোট ছোট পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা এই হ্রদটি চোখ জুড়িয়ে দেয়। হাঙ্গেরিয়ানরা তো বটেই, প্রচুর বিদেশিও এখানে আসে সাঁতার, মাছ ধরা ও নৌকা ভ্রমণের জন্য। ধারে ধারে রয়েছে ছোট ছোট গ্রাম, প্রচুর হোটেল ও অতিথিশালা। এখন অবশ্য শীত পড়ে গেছে। অধিকাংশই বন্ধ। বেলাভূমির অনেক অংশই জনশূন্য। আমরা পৌঁছোলাম দুপুরের দিকে, আগে কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। ক্ষুধার্ত উদরে ভ্রমণ তেমন জমে না। কিন্তু একটি খাবারের দোকান খুঁজে বার করতে আমাদের ঘণ্টাখানেক সময় ব্যয় করতে হয়, প্রায় সব রেস্তোরাঁই বন্ধ কিংবা খাদ্য নেই। একটি রেস্তোরাঁ পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত, সেটি সদ্য সরকারি থেকে প্রাইভেট হয়েছে, আমাদের আপ্যায়ন করে খাওয়াল এক অল্পবয়েসি পরিচারিকা। তার উৎসাহ ও ছোটাছুটি দেখেই বোঝা যায়, বেশি বিক্রি হলে তারও কিছু বেশি বেতনের সম্ভাবনা আছে। সরকারি দোকানের বিক্রির কম-বেশি নিয়ে কর্মচারীরা মোটেই মাথা ঘামায় না।

খাওয়া শেষ হলে স্টিফেন নিজের খাদ্যগুলির দাম দিতে চাইলে আমরা না না করে উঠলাম। ভাড়া করা গাড়ি নিলেও সবাই তো ড্রাইভারকে নিয়ে এক সঙ্গেই খেতে বসে। কেউ আবার ড্রাইভারের কাছ থেকে পয়সা নেয় নাকি? কিন্তু এইটুকুর জন্যই স্টিফেন এমনভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলেন যে মনে হল, এক বেলার খাবারের খরচ বাঁচানোও তাঁর কাছে অনেকখানি।

এর আগে একদিন এক হাঙ্গেরিয়ান দম্পতি আমাদের একটা বেশ উঁচু দরের রেস্তোরাঁয় খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওঁদের এক মেয়ে থাকে প্যারিসে। সেই সূত্রে অসীমের সঙ্গে যোগাযোগ। পিতা ছিলেন দেশে হাঙ্গেরির রাষ্ট্রদূত। ওঁদের গাড়ি আছে। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার। আমরা সব নাম জানি না বলে নানারকম মূল্যবান খাদ্য ও পানীয় ওঁরাই বেছে দিলেন, আমি মনে-মনে একটু সঙ্কুচিত বোধ করছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের জন্য ওঁদের অনেক পয়সা খরচ হয়ে যাবে। আমরা বন্ধুরা সংখ্যায় চারজন এবং কেউই কম খাই না। বিল আসবার পর ভূতপূর্ব রাষ্ট্রদূত বললেন, আমার স্ত্রী ও আমার অংশটুকু আমি দিয়ে দিই? কয়েক মুহূর্ত আমরা চুপ করে ছিলাম। তারপরেই ভাস্কর বলে উঠল, না, না, আপনারা দেবেন কেন। আমরা সবটাই দিয়ে দিচ্ছি! ভদ্রলোক সঙ্গে-সঙ্গে তা মেনে নিলেন। ওই দম্পতিকে কৃপণ মনে করার কোনও কারণ নেই, তাঁদের কথাবার্তা যথেষ্ট পরিশীলিত, কিন্তু দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় বোধহয় অতিরিক্ত কিছু ব্যয় করতে তাঁরা সক্ষম নন। আমার বন্ধু জর্জ সামলিও- কে আমরাই ডিনার খাইয়েছিলাম, কিন্তু তার বিনিময়ে সে পরে আমাদের এক কাপ চা খাওয়ারও নেমন্তন্ন করেনি। এমনও কি হতে পারে যে বাড়িতে বিদেশিদের আমন্ত্রণ করার ব্যাপারে এখনও এদের কোনও দ্বিধা আছে?

খাওয়া দাওয়া সেরে, খানিকক্ষণ একদিকে ঘুরে, তারপর আমরা গাড়ি সুদ্ধু ওপারে চলে গেলাম একটা ফেরিতে।

রবীন্দ্রনাথ এক সময় ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য এই হ্রদের তীরে কাটিয়ে গেছেন কিছুদিন। জায়গাটা পছন্দ করেছিলেন চমৎকার। এখানকার শান্ত নির্জনতায় মন আপনা থেকেই প্রসন্ন হয়ে ওঠে।

কবি সেই ১৯২৬ সালে এখানে একটি গাছ পুঁতেছিলেন। কী গাছ কে জানে, মূল গাছটি নিশ্চয়ই এতদিন বেঁচে নেই, সম্ভবত তার থেকে অন্য চারা জন্মেছে, কেন না, এখন সেই গাছটি দেখলে তার বয়েস খুব বেশি মনে হয় না। হাঙ্গেরির সরকার জায়গাটি যত্ন করে ঘিরে দিয়েছেন। পাশে একটি ট্যাবলেটে ঘটনাটির বিবরণ রয়েছে। তাতে অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে বলা হয়েছে হিন্দু পোয়েট', তখন এরা সব ভারতীয়কেই হিন্দু বলত। এই স্থানটি বেশ প্রসিদ্ধ, সমস্ত টুরিস্ট গাইড বুকেই রবীন্দ্রনাথের এই গাছটির উল্লেখ আছে, কোনও কোনও গাইড বুকে রবীন্দ্রনাথকে বলা হয়েছে 'হিন্দি কবি'।

এখানে রবীন্দ্রনাথের যে আবক্ষ মূর্তিটি রয়েছে, সেটি সম্পর্কে আমাদের পশ্চিম বাংলার এক মন্ত্রী একবার একটা বেফাঁস মন্তব্য করে বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। তিনি জানতেন না যে ওই মূর্তিটির শিল্পী রামকিংকর বেইজ। শিল্পীর পরিচয় কোথাও লেখা নেই। ইদানীং কালে কাছাকাছি আরও কয়েকটি গাছ পুঁতে গেছেন ইন্দিরা গান্ধি, ভি ভি গিরি ও আরও কয়েকজন রাম-শ্যাম-যদু-মধু ধরনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। গাছ পুঁতে এঁরা রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ হতে চেয়েছিলেন নাকি? বরং ভারত সরকারের টাকায় এঁরা এই স্থানটি আর একটু সুসজ্জিত করতে পারলে সুবুদ্ধির পরিচয় দিতেন।

সরকার কিছু করেননি, কিন্তু বছর আষ্টেক আগে এক বাঙালি দম্পতি বাংলা হরফে রবীন্দ্রনাথের চার লাইন কবিতা সমন্বিত একটি শ্বেত মর্মর ফলকে তাঁদের শ্রদ্ধা অর্পণ করে গেছেন। ভাষার টান বড় টান। এই দূর বিদেশে বাংলা লেখা দেখে আমরা বেশ খানিকটা চাপা হর্ষ অনুভব করি। মাত্র চার লাইন কবিতা, তাও পড়ি বারবার। এই বাংলা লেখায় তবু অন্তত 'হিন্দু কবি' ও 'হিন্দী কবি'র বিভ্রান্তি দূর করতে পেরেছে খানিকটা।

বিদেশে আমাদের বাংলা সাহিত্য তথা গোটা ভারতীয় সাহিত্যের প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক দেশগুলি রবীন্দ্রনাথকে প্রায় ভুলতে বসেছে। আধুনিক লেখকদের মধ্যেও অনেকে রবীন্দ্রনাথের নামটা শুধু জানে, লেখা কিছু পড়েনি। যারা পড়েছে, তারাও ঠোঁট উলটে বলে, নট মাই কাপ অফ টি। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে রবীন্দ্রনাথ এখনও খুবই সমাদৃত। বাংলার বাইরে রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে জনপ্রিয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেখানে তাঁর রচনাবলি পাঁচ লাখ কপি ছাপা হলেও অবিলম্বে শেষ হয়ে যায়। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতেও রবীন্দ্র-অনুরাগীর সংখ্যা অনেক। আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম চিনেদের রবীন্দ্র-প্রীতি দেখে। বাষট্টি সালের পর চিনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন, তারপর একটি প্রজন্ম পার হয়ে গেছে, চিনের যুবক-যুবতীরা ভারত সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না। কিন্তু চিনের যেসব লেখক সমাবেশে আমি গেছি, প্রত্যেক জায়গায় আমি রবীন্দ্র-বন্দনা শুনেছি। কোনও কোনও চিনা লেখক বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথ চিনা সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছেন! এঁরা কেউ শরৎচন্দ্রেরও নাম জানেন না, জীবনানন্দ-তারাশঙ্করের তো প্রশ্নই ওঠে না। রবীন্দ্রনাথ ওদের কাছে কতটা পরিচিত তার উদাহরণ স্বরূপ একটা ঘটনা বলি। ওখানকার সংস্কৃতিমন্ত্রীর সঙ্গে একদিন আমাদের মোলাকাত হয়েছিল। বৈঠকি মেজাজে গল্প করতে করতে তিনি এক সময় বললেন, বয়েস হয়ে গেছে, এখন কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। কলম নিয়ে বসলেও কলম কামড়াতে হয়, বার্ধক্যে মানুষের লেখার ক্ষমতা কমে যায়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন মহামানবের কথা আলাদা, তিনি আশি বছর বয়সেও কী বিপুল উদ্যমে লিখে গেছেন।

সাংহাইয়ের এক লেখকদের সভায় আমাকে যখন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন আমি খানিকটা উদ্ধতভাবেই বলেছিলাম, তোমরা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেক প্রশস্তি করছ বটে, কিন্তু আমি রবীন্দ্রনাথকে মোটেই গুরুঠাকুর মনে করি না। তোমাদের কি ধারণা, বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই শেষ কথা। আমি নিজে একজন লেখক হিসেবে এটাকে মোটেই সম্মানজনক মনে করি না। আমরা রবীন্দ্রনাথের অনেক সমালোচনা করি, তাঁর অনেক লেখা নস্যাৎ করে দিই! রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ না করেও আমাদের দেশে জীবনানন্দ দাশের মতন কবিরা মহৎ কবিতা রচনা করেছেন।

আমার সহযাত্রী হিন্দী লেখক কমলেশ্বর বেশ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। সভা শেষে একজন চিনা লেখক আমার পিঠে হাত দিয়ে বন্ধুর মতন আপন-করা সুরে বললেন, তুমি অন্য দেশে এসে তোমাদের দেশের এত বড় লোক সম্পর্কে এরকম উক্তি করলে কেন? আমি তো বিদেশে গিয়ে আমাদের জাতীয় লেখক লু সুন সম্পর্কে এরকম কোনও মন্তব্য প্রকাশের চিন্তাই করতে পারি না। আমি তাঁকে বলেছিলাম, লু সুন বড় লেখক আমরাও জানি, যেমন তোমরা জানো রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু তুমি কি বিদেশে গিয়ে এই ধারণা দেবে যে লু সুনের পর চিনা সাহিত্য থেমে আছে? সেটা চিনা সাহিত্যের পক্ষে মোটেই গৌরবের কথা নয়।

রবীন্দ্রসাহিত্য বারংবার পাঠ, উপভোগ ও উপলব্ধি ছাড়া বাংলা সাহিত্যে কারুর পক্ষে লেখক হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কলম হাতে নেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথকে দূরে সরিয়ে রাখাই তো স্বাভাবিক। কলম যখন হাতে থাকে না তখন রবীন্দ্রনাথ আমাদের মন অনেকটা জুড়ে থাকেন এখনও। আমি মাঝে-মাঝে রবীন্দ্রনাথকে স্বপ্ন দেখি, তাঁর সঙ্গে কথা বলি। সেদিন বালাতোন হ্রদের তীরে রবীন্দ্রনাথের মূর্তির সান্নিধ্যই ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। হ্রদের অন্যান্য অঞ্চলে আর না গিয়ে সেখানেই রয়ে গেলাম অনেকক্ষণ। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমরা সকলেই বেশ খানিকটা আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটা কৌতুক গল্পও চালু আছে হাঙ্গেরিতে। হাঙ্গেরিয়ানদের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পুরো নামটা উচ্চারণ করা বেশ শক্ত। ওদেশে কেউ যখন খুব মাতাল হয়ে যায়, তখন তার বন্ধুরা তার নেশার পরিমাণ পরীক্ষা করার জন্য জিগ্যেস করে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বানান কর তো। পারবি? এই গল্প শুনে রবীন্দ্রভক্তদের ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত না, কারণ এই গল্পেও প্রমাণ হয় যে ওদেশে সাধারণ মানুষের মনে রবীন্দ্রনাথ কতখানি জড়িয়ে আছেন! মাতাল সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর ওইসব দেশের দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেক তফাত। আমাদের দেশের মাতালরা রবীন্দ্রনাথের ধার ধারে না।

বালাতোন হ্রদ থেকে ফিরতে-ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল। বাড়ির কাছে এসে গাড়ি ভাড়া মেটাবার জন্য আমরা নিজেদের মধ্যে খুচরো খোঁজাখুঁজি করতে লাগলাম। দিতে হবে ছত্রিশ ডলার। কিন্তু আমাদের কোষাধ্যক্ষ বাদলের কাছে খুচরো ঠিক মিলছে না। তখন গাড়ির চালক স্টিফেন খুব মৃদু ও বিনীত স্বরে বললেন, যদি চল্লিশ ডলারই দিয়ে দাও, তা হলে তোমাদের চারজনকে মাত্র এক ডলার করে বেশি দিতে হবে, এমন কিছু গায়ে লাগবে না, কিন্তু ওই চার ডলার আমি পেতে পারি।

বাদল তৎক্ষণাৎ বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে, চল্লিশ ডলারই দিচ্ছি।

অসীম আমাকে মৃদু স্বরে বলল, দ্যাখো, এই স্টিফেন যখন ভারতে চাকরি করতে গিয়েছিল, তখন সে ছিল প্যান্ট-কোট-টাই পরা এক শ্বেতাঙ্গ সাহেব, তাই না! আমাদের দেশের লোকেরা নিশ্চয়ই ওকে সাহেব বলে খাতির করত। অথচ ও এখন আমাদের কাছে মুখ ফুটে মাত্র চার ডলার বকশিশ চাইছে। ব্যাপারটা খুব করুণ না!

এখানে বিদেশি সিগারেট খুব দুর্লভ, অনেকের কাছেই লোভনীয়। ভাস্কর স্টিফেনকে পুরো এক প্যাকেট সিগারেট উপহার দিল। তারপর জিগ্যেস করল, আচ্ছা স্টিফেন, তোমাদের দেশে এই যে কমুনিস্ট রেজিম বদলে গেল, গণতন্ত্র আসছে, এটা তোমার মতে ভালো না খারাপ হল?

বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন স্টিফেন। তারপর সংক্ষেপে বললেন, বোধহয় আগেরটাই ভালো ছিল।

ভাস্কর বলল, তাই নাকি? তুমি বুঝি কমুনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলে?

স্টিফেন বললেন, না, আমার সঙ্গে পার্টির কোনও যোগ ছিল না। আমি সাধারণ চাকরি করতাম, কখনও সাতে পাঁচে থাকিনি। তবু আমার মতে, হুট করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বদলের কোনও প্রয়োজন ছিল না।

আমি কৌতূহলী হলাম। এমন স্পষ্টভাবে আগের আমলের সমর্থনে কথাবার্তা আর কারুর মুখে শুনিনি। যারা কট্টর পার্টি মেম্বার ছিল তারা এখন প্রকাশ্যে নিজেদের পূর্ব পরিচয় দিতে চায় না, উলটো হাওয়ার স্রোতে কথা বলার সাহস নেই। সারাদিন ধরে স্টিফেনের সঙ্গে ঘুরে বুঝেছি, তিনি সরল, সাদাসিধে, ভালো মানুষ, তিনি কারুর মন জোগানো কথা বলবেন না। মিথ্যে কথাও বলবেন না। সুতরাং তাঁর যুক্তিটা শোনা দরকার।

স্টিফেন আবার বললেন, আমি বুদ্ধিজীবীও নই, অর্থনীতিবিদও নই। ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা নিয়ে মাথা ঘামাই না। কলকারখানা ও সব ব্যাবসা সরকার পরিচালনা করবেন, না ব্যক্তিগত মালিকানায় ভালো চলবে, তাও আমি বুঝি না। আমি শুধু ভাবছি, ভবিষ্যতে কী হবে? জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, ট্যাক্স বাড়ছে, সেই তুলনায় উপার্জন বাড়বে কি? আমাদের মতন মানুষরা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে তো? আগেকার আমলে খেয়ে পরে বেঁচে তো ছিলাম! কিছু-কিছু কষ্ট হয়েছে বটে, তবু...। এখনকার তরুণ-তরুণীরা গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছে। ওদের পক্ষে ওটা মানায়। কিন্তু আমার তো বয়েস হয়েছে, অনিশ্চয়তা দেখলে ভয় হয়।

একটু থেমে স্টিফেন আবার বললেন, সত্তরের দশকে কাদার-এর আমলে আমরা বেশ ভালোই ছিলাম। তারপর অবস্থা একটু একটু খারাপ হতে লাগল, জিনিসপত্রের অভাব দেখা দিল...

আমার মনে পড়ল, জানোস কাদার অনেকদিন আগে এমন একটা উক্তি করেছিলেন, যা সেই সময়ের সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় ছিল সম্পূর্ণ অভিনব।

আজ যিনি জাতীয় বীর হিসেবে পূজিত, সেই ইমরে নেগিকে বিশ্বাসঘাতক অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলা হয় ১৯৫৮ সালে। সোভিয়েত ট্যাংক এসে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল হাঙ্গেরির গণঅভ্যুত্থান। সেই ট্যাংকবাহিনী আর ফিরে গেল না। হাঙ্গেরিকে বাধ্য করার জন্য সোভিয়েত ব্লক থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হল নানারকম। বুডাপেস্টে একটি পুরো কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হল, যার প্রধানমন্ত্রী করা হল জানোস কাদার-কে।

কাদার সোভিয়েত ব্লকের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করার জন্য সব রকম চেষ্টা করে গেলেও তিনি বুঝেছিলেন, হাঙ্গেরির যুবসমাজ, বুদ্ধিজীবী ও কৃষকদের মধ্যে যে ক্ষোভ রয়ে গেছে, তা শুধু জোর জবরদস্তি দিয়ে দমন করা যাবে না। কাদারও ছিলেন অনেকটা ''জাতীয়তাবাদী কমিউনিস্ট''। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন যে খনি ও কলকারখানায় পরিচালনার ব্যাপারে শ্রমিক কাউন্সিলগুলিকে অনেকটা অধিকার দেওয়া হবে না। অনিচ্ছুক কৃষকদের কৃষি-সমবায়ে যোগ দিতে বাধ্য করা হবে না। নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এইসব প্রতিশ্রুতি তিনি অবশ্য শেষ পর্যন্ত মাটির চাপে রক্ষা করতে পারেননি। তবু চেষ্টা করেছিলেন।

অভ্যুত্থান দমনের পর সাধারণত চলে প্রতিশোধের পালা। কাদার আন্তর্জাতিক যে-কোনও ঘটনায় সোভিয়েত লাইন পুরোপুরি মেনে চললেও স্বদেশে বিক্ষুব্ধদের হত্যা, নির্যাতন বা কারাদণ্ডের প্রতি প্রবণতা দেখালেন না। দেশকে গড়ার জন্য সব ধরনের যোগ্য ও অভিজ্ঞ লোকদের সাহায্য চাইলেন, শুধুমাত্র পার্টির সদস্য হওয়াই যাদের যোগ্যতার মানদণ্ড নয়। দেশের সাধারণ মানুষ যাতে ভয় কাটিয়ে উঠে নিজের নিজের পেশায় মন দিতে পারে, ওপর মহলের খবরদারি ছাড়াও ইচ্ছে মতন পড়তে, লিখতে, ছবি আঁকতে বা কথা বলতে পারে, সেইজন্য তিনি ঘোষণা করলেন, 'যারা আমাদের বিরুদ্ধে নয়, তারা সবাই আমাদের পক্ষে' (He who is not against us is with us)।

এটা কমিউনিস্ট দুনিয়ায় এক সম্পূর্ণ নতুন কথা। রুশ বিপ্লবের আগে লেনিন একবার বলেছিলেন, 'যারা আমাদের পক্ষে নয়, আমাদের শত্রু'। পৃথিবীর সমস্ত কমিউনিস্ট এটাকেই ধ্রুব বাক্য বলে বিশ্বাস করে এসেছে এতদিন। অ-কমিউনিস্ট মাত্রই প্রতিক্রিয়াশীল। আমরা অল্প বয়েসে যখন স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তখন আমাদেরও এই কথাই শোনানো হয়েছিল। এমনকি কেউ যদি নির্ঝঞ্ঝাট, নির্দল হয়, কেউ যদি নিজেকে মানবতাবাদী বলে, তাকেও প্রতিক্রিয়াশীল বলে ছাপ মেরে দেওয়া হবে। কিছু কিছু মানুষের স্বভাবই এই, তারা কোনও দলে যেতে চায় না। মিছিলে যেতে চায় না। তারা নিরালায় নিজেদের কাজ করে যেতে চায়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, লেখক, শিল্পীদের মধ্যে অনেকে এই স্বভাবের, তারা এক ধরনের উদার মানবতায় বিশ্বাসী, যার সঙ্গে সাম্যবাদের প্রত্যক্ষ কোনও বিরোধ নেই। মানুষের এই নিরালা থাকার স্বভাবটাকে উপেক্ষা করে তাদের দলে টানবার চেষ্টা করে সাম্যবাদীরা, যারা তবুও দলে আসে না তাদের নানা বিড়ম্বনা, গালাগালি ও বাধা সহ্য করতে হয়।

এই গোঁড়ামির কুফল হয়েছে দুটি। কিছু লোক, যাদের জীবনযাত্রায় কিংবা চিন্তাধারায় সাম্যবাদের কিছুমাত্র চিহ্ন নেই, তারা মুখে পার্টির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে অনেক রকম সুবিধে ভোগ করে। এরকম বহু দেখা যায়। একজন অযোগ্য শিক্ষক অন্য অনেক যোগ্য শিক্ষককে সরিয়ে দিয়ে ওপরে উঠে যায় নিছক পার্টি সম্পর্কে গলাবাজির জোরে। এই অভিযোগ বহু শোনা যায়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে এরকম দৃষ্টান্ত ভুরি-ভুরি হওয়াতেই সাধারণ মানুষের এত ক্ষোভ জমেছিল।

অন্য কুফল হল, পার্টির প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখানোটাই প্রধান যোগ্যতা হওয়ার ফলে সমস্ত রকম সমালোচনার পথ বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হল এক দলীয় স্বৈরতন্ত্র। পার্টির নেতাদের যে-কোনও নির্দেশই অলঙ্ঘনীয়। বাইরের লোক পার্টির কোনও সমালোচনা করলে তাদের বলা হবে সি আই এ'র এজেন্ট, ধনতন্ত্রের চাকর ইত্যাদি। আর পার্টির কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে দেওয়া হবে শাস্তি। পার্টির প্রতি অন্ধ আনুগত্য এমনই চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছোয় যে স্টালিন যখন কোটি কোটি মানুষকে হত্যার আদেশ দেয় তখনও কেউ প্রতিবাদ করে না। রুমানিয়ায় চাউসেস্কু যখন একটি খুদে হিটলার হয়ে ওঠে, তখনও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় তাকে অপসারণের কথা উচ্চারণ করে না কেউ!

প্রায় সব ক'টি সমাজতান্ত্রিক দেশেই বহু লেখক পার্টির নির্দেশে নির্যাতিত হয়েছে। যে-কোনও ব্যাপারেই অন্ধ বিশ্বাস সৃষ্টিশীল শিল্পের অন্তরায়। লেখক-শিল্পীদের চরিত্র গঠনই এই যে তারা কারুর নির্দেশ মেনে চলতে পারে না। এক ধরনের বেপরোয়া ভাব কিংবা ক্ষ্যাপামিই তাদের সৃষ্টির প্রেরণা। যে-কোনও সমাজ ব্যবস্থায় যে-কোনও গলদ দেখালেই তাদের প্রতিবাদ বেরিয়ে আসে। তারা প্রবল রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, সমাজতন্ত্রের কোনও কোনও হাস্যকর দিকের প্রতিবাদ করতে তারা বাধ্য। কিন্তু পার্টির সুরে সুর মিলিয়ে কথা না বললেই কিংবা কিছু লিখলেই সেই লেখককে বলা হবে লোভী, ধনতন্ত্রের উপাসক কিংবা বুর্জোয়াদের দালাল কিংবা আরও বাছা বাছা সব গালাগাল। কেন সেই লোকরা প্রতিবাদ করছেন না বা সুরে সুর মেলাচ্ছেন না, তা ভালো করে বুঝে দেখার চেষ্টা না করেই তাঁর সততা সম্পর্কে সন্দেহ করা হয়। অথচ লেখকরাই তো সমাজের বিবেক! তাদের সমস্তরকম দল মতের ঊর্ধ্বে রাখতে পারলেই সমাজ ও শিল্পের পক্ষে মঙ্গল।

পাস্তেরনাক, সোলঝেনিৎসিন, মিলান কুন্দেরার মতন লেখকরা অযথা নির্যাতিত হয়েছেন। পাস্তেরনাক ক্ষুণ্ণ মনে লেখাই ছেড়ে দিলেন, একজন বিশিষ্ট কবি হয়েও জীবনের অনেকগুলি বছর কাটিয়ে দিলেন অকিঞ্চিকের অনুবাদ কর্মে। নোবেল পুরস্কার পেয়েও নিতে গেলেন না, তারপর তার মৃত্যু অনেকটা দুঃখিত, নীরব প্রস্থানের মতন। এখন আবার মস্কোতে পাস্তেরনাকের রচনা নিয়ে খুব নাচানাচি চলেছে। একদা যাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, এখন তাঁর রচনাই বিশেষ সমাদৃত।

সোলঝেনিৎসিনের রচনা 'ইভান দেনিশোভিচ-এর জীবনের একদিন' অনুবাদ করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, যখন কমিউনিস্ট পার্টি এখানে দ্বিধাবিভক্ত হয়নি। সোলঝেনিৎসিন ছিলেন আদর্শ লেখক। পরে যখন তিনি গুলাগ আর্চিপেলেগো লিখলেন, অমনি তিনি অচ্ছুৎ হয়ে গেলেন। দেশান্তরী হতে বাধ্য সোলঝেনিৎসিন, তবু তিনি কখনও স্বদেশের নিন্দে করেননি। অতি সম্প্রতি সেই গুলাগ-কেই একটা বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এবং সোলঝেনিৎসিনকে স্বদেশে ফেরার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যারা তখন সোলঝেনিৎসিনকে অপবাদ দিয়েছিলেন তাদের বিচার কে করবে? সোলঝেনিৎসিন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন এই পুরস্কার।

চেকোশ্লোভাকিয়ায় মিলান কুন্দেরাও খুব বড় মাপের লেখক। আগামী যে-কোনও বছরের মধ্যে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতে পারেন। চেক সরকার এঁকেও সহ্য করতে পারেননি, মিলা কুন্দেরা দেশ ছেড়ে চলে যান। তাঁর 'জোক' বা ঠাট্টা নামের উপন্যাসটি পড়লেই বোঝা যায় পার্টির নেতাদের হামবড়াই কোন নির্বুদ্ধিতার পর্যায়ে পৌঁছেছিল! এই উপন্যাসের কাহিনিতে একটি কলেজের ছাত্র তার এক বান্ধবীকে একটি পোস্ট কার্ডে চিঠি লেখে, যাতে শুধু লেখা ছিল, 'লং লিভ ট্রটস্কি'। পোস্টকার্ডটি পৌঁছে যায় ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারির কাছে। তার মতে এটা একটা সাংঘাতিক প্রতিক্রয়াশীল দলিল, কমিউনিস্ট দেশের এক ছাত্র এখনও ট্রটস্কির দীর্ঘজীবন কামনা করছে! আসলে কিন্তু ট্রটস্কি শব্দটার সঙ্গে স্টালিনের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং মেস্কিকোতে নির্বাসিত অবস্থায় স্টালিনপন্থীদের হাতে নিহত বোলশেভিক নেতা ট্রটস্কির কোনও সম্পর্ক নেই। ওটা একটা ঠাট্টা, একটা আদিরসাত্মক ইয়ারকি। ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক গোপন কোড ওয়ার্ড থাকে। ওটাও সে রকম, ট্রটস্কি একটি গোপন অঙ্গ। ছাত্র ইউনিয়নের কট্টর সেক্রেটারি কিংবা লোকাল কমিটির কেউ সেই ঠাট্টা বুঝল না, তারা এটাও বুঝল না যে সত্যিকারের ট্রটস্কিপন্থী হলে কেউ পোস্ট কার্ডে ওভাবে লিখে নিজেকে জাহির করত না। ওই সামান্য ঠাট্টার জন্য ছেলেটির পড়াশুনো বন্ধ হয়ে গেল, তাকে পাঠানো হল কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে, মেয়েটিরও জীবন নষ্ট হয়ে গেল। পার্টির কর্তাদের ওপর কোনও আপিল চলে না। তাদের নির্বোধ জেদে অপচয়িত হল দুটি জীবন।

সেইসব পার্টির কর্তারা আজ পলাতক কিংবা আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছে।



হাঙ্গেরি থেকে আমরা রুমানিয়া যাত্রা করলাম ট্রেনে। এই সেই বিখ্যাত ট্রেন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস, বহু গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে, সিনেমা তৈরি হয়েছে এই ট্রেন নিয়ে। নাম ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস হলেও এই ট্রেন অবশ্য প্রাচ্যের মধ্য দিয়ে যায় না, লন্ডন থেকে যাত্রা করে ইউরোপের অনেকগুলি দেশ পেরিয়ে ইস্তামবুলে এসে প্রাচ্যের এক প্রান্ত ছোঁয় শুধু। ইস্তামবুল শহরটিরও অর্ধেক ইউরোপে।

আমরা চারজন টিকিট কেটেছিলাম সেকেন্ড ক্লাসের। আন্তর্জাতিক যাত্রা হিসেবে ভাড়া খুবই সস্তা। আর একটু আরামদায়ক ক্লাসের টিকিট কাটার সাধ্য থাকলেও আমাদের স্বভাবই তো সস্তা খোঁজা। রাত ন'টা থেকে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত থাকতে হবে ট্রেনে। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস-এর সেই গৌরবের দিন আর নেই, তা ছাড়া গল্প-উপন্যাসগুলি উঁচু ক্লাসেই ঘটে, আমরা যে বগিতে উঠলাম সেটাতে রীতিমতন ভিড়। সাধারণ ট্রেনের সঙ্গে কোনও তফাত নেই। এই ট্রেনটি যখন যে-দেশের মধ্য দিয়ে চলে, তখন সে দেশের ব্যবস্থাপনা, হাঙ্গেরি ও রুমানিয়ার বর্তমান অবস্থার জন্য এই ট্রেনেও নানারকম বিশৃঙ্খলা। যে কুপেতে আমাদের স্থান হল, সেটি থ্রি-টিয়ার, অর্থাৎ ছ'জন লোকের শোওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু ছ'জন মানুষ শুয়ে পড়লে সেখানে মালপত্র রাখার আর কোনও জায়গা থাকে না, তা ছাড়া একেবারে ওপরের বাংক বেশ ছোট। লম্বা মানুষের অনুপযুক্ত। আমাদের দেশের ট্রেনের তুলনায় বেশ খারাপ। আরও দুজন লোক এসে পড়লে আমাদের চারখানা সুটকেস কোথায় রাখা হবে, এই চিন্তায় আমরা যখন বিচলিত তখন ভাস্কর একটা উপায় বার করে ফেলল। প্রথমে সে কন্ডাক্টরি গার্ডকে বোঝাবার চেষ্টা করল যে এইটুকু একটা কুপেতে দুজন মানুষ থাকবে কী করে? কন্ডাকটর গার্ডটি বলল, এখানে তো ছ'জনেরই রিজার্ভেশান, অন্য ছ'জন এলে জায়গা দিতেই হবে। ভাস্কর বলল, অন্য কুপেতে যদি একটা-দুটো সিট খালি থাকে, সেখানে তাদের চালান করে দেওয়া যায় না? আমরা চারজন এক সঙ্গে আছি...। কন্ডাকটর গার্ডটি মানতে চায় না। তখন ভাস্কর একটা একশো ফোরিন্টের নোট এগিয়ে দিল তার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মতন কাজ হল। কন্ডাকটর গার্ডিটি অল্প বয়েসি যুবক, অত্যন্ত সুদর্শন, শুট-টাই পরা নিখুঁত পোশাক, চিত্র তারকা হলে তাকে বেশ মানাত, মাত্র একশো ফোরিন্ট পেয়ে (আমাদের হিসেবে তিরিশ টাকার কাছাকাছি) তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সে জানাল যে আমাদের কোনও চিন্তা নেই, আমাদের কুপেতে আর কেউ ঢুকবে না, সে আমাদের যে-কোনও সাহায্য করতে প্রস্তুত। সে নিজে ধরাধরি করে আমাদের ভারী ভারী সুটকেস তুলে দিল ওপরের বাংকে।

সুষ্ঠুভাবে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার পর ভাস্করের হঠাৎ ঈষৎ গর্বিত মুখের দিকে চেয়ে অসীম ভর্ৎসনার সুরে বলল, ভাস্কর, তুমি কোন সাহসে লোকটিকে ঘুষ দিতে গেলে? আমি তো ইউরোপে কোনও লোককে এইভাবে ঘুষ দেওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারি না।

ভাস্কর বলল, মানুষের চরিত্র স্টাডি করতে হয়। সে ক্ষমতা তোমার নেই। এ ছেলেটার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলেই আমি ধরে ফেলছি এর লোভ আছে। দেখলে না, টাকাটা কী রকম খপ করে নিয়ে নিল।

আমিও এই প্রথম এত সাবলীলভাবে ঘুষের ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করলাম। এমন সুসজ্জিত, সুদর্শন যুবকটি যে এই সামান্য টাকার জন্য ব্যগ্র হবে, এ যেন কল্পনাই করা যায় না। ভাস্কর যখন প্রথম নোটটা বাড়িয়ে দিল, তখন আমার বেশ ভয়ই করছিল, যদি সে উলটে আমাদের অপমান করে।

চোখের সামনে না দেখলেও এইসব দেশে যে কী রকম ঘুষের রাজত্ব চলে, তা অনেকের মুখেই শুনেছি ও নানা লেখায় পড়েছি। ঘুষ ছাড়া অনেক জায়গায় কোনও কাজই হয় না। অনেকের ধারণা ভারতের মতন গরিব দেশগুলিতেই বুঝি ঘুষ-প্রবণতা রয়েছে, আসলে কিন্তু নানা ছদ্মবেশে ঘুষ-ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্ব জুড়ে। এসব দেশে কী রকম বাধ্যতামূলকভাবে ঘুষ দিতে হয়, তার একটা উদাহরণ শুনেছি। ধরা যাক, এক বাড়িতে জলের কল খারাপ হয়ে গেল। খাবার জলও আসছে না। শহরের কোনও দাবিই ব্যক্তিগত মালিকানার নয়, সবই সরকারি কোয়ার্টার, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বের জন্যও সরকারি বিভাগ আছে। বিপন্ন ব্যক্তিটি জলের কল সারাবার বিভাগে খবর দিল। খবর দিলেই যে সঙ্গে সঙ্গে মিস্তিরি ছুটে আসবে তা তো নয়। কাকুতি-মিনতি করে একজন মিস্তিরিকে ডেকে আনতে হবে। মিস্তিরি দেখে শুনে বলল, একটা ওয়াশার না পালটালে কল ঠিক হবে না, জল আসবে না। নীতিগতভাবে, সরকারি বিভাগ থেকে বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে ওয়াশার পাওয়ার কথা। কিন্তু নীতি আর বাস্তব ব্যবস্থার মধ্যে অনেক তফাত ঘটে যায়। মিস্তিরিটি বলল, ওয়াশার তো এখন স্টকে নেই! কবে আসবে বলা যাচ্ছে না, এক সপ্তাহও হতে পারে, তিন মাসও হতে পারে! এখন উপায়? নাগরিকজীবনে কলের জল ছাড়া কি একদিনও চলে? তখন মিস্তিরিটি বলবে, দশ রুবল পেলে সে কোনওক্রমে একটা ওয়াশার জোগাড় করে দিতে পারে।

আমাদের দেশে বেচারা কলের মিস্তিরিরা এক পয়সাও ঘুষ পায় না, একজনের বদলে অন্য মিস্তিরি ডেকে আনা যায়, বাজারের অনেক দোকানেই ওয়াশার কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশেও কোনও বাড়িতে বা কোয়ার্টারে নতুন জলের কলের কানেকশান পেতে হলে প্রচুর হাঁটাহাঁটি ও পুরসভার কোনও কর্মীকে ঘুষ দেওয়াটা আশ্চর্য কিছু নয়। মানুষ নীতি নির্ধারণ করে, আবার মানুষই তা ভাঙে।

চিনে গিয়ে শুনেছি, সেখানে ঘুষ দেওয়া নেওয়া সাংঘাতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য হলেও কোনও সরকারি কর্মচারী ও পার্টির উঁচু দিকের সদস্যদের সঙ্গে চেনাশুনো থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারুর কোনও জরুরি প্রয়োজন হলেই অমনি চতুর্দিকে খুঁজতে শুরু করে, কেউ চেনা আছে? ভালো চাকরি থেকে বিদেশযাত্রার অনুমতি পর্যন্ত অনেক কিছুই নির্ভর করে, ওপর মহলে কার কতটা চেনা আছে তার ওপর।

ধনতান্ত্রিক দেশের লোকজন আমাদের দেশে এলে রাস্তার ট্রাফিক পুলিশ হাসপাতালের চতুর্থশ্রেণির কর্মচারীদেরও প্রকাশ্যে ঘুষ নিতে দেখে নাক সিঁটকোয়। অধিকাংশ বিদেশিদের রচনায় এর উল্লেখ থাকে। ওদের দেশে রাস্তার পুলিশ ঘুষ নেয় না, কোনও সামাজিক সরকারি অফিসের কর্মচারী ঘুষের জন্য হাত পাতে না তা ঠিক, এসব সামাজিকভাবে নিন্দনীয়। ওসব দেশের রীতি হচ্ছে, চোখের সামনে ভদ্র সেজে থাকো, আড়ালে যত খুশি কুকীর্তি করে যেতে পারো। সামান্য দু-দশ টাকা ঘুষের বদলে ওসব দেশে যে লক্ষ-কোটি টাকার ঘুষের কারবার অনবরত চলে, তা কে না জানে! তবু ভণ্ডামি করে আমাদের দেশের এইসব ছোটখাটো ঘুষের ব্যাপার দেখে তারা আঁতকে ওঠে যেন ঘুষ কথাটার মানেই আগে জানত না।

সস্তায় এদিককার দেশগুলি ঘোরার জন্য 'ইস্টার্ন ইউরোপ অন আ শু স্ট্রিং' নামে একটি গাইড বই আছে। তার লেখক এই দেশগুলির প্রতি সহানুভূতিশীল, কোথাও নিন্দে করেননি। ভালো জিনিসপত্রের কথাই লিখেছেন, মন্দ দিকের কথা বাদ দিয়ে গেছেন। তবে তিনি কোথায় কীভাবে ঘুষ দিতে হবে, না দিলে কাজ পাওয়া যাবে না, তারও বেশ প্রয়োজনীয় বিবরণ দিয়েছেন। খুব বেশি টাকার ঘুষ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না বলে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন পকেটে অনেকগুলো এক ডলারের নোট এবং আমেরিকান সিগারেট রাখবার জন্য। আমেরিকান সিগারেটের খুব চাহিদা এই সব দেশে। তিনি লিখেছেন, কোনও কোনও জায়গায় কুড়ি ডলার দেওয়ার চেয়েও এক প্যাকেট কেন্ট সিগারেট দিলে বেশি কাজ হয়।

ভাস্কর সিগারেট খায় না, কিন্তু অনেকগুলি প্যাকেট কেন্ট সিগারেট নিয়ে এসেছে।

আমরা রুমানিয়ায় যাব শুনে জার্মানিতে অনেকেই চোখ কপালে তুলে বলেছিল, সেখানে কেন যাবে? রুমানিয়াতে গিয়ে কিছু খেতে পাবে না!

আমরা হেসে উত্তর দিয়েছি, আমরা গরিব ভারতের মানুষ, আমাদের আবার না খেতে পাওয়ার ভয় কী!

শুধু চাওসেস্কুর অপসারণের পরেই নয়, বছর চারেক ধরেই সারা ইউরোপে শোনা গেছে যে রুমানিয়ায় দারুণ খাদ্যাভাব। পোলান্ডে যখন দারুণ অনটন চলছে, তখনও অনেকে বলেছে যে এর তুলনায় রুমানিয়ার অবস্থা অনেক খারাপ। তবু কেউ কিছু ব্যবস্থা নেয়নি কেন? ওয়ারশ প্যাক্টের অন্তর্বর্তী হলেও এখানকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি কিন্তু পরস্পরকে অনেক ব্যাপারেই সাহায্য করেনি। এর মধ্যে হাঙ্গেরি ও রুমানিয়া। এই পাশাপাশি দুটি দেশের মধ্যে চরম বিরোধ। হাঙ্গেরিতে আমরা রুমানিয়ার প্রসঙ্গ তুললেই সবাই গম্ভীর হয়ে গেছে। আমাদের বন্ধু জর্জ সোমলিও-কে জিগ্যেস করেছিলাম, তুমি এর মধ্যে রুমানিয়া বেড়াতে যাওনি? জর্জ প্রায় খেঁকিয়ে উঠে বলেছিল, রুমানিয়া বেড়াতে যাব কোন দুঃখে? ওটা আবার একটা দেশ নাকি?

অসীম বুদ্ধি করে কিছু রুটি-মাখন-সসেজ নিয়ে এসেছে সঙ্গে। অতি সুদৃশ্য ডাইনিং কার ঘুরে এসে ভাস্কর জানাল সেখানে কোনও খাবার নেই।

রাত আড়াইটের সময় ট্রেন এসে দাঁড়াল হাঙ্গেরি-রুমানিয়া সীমান্তে। তারপর শুরু হল ইমিগ্রেশান-কাস্টমসের অত্যাচার।

সারা পৃথিবীতেই এখন ভিসা ব্যবস্থা বিচিত্র ও উদ্ভট। কোন দেশে কার কী ধরনের ভিসা লাগবে, তার কোনও নির্দিষ্ট মান নেই। হাঙ্গেরিতে ভিসা পাওয়ার জন্য বাদল ও আমাকে হোটেল বুক করে বাজে পয়সা খরচ করতে হয়েছিল, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড থেকে আসা অসীম ও ভাস্করের ভিসাই লাগেনি। ঠিক পাশের দেশটিতেই উলটো ব্যবহার। ভারতীয় হিসেবে বাদল ও আমার ভিসার প্রয়োজন নেই, কিন্তু অসীম ও ভাস্করের লাগবে, তাও আবার অসীমের তুলনায় ভাস্করের ভিসা ফি অনেক বেশি। তিনজন ব্যক্তি আমাদের কিউবিকলে এসে পাশপোর্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল, তাদের মধ্যে একজন ফরাসি ফ্রাংক ও ব্রিটিশ পাউন্ডের মূল্যবান হিসেব করতে হিমসিম খেয়ে গেল, অন্য দুজন আবদার ধরল, আমাদের সুটকেস খুলে দেখবে। রাত্রির তৃতীয় প্রহরে, ঘুম চোখে এসব অত্যাচারের মতনই মনে হয়। সুটকেস খুলতে বাধ্য করে, তারা হাত দিয়ে অন্যমনস্কভাবে জামা-কাপড় উলটে দেয়, আসলে তারা কিছুই দেখে না, সত্যিকারের গোপনীয় কোনও বস্তু থাকলে ওভাবে তা কিছুতেই বোঝা যাবে না, তবু নিছক লণ্ডভণ্ড করাতেই যেন তাদের আনন্দ।

কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের লোকজনদের ওপর যে কোনও চোটপাট করা যায় না, এ বিবেচনা হারিয়ে ফেলে ভাস্কর রীতিমতন তর্জন-গর্জন শুরু করে দিল। আমি আর বাদল ভাস্করকে থামাবার চেষ্টা করেও পারি না, তাকে টেনে নিয়ে গেলাম একপাশে। লোকগুলো ইংরিজি প্রায় বোঝেই না, তাই যা রক্ষে।

প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরে লোকগুলি বিদায় নিলে অসীম বলল, ভাস্কর, তুমি কী করছিলে? বিপদে ফেলে দিচ্ছিলে সবাইকে!

ভাস্কর বলল, তা বলে কি অসভ্যতা সহ্য করতে হবে রাত আড়াইটের সময়? বিপদ, বিপদ আবার কী?

অসীম বলল, যদি আমাদের জেলে পুরে দিত? একটা কিছু ফলস চার্জ দিয়ে দিলেই তো হল!

ভাস্কর বলল, জেলে দেবে, মামাবাড়ির আবদার? আমরা কি চুরি-জোচ্চুরি করেছি? আমাদের এমব্যাসিতে ফোন করতাম!

বাদল বলল। জেলে না দিলেও এই শীতের রাতে আমাদের ট্রেন থেকে নামিয়ে প্ল্যাটফর্মে বসিয়ে রাখতে তো পারত! সে ক্ষমতা এদের আছে। তখন কী হত?

ভাস্কর এবার ঠিক কোনও উত্তর খুঁজে না পেয়ে টপ করে শুয়ে পড়ে পাশ ফিরে নাক ডাকাতে লাগল।

পৃথিবীর অনেক দেশেই ঢোকার সময় লক্ষ করেছি, আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করার আগেই, আমাদের চেহারা দেখে ভারতীয় (ভারত উপমহাদেশীয়) বলে চিনতে পারলেই ইমিগ্রেশানের লোকদের ব্যবহার বদলে যায়। ভারতীয়রা আজ আর পৃথিবীর কোথাও স্বাগত নয়। সকলেরই ধারণা, এ দেশটা অত্যন্ত জনবহুল আর দরিদ্র, এ দেশে ছেলেমেয়েরা চাকরি কিংবা জীবিকার লোভে সব সময় অন্য দেশে থেকে যাওয়ার সুযোগ খোঁজে। একবার আমি আফ্রিকার কিনিয়ায় গিয়েছিলাম। আগে সেখানে ভারতীয়দের জন্য ভিসা লাগত না, আমি যাওয়ার আগের দিন থেকে ভিসা প্রবর্তিত হয়েছে, তা জানতে পেরে আমি লন্ডন থেকে কষ্ট করে ভিসা সংগ্রহ করেছিলাম। ইমিগ্রেশানের কাউন্টারে একজন কুচকুচে কালো রঙের মানুষ লাইনের সামনের দিকের শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে হেসে-হেসে কথা বলছিল ও চটপট স্ট্যাম্প মেরে ছেড়ে দিচ্ছিল। আমাকে দেখামাত্র লোকটি গম্ভীর হয়ে গেল। আমার কাগজপত্র সব ঠিকঠাক, তবু সে জিগ্যেস করল, তুমি কেন এসেছ? কতদিন থাকবে? আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলাম, আমরা যতই বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে রাগারাগি করি, আসলে কালো লোকরাই কালো লোকদের দেখতে পারে না।

হাঙ্গেরিতে ঢোকার মুখে আমার ও বাদলের বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। উপযুক্ত ভিসা সঙ্গে আছে, ইমিগ্রেশান কাউন্টার থেকে ছেড়েও অফিসার দূর থেকে ডেকে আমাদের থামাল এবং পাশপোর্ট দেখতে চাইল। কাস্টমস অফিসারের পক্ষে মালপত্রের আকার-প্রকার লক্ষ করাই স্বাভাবিক, কিন্তু সে আমাদের পাসপোর্ট দেখতে দেখতে গম্ভীর হয়ে গেল এবং আমাদের অতি নিরীহ চেহারার সুটকেস দুটি খুলতে বলল, কী দেখল সে আমাদের পাসপোর্টে? বিরক্তি চেপে তাকে আমাদের সুটকেস দুটি ঘাঁটাঘাঁটি করার সুযোগ দিলাম। যথারীতি মিনিট দু-এক বাদে লোকটি বলল, ঠিক আছে, যেতে পারো।

বাক্স গুছোবার পর আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, একটা প্রশ্ন করতে পারি? এই যে দেখছি গ্রিন চ্যানেল দিয়ে অন্য অনেক লোক সোজা বেরিয়ে যাচ্ছে, তুমি শুধু আমাদের থামালে কেন? আমাদের মুখ দেখে?

লোকটি থতোমতো খেয়ে বলল, না, সে সব নয়। পাঁচজন-দশজন পরপর এক এক জনকে থামাই!

এ কথাটি মোটেই সত্যি নয়। আমরা চোখের সামনে কুড়ি-পঁচিশ জনকে পার হতে দেখেছি। সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে। তা ছাড়া, দশজন অন্তর একজনকে চেক করার ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দু'জনকে ধরা হল কেন? সমগ্র প্লেন-যাত্রীদের মধ্যে আমরা দু'জনেই মাত্র অশ্বেতকায়। হাঙ্গেরিতে বর্ণবিদ্বেষের কথা কখনও শোনা যায়নি, তবু আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অবশ্য এ কথাও ঠিক, ওই একটি ঘটনা ছাড়া। হাঙ্গেরিতে আমরা যে-কটা দিন কাটিয়েছি, সকলের কাছ থেকেই ভালো ব্যবহার পেয়েছি। এমনও হতে পারে, কাস্টমস অফিসারটি প্রথমে আমাদের জিপসি ভেবেছিল, পরে পাসপোর্ট দেখে বুঝেছিল, আমরা জিপসিদের পূর্বপুরুষের দেশের। হাঙ্গেরিতে অনেকেই জিপসিদের পছন্দ করে না। এখানকার জিপসিদের প্রতি সরকারের বিরূপ মনোভাব এবং পুলিশি অত্যাচারের কিছু কিছু বিবরণ পত্র-পত্রিকায় পড়েছি।

লন্ডনের বিমানবন্দরে ভারতীয়দের বহু হয়রানির কাহিনি শোনা যায়। আমার কখনও সেরকম অভিজ্ঞতা হয়নি, বরং এ কথা বলতে পারি যে ইংরেজেরা এখানে রুল অফ ল মানে। ইমিগ্রেশান থেকে আপত্তি জানালেও তার ওপর আপিলের ব্যবস্থা আছে। মনে যদি অপরাধবোধ না থাকে, তা হলে ইমিগ্রেশান কর্মচারীর সঙ্গে তর্ক করা যায়। চার বছর আগেও ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য ভারতীয়দের কোনও ভিসার ব্যবস্থা ছিল না। সেইরকমই একটা সময়ে আমি মস্কো থেকে ফেরার পথে লন্ডন গিয়েছিলাম। ভিসা ছিল না, কিন্তু ইমিগ্রেশান কাউন্টারে নানারকম প্রশ্নপর্ব চলত। আমাকে কর্মচারীটি জিগ্যেস করল, তুমি লন্ডনে আসতে চাও কেন? আমি হালকাভাবে উত্তর দিলাম, রাশিয়ায় একটা সরকারি নেমন্তন্ন ছিল, ফেরার পথে লন্ডনে বন্ধুদের সঙ্গে কয়েকদিন আড্ডা দিয়ে যেতে চাই। সে জিগ্যেস করল, থাকবে কোথায়? পয়সা পাবে কোথায়? আমি উত্তর দিলাম, এক বন্ধুর বাড়িতে থাকব, বিশেষ পয়সা লাগবে না। লোকটি অবিশ্বাসের চোখে কয়েক পলক চেয়ে রইল। ইংরেজ জাতি আড্ডার মর্ম বোঝে না, আমাদের কাছে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার চেয়ে মনোরম আর কী হতে পারে? কর্মচারীটি একবার জিগ্যেস করল, সোভিয়েত সরকার যে তোমায় নেমন্তন্ন করেছিল, তার প্রমাণ কোথায়? তুমি যে মস্কো থেকে আসছ তা বুঝব কী করে? তোমার পাসপোর্টে তো সোভিয়েত ভিসা নেই এবার আমার একটু মজা করার ইচ্ছে হল। আমার কোনও ঝুঁকি নেই, জরুরি কোনও কাজেও আসিনি, ঢুকতে যদি না দেয়, পরের প্লেনে চেপে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাব। লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, তুমি এই কাউন্টারে বসে কাজ করছ, অথচ তুমি এটা জানো না যে সোভিয়েত ভিসার ছাপ কখনও থাকে না পাসপোর্টে? আলাদা কাগজে ভিসা থাকে, আসার সময় সেটা নিয়ে নেয়! এই কথাটা শোনামাত্র রাগ করার বদলে অত্যন্ত বিনীতভাবে সেই কর্মচারীটি বলল, ঠিক! ঠিক! আপনার লন্ডন-বাস সুখকর হোক! ব্রিটিশ চরিত্রের এই দিকটি আমার ভালো লাগে।

সকালবেলা চলন্ত জানালা দিয়ে দেখা গেল রুমানিয়ার দৃশ্য। ছোট ছোট পাহাড় ও নিবিড় জঙ্গল। শীত শুরু হয়েছে, কিন্তু সব গাছের পাতা ঝরেনি। এদিককার গাছের পাতা ঝরে যাওয়ার আগে নানারকম রং বদলায়। এই অরণ্য যেন টেকনিকালার।

ব্রেকফাস্ট খাবার জন্য আমরা গেলাম ডাইনিং কামরায়। প্রচুর চেয়ার টেবিল, প্রায় সবই ফাঁকা। ফাঁকা থাকার কারণটাও অবিলম্বে জানা যায়, কোনও খাবার নেই। এত বড় একটা খাবারের জায়গা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে, অথচ কোনও খাবার নেই। অনেক দূরের একটা টেবিলে একজন লোক বসে কিছু খাচ্ছে। ভাস্কর সেই দিকে আঙুল তুলে দেখাতেই পরিচারক বলল, ওইটুকুই শেষ খাবার ছিল, তারপর ফুরিয়ে গেছে।

ভাস্কর ছাড়ার পাত্র নয়। পকেট থেকে বার করল কেন্ট সিগারেটের একটা প্যাকেট। তারপরেই চলে এল চার প্লেট ওমলেট। এর সঙ্গে টোস্টের দুরাশা করে কোনও লাভ নেই, কারণ রুটি সত্যি নেই। ওমলেটে ছড়াবার জন্য গোলমরিচও পাওয়া যাবে না। চা-কফির জন্য দুধ নেই। শুধু নুন দেওয়া ডিম ভাজা ও কালো চা, তাই খেতে খেতে মনে পড়ল গ্রাহাম গ্রিন ও আগাথা ক্রিস্টি এই ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে খাওয়া দাওয়ার কত না বর্ণনা লিখেছেন!

বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে আরও মনে হল, এই সুন্দর দেশটিতে খাদ্যাভাব সৃষ্টি করেছে কিছু মানুষ। রুমানিয়া কখনও খুব গরিব দেশ ছিল না, এখন সারা ইউরোপের করুণার পাত্র।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেট করে ট্রেন ঢুকল বুখারেস্ট শহরে।



প্যারিস শহরের বিখ্যাত রেল স্টেশন গার দু নর-এর অনুকরণে বুখারেস্ট-এর প্রধান রেল স্টেশনের নাম গারা দে নরড হলেও, আমি এর সঙ্গে হাওড়া স্টেশনেরই মিল পেলাম বেশি। ইউরোপের আর কোনও স্টেশনে আমি এত মাল বইবার কুলি দেখিনি। হাওড়া স্টেশনে যেমন লাল জামা পরা লাইসেন্সড কুলি ছাড়াও আরও কিছু ছুটকো-ছাটকা লোক মাল বইবার কাজ করে এখানেও আমরা কামরা থেকে নামার পর সরকারি কুলিরা এগিয়ে আসবার আগেই এক খোঁচা-খোঁচা দাড়ি ভরতি মুখ, প্রায় বৃদ্ধ, আমাদের দুটো সুটকেস তুলে নিয়ে দৌড় লাগাল।

ট্রেনে ভাস্কর দুটি গ্রিক মেয়ের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছিল, মেয়ে দুটি ভাঙা ভাঙা ইংরিজি জানে। আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও ভাস্কর বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। কারণ ইংরিজি বলা মানুষ খুঁজে বার করা খুব দুষ্কর। মেয়ে দুটি ডাক্তারির ছাত্রী, সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে বুখারেস্ট পড়তে এসেছে। এই মেয়ে দুটি আগেই আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল যে বুখারেস্ট রেল স্টেশনে চোর-জোচ্চোরের খুব উপদ্রব, পকেটের টাকাকড়ি সব সময় সামলে রাখতে হবে, নজরে না রাখলেই সুটকেস-ব্যাগ উধাও হয়ে যেতে পারে। হোটেল বাছতে হবে খুব দেখে শুনে, কারণ অধিকাংশ হোটেলই ঠকায়। রাস্তার কোনও লোক যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সাহায্য করতে আসে, তা হলে ধরে নিতে হবে, তার কোনও বদ মতলব আছে। এসব কথা আমাদের খুব অচেনা লাগে না।

সেই মালবাহক প্রৌঢ়ের পিছু পিছু ছুটলাম আমরা। কত ভাড়া দিতে হবে, তা আমাদের আন্দাজ নেই, খুচরো দু-চার ডলার দিতেই সে খুব কৃতজ্ঞ ভঙ্গি করল। পরে জেনেছি, এখানকার মধ্যবিত্তদের মাসিক উপার্জন একশো ডলারের মতন।

গ্রিক মেয়ে দুটি আমাদের বিশ্বাসযোগ্য হোটেল খুঁজে দিতে সাহায্য করতে চেয়েছিল, কিন্তু কাছাকাছি একটা টুরিস্ট অফিস দেখে অসীম বলল, আগে ওদের কাছ থেকেই সন্ধান নেওয়া উচিত। আমি আর বাদল রইলাম মাল পাহারা দিতে, বাকিরা চলে গেল সেদিকে। তারপর বেশ কিছু সময় চলে গেল। স্টেশনে বেশ কিছু লোক এমনিই ঘুরে বেড়াচ্ছে, মনে হয় যেন অলস, বেকার। কেউ-কেউ আমাদের কাছাকাছি এসে বসছে। আবার উঠে যাচ্ছে, কেউ একটু দূর থেকে তেরচাভাবে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আমি ভাবছি, এর মধ্যে কেউ কি আমাদের কোনও ব্যাগ তুলে নিয়ে পালাবার মতলব আঁটছে? কেউ খুব কাছ ঘেঁষে এলে আমি বেশি সতর্ক হয়ে উঠছি। এক সময় আমার মনে হল, এরকমভাবে সব লোককে সন্দেহ করা অতি বিশ্রী ব্যাপার। দু-চারটি ছ্যাঁচড়া-ছিনতাইবাজ থাকতে পারে, বাকিরা অবশ্যই সাধারণ, ভদ্র মানুষ। কিন্তু রুমানিয়া সম্পর্কে আগে থেকে এত সাবধান বাণী শুনেছি যে সকলকেই যেন অবিশ্বাস করতে হয়, আবার মনের মধ্যে মানুষ সম্পর্কে এরকম অবিশ্বাস পুষে রাখতেও খারাপ লাগে। আমি অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করলাম। জানি যে, বাদলের অতি সতর্ক নজর এড়িয়ে আমাদের কোনও জিনিসে কারুর হাত ছোঁওয়াবার সাধ্য নেই।

খানিক বাদে অসীম সদলবলে ফিরে এল, সঙ্গে একজন গোলগাল, মাঝ বয়সি মহিলা যুক্ত হয়েছে। বার্তা এই যে, পর্যটক দফতর থেকে জানা গেছে, শহরের কোনও হোটেল খালি নেই, কারণ এখানে ট্রেড ফেয়ার আছে। একমাত্র উপায়, কারুর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকা। ওই দফতর থেকেই একজন মহিলাকে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, তার বাড়িতে চার জনের স্থান হবে।

মহিলার নাম মাদাম দিদা। তাঁর ইংরিজি জ্ঞান দশ-বারোটি শব্দে সীমাবদ্ধ। তাতেই কাজ চলে যাবে। ট্যাক্সিতে অনেক রাস্তা ঘুরে আমরা তার বাড়িতে পৌঁছোলাম। এই এলাকার চতুর্দিকেই ফ্ল্যাট বাড়ি। এরকম এলাকা আজকাল পৃথিবীর সব শহরেই দেখা যায়। একই ধাঁচের সব বাড়ি, ভেতরে খুপরি এলাকা আজকাল পৃথিবীর সব শহরেই দেখা যায়। একই ধাঁচের সব বাড়ি, ভেতরে খুপরি খুপরি ফ্ল্যাট। দু-খানা ছোট ছোট শয়নকক্ষ, একটি বসবার ঘর, রান্না ঘর ও বাথরুম। এই ফ্ল্যাটটার বিশদ বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। বাথরুমের ফ্লাশ কাজ করে না। রং করা টিনের বাথ-টবের মধ্যে একটা বালতি। ইউরোপের আর কোনও দেশে আমি বালতি নামক বস্তুটি আগে দেখিনি। সভ্য দেশে চব্বিশ ঘণ্টাই কলে জল থাকে, সুতরাং বালতির প্রয়োজন কী? এই বালতিতে জল নিয়ে কমোড পরিষ্কার করতে হবে। সব সভ্য দেশেই দুটি কল থাকে, একটি দিয়ে অবিরাম গরম জল পাওয়ার কথা। এখানে অনেক সময় কোনও কলেই জল থাকে না। একটা সরু টয়লেট পেপারের রোল রয়েছে। সেটাও মনে হয় নেহাৎ সাজাবার জন্য, তাও মোটা হলদে ও শিরিষ কাগজের মতন খসখসে। অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক দেশেই টয়লেট পেপার অতি নিম্ন মানের। রুমানিয়াতে এই বস্তুও খুব দুর্লভ। এই সব দেশের লোক ইংল্যান্ড-ফ্রান্সে বেড়াতে গেলে নিশ্চয়ই ভাববে, কেন তাদের দেশ এই অতি প্রাথমিক প্রয়োজনীয় জিনিসটিও বানাতে পারে না? ভাস্কর নিজের পশ্চাদদেশের প্রতি মায়াবশত বিলেত থেকে ভালো জাতের টয়লেট পেপার সঙ্গে এনেছে। মোট কথা, আমাদের যে-কোনও মধ্যবিত্ত বাড়ির তুলনাতেও এ বাড়ির বাথরুম বেশ খারাপ।

মাদাম দিদা বিধবা, তাঁর স্বামী কেমিস্ট ছিলেন, বছর তিনেক আগে মারা গেছেন। সতেরো-আঠারো বছরের একটি মাত্র ছেলে তাঁর সঙ্গেই থাকে। ফ্ল্যাটটাতে ঢুকেই মনে হয়েছিল, এখানে আমাদের চারজনের জায়গা হবে কী করে? ছেলের ঘরে একটি সিঙ্গল খাট, অন্য ঘরের খাটটি নব-বিবাহিতের পক্ষে আদর্শ হলেও দুজন পুরুষের পক্ষে অনুপযুক্ত। বসবার ঘরের সোফাটি টেনে নিলে একজনের বিছানা হতে পারে। তা হলে চতুর্থজন শোবে কোথায়? মাদাম দিদা জানালেন যে বাকি একজনের জন্য মেঝেতে বিছানা পেতে দেওয়া হবে। বসবার ঘরের মেঝেতে রয়েছে একটা নোংরা, ক্ষয়ে যাওয়া কার্পেট।

ব্যবস্থা দেখে ভাস্কর খেপে উঠল। আমাদের মাথাপিছু দৈনিক কুড়ি ডলার দিতে হবে। সমস্ত কাগজপত্রে লেখা আছে যে কুড়ি ডলারে এখানকার প্রথম শ্রেণির হোটেলে ঘর পাওয়ার কথা। এত টাকা খরচ করেও আমরা এত কষ্ট সহ্য করতে যাব কেন?

এতটুকু ছোট ফ্ল্যাটে চারজন আত্মীয় এসে পড়লেও স্থান সংকুলান হওয়ার কথা নয়। তবু চারজন পেয়িংগেস্টকে নিয়ে আসা হল। কেন? বাড়িতে বিদেশি অতিথি রাখার জন্য নিশ্চয়ই লাইসেন্স লাগে, সরকারের পক্ষ থেকে এসব বাড়ি পরিদর্শন করার ব্যবস্থা নেই! এর আগে অন্যান্য দেশেও আমরা পেয়িংগেস্ট হয়ে থেকেছি, সে সব জায়গায় অতিথিদের কী কী সুবিধে দেওয়া হবে, তার একটা নির্দিষ্ট তালিকা থাকে। বুডাপেস্টেও আমরা এর চেয়ে অন্তত দশগুণ আরামে ছিলাম।

আমাদের উষ্মা দেখে মাদাম দিদা শেষ পর্যন্ত কুণ্ঠিতভাবে স্বীকার করলেন যে, আসলে তাঁর লাইসেন্স মাত্র দুজন অতিথি রাখার জন্য। কিন্তু আমাদের চারজনকে দেখে লোভে পড়ে তিনি নিয়ে এসেছেন। আমাদের স্থান দেওয়ার জন্য তাঁকে শুতে হবে রান্নাঘরে, ছেলেকে পাঠাতে হবে অন্য বাড়িতে।

শুধু তাই নয়, পরে আমরা শহর ঘুরে জেনেছিলাম, অনেক হোটেলের ঘর খালি আছে, টুরিস্ট দফতরের কর্মীটি আমাদের মিথ্যে কথা বলেছিল। নিশ্চিত তার সঙ্গে মাদাম দিদার কমিশনের ব্যবস্থা আছে।

আমরা সহজেই বাসস্থান পালটে ফেলতে পারতাম, কিন্তু আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম, এই ক্ষুদ্র রুমানিয়ান পরিবারটি নিছক দারিদ্র্যের জন্যই এমন লোভী হয়েছে এবং নিজেরাও অনেক অসুবিধে ভোগ করছে, আমাদেরও খানিকটা মেনে নিয়ে এদের সাহায্য করাই উচিত।

বাদল বলল, চার-পাঁচদিন থাকব, কী আর এমন কষ্ট হবে। হোটেলে থাকার চেয়ে কারুর বাড়িতে থাকা অনেক ভালো। অসীমেরও সে রকমই হত। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভাস্করকে ঠান্ডা করা হল।

চারজনের মধ্যে মেঝেতে কে শোবে, সেটা ঠিক করা মুশকিল, কারণ প্রত্যেকেই রাজি, তাই লটারি করা হল এবং বলাই বাহুল্য এই দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী হলাম আমিই!

মেঝেতে শুতে আমার মোটেই খারাপ লাগে না, তবে বারান্দার দিকের দরজার তলা দিয়ে একটা শিরশিরে বাতাস এসে বড় জ্বালাতন করল সারারাত। শীতের রাতেও ঘর গরম করা যাবে না, একটা রুম হিটার থাকলেও সেটার ব্যবহার নিষিদ্ধ। এখনও অবশ্য শূন্যের দিকে পারদ নামেনি, কিন্তু ডিসেম্বর -জানুয়ারিতে এখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে। তখনও বুখারেস্টের মানুষ বিদ্যুতের অভাবে ঘর গরম করতে পারেনি, ইউরোপের অন্য কোনও দেশে এ অবস্থা অকল্পনীয়।

'লোডশেডিং' এই বাক্যবন্ধ নিতান্তই পশ্চিমবঙ্গীয় ইংরিজি, কিন্তু এই ব্যাপারটিতে বুখারেস্ট শহর অনায়াসেই কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এখানকার অনেক রাস্তায় আলো থাকে না। এমনকি পরে আমরা এয়ারপোর্টেও অন্ধকার দেখেছি। তবে লাইন দেওয়ার প্রতিযোগিতায় সাম্প্রতিক বুখারেস্ট কলকাতার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। আমরা পাউরুটি, চিনি, কেরোসিন, ডিজেলের লম্বা লাইন দেখেছি কলকাতায়, এখানে সর্বত্র লাইন, কোনটা যে কীসের জন্য, তা বোঝা দুষ্কর। লাইনে যারা দাঁড়ায়, তারাও অনেক সময় জানে না। পথ চলতি মানুষ কোনও একটা দোকানের সামনে লাইন দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ে, কিছু একটা তো পাওয়া যাবে! বর্তমানে এখানে অপ্রাপ্য দ্রব্যের তালিকা বিশাল। দুধ-মাছ-মাংস থেকে টয়লেট পেপার পর্যন্ত! দুধ নেই, সুতরাং আইসক্রিমও নেই। হাঙ্গেরিতে সব দোকানে আইসক্রিম দেখেছি, পাশের দেশ রুমানিয়ায় আইসক্রিম অদৃশ্য। আমরা স্কুলে পড়বার পর স্কুল-গেটের সামনে এক রকম জিনিস পাওয়া যেত, গুঁড়ো করা বরফের মধ্যে লাল বা নীল রঙের একটু সিরাপ মেশানো, সেটাই চেটে চেটে খেতাম। অনেকদিন পর সেই জিনিস দেখলাম রুমানিয়ায়, ক্রিমবিহীন আইসক্রিম, বয়স্ক লোকেরাও তাই-ই খাচ্ছে।

একদিন এখানকার মেট্রো রেলে রাত্তিরবেলা চলন্ত কামরার মধ্যে মুরগির ডাক শুনে চমকে উঠেছিলাম। প্রথমে মনে হয়েছিল, কোনও চ্যাংড়া ছেলে বুঝি ইয়ারকি করছে। দু-তিনবার শোনার পর লক্ষ করে দেখি, সত্যিই একজন লোক তার কোটের আড়ালে ঢেকে একটা জ্যান্ত মুরগি নিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের ট্রেনে জ্যান্ত মুরগি? অন্য কারুর মুখে এ ঘটনা শুনলে আমি বিশ্বাস করতাম না। এখানে মুরগি এখন এতই দুর্লভ যে একজন কেউ কোনওক্রমে একটা যোগাড় করে এই অবস্থাতেই বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। অন্য যাত্রীরা তার দিকে তাকাচ্ছে ঈর্ষার চোখে। সকালবেলা মেট্রোয় যেতে-যেতে দেখেছি, অনেক অফিসযাত্রীর ফিটফাট পোশাক, গলায় টাই রয়েছে বটে, কিন্তু গালে দু-তিন দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সাহেব জাতি দাড়ি রাখে, অথবা প্রতিদিন দাড়ি কামায়, এত লোক খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে অফিস যায়, এমন আগে দেখিনি। স্থানীয় একজনকে কারণটা জিগ্যেস করায় সে বলেছিল, ব্লেড পাওয়া যাচ্ছে না। ওদের মুখের কাছে গিয়ে কথা বলো না, কারণ টুথপেস্টও পাওয়া যাচ্ছে না বলে অনেকে দাঁতও মাজে না।

রুমানিয়ানরা শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান-দর্শন-জ্ঞান চর্চায় যথেষ্ট উন্নত। সেই জাতির এরকম শোচনীয় অবস্থা কেন? শুধু আজ নয়, পাঁচ-সাত বছর ধরেই নানা অনটন চলছে। এর জন্য দায়ী শুধু চাউসেস্কু আর তার দলবল? এই দুষ্টচক্রকে নিবৃত্ত করার কোনও উপায় এখানকার রাষ্ট্রব্যবস্থায় ছিল না?

রুমানিয়ার চাষিরা এক সময় যথেষ্ট সম্পন্ন ছিল। ১৯৬৫ সালের সংবিধানে সমস্ত চাষের জমিকে সামাজিক সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে চাষিদের বাধ্য করা হয় রাষ্ট্রীয় খামার কিংবা সমবায়ে যোগ দিতে। চাষিদের মনস্তত্বের কোনও গুরুত্ব দেওয়া হল না, সমাজতান্ত্রিক চেতনা গড়ে তোলার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হল না, একটা ব্যবস্থা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হল ওপর থেকে। সব কিছু চলতে লাগল এক কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায়, যা আসলে সমাজতন্ত্র-বিরোধী।

রুমানিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল চাউসেস্কু আর একটা উদ্ভট কাণ্ড করেছিলেন। গ্রামের চাষিদের বাড়িঘর ভেঙে-গুঁড়িয়ে সেখানে তৈরি করিয়েছিলেন লম্বা লম্বা ফ্ল্যাটবাড়ি। যে-সব চাষিরা নিজস্ব বাড়িতে ফুলগাছ-টমেটো গাছ, গোরু-ছাগল-মুরগি নিয়ে থাকত, তারা সেইসব নিয়ে উঠে যাবে দশতলার ফ্ল্যাটে? যত ছোটই হোক, তবু একটি পরিবারের নিজস্ব বাসস্থান নির্বাচন ও ইচ্ছেমতন সাজাবার স্বাধীনতাটুকুও যদি না থাকে, তবে তা কীসের সাম্যবাদ।

দ্রুত বড় বড় কলকারখানা স্থাপন করে দেশটাকে শিল্পোন্নত করার ঝোঁকে কৃষি মার খেয়েছে। ড্যানিয়ুব নদী থেকে বিশাল খাল কাটা কিংবা বুখারেস্টে মেট্রো রেল বানাবার জন্য এত অর্থের বিনিয়োগ হয়েছে যা দেশের অর্থনীতির পক্ষে অনুপযুক্ত। তবু এ দেশের জাতীয় উৎপাদনের একত্রিশ ভাগই কৃষিদ্রব্য, সুতরাং দেশের মানুষের খাদ্যাভাব থাকার কথা ছিল না। কিন্তু রুমানিয়ার সরকার বিদেশি মুদ্রা অর্জনের জন্য খাদ্যদ্রব্য, পেট্রল, খনিজ অন্যান্য দেশে চালান দিয়ে দেশের মানুষকে বঞ্চিত করেছে বছরের পর বছর। কাগজেকলমে দেখানো হত যে এই সব রপ্তানি করে রুমানিয়ার বৈদেশিক ঋণ অনেক কমিয়ে ফেলা হয়েছে, এখন অবশ্য প্রকাশ পাচ্ছে যে, ওইসব বিদেশি মুদ্রা দিয়ে চাউসেস্কু আর তার পত্নী অঢেল ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়েছে, বাথরুমে পর্যন্ত নিয়েছে সোনার কল।

হাঙ্গেরিতে থাকার সময় আমরা লক্ষ করেছি, রুমানিয়ার সাধারণ মানুষদের এ রকম দুরবস্থা নিয়ে কারুর কোনও মাথাব্যথা নেই। বরং রুমানিয়ানদের সম্পর্কে হাঙ্গেরিতে অবজ্ঞা বা বিদ্বেষের ভাব বেশ প্রবল। ট্রানসিলভানিয়া নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা ক্ষত আছে বটে, কিন্তু এই দুই সমাজতান্ত্রিক দেশের সাধারণ মানুষও পরস্পরের প্রতি কোনও সমভ্রাতৃত্ব বোধ করে না? শ্রেণিহীন সমাজের আদর্শ যারা গড়তে চায়, সেখানেও জাতিভেদ!

হাঙ্গেরিতে একজনও বাঙালি বা ভারতীয়ের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি। একদিকে বাঙালিদের ঘরকুনো বলে বদনাম আছে, আবার পৃথিবীর বহু দুর্গম অঞ্চলেও বাঙালির সন্ধান পাওয়া যায়। আফ্রিকার নাইরোবি শহরের টিমে আমি একজন বাঙালির নাম দেখেছিলাম। আমার দেখা জায়গাগুলোর মধ্যে শুধু বুলগেরিয়া আর সাংহাই শহরে কোনও বাঙালির খোঁজ পাইনি। অতিশয় জনবহুল সাংহাই শহরে কোনও ভারতীয়ের সন্ধান পাওয়াও দুষ্কর। হাঙ্গেরিতে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-চারজন ভারতীয় আছে বটে, কিন্তু কেউ তাদের ঠিকানা বলতে পারেনি, ভারতীয় দূতাবাসে ফোন করেও কিছু সুবিধে হয়নি।

রুমানিয়ায় এসে আমরা আমাদের দূতাবাসে ফোন করে কোনও ভারতীয়ের সন্ধান চাইলাম। ওঁরা যে মহিলার নাম ও ঠিকানা দিলেন, তিনি একজন বাঙালি। গোটা রুমানিয়ায় দূতাবাসের বাইরে ভারতীয় বলতেও ওই একজনই। শ্রীমতী অমিতা বসুর নামের সঙ্গে আমরা আগেই পরিচিত, তিনি একজন লেখিকা, 'দেশ'-'আনন্দবাজারে' তাঁর বেশ কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

আমাদের ফোন পেয়েই অমিতা বসু আগ্রহের সঙ্গে বললেন, আপনারা যেখানে আছেন, সেখানেই থাকুন, আমি আপনাদের কাছে চলে আসছি।

অমিতা বসু অনেক বছর আগে তাঁর স্বামীর সঙ্গে এসেছিলেন এ দেশে। স্বামী এসেছিলেন চাকরির সূত্রে, অমিতা অবসর সময়ে রুমানিয়ার ভাষা শিখে নিয়েছিলেন, তারপর ওই ভাষা থেকে কিছু কিছু অনুবাদ করেন বাংলায়। বছর দু-আড়াই বাদে এই দম্পতি ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। কিছুদিন বাদে অমিতা আবার একা রুমানিয়াতে যান একটা অনুবাদক-সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে। তারপর থেকে তিনি এই দেশের সঙ্গে যেন একটা অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন। বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে অমিতা এখানে একা-একা রয়ে গেছেন দীর্ঘকাল। চাউসেস্কুর আমলের যাবতীয় কাণ্ডকারখানা ও গণঅভ্যুত্থান তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, চরম দুঃসময়ে আতঙ্কিত অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন।

গত শতাব্দীর রুমানিয়ার প্রখ্যাত কবি, বলা যায় রুমানিয়ার জাতীয় কবি মিহাইল এমিনেস্কু-কে নিয়ে গবেষণা করেছেন অমিতা। মিহাইল এমিনেস্কুর খ্যাতি এখন আন্তর্জাতিক, যদিও আমাদের বাংলাতে তেমন পরিচিত নন। এই কবি বেঁচেছিলেন মাত্র ঊনচল্লিশ বছর, লিখেছেনও খুব কম, তাতেই তিনি চিরস্মরণীয়। রুমানিয়ান ভাষা ল্যাটিন ভাষার অন্তর্গত, কিছু কিছু শ্লাভিক শব্দ এর মধ্যে ঢুকে গেলেও এই ভাষার আত্মীয়তা অনেকটাই ফরাসি-ইতালিয়ানের সঙ্গে। এখানকার কবি-সাহিত্যিকরা এককালে পশ্চিম ইউরোপের সাহিত্য দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, কেউ কেউ পশ্চিমি সাহিত্যকেও মাতিয়েছেন। ফ্রান্সে সিম্বলিজম-এর পূর্ববর্তী যে ডাডাইজম, তার অন্যতম প্রবক্তা ত্রিস্তান জারার জন্ম রুমানিয়ায়। একালের বিখ্যাত নাট্যকার ইউজিন আয়েনেস্কোও রুমানিয়ান। আমাদের জানাশোনা সাহিত্য পরিধির মধ্যে আরও দুটি তথ্য উল্লেখযোগ্য। রোমান আমলে সম্রাট অকটোভিয়ান অগাস্টাস মহান ল্যাটিন কবি ওভিদ-এর ওপর রাগ করে তাঁকে রুমানিয়ার কৃষ্ণ উপসাগরের তীরে নির্বাসন দিয়েছিলেন। আর পঞ্চদশ শতাব্দীতে এখানকারই এক পরগণার রাজকুমার শত্রুদের ছিন্নমুণ্ড বর্শার ডগায় গেঁথে, কোনও রাসায়নিক দ্রব্য মাখিয়ে জীবন্তর মতন করে রাখতেন। তাঁকে নিয়েই কাউন্ট ড্রাকুলার গল্প প্রচলিত হয়, আয়ার্ল্যান্ডের ঔপন্যাসিক এই চরিত্রটি নিয়ে ভ্যাম্পায়ারের গল্প লিখে বিখ্যাত হন।

মিহাইল এমিনেস্কু অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ফরাসি সাহিত্য থেকে। আবার রুমানিয়ার প্রাচীন গাথা ও উপকথা, দেশের মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকসাহিত্যের প্রতিও ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। এই দুই ধারা মিশিয়ে তিনি রুমানিয়ান সাহিত্যে এক নতুন রূপ এনে দেন। দুঃখের বিষয়, এই প্রতিভাবান কবি বেশিদিন বাঁচলেন না, ব্যর্থ প্রেম, পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারা, নৈরাশ্যবোধ থেকে শেষপর্যন্ত এক পাগলাগারদে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পরেও ফরাসি সাহিত্য ও রুমানিয়ার লোকসাহিত্যের একটা মিশ্র রূপ এখানে চলে আসছিল, পরবর্তীকালে অবশ্য সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব যথেষ্ট দেখা যায়।

অমিতা বসু এখানে একজন এমিনেস্কু বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। আবার রবীন্দ্রনাথকে এ-দেশের মানুষের কাছে সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত করার জন্য তিনি রবীন্দ্র রচনাবলি অনুবাদেও হাত দিয়েছেন। রুমানিয়ান ও বাংলা, এই দু-ভাষাতে লেখাতেই তিনি সিদ্ধহস্ত। এখানকার বাংলার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে তিনি বাংলা-রুমানিয়ান অভিধান একটা তৈরি করেছেন, সেটা খুবই মূল্যবান কাজ।

এক সময় আমি জিগ্যেস করলাম, আপনার বাংলা বিভাগ কেমন চলছে? ক'জন ছাত্রছাত্রী?

উত্তর না দিয়ে তিনি চুপ করে চেয়ে রইলেন।

আমাদের ডাক শুনে চলে আসবার পর অমিতার সঙ্গে অল্পক্ষণেই ভাব জমে গেল। শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি সবদিকেই সজাগ এই মহিলার রসিকতাবোধ খুব প্রবল। আমাদের সঙ্গে নিয়ে বুখারেস্ট শহরটি দেখাবার সময় তিনি গত বছরের ভয়াবহ দিনগুলির কথা বলতে-বলতে নানারকম কৌতুক কাহিনিও শোনাচ্ছিলেন। কিন্তু লক্ষ করছিলাম, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলতে চান না। সে বিষয়ে প্রশ্নও করা যায় না। একবার শুধু বলেছিলেন, আপনারা চরজন বাঙালি এসেছেন, আপনাদের তো একদিন আমার ফ্ল্যাটে রান্না করে খাওয়ানো উচিত। কিন্তু কিছুই যে পাওয়া যায় না এখানে।

বাংলা বিভাগ সম্পর্কে আমার কৌতূহলের উত্তরে, একটু সময় নিয়ে, নির্লিপ্ত গলায় তিনি বললেন, এখন বুখারেস্টে কোনও বাংলা বিভাগ নেই। উঠে গেছে!

বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও হিন্দি পড়াবার ব্যবস্থা ছিল। গত এক-দেড় বছর ধরে হিন্দির কোনও অধ্যাপক ছিল না, হিন্দি জানা এক রুমানিয়ান মহিলা সেই ক্লাস নিচ্ছিলেন। তা নিয়ে আমাদের দূতাবাসের হিন্দিওয়ালাদের খুব মাথাব্যথা দেখা দিল। হিন্দির কেউ নেই, অথচ বাংলার একজন দেশি অধ্যাপিকা রয়েছে, এ কখনও হতে পারে? হিন্দি রাষ্ট্রভাষা, হিন্দির দাবি আগে! হিন্দি প্রেমিকারা এই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বারবার উত্যক্ত করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাংলা-হিন্দি দুটো বিভাগই তুলে দিয়েছেন।

অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন অমিতার কোনও জীবিকা নেই।

এরপর যে প্রশ্নটা আমাদের সকলেরই মনে এসেছিল সেটা অসীম জিগ্যেস করল, চাকরি নেই, তা হলে আপনি এখানে চালাবেন কী করে?

অমিতা বললেন, যেমন করে হোক আমি চালাব। দেশে ফিরব না। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে ভালোবাসে। চরম বিপদ আর দুঃখের দিনগুলিতে আমি ওদের সঙ্গে থেকেছি। এখন ওদের ছেড়ে চলে যেতে পারব না। শেষপর্যন্ত কী হয়, আমি দেখতে চাই।

আস্তে-আস্তে কথা বললেও তাঁর কণ্ঠস্বরে একটা তীব্র জেদ ফুটে ওঠে। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে এমন সাহসিনী খুব কমই দেখা যায়।

১০

বুখারেস্টে রাস্তায় বেরুলেই একটা ধ্বনি শোনা যায়। সেটা অনেকটা গানের গানের ধুয়োর মতন। ডলার, ডলার, চেইঞ্জ মানি? চেইঞ্জ মানি? যে এক বর্ণও ইংরিজি জানে না, সেও এই গানের লাইনটা জানে!

সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রথম প্রথম এই ডলার-লোভ দেখে বিস্মিত হয়েছি, পরে মন খারাপ লেগেছে। যেবারে বুলগেরিয়া গিয়েছিলাম, সেবারে হোটেলে পৌঁছেই লিফট দিয়ে উঠছি, দুজন পোর্টার দু-দিক থেকে বলতে শুরু করেছিল, ডলার, ডলার? চেইঞ্জ মানি? চেকোশ্লোভাকিয়ায় কোনও দোকানে দিনার দিয়ে কিছু কিনতে গেলেই কাউন্টারের লোকটি ফিসফিসিয়ে বলেছে, ডলার, থ্রি টাইমস! ফোর টাইমস! হাঙ্গেরিতে, প্রাক্তন পূর্ব জার্মানিতে এরকম বহুবার শুনেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নের কোথাও আমার এ অভিজ্ঞতা হয়নি। সেখানে আমার সঙ্গে সব সময় একজন সরকারি প্রতিনিধি থাকত। চিনে আমাদের সঙ্গে প্রতিনিধি থাকত দুজন। কিন্তু কখনও একলা হোটেল ছেড়ে বেড়াতে বেরুলেই অমনি কয়েকজন লোক ঘিরে ধরে সেই ধুয়ো তুলেছে, ডলার, ডলার, চেইঞ্জ মানি? এইসব দেশগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চরম শত্রু মনে করে, আমেরিকায় অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে প্রতিনিয়ত প্রচার চলে, তবু ডলারের প্রতি এই কাঙালপনা কেন? জার্মান মার্ক ও জাপানি ইয়েন খুব দৃঢ় কারেন্সি, ব্রিটিশ পাউন্ড তার ক্রম হ্রাসমান সম্মান অনেকটা পুনরুদ্ধার করেছে, তবু সবাই ডলার চায়। পাউন্ড ও মার্কেরও চাহিদা আছে হাঙ্গেরি-রুমানিয়ায়, কিন্তু প্রথমে সকলেই ডলারের গানটি গায়। এইসব দেশগুলিতে পুলিশ ও গুপ্তবাহিনী যথেষ্ট সক্রিয়, তবু তারা প্রকাশ্য রাস্তায় এরকম চোরাকারবারিকে ধরতে পারে না? এটা অবিশ্বাস্য! কাগজে-কলমে সরকারি ব্যাংক ছাড়া বিদেশি মুদ্রা ভাঙানো নিষিদ্ধ, অথচ হাজার-হাজার লোক দিনের বেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে টুরিস্টদের কাছ থেকে অনেক গুণ বেশি দামে ডলার কিনছে, অথচ তাদের পুলিশে ধরে না। নিশ্চয়ই সরকারিভাবে এই চোরা কারবারের প্রতি প্রশ্রয় আছে। এটা যে অর্থনীতির কোন কূটকৌশল তা আমার বোধগম্য হয় না! মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদরাও এর কোনও ব্যাখ্যা দেননি, অনেকে এই ব্যাপারটার উল্লেখই করেন না, যেন এর কোনও অস্তিত্ব নেই!

আর একটা ব্যাপারও আমার খুবই বিসদৃশ মনে হয়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির বড় বড় শহরে কিছু কিছু দোকান থাকে বিদেশিদের জন্য। এদের চলতি নাম 'ডলার শপ'। সেইসব দোকানে ভালো ভালো জিনিসপত্র সাজানো থাকে। স্কচ হুইস্কি, আমেরিকান সিগারেট থেকে শুরু করে ফরাসি পারফিউম, সুইস ঘড়ি, শৌখিন জামা-কাপড় পর্যন্ত। সেগুলি শুধু ডলার কিংবা হার্ড কারেন্সি দিয়ে কেনা যাবে, অর্থাৎ বিদেশিদের জন্য। দেশের মানুষ দোকানের শো উইন্ডোর সামনে দাঁড়িয়ে সেইসব জিনিসপত্র লোভীর মতন দেখে! দোকানে জিনিসপত্র সাজানো হয়েছে, অথচ তারা নিজেদের টাকায় কিনতে পারবে না, এ কী অপমানজনক ব্যবস্থা। ওইসব দোকান একেবারে না রাখলে কী ক্ষতি ছিল? বিদেশি পর্যটকরা সমাজতান্ত্রিক দেশে বেড়াতে গিয়ে ফ্রেঞ্চ পারফিউম কিনতে যাবে কেন? দেশের মানুষদের এইসব জিনিস কেনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ফলে তারা যে-কোনও উপায়ে ডলার সংগ্রহ করতে চাইবে, এতে আর আশ্চর্য কী! আমাদের ভারতে এরকম কোনও দোকান নেই, সেজন্য ধন্যবাদ!

চিনে আর একটা ব্যাপার দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। দু'রকম টাকা! সরকারি-ভাবে ডলার ভাঙালে একরকম চিনা টাকা দেওয়া হবে, যার চেহারা সাধারণ চিনা টাকার থেকে আলাদা। বিদেশিরা ওই টাকা দিয়ে যে-কোনও দোকান থেকে যে-কোনও জিনিস কিনতে পারে। সেই নোটের চেহারা আলাদা হলেও অন্য চিনা নোটের সঙ্গে মূল্যের কোনও তফাত নেই। একই দেশে এই দু'রকম নোট চালু রাখার সুবিধে কী তা জানি না, কিন্তু দেখেছি, কোনও দোকানে গিয়ে আমাদের ওই টাকা দিয়ে কিছু কিনতে গেলে পাশ থেকে অনেকে এসে নিজেদের টাকার সঙ্গে বদলাবদলি করতে চায়। অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিও এই টাকা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। মূল্যমান সমান, সুতরাং হস্তান্তরে বে-আইনি বোধ হয় না। চিনারা ওই টাকা দিয়ে বিদেশিদের জন্য নির্দিষ্ট দোকানে বিদেশি দ্রব্য কিনতে পারে। চিনে এখন আমেরিকান দ্রব্য এবং জামাকাপড় সম্পর্কে দারুণ ঝোঁক। আমেরিকান সিগারেটের বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেছি। আমাদের দেশে কোথাও এরকম নেই। বড় বড় হোটেলগুলিতে আমেরিকানদের মনোরঞ্জনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। হোটেলের একটা টিভি চ্যানেলে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই আমেরিকান প্রোগ্রাম দেখানো হয়। পোর্টার, লিফটম্যান, রেস্তোরাঁর বয়রা থ্যাংক ইউ-এর উত্তরে আমেরিকান কায়দায় বলে ইউ আর ওয়েলকাম। ষাট-সত্তরের দশকে আমাদের বাংলার যুব সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ পৃথিবীর অন্য দেশগুলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আদর্শের জন্য চিনের দিকে ব্যাকুল-ভাবে তাকিয়েছিল, তাদের কথা ভেবে আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

চিনের সাধারণ মানুষের ভদ্রতা, বিনয় ও শৃঙ্খলাবোধ দেখে অনবরত মুগ্ধ হতে হয়। গ্রামে ঘোরার সুযোগ হয়নি, বড় বড় শহরগুলির অবস্থা আমাদের দেশের থেকে কিছুটা ভালো। গ্রামে দারিদ্র্যের কথা শোনা যায়, নেশা ও নারীদেহ নিয়ে ব্যাবসা একেবারে লুপ্ত হয়নি, বেকার রয়েছে, জীবিকার ক্ষেত্রে নানা বৈষম্যও রয়েছে, সেটাই তো কত প্রয়োজনীয় ব্যাপার, সেটাও আমাদের সরকার বোঝে না। বোম্বাইয়ের তুলনায় পেইচিং অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন। কলকাতার চেয়ে সাংহাইয়ের জনসংখ্যা অনেক বেশি, তবু সাংহাইয়ের কোনও রাস্তাতেই কলকাতার মতন এমন জঘন্য আবর্জনার স্তূপ জমে থাকে না। সাংহাইয়ের এক জনবহুল জায়গায় সিগারেটের টুকরো ফেলায় এক বৃদ্ধা সরকারি প্রতিনিধি আমার চার ইউয়ান ফাইন করায় বেশ মজা লেগেছিল। আমাদের দেশে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলার জন্য কেউ যদি ফাইন করত, আমি খুশি হতাম।

কিন্তু চিনে আমেরিকান উপস্থিতি দেখে বিমূঢ় বোধ করেছিলাম। সরকারি ভাবেও আমেরিকা-তোষণের ঢালাও ব্যবস্থা। চিনাদের যে-জাতীয় পোশাক দেখতে আমরা অভ্যস্ত, তা একেবারে অদৃশ্য। রাস্তার সমস্ত নারী পুরুষ পশ্চিমি পোশাক পরে আছে। আমার সহযাত্রী হিন্দি লেখক কমলেশ্বর একটা চিনা কোট কিনতে চেয়েছিলেন, অনেক খোঁজ করেও পেলেন না। ভারতে কিন্তু আমেরিকা এভাবে এখনও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

ডলার-হ্যাংলামি অন্য অনেক দেশে দেখলেও বুখারেস্টের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই চলে না। অন্যান্য দেশে হোটেলের সামনে, বাজারে, বাসস্টপে, রেল স্টেশনে এইসব কালোবাজারিরা ঘোরাফেরা করে। বুখারেস্টে এরা সর্বত্র। রাস্তায় যেতে-যেতে কোনও মানুষের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই যদি সে চিনতে পারে যে আমরা বিদেশি, অমনি কাছে এসে বলে ডলার, ডলার, চেইঞ্জ মানি? এই একঘেয়ে গানের ধুয়ো শুনতে শুনতে আমাদের তিতিবিরক্ত হওয়ার মতন অবস্থা! রুমানিয়ার টাকার নাম লেই, সরকারি বিনিময় হারের চেয়ে আটগুণ-দশগুণ এক একজন দিতে চায়। টুরিস্টদের ঠকাবারও নানারকম প্রক্রিয়া আছে। ডলারের বিনিময়ে বড় একটা টাকার বান্ডিল হাতে গুঁজে দিয়ে একজন দ্রুত চলে যায়, খুলে দেখা যায়, ওপরে কয়েকখানা মাত্র নোট, ভেতরে বাজে কাগজ!

বেশি টাকা পেয়েও তো লাভ নেই, লেই দিয়ে বিশেষ কিছুই পাওয়া যায় না। রেস্তোরাঁয় গিয়ে পঞ্চাশ রকম খাবারের তালিকার মধ্যে শুধু একরকম যদি পাওয়া যায়, তাহলেই সেটা ভাগ্য বলতে হবে। যদি কোনও দোকানে বিয়ার পাওয়া যাচ্ছে এমন শোনা যায়, তা হলেই সেখানে বিরাট ভিড় জমে। অন্যান্য দোকান থেকেও কিছুই কেনার নেই। আমাদের দেশে আজকাল সমস্ত দোকানদারই জিনিসপত্র কিনলে পাতলা পলিথিনের ব্যাগ দেয়, এমনকি বাজারের মাছওয়ালারাও দেয়। বুখারেস্টে আমাদের হাতের জিনিসপত্র বইবার জন্য সেরকম একটা ব্যাগ খোঁজ করেছিলাম, প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে বহু দোকান ঘোরার পর শেষ পর্যন্ত একটা দোকান থেকে ওইরকম একটা অতি সাধারণ ব্যাগ পয়সা দিয়ে কিনতে হল।

অমিতা বসুর সঙ্গে বুখারেস্ট শহর ঘুরতে বেরিয়ে আমরা চলে এলাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। চাউসেস্কুর আমল থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রামকে এখানে সবাই বলে দ্বিতীয় বিপ্লব। তার কেন্দ্র ছিল এই এলাকা। বারবার এখানে খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। নিহতদের স্মরণে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে শহিদ বেদি, সেখানে জ্বলছে অনেক মোমবাতি। রাস্তায় যেতে-যেতে অনেকেই হঠাৎ থেমে গিয়ে একটা করে মোমবাতি কিনে জ্বেলে দিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কোনও মহিলার বিষণ্ণ থমথমে মুখ দেখে মনে হয়, হয়তো তাঁরই স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা প্রাণ দিয়েছে সেই সময়ে।

অমিতা সেই পুরো সময়টার প্রত্যক্ষদর্শী, তাঁর কাছে আমরা বিস্তৃতভাবে শুনলাম সব ঘটনা। এসব অমিতা লিখেছেনও। পার্টি অফিসের বারান্দা থেকে চাউসেস্কুর শেষ বক্তৃতা দিতে-দিতে মাঝপথে থামিয়ে, সেই বাড়িরই ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে সস্ত্রীক পালাবার চেষ্টা, ধরা পড়া, দ্রুত বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের কথা এখন অনেকেরই জানা হয়ে গেছে। এখানে ঘুরতে-ঘুরতে আমার চিনের কথা মনে পড়ছিল বারবার, কারণ, রুমানিয়ায় গণঅভ্যুত্থান যখন ঘটে, তখন আমি চিনে ছিলাম। সে প্রায় বছরখানেক আগেকার কথা। চিনের কোনও সংবাদপত্রে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ থাকত না। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে যে কী সব পরিবর্তন ঘটছে তার চিন সরকার তাদের দেশবাসীকে জানাতে চান না। কিন্তু আমরা হোটেলে টিভি-র একটা চ্যানেলে আমেরিকানদের দ্বারা পরিবেশিত সমস্ত ছবিই দেখেছি! মজার ব্যাপার, হোটেলে থাকলে সব কিছু দেখা ও জানা যাবে, কিন্তু সাধারণ মানুষের সে অধিকার নেই। অবশ্য বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর ব্যাপারটাও টের পেয়েছিলাম তখন। সকালবেলা আমাদের গাড়ির ড্রাইভার, ইন্টারপ্রেটাররা নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলত, তখন চিনে ভাষা একবর্ণ বুঝতে না পারলেও একটা নাম শুনতাম বারে-বারে, রুমানিয়া! রুমানিয়া! অর্থাৎ তারা ঠিক জেনেছে।

বুখারেস্টের সর্বত্র লাইন। কে যে কীসের জন্য লাইন দিয়েছে তা বোঝবার উপায় নেই। লাইনে যারা দাঁড়িয়ে আছে, সবাই যে গম্ভীর ও বিরক্ত তাও নয়। কেউ কেউ হাসাহাসি করছে। চরম দুঃসাহসের মধ্যেও রসিকতাবোধ নষ্ট হয় না। বছরের পর বছর দুর্ভোগ চলেছে রুমানিয়ায়, তার মধ্যেও রসিকতার সৃষ্টি হয়েছে এবং মুখে মুখে ছড়িয়েছে। মানুষের প্রতিবাদ জানাবার আর কোনও উপায় নেই, খবরের কাগজগুলি শুধু মিথ্যে কথা লেখে, বেতারে দুরদর্শনে শুধু সরকারি প্রচার, সভা-সমিতি নিষিদ্ধ। চতুর্দিকে গুপ্তচর, কোথাও যে সাধারণ মানুষ পাঁচজনে মিলে সুখ-দুঃখের কথা বলবে তারও উপায় নেই, তাদেরই মধ্যে একটা গুপ্তচর কিনা তাই বা কে জানে! এই গুপ্তচর ব্যবস্থা যে এখানে কী সাংঘাতিক ছড়িয়েছিল, তার একটা অবিশ্বাস্য উদাহরণ শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। ইস্কুল থেকে ছেলেমেয়েদের বলা হত, তাদের বাবা-মায়েরা বাড়িতে কী আলোচনা করে তা স্কুলে এসে জানাতে হবে। তার মধ্যে কোনও সরকার-বিরোধী কথা থাকলেই অমনি গ্রেফতার! অর্থাৎ নিষ্পাপ শিশুদেরও গুপ্তচর বানানো হত। তাদেরই বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে। সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে প্রত্যেক মানুষের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতে গিয়ে এ কী হৃদয়হীন বন্ধনেরও ব্যবস্থা করে ছিল!

এই রকম সময়ে রসিকতাগুলোই প্রতিবাদ। রসিকতার স্রষ্টার কোনও নাম থাকে না, মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। অনেক বক্তৃতার চেয়েও একটি রসিকতার আঘাত বেশি মোক্ষম!

অমিতার কাছ থেকে শোনা একটি রসিকতা এখানে বলা যেতে পারে। এই ডাক্তারের কাছে এক যুবতী মহিলা গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে। মহিলাটির খুবই শক্ত অসুখ করেছিল, অন্য ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছিল, বাঁচার কোনও আশাই ছিল না। এই ডাক্তারটি প্রায় যমের সঙ্গে লড়াই করে মহিলাটিকে শুধু বাঁচালেন তাই-ই নয়, সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুললেন। প্রায় একটি মিরাকল বলা যেতে পারে। কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হয়ে মহিলাটি ডাক্তারকে বললেন, আপনি আমার জন্য যা করলেন, তা তো শুধু টাকাপয়সা দিয়ে শোধ করা যায় না। আমি আপনাকে অন্য একটা কিছু দিতে চাই। আপনি কি নেবেন বলুন। ডাক্তার এ কথা উড়িয়ে দিলেন, তিনি কিছুই চান না, কিন্তু মহিলাটি ঝুলোঝুলি করতে লাগলেন, কিছু একটা না দিলে তিনি তৃপ্তি পাবেন না! অনেকক্ষণ পরে ডাক্তারটি বললেন, বেশ, ঠিক আছে, যদি কিছু দিতেই চান, তা হলে আপনার জীবনের একটি রাত্রি শুধু আমাকে দিন!

এ কথা শুনে চুপসে গেলেন মহিলাটি। ডাক্তারটিকে তাঁর খুবই ভদ্র ও সভ্য মনে হয়েছিল, কিন্তু এ যে কুপ্রস্তাব। এমন তিনি আশা করেননি।

কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি ফিরে গেলেন মহিলাটি। স্বামীকে বললেন সব কথা। ডাক্তারটিকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কিছু একটা দিতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ডাক্তার যা চাইলেন, তা দেওয়া যায় না। এমনই নিরাশ হয়ে পড়েছেন মহিলা যে তাঁর প্রায় ভেঙে পড়বার মতন অবস্থা। স্বামী বললেন যে বউ যদি এত কান্নাকাটি করে, তাহলে সে বোধহয় আবার অসুখে পড়বে! তখন স্বামী বললেন, ডাক্তার যা চেয়েছেন, তা দিতেই বা আপত্তির কী আছে? ডাক্তার প্রায় তোমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। ওঁর সাহায্য ছাড়া তুমি বাঁচতেই না। সুতরাং এই নতুন জীবন থেকে মাত্র একটা রাত ওঁকে দিতেই পারো। আমি কিছু মনে করব না।

স্বামীই জোর করে আবার পাঠালেন স্ত্রীকে। মহিলাটি ডাক্তারের কাছে এসে নতমুখে বললেন, আমি রাজি। আজ রাতে আমি নিজেকে আপনার কাছে নিবেদন করলাম।

ডাক্তার সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, রাজি? চলুন তা হলে বেরিয়ে পড়া যাক। ডাক্তার নিজের গাড়িতে মহিলাটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তখন বেশ রাত, রাস্তাঘাট ফাঁকা। খানিকটা দূর যাওয়ার পর ডাক্তার এক জায়গায় গাড়ি থামালেন। তারপর গাড়ি থেকে একটা ছোট্ট টুল বার করে ফুটপাথে পেতে দিয়ে মহিলাটিকে বললেন, আপনি এই টুলের ওপর সারারাত বসে থাকুন!

মহিলাটি ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললেন, তার মানে? আমি এখানে সারারাত বসে থাকব?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, ওই যে সামনে দোকানটি দেখছেন, কাল সকালে ওর দরজা খুললেই সামনে বিরাট লাইন পড়ে যাবে! তাই আপনি আমার জন্য এখানে জায়গা রাখুন!

রুমানিয়ার লাইনের প্রসঙ্গে আর একটা কথাও বলা যায়। এখানে মাংস, রুটি, চিনি, দুধ, মাখনের জন্য যেমন লোকে লাইন দেয়, তেমনি লোকে লাইন দেয় বইয়ের দোকানেও। বই পড়ার ক্ষুধাও এখানে প্রচণ্ড। আমাদের সামনেই একটি দোকানে বিদেশি কিছু পত্র-পত্রিকা এসে পৌঁছল, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে লম্বা লাইন পড়ে গেল। তরুণ-তরুণী ছাড়া বয়স্করাও রয়েছেন সেই লাইনে। আমি আগেও শুনেছি, বিখ্যাত কবিদের নতুন কবিতার বই বেরুলে এখানে লোকে লাইন দিয়ে কেনে। রুমানিয়ানদের মতন কবিতা-প্রেমিক জাত খুব কমই আছে। আমরা বাঙালিরা কবিতা নিয়ে গর্ব করি, কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে আমরা এখনও শতকরা চল্লিশ জনের বেশি মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে পারিনি। শতকরা চল্লিশ জনের মধ্যেও অনেকেই স্কুলের গণ্ডি পেরোয় না। সুতরাং এরা কবিতার পাঠক হবে, এমন আশা করা যায় না। শতকরা কুড়ি-পঁচিশজন মোটামুটি শিক্ষিত, তাদেরও অনেকেরই ক্রয়ক্ষমতা নেই। সেই জন্যই জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের দেশে অতি মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষ কবিতা কিংবা সাহিত্যপাঠ করে। আর এই ছোট দেশ রুমানিয়ায় প্রায় সকলেই সাক্ষর। কবিতার বইয়ের যেমন বিক্রি ছিল এখানে, তাতে একজন কবি শুধু কবিতা রচনা করেই জীবিকাও নির্বাহ করতে পারতেন। এমন সংস্কৃতিসম্পন্ন একটি জাতিকে শুধু পেটে মারা হয়েছে তাই-ই নয়, তাদের সুস্থ সংস্কৃতি থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে বছরের পর বছর। পত্র-পত্রিকায় শুধু ভরা থাকত চাউসেস্কু ও তাঁর পত্নীর জয়গান। চাউসেস্কু ও তার চেলাচামুণ্ডারা এমন তাণ্ডব চালালোই বা কী করে এতগুলি বছর? মার্কসবাদের এমন অপব্যবহারের প্রতিবাদ করেননি কেন প্রকৃত মার্কসবাদীরা? আমাদের দেশের কোনও তাত্বিক কি এর আগে কখনও স্বীকার করেছেন যে, রুমানিয়ায় যা চলছে, তা সমাজতন্ত্রও নয়, মার্কসবাদও নয়? তাঁরা কিছুই জানতেন না?

১১

ঐতিহাসিক টয়েনবি বলেছিলেন, মার্কসবাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবে জাতীয়তাবাদ।

আমরা ভাবতাম, এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে জাতীয়তাবাদই একদিন পরাস্ত হবে। জাতীয়তাবাদের মধ্যে সংকীর্ণতা আছে, কিন্তু মার্কসবাদ বিশ্বমানবতার পথ দেখিয়েছে। আমরা কি নিছক বাঙালি বা ভারতীয় বা পাকিস্তানি বা ইংরেজ বা চিনে বা রাশিয়ান হওয়ার বদলে শুধু মানুষ হতে চাই না? আমরা শুধু একটা দেশের নাগরিক হওয়ার বদলে কি হতে চাই না সমগ্র পৃথিবীর নাগরিক? পৃথিবীর সমস্ত দেশগুলির সীমানাই তো কৃত্রিম, মাত্র আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে এই সব সীমানার রেখাগুলি কতবার ভাঙচুর হয়েছে। মাতৃভূমি কিংবা পিতৃভূমি বলে যে ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়েছে, সেসব শুধু শাসকশ্রেণির প্রচার ছাড়া আর কী? দেশাত্মবোধক গানগুলিতে সমৃদ্ধ হয় অস্ত্রের কারখানা। দেশপ্রেমের নামে বহুবার লক্ষ লক্ষ মানুষ অকারণ যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। দেশের জন্য লড়াই করতে গিয়ে অকালে এই পৃথিবীটাকেই ছেড়ে চলে যাওয়ার কি কোনও যুক্তি থাকতে পারে?

বিশ্বমানবতা কিংবা বিশ্বনাগরিকত্ব, এসবই এখনও নিছক কবি-কল্পনা? অনেক সময় কবিরাও উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়।

মার্কসবাদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের লড়াইটা ঠিকমতন শুরুই হল না। জাতীয়তাবাদ প্রবল প্রতাপে প্রায় সমস্ত মানুষের মস্তিষ্ক অধিকার করে আছে। মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে যেসব দেশ সমাজতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হচ্ছিল, সেখানেও জাতীয়তাবাদ নির্মূল করার কোনও চেষ্টা হয়নি। পাশাপাশি দেশগুলির মধ্যে রেষারেষি প্রকট হয়ে উঠেছে মাঝে-মাঝে। চিনে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ পর্যন্ত হয়েছে। অথচ সীমান্ত থাকারই তো কথা নয়! এই দুই অতিকায় সমাজতান্ত্রিক দেশের মধ্যে বিচ্ছেদ বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা দাঁড়াল। যে এরা দুজনেই এদের আদর্শের প্রবল প্রতিপক্ষ আমেরিকার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াল।

একই সমাজতান্ত্রিক দেশের মধ্যেও হয়ে রয়ে গেছে জাতিভেদ। চেকোশ্লোভাকিয়ায় গিয়ে টের পেয়েছিলাম, চেক এবং শ্লোভাকদের মধ্যে রীতিমতন ঈর্ষার সম্পর্ক, শ্লোভাকরা চেকদের তুলনায় নিজেদের বঞ্চিত মনে করে।

ভারত এবং পাকিস্তানের চিরবৈরিতার উপলক্ষ যেমন কাশ্মীর, তেমনি হাঙ্গেরি আর রুমানিয়া, এই দুই পাশাপাশি দেশের মধ্যে রয়ে গেছে এক কাশ্মীর, এখানে তার নাম ট্রানসিলভানিয়া।

কাশ্মীরের জনসংখ্যার অধিকাংশই মুসলমান, কিন্তু রাজ্য ছিল হিন্দু, গোড়ার দিকে জনসাধারণের নেতা শেখ আবদুল্লা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ, তাই কাশ্মীর সংযুক্ত হল ভারতের সঙ্গে। কিন্তু ওই অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য পাকিস্তান তার দাবি ছাড়বে কেন? আর ট্রানসিলভানিয়া রুমানিয়ার অন্তর্গত হলেও এককালে ছিল হাঙ্গেরির মধ্যে, এখনও সেখানে প্রচুর হাঙ্গেরিয়ান বাস করে। এই উপলক্ষ নিয়ে বিরোধ লেগেই আছে। হাঙ্গেরিতে 'হিস্ট্রি অব ট্রানসিলভানিয়া' নামে বই প্রকাশিত হলে রুমানিয়া সেটা ইতিহাসের বিকৃতি বলে নিষিদ্ধ করে দেয়। আবার রুমানিয়ার সরকার একবার সে দেশে হাঙ্গেরিয়ার নাম শুনলেই অবজ্ঞায় ঠোঁট কুঁচকোয়। আর রুমানিয়ানরা মনে করে, তাদের অনেক দুর্ভাগ্যের মূলে আছে হাঙ্গেরিয়ানরা। বর্তমান দুঃসময়েও হাঙ্গেরিয়ানা আইসক্রিম খায়, রুমানিয়ানরা শুধু বরফ চোষে। বেলজিয়ামে এক আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনে আমি একদিন হাঙ্গেরিয়ান কবি জর্জ সোমলিও'র স্ত্রী আনাকে কাঁদতে দেখেছিলাম। কারণ জিগ্যেস করে জেনেছিলাম যে আমার ঠিক পাশেই এক রুমানিয়ান কবির বসার জায়গা, কিন্তু সে একজন হাঙ্গেরিয়ানদের পাশে বসতে অস্বীকার করে উঠে চলে গিয়েছিল। কবিদের মধ্যেও এমন ভুল জাত্যাভিমান।

রুমানিয়ায় কোনওদিন গণতন্ত্রের ঠিক মতন পরীক্ষাই হয়নি। সামন্ততন্ত্র থেকেই পৌঁছে গিয়েছিল সমাজতন্ত্রে। নানা উপজাতি অধ্যুষিত এই অঞ্চলটি মোটামুটি একটি দেশ হিসেবে দানা বাঁধে রোমান আমলে। রোমান সাম্রাজ্য ড্যানিউব নদীর দুই প্রান্ত ধরে এগিয়ে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। দশম শতাব্দীর থেকে বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের ভগ্নদশা শুরু হয়। রোমানিয়ার ট্রানসিলভানিয়া অঞ্চল চলে যায় হাঙ্গেরির দখলে। তারপর তুর্কিদের অটোমান সাম্রাজ্য হাঙ্গেরিকে গ্রাস করার পর ট্রানসিলভানিয়াও নিয়ে নেয়। তারপর হাতবদল হতে হতে, এই শতাব্দীর প্রথম মহাযুদ্ধে ট্রানসিলভানিয়া আবার রুমানিয়ার অন্তর্গত হয়ে যায়। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের পতনের পর রুমানিয়া নিজের পায়ে দাঁড়ায়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রুমানিয়ার ভূমিকা ছিল খুবই দুর্ভাগ্যজনক। প্রথমদিকে এই দেশ ছিল মিত্র বাহিনীর পক্ষে। নাতসি জার্মানি হাঙ্গেরির ওপর আধিপত্য বিস্তার করার পর রুমানিয়ার দিকে ধেয়ে আসে। ট্রানসিলভানিয়ার অনেকখানি অংশ আবার হাঙ্গেরিতে চলে যায়। এর ফলে যে জনবিক্ষোভ হয়, তাতে রাজা দ্বিতীয় ক্যারল সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, সেই সিংহাসনে বসলেন তাঁর ছেলে মাইকেল। রাজা মাইকেল সমস্ত ক্ষমতা হাতে নিয়ে আপোস করতে গেলেন হিটলারের সঙ্গে। জনগণ কিন্তু সোভিয়েত বিরোধী ভূমিকা মেনে নিতে চায়নি। জার্মানির শেষ দশায় সোভিয়েত বাহিনী যখন রুমানিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে, তখন জনসাধারণের প্রবল প্রতিবাদে রুমানিয়া আবার হঠাৎ দল বদল করে। রুমানিয়ার সরকার সোভিয়েত পক্ষকে সমর্থন করে এবং যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানির বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত বাহিনীর সহায়তায় জার্মানি-হাঙ্গেরিয়ান সৈন্যদের বিতাড়িত করতে সমর্থ হয় রুমানিয়া। দুবার দু পক্ষে লড়াই করে তার নিজস্ব ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রচণ্ড। এইটুকু দেশের সাড়ে ছ'লাখেরও বেশি সৈন্য নিহত হয়।

যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই রুমানিয়ায় রাজতন্ত্রের অবসান হল। ত্রাতা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সংবর্ধনা জানাল সাধারণ মানুষ, এবং সোভিয়েত ধাঁচের সরকারই যে এখানে প্রতিষ্ঠিত হবে, সেটাও স্বাভাবিক। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলো মিলে গিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি নাম দিয়ে সরকার গড়ল। ১৯৬৫ সালে এই ওয়ার্কার্স পার্টি আবার নাম নিল কমিউনিস্ট পার্টি, সেই সালেই চাউসেস্কুর ক্ষমতার রঙ্গভূমিতে প্রথম আগমন।

প্রথমদিকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রুমানিয়া যথেষ্ট উন্নতি করেছিল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতি আস্তে-আস্তে চাঙ্গা হয়, বৈদেশিক ঋণ অনেক কমে যায়, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপও সমৃদ্ধ হয়। সোভিয়েত ব্লকের অন্তর্গত হয়েও রুমানিয়া তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। প্রেসিডেন্ট চাউসেস্কুর ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানবোধ সর্ব স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছে। ক্রমে সেই আত্মসম্মানবোধ, রূপান্তরিত হতে লাগল আত্মম্ভরিতায়, সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হল প্রেসিডেন্ট ও তার স্ত্রীর হাতে, স্বেচ্ছাচার থেকে এল স্বৈরাচার। হিটলারের কবল থেকে উদ্ধার পেয়ে যে দেশ এক কল্যাণমূলক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানকার রাষ্ট্রনায়ক যে ক্রমশ এক ছোটখাটো হিটলারে রূপান্তরিত হচ্ছে, সেদিকে কেউ নজর দিল না, কিংবা বাধা দিল না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যতই ত্রুটি থাক, অপদার্থ প্রধানমন্ত্রীকে তবু সরিয়ে দেওয়া যায়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সে ব্যবস্থা থাকতে পারে না? যেহেতু সংবাদপত্রের বাক স্বাধীনতা দেওয়া হয় না, কোনও বিরোধী দলের অস্তিত্ব রাখা হয় না, তাই স্বৈরাচারী শাসক ও তার ঘনিষ্ঠ দলবলের কীর্তিকাহিনী প্রকাশেরও কোনও উপায় থাকে না। স্টালিনের জীবিতকালে কেউ তার প্রতিবাদ করেনি, দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে, এমনকী হাজার হাজার সাচ্চা কমিউনিস্টকেও স্টালিন ফাঁসির মঞ্চে পাঠিয়েছিল, তা তখন জানা যায়নি।

মানুষকে হাত-পা বেঁধে কারাগারে রাখা যায়, কিন্তু তার মনটাকে কিছুতেই বন্দি করা যায় না।

বিংশ শতাব্দী শেষ হওয়ার দশ বছর আগেই সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ উত্তাল হয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিকে একসঙ্গে কাঁপিয়ে দিল। একটির পর একটি দেশ জনসাধারণের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। সৈন্যবাহিনী দিয়েও যে এই প্রতিবাদ দমন করা যাবে না, শাসকশ্রেণি তা বুঝেছিল বলে রক্তাক্ত সংগ্রাম হয়নি। চেকোশ্লোভাকিয়ায় মিছিলের মানুষ সৈন্যদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে ফুলের মালা।

একমাত্র রুমানিয়ার বৃদ্ধ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কী নিদারুণ লোভ! সেই লোভের পরিণামে বুখারেস্টের পথে পথে রক্ত-গঙ্গা বয়েছে। চাউসেস্কু ভেবেছিলেন তিনি অমর হবেন, কী সব ওষুধ-বিষুধ খেয়ে নাকি তিনি জরা দমন করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তাঁর ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়া বউ ইচ্ছেমতন ডক্টরেট নিয়েছেন, রুমানিয়ার রাজরাজেশ্বরী হয়েও তৃপ্ত হননি, চেয়েছিলেন অনন্ত পরমায়ু। বুখারেস্ট শহরের একটা বিরাট এলাকার সমস্ত ঘরবাড়ি ধ্বংস করে চাউসেস্কু বানাচ্ছিলেন এক বিশাল প্রাসাদ। তার সামনের উদ্যানে সবেমাত্র গাছ পোঁতা হয়েছিল, ফুল-ফল দেখা দেয়নি। চাউসেস্কু দম্পতি আশা করেছিলেন, আরও বহু বছর বেঁচে তারা ওই প্রাসাদ ও উদ্যান উপভোগ করে যাবেন।

বিক্ষোভ বা বিদ্রোহের আশঙ্কায় চাউসেস্কু আগে থেকেই এক নিজস্ব গুপ্ত রক্ষী বাহিনী তৈরি করে রেখেছিলেন। শুধু চাউসেস্কু দম্পতিকে আমৃত্যু রক্ষা করার জন্য এরা নাকি ছিল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এদের অবস্থান ছিল মাটির নীচে। যে-কোনও বাড়ির ভূমি ভেদ করে এরা উঠে আসতে পারত। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, জাতীয় মিউজিয়ামের ফাঁপা দেওয়ালের মধ্যেও এরা লুকিয়ে ছিল। যেখান থেকে সেখান থেকে এরা হঠাৎ-হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে। সেনাবাহিনী জনসাধারণের দিকে চলে গেলেও এই গুপ্ত রক্ষীবাহিনী অকারণে কত যে নরহত্যা করেছে তার ঠিক নেই। বুখারেস্টে এখনও লোকের মুখে মুখে সেই বীভৎস কাহিনি শোনা যায়। সে সব কাহিনি যে অতিরঞ্জিত নয়, তার প্রমাণ রয়েছে শহরের বহু বাড়ির দেওয়ালে গুলিগোলার দাগে। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির হাজার হাজার বই পুড়েছে, জাতীয় মিউজিয়ামের অনেক অমূল্য সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে এদের তাণ্ডবে।

বুখারেস্ট শহরটি এককালে বেশ সুদৃশ্য ছিল এমন পড়েছি, কিন্তু এখন দেখার মতন বিশেষ কিছু চোখে পড়ে না। বুডাপেস্ট-এর সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। ড্যানিয়ুব নদী এ শহর থেকে অনেক দূরে। এখানকার প্রাচীন এলাকাগুলি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউরোপীয়রা ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য পুরোনো বাড়িগুলো সযত্নে রক্ষা করে, চাউসেস্কু সেগুলো নষ্ট করে শুধু সারি সারি ফ্ল্যাটবাড়ি তোলার ব্যবস্থা করেছিলেন। অমিতা বসুর সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঘুরছিলাম। যে-কোনও কথাতেই চাউসেস্কুর কোনও না কোনও অত্যাচারের প্রসঙ্গ আসে। চাউসেস্কুর প্রাসাদ, পার্টি অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রণাঙ্গন, বুলেট-বিক্ষত মিউজিয়াম, এই সব ছাড়া যেন আর কিছুই দেখার নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানি কিংবা হাঙ্গেরিতে বড় বড় গির্জাগুলি সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করা হত, কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মকে বাদ দিলেও এই সব পুরোনো গির্জাগুলি চমৎকার ভাস্কর্যের নিদর্শন। এখানে গির্জাগুলি অবহেলিত, কোনও কোনও গির্জা ভেঙেও ফেলা হয়েছে শুনেছি।

রুমানিয়ার একজন কবির সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল। আয়ওয়া শহরে আমরা কিছুদিন প্রতিবেশী ছিলাম। সেই কবির নাম মারিন সোরেস্কু, তাঁর খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি কানাডা চলে গেছেন কোনও সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে। রাজনীতির লোকদের সঙ্গে আমি কথাবার্তায় সুবিধে করতে পারি না, আমার ইচ্ছে ছিল দু-একজন কবি বা লেখকের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর। অমিতা এরকম অনেককে চেনেন। বিদেশ যাত্রার পথ খুলে যাওয়ায় প্রধান কবি-সাহিত্যিকরা অনেকেই এখন বিদেশে। যে দু-একজন আছেন, তাঁরা ইংরিজি জানেন না। ইয়োন হোরেয়া এখানকার একজন বিখ্যাত কবি এবং সম্পাদক। এঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও নিরাশ হতে হল, কারণ মাত্র কয়েকদিন আগে এই কবির মা মারা গেছেন, তিনি বাড়ি থেকে বেরুচ্ছেন না। তবে ইয়োন হোরেয়া'র মেয়ে ইরিনা আমাদের নেমন্তন্ন করল এক সন্ধ্যায় তার অ্যাপার্টমেন্টে।

রুমানিয়ায় নিজের বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে কোনও বিদেশিকে আমন্ত্রণ জানানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। কারুর বাড়িতে বিদেশি অতিথি এলে পুলিশি হামলা ছিল অবধারিত। ইরিনার ফ্ল্যাটে আমরাই প্রথম বিদেশি।

ইরিনার বয়েস তিরিশের কাছাকাছি, ছিপছিপে ধারালো চেহারা, বিবাহ-বিচ্ছিন্না। একটি সন্তান নিয়ে আলাদা থাকে। ইরিনা ঠিক লেখিকা নয়, অনুবাদিকা, ইংরিজি সাহিত্য পড়েছে, তার বাবার একটি সাহিত্য পত্রিকা চালাতে সে সবরকম সাহায্য করে, নিজে প্রুফ দেখে পর্যন্ত।

ঠিকানা খুঁজে আমরা এলাম একটা দশতলা বাড়িতে। ইরিনা থাকে দশমতলায় কিন্তু সে বাড়ির লিফট ন'তলা পর্যন্ত। বাড়িটি নতুন, কিন্তু লিফটটা অমন কেন, তা বোঝা গেল না। ইরিনার ফ্ল্যাটটি বেশ বড়। ভাড়া নয়, নিজস্ব। এত কম বয়েসে, শুধু অনুবাদের কাজ করে সে এরকম একটা ফ্ল্যাট কিনেছে? এদেশে লিখে কি এত টাকা পাওয়া যায়? আমাদের মনে-মনে এই প্রশ্নটা ঘুরছিল, সেটা একবার উচ্চারিত হতে ইরিনা জানাল যে সে তার প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে খোরপোষ বাবদ এক পয়সাও নেয়নি, তার নিজস্ব উপার্জনেও এরকম ফ্ল্যাট কেনা যায় না। সে তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, তাঁরা তাঁদের কন্যাকে এই ফ্ল্যাটটা উপহার দিয়েছেন।

এসব দেশে কেউ সন্ধের পর নেমন্তন্ন করলে ফুল ও ওয়াইনের বোতল নিয়ে যাওয়ার প্রথা। ইরিনা আমাদের জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করেছিল, তিনটি ডিম সেদ্ধ টুকরো-টুকরো করা, কয়েক স্লাইস রুটি, কয়েক টুকরো স্যালামি ও কিছু স্যালাড। আমরা পাঁচজন বুভুক্ষুর মতন দ্রুত সেগুলো শেষ করে ফেললাম। কারুর বাড়ির খাদ্যতালিকা এভাবে জানানো শিষ্টাচার সম্মত নয়, তা ছাড়া আমরা গেছি আড্ডা দিতে, খাবারের ব্যাপারটা জরুরি নয়। তবু এই কথাটা মনে আসেই যে আমাদের দেশের যে-কোনও মধ্যবিত্ত বাড়িতে পাঁচজন অতিথি এলে এর চেয়ে অনেক বেশি খাবারের ব্যবস্থা থাকে। ইরিনার ফ্ল্যাটটা যেভাবে সাজানো, তাতে তার অবস্থা বেশ সচ্ছলই বলা যায়। কিন্তু এদেশে যে এখন পয়সা থাকলেও কিছু পাওয়া যায় না। এইগুলি সংগ্রহ করতেই নিশ্চয়ই ইরিনাকে অনেক কষ্ট এবং ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।

ইরিনা বেশ তেজি ধরনের মেয়ে। যে-কোনও প্রশ্নের উত্তরে কোনও দ্বিধা না করে স্পষ্ট কথা বলে। আমরা অমিতার মুখে এখনকার দ্বিতীয় বিপ্লব ও চাউসেস্কুর পতনের কাহিনি শুনেছি। এবার সেই কাহিনিই শুনতে চাইলাম ইরিনার মুখে। দুটো ভাষ্য মিলিয়ে নেওয়ার জন্য। অমিতা ও ইরিনার মধ্যে কিছু কিছু মতভেদ আছে, চাউসেস্কুর আমলের প্রতি অমিতার রয়েছে ভীতি ও ঘৃণার ভাব, ইরিনার রয়েছে অবিমিশ্র ক্রোধ। এমনকি বর্তমান রুমানিয়ার শাসকদেরও ইরিনা পছন্দ করে না, তার ধারণা এদের মধ্যেও রয়ে গেছে চাউসেস্কুর কিছু কিছু গুপ্ত সমর্থক।

আমি জিগ্যেস করলাম, চাউসেস্কুকে এরকম বাড়তে দেওয়া হল কেন? একটা সমাজতান্ত্রিক দেশের কর্ণধার কী করে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে? তাকে সংযত করার কোনও ক্ষমতা কি পার্টির ছিল না। কিংবা পার্টি তাকে সরিয়ে দিতে পারেনি?

ইরিনা বলল, না। কেউ সাহস করেনি। তার জন্য আমিও দায়ী। এককালে আমিও ছিলাম কমিউনিস্ট পার্টির কট্টর সদস্য।

ভাস্কর জিগ্যেস করল, তুমি গোড়া থেকে বলো। তুমি কবে পার্টি মেম্বার হলে?

ইরিনা বলল, তখন আমি সদ্য ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছি। আমার বাবা বহুদিনের কমিউনিস্ট। সাচ্চা কমিউনিস্ট, এই আদর্শে বিশ্বাস করতেন, কোনওদিন পার্টির পোস্ট নিতে চাননি। আমার বয়ফ্রেন্ড যে পরে আমার স্বামী হয় সেও পার্টির সক্রিয় সদস্য। পৃথিবীতে যে দুজনকে আমি সবচেয়ে ভালোবাসি, তারা যে আদর্শে বিশ্বাস করে, আমি সেই আদর্শকে মহৎ মনে করব না? তাই আমিও পার্টির সদস্য হতে চাইলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি অবশ্য আমাকে যাচাই করে নিয়েছিল। বারবার প্রশ্ন করেছিল, কেন আমি সদস্য হতে চাই।

বাদল জিগ্যেস করল, কেন, যে কেউ বুঝি ইচ্ছে করলেই পার্টির মেম্বার হতে পারত না?

ইরিনা বলল, না। খুব বেছে-বেছে মেম্বার করা হত। পরে আমি তার কারণটা বুঝতে পেরেছি। তখন আমাদের দেশের যা অবস্থা, তাতে পার্টির মেম্বার হওয়া মানেই বিশেষ কতকগুলো সুবিধেভোগী হওয়া, সবাইকে তারা সেই সুযোগ দেবে কেন?

অসীম জিগ্যেস করল, এটা তুমি কবে জানলে?

ইরিনা বলল, প্রায় প্রথমদিকেই। আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম, ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য আমাকে কাজে লাগানো হত। আমি সেটা খুশি মনেই করতাম। একদিন একটা ধাক্কা খেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টি মেম্বারদের নিয়ে একদিন একটা গোপন মিটিং হল, একজন অধ্যাপক আমাদের নীতি বোঝাতে এলেন। সেই অধ্যাপকটির ভাষা কী খারাপ! সে অন্যান্য কয়েকজন অধ্যাপকের নামে কুৎসিত গালমন্দ করে বলল, ওরা প্রতিক্রিয়াশীল, ওদের চিনে রাখতে হবে। কিন্তু সেইসব অধ্যাপকদের আমি চিনি, তাঁরা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, মন দিয়ে পড়ান, কোনও সাত-পাঁচে থাকেন না। বরং আমাদের নেতা এই অধ্যাপকটিই ফাঁকিবাজ এবং অযোগ্য! বাড়িতে আমি বাবার সামনে এসে কেঁদে ফেলেছিলাম। কেন একজন কমিউনিস্ট খারাপ গালাগালি দেবে? নিজে অযোগ্য হয়েও কেন অন্য অধ্যাপকদের নিন্দে করবে। এইরকম লোক নেতা হয় কী করে?

বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, পার্টির মধ্যে এরকম দু-একজন লোক তো ঢুকে পড়তেই পারে। প্রথমেই অত ভেঙে পড়িস না! এই আদর্শের জন্য কত মেম্বার কত আত্মত্যাগ করেছে, সেটাও দেখতে পাবি!

কিন্তু আমি আরও ধাক্কা খেতে লাগলাম। আমার ধারণা ছিল, যারা এই পার্টির মেম্বার হয়, তারা একটা আদর্শকে নিজের জীবনেও প্রমাণ করে, তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির লোভ থাকে না, তারা দেশের মানুষের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সে রকম মানুষ অনেক ছিল, যখন পার্টি ছিল সংগ্রামের মধ্যে, যখন পার্টি ছিল বামপন্থী অর্থাৎ সরকার বিরোধী পক্ষ। কিন্তু পার্টি যখন একচ্ছত্র ক্ষমতায় এল, তারপর থেকে অবস্থা হল, যেন পার্টির মেম্বার হওয়া মানেই যা খুশি করার লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া। ঘুষ, কালোবাজারি, ইচ্ছেমতন যাকে তাকে শাস্তি দেওয়া, এসব কিছুই বাদ যায়নি। বিয়ের আগেই আমি প্রেগন্যান্ট হই। আমার বয়ফ্রেন্ডের তখন আমার ওপর টান চলে গেছে। আমি তাকে জোর করে বিয়ে করতে চাইনি। কিন্তু আমার সন্তানকেও নষ্ট করতে চাইনি। আমি তাকে কাতরভাবে অনুরোধ করলাম, কিন্তু সে ছিল একটা সত্যিকারের রাস্কেল, কিছুদিন পরই বিয়ে ভেঙে গেল। এবং আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমার ছেলেকে কেড়ে নিতে চাইল। আমি তখন লড়ে গেছি। একা ছুটোছুটি করেছি ডাক্তারের কাছে, কোর্টে কেস করেছি। কিন্তু ডাক্তার থেকে বিচারক পর্যন্ত আমার কাছে ঘুষ চেয়েছে। এক এক সময় আমার নার্ভাস ব্রেকডাউনের মতন হত।

আমি জিগ্যেস করলাম, ডাক্তার, বিচারক, এঁরা ঘুষ চাইলে এঁদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করা যেত না।

ইরিনা বলল, এরা সবাই ছিল পার্টির বড় বড় পোস্টে। এদের গায়ে হাত ছোঁয়াবার কোনও উপায় ছিল না। বুঝতে পারছ না, এরাও ছিল ছোট ছোট চাউসেস্কু! সেইজন্যই বড় চাউসেস্কুকে এরা সরাতে চায়নি। আমি নিজে তখন পার্টির মেম্বারশিপ ছেড়ে দেওয়ার কথা অনেকবার ভেবেছি। কিন্তু পারিনি। মেম্বারশিপ পাওয়া যেমন শক্ত, ছেড়ে দেওয়াও তেমন শক্ত। ছেড়ে দিলেই পার্টি পেছনে লাগত। আমি তবু অন্য দেশে পালিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু ভেবেছিলাম, আমি চলে গেলে ওরা আমার বাবার ওপর অত্যাচার করবে। আমার বাবা যে খাঁটি মানুষ! পরে, এই বিপ্লবের পরে, বাবা বলেছেন যে সেই সময়ে দুঃখে-অভিমানে বাবাও পার্টি ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করেছিলেন, কিন্তু তিনি ভয় পেয়েছিলেন আমার কথা ভেবে। তিনি ছেড়ে দিলে ওরা যদি আমার ওপর প্রতিশোধ নেয়!

অনেকক্ষণ ধরে চলতে লাগল এইসব কথা। ইরিনা চোখের জল মুছতে লাগল বারবার। একসময় ধরা গলায় সে আবার বলল, আপদগুলো বিদায় হয়েছে। আমাদের দেশটা কবে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াবে জানি না। কিন্তু এত কিছু সত্বেও আমি কমিউনিজমের ওপর বিশ্বাস হারাইনি। এইসব লোকগুলো তাকে নষ্ট করেছে, দেশটাকে এত খারাপ অবস্থায় নিয়ে গেছে, তবু আদর্শ হিসেবে একে বাদ দেওয়া যায় না।

আমি বললাম, আদর্শ হিসেবে সাম্যবাদ অবশ্যই অনেক উঁচুতে।

ইরিনা বলল, ইচ্ছে করলে আমি এখন দেশের বাইরে চলে যেতে পারি। আমি ইংরিজি জানি, জার্মান জানি, জার্মানিতে আমার কিছু বন্ধুবান্ধব আছে, সেখানে গেলে আমার কাজ পাওয়ার কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু আমি যাব না, কিছুতেই যাব না। অনেকে চলে যাচ্ছে, আমি যাব না। সাম্যবাদের সঙ্গে মানুষের স্বাধীনতার কি কোনও বিরোধ আছে? কেন এতগুলো বছর ধরে দেশের মানুষকে ভয় দেখিয়ে, ঠকিয়ে, মিথ্যে কথা বলে সাম্যবাদ প্রচার করা হয়েছিল? মিথ্যে কথা আমি দু চক্ষে সহ্য করতে পারি না। আমি চাই সত্য এবং ন্যায়, সমস্ত মানুষের চিন্তা ও জীবনযাত্রার স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক সাম্যবাদ, সব একসঙ্গে।

১২

রুমানিয়ার অবস্থা কি আমাদের দেশের চেয়েও খারাপ?

আপাতদৃষ্টিতে সেইরকমই মনে হয় বটে। কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে? আমাদের চার জনের দলটির মধ্যে বাদল ও আমি কলকাতাবাসী, ভাস্কর ও অসীম বহুকাল প্রবাসী। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা আলাদা হবেই। রুমানিয়ায় মাংস পাওয়া যায় না, দুধ নেই, মাখন নেই, এরকম প্রয়োজনীয় অথচ অপ্রাপ্তব্য বস্তুর তালিকা অতি দীর্ঘ। ইংল্যান্ড ফ্রান্সে এই অবস্থা অকল্পনীয়, পয়সা থাকলে সেখানে সব কিছুই পাওয়া যায়। ওই সব দেশে বিক্রেতারাই খদ্দেরদের নানারকম প্রলোভন দেখায়, নিছক খাবারের জিনিস কেনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। ওই সব দেশের দোকানে ঢুকলে কুড়ি রকমের মাংস, বারো রকমের রুটি, সাত রকমের দুধ, পাঁচ রকমের ডিম, চল্লিশ রকমের বিস্কিট ইত্যাদির মধ্যে পছন্দমতন বেছে নিতে যা সময় লাগে। ভাস্কর আর অসীমের মনে এই তুলনা আসবেই।

বাদল বলল, আমাদের কলকাতার অবস্থাও এর চেয়ে অনেক ভালো। টাকা থাকলে সব কিছু পাওয়া যায়।

আমি বললাম, না, পাওয়া যায় না।

বাদল বলল, মাছ, মাংস, রুটি, ডিম, এসব পাওয়া যায় না?

আমি বললাম, না।

বাদল খানিকটা হকচকিয়ে যেতে আমি খানিকটা রহস্য করে বললাম, মনে করুন, কলকাতার সব লোক একদিন মাংস খাবে ঠিক করল, তখন কি লাইন দিয়েও সবাই মাংস পাবে? মনে করুন, পশ্চিম বাংলার সব মানুষ ভাবল, তাদের প্রতিদিন ডিম খাওয়া উচিত, তত ডিম পাওয়া যাবে বাজারে? আমাদের দেশের শতকরা পঞ্চাশ ষাটজন লোক জীবনে কখনও মাখন খায়নি, তারাও যদি মাখন খেতে চায়, তার জোগান দেওয়া যাবে?

আমাদের দেশের শতকরা পঞ্চাশ জনেরও বেশি মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নীচে, তাদের কোনও ক্রয়ক্ষমতাই নেই, তাদের জন্য ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনও হয় না। আমাদের দেশে কংগ্রেসি কিংবা বামপন্থী কোনও সরকারই দারিদ্র্যসীমার বিশেষ হেরফের ঘটাতে পারেনি। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত মানুষরাই কখনও পাউরুটি কিংবা বিদ্যুৎ কিংবা পেট্রোল না পেলে চেঁচামেচি করে, সরকারও তাদেরই মনতুষ্টির চেষ্টা করে। আর দেশের যে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ প্রায় কিছুই পায় না, তারা নীরবই থেকে যায়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রত্যেক মানুষেরই কিছু না কিছু রোজগার থাকে, মাংস-মাখন-ডিম-কফি এসব, আমাদের শুধু ডাল-ভাতের মতনই, ওদের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, সকলেরই এগুলো পাওয়ার কথা, রুমানিয়ায় সকলে সেগুলো এখন পাচ্ছে না বলেই এত কথা উঠছে। তাহলেও এদেশে কেউ এখনও না খেয়ে নেই, শহরের ফুটপাথে ভিখিরির পাল জোটেনি। সুতরাং আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা চলে না।

অসীম বলল, ভারতের চেয়ে এখানকার অবস্থা অবশ্যই ভালো। এখানে তবু তো সব লোক লেখাপড়ার সুযোগ পায়, না খেয়ে কেউ মরে না, সকলেরই কিছু না কিছু কাজ আছে, শহরে আবর্জনার স্তূপ জমেনি।

ভাস্কর বলল, সমাজতন্ত্র আসবার আগে কি এখানে কেউ না খেয়ে থাকত? ইউরোপের কোন দেশের লোক না খেয়ে থাকে? তথাকথিত ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর সাধারণ মানুষও এদের তুলনায় ভালো খেতে-পরতে পায় না? সেখানেও সব লোক কাজ পায়, কাজ না থাকলে সরকার বেকার-ভাতা দেয়। এখানে সবাই কাজ পায় তবু কাজ করে না।

আমি আর তর্কের মধ্যে যেতে চাই না। তুলনা করে লাভ নেই। সমাজতন্ত্র সমস্ত মানুষের মধ্যে সমবন্টনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ঘোচাবার কথা বলেছিল, এই আদর্শ ব্যবস্থাকে কে অস্বীকার করবে? তবু অতিরিক্ত ক্ষমতালোভী একটা শ্রেণি তৈরি হয়ে গেল, তাদের জন্য এই আদর্শ ব্যর্থ হয়ে গেল। এ জন্য মনের মধ্যে একটা বেদনাবোধ থেকেই যায়।

আমাদের রুমানিয়ায় ফেরার পালা এবার শেষ হল। আমাদের বাড়িউলি মাদাম দিদার ইচ্ছে আমরা আরও কয়েকটা দিন থেকে যাই। আমাদের কাছ থেকে চার দিনের ঘর ভাড়া হিসেবে উনি যত ডলার পেয়েছেন, তা এখানকার সাধারণ মানুষের তিন মাসের মাইনে। সুতরাং আমাদের আরও কয়েকটা দিন ধরে রাখার আগ্রহ তো ওঁর থাকবেই। ওঁর মতে, ভারতীয়রা বেশ ভালো লোক, পছন্দ মতন পেলে উনি একজন ভারতীয়কে বিয়ে করতে চান। আমাদের দলে অসীমই একমাত্র অকৃতদার এবং অতিশয় সুপাত্র এবং বয়েসের দিক দিয়েও মাদাম দিদার সঙ্গে মানিয়ে যাবে। আমরা তিনজনে অসীমের নাম প্রস্তাব করায় অসীম তৎক্ষণাৎ এ দেশ থেকে একটা দৌড় লাগাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।

ছুটি ফুরিয়ে গেছে বলে ভাস্কর ও অসীম ফিরে যাবে যে-যার শহরে এবং ওদের ফিরতে হবে হাঙ্গেরি হয়ে। বাদল আর আমি যাব পোল্যান্ড। ওরা দু'জন গেল রেল স্টেশানের দিকে, আমরা দুজন বিমানবন্দরে।

বুখারেস্ট শহর ছাড়িয়ে বিমানবন্দরটি বেশ দূরে। আমাদের ফ্লাইট ডিলেইড, বসে থাকতে হবে বেশ কিছুক্ষণ। বিদ্যুৎসংকটের জন্য এয়ারপোর্টের অধিকাংশ জায়গাই অন্ধকার, দু-এক জায়গায় টিমটিম করে আলো জ্বলছে। রেস্তোরাঁয় খাবারদাবার কিছু নেই। এখানে অপেক্ষা করাটা মোটেই সুখকর নয়। আমাদের কাছে যে সামান্য কিছু রুমানিয়ান টাকা রয়ে গেছে তা খরচ করে ফেলবার জন্য আমরা দুটো বিয়ার নিয়ে বসলাম। রেস্তোরাঁয় আর বিশেষ লোক নেই। এক কোণের টেবিলে তিনটি যুবক বসে নিজেদের মধ্যে নিম্নস্বরে কথা বলছে, এক সময় আমি তাদের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, আপনারা ঢাকা থেকে এসেছেন?

ওরা ভূত দেখার মতন চমকে উঠল, একজন বিস্ফারিত চোখে জিগ্যেস করল আপনি বাংলার কথা বলছেন? সত্যি? কানে ভুল শুনছি না তো!

যুবক তিনটি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, আমাদের কাছাকাছি এসে বসল। ওদের দুজনের বয়েস একুশ-বাইশ, অন্য জনের ত্রিশ-বত্রিশ হবে। বয়স্ক ছেলেটি চালু ধরনের, অন্য দুজন একেবারেই সরল নিরীহ। ওদের কাহিনি খুবই করুণ। রুমানিয়ায় ঢুকতে ভারতীয়-বাংলাদেশিদের ভিসা লাগে না, ওরা তবু ঢাকা থেকে ভিসা নিয়ে এসেছে, এখানে তবু ওদের আটকে দিয়েছে। ওদের প্লেনের টিকিট এক দিকের, এখানে ইমিগ্রেশান থেকে সন্দেহ করা হয়েছে যে, ওরা বেড়াতে আসেনি, কাজ খুঁজতে এসেছে। ওদের উদ্দেশ্য সত্যিই তাই।

বাদল বলল, তোমরা আর কোনও দেশ খুঁজে পেলে না? রুমানিয়ায় এসেছ কাজ খুঁজতে?

অল্প বয়সীদের একজন জিগ্যেস করল, কেন দাদা, দেশটা খারাপ?

বাদল বলল, ভাগ্যিস ঢুকতে পারনি। ভেতরে গেলে কাজ তো পেতেই না, ক'দিন বাদে না খেয়ে থাকতে হত।

কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল, বয়স্ক ছেলেটি অন্য দুজনকে স্বপ্ন দেখিয়ে এনেছে। এর আগে সে আরও কিছু ছেলেকে ঢাকা থেকে চালান করেছে অন্য দেশে। তার ধারণা, রুমানিয়ায় ঢোকা সবচেয়ে সহজ, তারপর এখান থেকে কোনওক্রমে জার্মানিতে পৌঁছে যেতে পারবে। জার্মানি হচ্ছে সমস্ত সুযোগ সন্ধানীদের স্বর্গ। অল্পবয়েসি ছেলে দুটির ইতিহাস-ভূগোল সম্পর্কেও কোনও ধারণা নেই, ঢাকায় কলেজ ইউনিভার্সিটি প্রায়ই বন্ধ থাকে, পাস করলেও চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, তাই বিদেশের হাতছানিতে ওরা প্রলুব্ধ হয়েছে। এটাকে ঠিক অ্যাডভেঞ্চারও বলা যায় না, ওরা দেশ ছেড়েছে হতাশায়। মরিয়া হয়ে প্লেন ভাড়ার টাকা সংগ্রহ করেছিল, এখন সবই গেল।

ওদের তিনজনকে গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে এই এয়ারপোর্টে। একটা নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। চারদিন ধরে ওরা রয়েছে। অন্য কোনও দেশ ওদের নামতে দেবে না, এখান থেকে ঢাকার সরাসরি কোনও ফ্লাইট পেলে তাতে ওদের পাঠানো হবে। এর মধ্যে সেপাই-সান্ত্রিরা নানা ছুতোয় ঘুষ নিচ্ছে ওদের কাছ থেকে। কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে। আজ সকালেই একজন পুলিশ ওদের বলেছে, একশো ডলার দাও, দু-ঘণ্টা বাদে ওদের শহরে পাচার করে দেবে। একশো ডলার গেল, দু-ঘণ্টা পরে জানা গেল, সেই পুলিশটি কয়েকদিনের জন্য ছুটিতে চলে গেছে। আবার আর একজন সেই একই আশ্বাস দিয়েছে।

ওদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। একজন বলল, দাদা, সাহেবরা যে এত ঘুষ নিতে পারে, তা আমরা জানতাম না। এখানে প্রত্যেকে ঘুষ চায়। আমাদের একেবারে ফতুর করে দিচ্ছে। এখানে ওরা দুবেলা খেতে দেয় বটে, কিন্তু যা খাই কিছুই ভালো লাগে না।

বাঙালি পেয়ে ওরা আমাদের ছাড়তে চায় না। কিন্তু ওদের সাহায্য করার কোনও উপায়ই আমরা খুঁজে পেলাম না। আমাদের একটু পরেই চলে যেতে হবে। বাদল আর আমি প্রস্তাব দিলাম তোমাদের টাকা পয়সা যদি ফুরিয়ে গিয়ে থাকে, আমরা কিছু দিতে পারি। পরে না হয় দেশে ফিরে গিয়ে কোনওসময় শোধ করে দিও।

ওদের একজন বলল, আপনাদের কাছ থেকে নিলে সে টাকাও চলে যাবে। কোনও লাভ নেই। আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলে, যখন দেখবে ঘুষ পাওয়ার আর কোনও আশা নেই, তখন ওরা নিজেদের গরজেই আমাদের ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করবে।

ভারাক্রান্ত মনে ছেলে তিনটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বিমানের দিকে হেঁটে গেলাম। তারপর ওদের কী পরিণতি হল জানি না। আশা করি, সুস্থভাবে তারা দেশে ফিরে গিয়ে দুটি মাছের ঝোল-ভাত খেতে পেয়েছে।

আমরা ওয়ারশ পৌঁছলাম সন্ধের পর। এখানে আমাদের অভ্যর্থনা হল চমকপ্রদ। ওয়ারশ-তে আমাদের থাকার জায়গা ঠিক করে আসিনি। সেরকম বিশেষ চেনাশুনোও কেউ নেই। তবে ফ্রাংকফুর্টে থাকার সময় লন্ডনে টেলিফোনে কথাবার্তা হয়েছিল বিশিষ্ট শিল্প-সমালোচক আকুমল রামচন্দরের সঙ্গে। আকুমলের সঙ্গে পোল্যান্ডের খুব যোগাযোগ। আমরা ওয়ারশ যাব শুনে, দিন হিসেব করে আকুমলও চলে এসেছে। বিমান বন্দরের বাইরে এসে দেখি আকুমল দুটি পোলিশ যুবককে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকুমল তো বাংলা জানেই, তা ছাড়া পোলিশ যুবকদ্বয়ের একজন বেশ পরিষ্কার বাংলায় বলল, আসুন, পোল্যান্ডে স্বাগতম। কোনও কষ্ট হয়নি তো?

এই যুবকটির নাম পিওতর বালসেরোউইভস, ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারততত্ব নিয়ে পড়াশুনো করে। অন্যজনের নাম জাসেক ফ্রাকৎসাক (কিংবা ফ্রমসাফ), একজন প্রখ্যাত গ্রাফিক শিল্পী। ট্যাক্সি ধরতে হল না, জাসেক এর নিজের গাড়ি আছে। সেই গাড়িতে উঠে আরও ভালো খবর পাওয়া গেল যে, আকুমল আমাদের জন্য থাকার জায়গাও ঠিক করে ফেলেছে।

আগেই শুনেছিলাম যে ওয়ারশ-তে সাধারণ হোটেল পাওয়া দুষ্কর, নামি হোটেলগুলি এতই দামি যে আমাদের প্রায় সাধ্যাতীত। কিন্তু আকুমলের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের তুলনা নেই। অনেক হোটেলের সে সন্ধান নিয়েছে বটে, কিন্তু আমরা এখানে পৌঁছোবার মাত্র দু-ঘণ্টা আগে একটা চায়ের আসরে সে অনেকের মধ্যে বসে আমাদের থাকার জায়গার প্রসঙ্গ তুলেছিল। তখন শিক্ষা বিভাগের একজন কর্তাব্যক্তি একটি গেস্ট হাউসের ঘর ঠিক করে দেন আমাদের জন্য। সে গেস্ট হাউসটিও সাধারণ নয়, আর্ট হিস্টোরিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত, খরচ যৎসামান্য। অর্থাৎ পণ্ডিত ব্যক্তিরাই শুধু সেখানে থাকার অধিকারী, এই প্রথম আমাদের মতন দুজন অপণ্ডিতের সেখানে পদার্পণ।

গেস্ট হাউসটি পুরোনো শহর। সেন্ট জনস ক্যাথিড্রালের কাছাকাছি এই এলাকাটি টুরিস্টদের একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান। অর্থাৎ যেখানে সবাই বেড়াতে আসে, আমরা রাত্রিবাস করব সেখানেই। বাড়িটি পুরোনো আমলের, এক একটা ফ্লোর এখনকার দেড়তলার সামন তো হবেই এবং লম্বা কাঠের সিঁড়ি। আমাদের ঘর চার তলায়। খুবই প্রশস্ত কক্ষ, কাছেই বাথরুম ও রান্নাঘর, চমৎকার ব্যবস্থা। প্রথম রাত্তিরেই যাতে আমাদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে না হয়, সে বন্দোবস্তও করে রেখেছে আকুমল। মালপত্র রেখেই আমাদের আবার রওনা দিতে হল। জীবনে যাঁদের দেখিনি, যাঁদের নামও শুনিনি, সেরকম একটি পরিবারে আমাদের নেমন্তন্ন আছে।

শহরের অন্য প্রান্তে সেই বাড়ির গৃহকর্তা একজন সাংবাদিক, তাঁর নাম অ্যানড্রু টারনডস্কি। ইনি রয়টারের ওয়ারশ প্রতিনিধি। কথাবার্তা শুনে পাক্কা ইংরেজ মনে হলেও পদবিটা খটকা জাগায়। এঁর বাবা-মা পোলিশ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেই তাঁরা পোল্যান্ড ছেড়ে চলে যান। অ্যানড্রু'র জন্ম সুইটজারল্যান্ডে, কৈশোর কেটেছে, স্কটল্যান্ডে, লেখাপড়া করেছেন অক্সফোর্ডে। তারপর চাকরির সূত্রে ঘুরেছেন সারা পৃথিবী। পোল্যান্ডে এসে ইনি এখন পোলিশ ভাষা শিখছেন এবং এখানকার ঘটনাবলি সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ শুধু জীবিকার কারণের চেয়ে অনেক বেশি। এঁর স্ত্রীর নাম ওয়াফা, গৌরাঙ্গিনী হলেও তাঁকে ঠিক মেমসাহেব বলে মনে হয় না। বসবার ঘরের দেওয়ালে দু-একটা ভারতীয় মোটিফ দেখে সন্দেহ হয়, ইনি ভারতীয় নাকি? কথা বলে জানা গেল, ওয়াফা লেবাননের মেয়ে, তিনিও সাংবাদিক ছিলেন এবং একসময় দু'জনেই ছিলেন দিল্লিতে। এঁর কথার মধ্যে বেশ একটা আপন-আপন সুর আছে। রান্না-বান্নায় লেবানন, পোল্যান্ড, ব্রিটেন ও ভারতের ছোঁয়া আছে। আকুমল বানিয়েছে স্যালাড ও পাঁপড় ভাজা। এই সাংবাদিক দম্পতির পাঁপড় ভাজা খুব প্রিয়। এ বাড়ির খাবার টেবিলে বসলে বোঝা যায় না যে এ দেশে খাদ্যদ্রব্যের কোনও অভাব আছে।

কোনও একটা নতুন শহরে এসে পরিবেশটা বুঝে নিতে অন্তত একটা দিন সময় লাগে। ওয়ারশতে এসে আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বেশ একটা অন্তরঙ্গ আবহাওয়া পেয়ে গেলাম। শিল্পী জাসেক বেশ ঝকঝকে ইংরিজি বলে এবং জোর দিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। সমস্ত কথাই পোল্যান্ডের সাম্প্রতিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে। অ্যানড্রু আমাদের কাছে রুমানিয়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাইছিলেন কিন্তু জাসেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার পোল্যান্ডের প্রসঙ্গে টেনে আনে। জাসেক এবং আকুমল দুজনেই আগেকার শাসনতন্ত্রের ঘোর বিরোধী, ওদের মতে পোল্যান্ড দুঃশাসন মুক্ত হয়েছে। অ্যানড্রু ভবিষ্যতের জন্য চিন্তিত। এই পরিবর্তনের কতটা সুফল পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট সংশয় আছে।

আকুমল বাইরের মানুষ হলেও গত এক দশক ধরে পোল্যান্ডের সমস্ত ঘটনা তার নখদর্পণে। তবু আমরা জাসেক-এর কাছেই জানতে চাইলাম, পূর্ববর্তী ব্যবস্থা সম্পর্কে তার প্রধান অভিযোগ কী কী।

জাসেক শুধু শিল্পী নয়, খুবই ইতিহাসমনস্ক। ইতিহাস ও সাহিত্য থেকে মাঝে মাঝেই উদ্ধৃতি দেয়। সে বলল, মানুষ অনেক কিছু সহ্য করতে পারে, কিন্তু বেশিদিন ভণ্ডামি সহ্য করতে পারে না। যুগ যুগ ধরে পোলিশরা বহু অত্যাচার সহ্য করেছে, বিদেশি শক্তি এ দেশটাকে বারবার টুকরো-টুকরো করেছে, এক সময় পোলান্ডের নামটাও পৃথিবীর ম্যাপ থেকে মুছে গিয়েছিল, তবু এদেশের মানুষ কখনও আত্মমর্যাদা হারায়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এদেশের ষাট লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, তবু তো ভেঙে পড়েনি এ জাতটা। সমাজতন্ত্রের রাস্তা ধরে ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে এই জাতটা আবার উঠে দাঁড়াল। কিন্তু তারপর একদলীয় শাসন এমন একটা স্বৈরতন্ত্রের পর্যায়ে গেল, যাতে গড়ে উঠল একটা নতুন অ্যারিস্টোক্রাট শ্রেণি, যারা দেশকে মানুষকে সমাজতন্ত্রের স্তোক বাক্য দেয়, আর নিজেরা বেশি-বেশি সুবিধে ভোগ করে। তাদের পতন অনিবার্য ছিল।

কথায়-কথায় লেক ভালেনসার কথা এসে পড়ে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন উপলক্ষে তখন হাওয়া গরম। সলিডারিটির নেতা ভালেনসা শুধু পোল্যান্ডের নয়, পূর্ব ইউরোপের সবকটি দেশের পালা বদলের নেতা। ১৯৮০ সালে তাঁর নেতৃত্বে এক বিরাট শ্রমিক আন্দোলন পোল্যান্ড কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যে দেশ শাসন করছে ওয়ার্কার্স পার্টি, সে দেশের শ্রমিকরাই বিদ্রোহ করে কেন? তা হলে কারা প্রকৃত শ্রমিক? মার্শাল ল জারি করে সলিডারিটির আন্দোলন সাময়িকভাবে দমন করা গেলেও জনতার রোষ আবার ফুঁসে ওঠে।

পূর্বতন সরকারের পতনের পর লেক ভালেনসা বলেছিলেন, তিনি শ্রমিক, তিনি সরকারের কোনও পদ চান না। কিন্তু এতবড় একটা ইতিহাস বদলের নায়কের মর্যাদা অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য। কয়েকমাসের মধ্যে নিজেকে কিছুটা অবহেলিত মনে করে ভালেনসা মত বদল করে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন-প্রার্থী হয়েছেন।

জাসেক কিন্তু ভালেনসার সমর্থক নয়। ভালেনসা-কে সে অবশ্যই হিরো মনে করে, তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকাও মান্য করে, কিন্তু ভালেনসা প্রেসিডেন্ট হোন, এটা সে চায় না।

জাসেক বলল, ভাসেনসা হেরে গেলে আমি দুঃখিত হব, আর জিতলে হতাশ হব।

কথাটা ধাঁধার মতন, ঠিক বোঝা যায় না।

অ্যানড্রু বললেন, ভালেনসা নির্বাচনে হেরে গেলে তাঁর খুবই অসম্মান হবে। এতবড় একটা কাণ্ড যিনি ঘটালেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যিনি এনে দিলেন, তাঁকেই দেশের মানুষ ভোট দেবে না, এটা অকৃতজ্ঞতা নয়? কিন্তু জাসেক-এর মতন বুদ্ধিজীবীরা ভালেনসাকে রাষ্ট্রপতির পদে চায় না, কারণ ভালেনসা ঠিক শিক্ষিত নন। তিনি একজন ইলেকট্রিশিয়ান। তাঁকে অন্যভাবে সম্মান জানানো যেতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রপতি পদে বসানোর দরকার কি? দেশ গড়ার জন্য একজন উপযুক্ত লোক দরকার, তাই না জাসেক?

জাসেক বলল, ভালেনসা একজন ইলেকট্রিশিয়ান বলেই যে তাঁকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসাতে আমাদের আপত্তি তা নয়। আমাদের আশঙ্কা অন্য। বিপ্লবী আন্দোলনের নেতা হিসেবে যাঁকে আমরা এত শ্রদ্ধা করি তিনি যদি ক্ষমতার আসনে বসার পর বদলে যান? যদি তিনিও আস্তে-আস্তে রূপান্তরিত হয়ে, হয়ে ওঠেন এক স্বৈরাচারী? তাহলে যে আমাদের দুঃখের শেষ থাকবে না।

১৩

সকালবেলা আমাদের বাসস্থান থেকে বেরুলেই দেখতে পাই চতুর্দিকে টুরিস্টদের মেলা। ওয়ারশ শহরের এই 'ওল্ড টাউন' টুরিস্টদের অবশ্য দ্রষ্টব্য। একটা প্রকাণ্ড চত্বর ঘিরে সব পুরোনো আমলের বাড়ি, গির্জা, মিউজিয়াম। অনেক রকম জিনিসপত্তর নিয়ে সকাল থেকেই এখানে বসে যায় সার সার নারী-পুরুষ ফেরিওয়ালা। কাছাকাছি অনেক বিখ্যাত হোটেল-রেস্তোরাঁ, খুচরো খাবারের দোকান। খোয়া-পাথর বাঁধানো এই চত্বরটায় ঘুরলে খানিকটা মধ্যযুগীয় আবহাওয়া অনুভব করা যায়। আবার একটা বিস্ময়বোধও জেগে থাকে। এই যে সব বিশাল বিশাল প্রাসাদ, এর কোনওটাই আসল নয়, সব নকল। গোটা পুরোনো শহরটাই প্রকৃতপক্ষে অর্বাচীন।

ওয়ারশ শহরের প্রায় পুরোটাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পোলিশ জাতি দারুণ অধ্যবসায়ে সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে সমস্ত পুরোনো বাড়িগুলো আবার নিখুঁতভাবে গড়ে তুলেছে। ঐতিহ্য রক্ষা করার প্রতি মমতায় তারা পুরোনোর জায়গায় নতুন গড়েনি, সবকিছুই পুনর্নির্মাণ করেছে। কমিউনিস্ট দুনিয়ায় সর্বত্রই ঐতিহ্য রক্ষার এই আন্তরিক প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনগ্রাড শহরে এবং অন্যত্র অনেক ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক বাড়ি আবার ইঞ্চি ইঞ্চি করে হুবহু আগের মতন গড়ে তোলা হয়েছে। চিনেও আছে এরকম সংরক্ষণের নিদর্শন। একমাত্র রুমানিয়ায় চাউসেস্কু ঐতিহ্যের কোনও তোয়াক্কা করেননি, তিনি চেয়েছিলেন তাঁর আমল থেকেই নতুন ইতিহাস শুরু হোক। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে এবং তাঁর পত্নীকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করল নির্দয়ভাবে।

নাতসিরা ওয়ারশ শহরটা দখল করেও এক সময় ত্রুদ্ধ হয়ে পুরো শহরটা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। যুদ্ধের সময় অন্যান্য অনেক শহর ধ্বংস হয়েছে বোমাবর্ষণে, কিন্তু ওয়ারশ ধ্বংস হয়েছিল ডিনামাইটে। যে কারণ উপলক্ষে এমনটি ঘটেছিল, তা নিয়ে আজও বিতর্ক আছে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যেমন চরম দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে পোল্যান্ডকে, তেমনি পোলিশ জাতি অসম সাহসিকতারও পরিচয় দিয়েছে। অসম্ভব অমানুষিক অত্যাচারেও তারা মাথা নত করেনি। পোলান্ড কোনও কুইশলিং-এর জন্ম দেয়নি। যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই তারা বিনা প্রতিরোধে এগোতে দেয়নি জার্মানদের। ডানজিগ বন্দরে মাত্র ১৮৯ জন পোলিশ বীর সাতদিন ধরে শ্লেসুইটগ হলস্টিন নামে রণতরীকে আটকে রেখেছিল। পশ্চিম সীমানা দিয়ে যখন জার্মান ট্যাংক বাহিনী ঢোকে তখন তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়েছিল পোল্যান্ডের পো মোরস্কা বিগ্রেড নামে অশ্বারোহী বাহিনী। কামানের বিরুদ্ধে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে লড়তে যাওয়ার মতন ঘটনা। শত্রুর গোলায় সেই অশ্বারোহী বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও সেই শৌর্যের কাহিনি অবিস্মরণীয়।

জার্মান অধিকারের সময় দেশের ভেতরে ও বাইরে পোলিশ প্রতিরোধ বাহিনী আগাগোড়া সক্রিয় ছিল। এই প্রতিরোধ বাহিনী ছিল দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। একটি গোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী, নাম আরমিয়া ক্রাজাওয়া বা হোম আর্মি, অন্যটি ছিল কমিউনিস্ট গোয়ারডিয়া লুডো, বা পিপলস গার্ড। ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি যুদ্ধের গতি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বোঝা গিয়েছিল যে জার্মানদের শেষ পর্যন্ত হারতেই হবে। সেই সময় ওয়ারশ-তে লুকিয়ে থাকা পোলিশ প্রতিরোধ বাহিনী একটা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিল। তারা চেয়েছিল সোভিয়েত ও ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির সাহায্য নিয়ে নিজেরাই ওয়ারশ-কে শত্রুমুক্ত করবে। সোভিয়েত বাহিনী ততদিনে ভিসটুলা নদীর দক্ষিণ তীরে পৌঁছে গেছে। শহরের মধ্য থেকে প্রতিরোধ বাহিনীর অভ্যুত্থানে নাতসিদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলা হবে, সেই সুযোগে সোভিয়েত বাহিনী নদী পেরিয়ে এসে আক্রমণ করলেই নাতসীরা ফাঁদে পড়ে যাবে। লন্ডন থেকেও প্রতিরোধ বাহিনীর এই পরিকল্পনাকে সমর্থন জানানো হল। অভ্যুত্থানের দিন ঠিক হল। ১ আগস্ট। যথাসময়ে অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেল, ওয়ারশ-এর পথে পথে শুরু হল লড়াই, কিন্তু সোভিয়েত বাহিনী এগিয়ে এল না সাহায্য করতে। জার্মানদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার মতন অস্ত্রও ছিল না প্রতিরোধ বাহিনীর, তবু তারা একমাস পাঁচ দিন ধরে দুরন্ত লড়াই করার পর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল, ততদিনে আড়াই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিয়েছে।

এই প্রতিরোধ দমন করার পর, ওয়ারশ শহরে যারা বেঁচেছিল তাদেরও শহর থেকে তাড়িয়ে দিল নাতসিরা। তারপর এক একটা পাড়া ধরে-ধরে সমস্ত বাড়িঘর ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে লাগল। ওয়ারশ শহরটাকেই তারা একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। তিন মাস পরে সোভিয়েত বাহিনী যখন বিজয়ীর বেশে এখানে প্রবেশ করল, তখন চতুর্দিকে শুধু ধ্বংসস্তূপের নীরবতা।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পোল্যান্ডের জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ, প্রায় ষাট লক্ষ নারী-পুরুষ নিহত হয়, তার মধ্যে অর্ধেক ইহুদি।

এখন আবার নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, চুয়াল্লিশ সালে সেই ওয়ারশ অভ্যুত্থানের সময় সোভিয়েত বাহিনী নদী পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে এল না কেন? এই নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতার কারণ কী? আজও এর সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। স্টালিন পরবর্তীকালে বলেছিলেন, ওই ওয়ারশ অভ্যুত্থান ছিল প্রি-ম্যাচিওর, আরও প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করা উচিত ছিল। তাহলে লন্ডন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এই অভ্যুত্থান শুরু করার সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়েছিল কেন? লন্ডন-মস্কো তখন তো মিত্র পক্ষীয় আঁতাতে ছিল। আসলে যুদ্ধের সময়েও হৃদয়হীন রাজনীতির খেলা চলে, যুদ্ধ যখন চলছে, তখনই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কে কোন অঞ্চলের ক্ষমতা দখল করবে, সেই হিসেব কষা হয়। ওয়ারশ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিল অ-কমিউনিস্ট জাতীয়তাবাদী হোম আর্মি, চার্চিল ট্রুম্যানের পশ্চিমি জোট মনে করেছিল, এই অভ্যুত্থান সফল হলে জার্মানদের হঠিয়ে দিয়ে হোম আর্মি পোল্যান্ডে সরকার গড়তে পারবে। অপরপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইচ্ছে কমিউনিস্ট পিপলস গার্ডের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। সুতরাং ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর হোম আর্মির মুক্তিযোদ্ধারা যখন জার্মানদের হাতে কচু-কাটা হতে লাগল, তখন নদীর অপর পারে সোভিয়েত বাহিনী রয়ে গেল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। হোম আর্মির আর বিশেষ কেউ অবশিষ্ট রইল না, এরপর পোল্যান্ড যুদ্ধ শেষে স্বাভাবিক ভাবেই পিপলস গার্ডের হাতে চলে এল। যে নাতসিরা ছিল কমিউনিস্টদের ঘোর শত্রু, তারাই কিন্তু এখানকার সমস্ত জাতীয়তাবাদীদের হত্যা করে সমগ্র পোল্যান্ড কমিউনিস্টদের হাতে তুলে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করে গেল।

পশ্চিমি জোট কিংবা সোভিয়েত পক্ষ, কেউই তাদের বিশেষ স্বার্থসম্পন্ন মনোভাবের কথা এ পর্যন্ত স্বীকার করেনি। কিন্তু পোল্যান্ডের তরুণ সমাজ ওয়ারশ অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার এইরকম ভাবেই ব্যাখ্যা করে।

সকালবেলা আকুমল ও শিল্পী জাসেক আমাদের সঙ্গী। জাসেক আমাদের নিয়ে এল ইতিহাস-মিউজিয়াম দেখাতে। ওয়ারশ-তে এই মিউজিয়ামটি একটি অবশ্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে। এটি পোল্যান্ডের সমগ্র ইতিহাস ও পুরাতত্বের একটি মূল্যবান সংগ্রহশালা তো বটেই। তা ছাড়া এখানে প্রতিদিন সকালে একটি ফিলম শো হয়, তাতে বোঝা যায়, যুদ্ধে এই নগরীর কতখানি ধ্বংস হয়েছিল, এবং আবার কত নিখুঁত সুন্দরভাবে তা গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি সরকারের পালা বদলের পর নতুনভাবে সাজানো হয়েছে মিউজিয়ামটিকে। জাসেক মাঝে মাঝেই দেওয়ালের দু-একটি ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগল, এই ছবি আগে ছিল না। আগের সরকার টাঙাতে দিত না। তার মধ্যে কোনও কোনওটি নিরীহ ঐতিহাসিক যুদ্ধের আঁকা ছবি। তার মধ্যে নগ্নতা, অশ্লীলতা বা বিমূর্ততা কিছুই নেই। আমি সেরকম একটা ছবি সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম, এই ছবিটার কী দোষ ছিল? এটা টাঙাতে দিত না কেন? পুরোনো ঐতিহাসিক ছবি সম্পর্কে সমাজতান্ত্রিক সরকারের কী আপত্তি থাকতে পারে?

জাসেক হাসতে-হাসতে বলল, এটা কোন যুদ্ধের ছবি জানো? চারশো বছর আগে রাজা প্রথম সিগিসমুণ্ডের আমলে পোলান্ড খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেই সময়ে আমাদের রেনেশাঁস আসে। প্রথম সিগিসমুণ্ডের নেতৃত্বে পোল্যান্ড আর লিথুয়ানিয়া এক হয়ে যায়, আমাদের সামরিক বাহিনী রাশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার প্রতিহত করে। এটা সেই যুদ্ধের ছবি। এটা টাঙাতে দেওয়া হয়নি, কারণ এখনকার রাশিয়ানরা এবং মস্কোপন্থীরা মনে করত, কোনও কালে, এমনকি সুদূর অতীতেও পোল্যান্ডের সঙ্গে রাশিয়ার সংর্ঘর্ষ হয়েছিল, তা দেখানো উচিত নয়। তা হলে সোভিয়েত পোল্যান্ড মৈত্রী নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আসলে পোল্যান্ডের মানুষ যে কখনও সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, সেটাই ও ব্যাটারা দেখাতে চাইত না।

আমি স্তম্ভিত। সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য ইতিহাসের এমন বিকৃতি কিংবা ইতিহাস এমনভাবে মুছে ফেলার চেষ্টারও যে প্রয়োজন আছে, তা কখনও শুনিনি। মার্কস কিংবা লেনিন কখনও এরকম কথা বলেছেন? নিশ্চিত কিছু মাথামোটা লোক এরকম নীতি নির্ধারণ করেছিল। এরাই সেনসারশীপ চাপাতে চাপাতে ক্রমশ একটা কুৎসিত অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। বই ছাপার আগেই সেনসরশিপ, সিনেমা তোলার আগেই সেনসরশিপ। রেডিও, টিভি, খবরের কাগজে শুধু প্রচার আর প্রচার। শিল্পগুণহীন একঘেয়ে প্রচারে মানুষ যে অনেক ভালো জিনিস সম্পর্কেও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে তা এইসব নীতি নির্ধারকরা বোঝে না। দেশের সব মানুষ কি শিশু যে একই কথা বারবার বোঝাতে হবে তাদের? একই ধরনের সাহিত্য, একই ধরনের ছবি কিংবা গান দেওয়া হবে! সোভিয়েত ইউনিয়নের কত ভালো দিক আছে, কিন্তু এখানে অতিরিক্ত সোভিয়েত পক্ষপাতিত্বে অনেক মানুষ সে দেশ সম্পর্কে বিরূপ হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানরা পোলান্ডের ওপর কত অত্যাচার করেছে তা আমরা জানি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এসেছিল পরিত্রাতা হিসেবে। কিন্তু জাসেক এবং আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, নাতসি বাহিনী এবং সোভিয়েত বাহিনীর ওপর এদের সমান রাগ রয়ে গেছে। জাসেক বলল, তার দুই দাদু, মায়ের বাবা এবং বাবার বাবা, দুজনেই গত মহাযুদ্ধে মারা গেছে, একজন রাশিয়ান কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে, অন্যজন জার্মানদের। ওয়ারশ অভ্যুত্থানের সময় নাতসী বাহিনী আড়াই লক্ষ নাগরিককে হত্যা করেছে তা যেমন ক্ষমার অযোগ্য, তেমনি কমিউনিস্ট নয় বলেই তাদের সাহায্যের জন্য সোভিয়েত বাহিনী এগিয়ে আসেনি, এটাও এরা ভুলতে পারে না।

স্টালিন আমলের দর্পের প্রতীক হয়ে আছে ওয়ারশ শহরের মাঝখানে একটা তিরিশতলা বাড়ি। পোলান্ডের প্রতি এটা জোসেফ স্টালিনের উপহার, এর নাম দেওয়া হয়েছিল 'প্যালেস অফ কালচার'। মস্কো শহরে হোটেল ইউক্রাইন আমি দেখেছি, হুবহু তারই অনুরূপ এই বিশাল বাড়িটি ওয়ারশ শহরের চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে একেবারেই বেমানান ও খুবই দৃষ্টিকটু দেখায়। একটা শহরের গঠনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হল কি না তা তোয়াক্কা না করে, এ যেন এক রাজা তাঁর ইচ্ছে মতন একখানা বাড়ি চাপিয়ে দিয়েছেন। বাড়িটি দেখলে জোর জবরদস্তি করে কালচার চাপিয়ে দেওয়ার কথাও মনে হয়। যে-কোনও টুরিস্টের চোখেও বাড়িটি বিসদৃশ লাগে, ওয়ারশ নাগরিকরা এর দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায়। জাসেক-এর মতে এই বাড়িটি এখন ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা উচিত। আমরা বলি, এত বড় একটা বাড়ি ভেঙে নষ্ট করবে কেন, হোটেল-টোটেল বানালেই তো হয়। জাসেক-এর মতন অনেকেই ওই দর্পের আর কোনও চিহ্ন রাখতে চায় না।

এ বাড়িটি নিয়ে অনেক রসিকতা চালু আছে তার মধ্যে একটা এরকম ঃ

বলতে পারো কোন জায়গা থেকে ওয়ারশ শহরের দৃশ্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায়?

হ্যাঁ পারি। এই প্যালেস অফ কালচারের ছাদ থেকে।

কেন? কেন?

কারণ এই একমাত্র জায়গা থেকেই এ বাড়িটা দেখা যায় না।

এই শহরে যাতায়াতের পথে আর একটি বড় বাড়িও চোখে পড়বেই। এটার নাম 'পার্টি হাউজ'। কিছুদিন আগেও এটা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সদর দফতর। এতবড় বাড়িটিকে পার্টির বিলাসিতার চিহ্ন প্রকট। বাড়িটা এখন খাঁ খাঁ করছে। পোলান্ডে এখন কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব নেই, সুতরাং বাড়িটার দাবিদারও কেউ নেই, কেউ আর এখানে ঢোকে না। এখন কী হবে এই বাড়ি নিয়ে? শোনা যাচ্ছে সরকার থেকে কোনও ব্যাংককে ভাড়া দিয়ে দেওয়া হবে।

আগের আমলে সরকারি প্রচারযন্ত্র কত নির্লজ্জ অবস্থায় পৌঁছেছিল, তার একটি কাহিনী শুনলাম প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জানুসির বাড়িতে গিয়ে। জানুসি এখানে বিশেষ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। পোলান্ডের চলচ্চিত্র বিশেষ উন্নত, আমরা আন্দ্রে ওয়াইদার ভক্ত অনেকদিন থেকেই। এখন ওয়াইদা'র পাশাপাশি জানুসির স্থান। শিল্পী জাসেক-এর মতে, ওয়াইদা'র চলচ্চিত্রকে যদি কনসার্টের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তা হলে জানুসির ছবিগুলিকে বলা যেতে পারে চেম্বার মিউজিক।

জানুসি যেখানে থাকেন, সেটা মনে হয় ওয়ারশ'র অভিজাত পাড়া। নিরিবিলি রাস্তা, সুন্দর সুন্দর বাড়ি, রাস্তার মোড়ে মোড়ে আগেকার দিনের গ্যাসের আলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আকুমলের সঙ্গে জানুসির বিশেষ বন্ধুত্ব, আমার সঙ্গেও তাঁর আগে পরিচয় হয়েছে, সেই সুবাদে আমরা তাঁর বাড়িতে এক সন্ধেবেলা চায়ের নেমন্তন্ন পেয়েছিলাম।

জানুসির সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ সময় কাটালেই বেশ একটা মুগ্ধতার সৃষ্টি হয়। এই প্রতিভাবান মানুষটির ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধির প্রাখর্য অনুভব করা যায় অবিলম্বে, তবু তাঁর ব্যবহারে রয়েছে বিনীত ভদ্রতা। বাড়িতে কোনও অতিথি এলে তিনি তাঁদের ছবি তুলে রাখেন, একটা বড় খাতায় অতিথিদের নাম ঠিকানা ও কিছু একটা বক্তব্য লিখে দিতে অনুরোধ করেন। এই ভাবে তাঁর অনেক খাতা জমেছে। তিনি নিজে পৃথিবীর যত দেশে গেছেন, যত মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে, সেইসব জায়গা ও মানুষজনের ছবি তিনি সেঁটে রাখেন আলাদা একটি অ্যালবামে। সেই অ্যালবামটা খুলে তিনি কলকাতা ও আমার ফ্ল্যাটের ছবি দেখিয়ে চমকে দিলেন। জানুসি বললেন, অনেক বই পড়ার মতন, মাঝে মাঝে এই খাতা ও অ্যালবামের পাতা উলটে স্মৃতি-রোমন্থন করাও বেশ আনন্দদায়ক।

জানুসির বাড়িটি যথেষ্ট বড়। তিনি আর একটা ছ'খানা ঘরওয়ালা বাড়ি বানাচ্ছেন, সেই পুরো বাড়িটাই হবে অতিথিশালা। যে-কোনও সময় সেখানে বারোজন অতিথি থাকতে পারবে। অতিথি আপ্যায়ন করা তাঁর বিশেষ শখ। তাঁর মতে, হোটেলে কিংবা কনফারেন্স রুমে মানুষের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় ঠিক মতন জমে না, বাড়িতে এসে কেউ থাকলে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হতে পারে। কতরকম অতিথি যে তার বাড়িতে এসে থেকে যায় তার ইয়ত্তা নেই! (তিনি আমাদেরও থেকে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন!) এই সন্ধেবেলা মস্কো থেকে তাঁর কয়েকজন অতিথি আসবার কথা। কিছুদিন আগে জানুসি মস্কো গিয়েছিলেন, তখন এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। পোল্যান্ডের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের কাহিনি মস্কোতে অনেকটা বিকৃতভাবে পরিবেশিত হয়েছে, সেইজন্য ট্যাক্সি ড্রাইভারটি জানুসিকে হঠাৎ বলেছিল, পোল্যান্ডের লোকেরা অকৃতজ্ঞ! একথা শুনে জানুসি রাগ করেননি, তিনি বলেছিলেন, পোল্যান্ডের অবস্থা নিজের চোখে দেখলে তুমি সব বুঝতে পারবে, তুমি ওয়ারশ-তে চলে এসো, আমার বাড়িতে থাকবে। তোমার কোনও খরচ লাগবে না। লোকটি এই প্রস্তাবে হকচকিয়ে গিয়ে বলেছিল, বিনা পয়সায় ওয়ারশ ঘুরে আসতে পারব? তা হলে আমার স্ত্রীকে...। জানুসি বললেন, তাঁকেও নিয়ে এসো। লোকটি বলল, আমার তিনটি ছেলেমেয়ে...। জানুসি বললেন, তাদেরও। এমনকি তোমার যদি শাশুড়ি থাকেন...

আজ সন্ধেবেলা সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারের সপরিবারে পৌঁছবার কথা।

খানিকক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর জানুসি জানতে চাইলেন, আপনারা কী খাবেন, বলুন! চা, কফি, হুইস্কি, রেড ওয়াইন, হোয়াইট ওয়াইন?

আমি বললাম, কফি, দুধ চিনি ছাড়া!

জানুসি হেসে বললেন, দুধ অবশ্য চাইলেও দিতে পারতাম না। দুধ কোথায় পাব?

জানুসির মতন সচ্ছল ব্যক্তির বাড়িতেও দুধ নেই, এতে বোঝা যায়, ওয়ারশ-তে দুধের অভাব কত প্রকট।

কয়েকদিন আগে বাইরে কোথাও শুটিং করতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনা হয়েছিল, জানুসির পায়ে বেশ চোট লেগেছে, তাঁর বিশ্রাম নেওয়ার কথা, তবু তিনি একটা লাঠি হাতে নিয়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে তার বাড়ির নানান ছবি দেখিয়ে, নিয়ে এলেন চায়ের টেবিলে। চা-কফির সঙ্গে নানারকম নোনতা মিষ্টি খাবারও রয়েছে। এ বাড়িতে থাকেন জানুসি, তাঁর স্ত্রী ও মা। কয়েকজন অন্য অতিথিও রয়েছেন। খাবার টেবিলে অনেক গল্প হতে লাগল, তার মধ্যে জানুসির দাড়ির গল্প বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

কোনও কারণে আমি দাড়ির প্রসঙ্গ তুলেছিলাম, জানুসি তাঁর গালের অল্প অল্প দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, এই দাড়ি আমি কবে থেকে রাখতে শুরু করেছি, শুনবেন? এই দাড়ির সঙ্গে আমাদের বিপ্লবের সম্পর্ক আছে।

জানুসি সলিডারিটির সক্রিয় সমর্থক ছিলেন তা জানি। পূর্বতন সরকার পরিবর্তনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। নতুন সরকার গঠনের সময় জানুসির মন্ত্রিত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, তিনি রাজি হননি। কিন্তু তার সঙ্গে দাড়ির সম্পর্ক?

গত কয়েক দশক ধরে পোলান্ডের প্রচার ব্যবস্থা অতি বিশ্রী অবস্থায় পৌঁছেছিল। রেডিও, টিভিতে শুধু সরকারি প্রচার। বিবেকবান বুদ্ধিজীবীরা কেউ রেডিও টিভির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত না। টিভির খবরে এত বেশি মিথ্যে কথা থাকত যে কেউ তো শুনতোই না, ওই সময় টিভি বন্ধ করে অনেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসত, যাতে প্রতিবেশীরা বোঝে যে টিভির খবর বয়কট করা হয়েছে।

এইরকম একটা সময়ে জানুসি ফিলমের কাজে বিদেশে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকতে থাকতেই তিনি কানাঘুষো শুনলেন যে ফেরার সময় তিনি যখন প্লেন থেকে নামবেন, তখন টিভি ক্যামেরায় তাঁর ছবি তোলা হবে। তাঁর অনেক পুরোনো যে-সব সাক্ষাৎকার ছিল তার থেকে কিছু কিছু ক্লিপিং বাছাই করে, প্লেন থেকে নামার ছবির সঙ্গে জুড়ে টিভিতে প্রচার করা হবে যে জানুসি বিদেশ থেকে ফিরে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

সরকারি প্রচারযন্ত্রে এই ষড়যন্ত্র বানচাল করার জন্য জানুসি বিদেশে বসেই দাড়ি কামানো বন্ধ করে দিলেন। এক মুখ দাড়ি নিয়ে যখন ফিরলেন, তখন তাঁর সেই মুখের সঙ্গে আগের কোনও ছবিই মিলবে না। পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়ে গেলে তখনকার প্রচারমন্ত্রী জানুসিকে একদিন ডেকে জিগ্যেস করলেন, টিভিতে অশংগ্রহণ করতে তোমার এত আপত্তি কেন? জানুসি উত্তর দিলেন, তোমরা একটাও সত্যি কথা বলতে দাও না, সেইজন্যই আপত্তি? মার্শাল ল' তুলে নাও, সেনসরশিপ তুলে নাও, আমাদের সত্যি কথা বলতে দাও, তাহলে নিশ্চয়ই অংশগ্রহণ করব। প্রধানমন্ত্রী তখন মৃদু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বললেন, ঠিক আছে, দাড়ি যখন রেখেছ, তোমার পাশপোর্টের ছবি বদলে এই দাড়িওয়ালা মুখের ছবি বসাতে হবে। তুমি আর দাড়ি কামাতে পারবে না। ভুল করেও যদি দাড়ি কামিয়ে ফেলো, তারপর দেশের বাইরে যেতে গেলে তোমাকে আটকানো হবে!

কাহিনিটি শেষ করে জানুসি হাসতে-হাসতে বললেন, এখন অবশ্য আর কোনও অসুবিধে নেই। এখন দাড়ি কামিয়ে ফেলতে পারি, কিন্তু এই দাড়ির ওপর মায়া পড়ে গেছে!

এরপর আমাদের একটা ব্যালে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল বলে আর বেশিক্ষণ গল্প করা গেল না।

কিন্তু আর একটা ঘটনারও উল্লেখ করা দরকার। আমাদের দলটিতে ওম চৌহান নামে আর এক ভারতীয় ছিলেন। ইনি একজন লন্ডন-প্রবাসী ব্যবসায়ী, আকুমলের পূর্ব পরিচিত। বেশ ধনী ব্যক্তি। পোল্যান্ড এখন পশ্চিম দুনিয়ার দিকে ব্যাবসা-বাণিজ্যের দ্বার খুলে দিয়েছে, সেইজন্য শ্রীযুক্ত চৌহান লন্ডন থেকে এসেছেন ওয়ারশ-তে তাঁর ব্যবসায় কোনও শাখা খোলা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে। এমনকি স্বল্পভাষী ভদ্রলোক, কিছু কিছু বাংলা জানেন, কারণ অল্পবয়েসে কলকাতায় পড়াশুনো করেছেন। জানুসির বাড়িতে পৌঁছবার পর আলাপ-পরিচয় পর্বের সময় জানুসি বাদল বসুর পরিচয় জানলেন, তারপর চৌহানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনিও কি কলকাতার? আপনার সঙ্গে কি আমার দেখা হয়েছিল? শ্রীযুক্ত চৌহান তক্ষুনি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন, তারপর বেশ চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, আপনি আমাকে চেনেন না, তাই না? আপনার সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি? বেশ ভালো কথা!

শ্রীযুক্ত চৌহানের কথার এরকম তীব্রতায় আমরা চমকে উঠলাম। জানুসি বিব্রতভাবে আকুমলের দিকে তাকালেন। আকুমলও লজ্জা পেয়ে বলল, ওম চৌহানের সঙ্গে আপনার লন্ডনে একবার দেখা হয়েছিল, আরও অনেক লোক ছিল তাই আপনার মনে নেই, আমরা একসঙ্গে ডিনার খেয়েছিলাম, উনি কিছু সাহায্য করেছিলেন।

ওম চৌহান আরও উগ্রভাবে বললেন, আপনারা বিখ্যাত লোক, তাই ইচ্ছে মতন অন্যদের ভুলে যেতে পারেন, আমি সেই সময় পাঁচ হাজার পাউন্ডের ওষুধ দান করেছিলাম, পাঁচ হাজার পাউন্ড, তাও আপনার মনে নেই নিশ্চয়ই।

জানুসি বারবার বলতে লাগলেন, অবশ্যই, অবশ্যই। আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমায় ক্ষমা করবেন।

ওম চৌহান আবার বললেন, পাঁচ হাজার পাউন্ড দান করেছি, কম নয়, আপনার মনে রাখা উচিত ছিল...

জানুসি আমাদের দিকে তাকিয়ে কাতরভাবে বললেন, আমারই দোষ, পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরতে হয়, অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, সব মুখ মনে না রাখতে পারাটা আমার অন্যায়।

জানুসির প্রতি এরকম আক্রমণে আমরা মর্মাহত বোধ করছিলাম। এরকম ভুল তো হতেই পারে, আমাদের সকলেরই হয়। পোল্যান্ডের যখন খুবই দুঃসময় চলছিল, তখন জানুসি বিভিন্ন দেশে খাদ্য ও ওষুধপত্র সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছিলেন। সেই সময় আকুমলের দৌত্যে লন্ডনের ব্যবসায়ী চৌহান কিছু ওষুধ দান করেছিলেন, তাঁর ওষুধের ব্যাবসা। পাঁচ হাজার পাউন্ডের ওষুধ তিনি জানুসিকে দান করেননি। করেছিলেন পোল্যান্ডের মানুষকে। তবু সেই দানের কথা তিনি এতবার উল্লেখ করতে লাগলেন যে লজ্জায় আমাদের মাথা কাটা যেতে লাগল। দান তাকেই বলে, যার বিনিময়ে কোনও প্রত্যাশা থাকে না। তিনিই প্রকৃত দাতা, যিনি আত্মগোপন করে দান করেন। এইরকমই ভারতীয় ধারণা। সেসব ধারণা কবে চুকে বুকে গেছে। এখন লোকে দান করে আত্মপ্রচার কিংবা ইনকাম ট্যাক্স বাঁচাবার জন্য! বুদ্ধ-গান্ধির দেশের মানুষ নাকি শান্তিপ্রিয় জাতি, আজ সারা ভারত জুড়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা দেখলে তা কে বলবে? ভারতীয়দের কি ভদ্রতা ও সৌজন্যর খ্যাতি ছিল? আজ আর তা বোঝার উপায় নেই।

আকুমল আমাদের জন্য গ্র্যান্ড থিয়েটারে একটি ব্যালের টিকিট কেটে রেখেছিল। এসব টিকিট যেমন দামি, তেমনই দুষ্প্রাপ্য। ওম চৌহানদের মতন মানুষদের ঠিক বিপরীত চরিত্র আকুমল। যত উপার্জন তার চেয়েও বেশি ব্যয় করাই যেন আকুমলের ব্রত। অন্যদের জন্য খরচের কোনও প্রসঙ্গই সে তুলতে দেয় না। সকলের পীড়াপীড়িতে তার একটাই উত্তর। আমার পয়সা ফুরিয়ে গেলে আমি চাইব।

আকুমল বিভিন্ন শিল্পীকে জনসমক্ষে তুলে ধরে। আপাতত সে পোল্যান্ডের তরুণ শিল্পীদের লন্ডনে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করার চেষ্টায় মেতে আছে। পোল্যান্ডে যে যাওয়া-আসা করছে বহুবার, এ দেশের অনেক কিছু সম্পর্কেই সে উচ্ছ্বসিত। ওয়ারশ শহরটিকে সে এত ভালোবেসে ফেলেছে যে তার মতে এ শহর প্যারিসের সঙ্গে তুলনীয়। এ বিষয়ে তার সঙ্গে আমরা একমত হতে পারি না অবশ্য। প্যারিসের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোনও শহরেরই তুলনা চলে না। এমনকি বুডাপেস্ট নগরও দৃশ্যত ওয়ার'শর চেয়ে রূপবান। তবে, ওয়ারশ'রও এক ধরনের সাদামাটা সৌন্দর্য আছে। কোপারনিকাস ও সপ্যাঁর এই শহর, বিজ্ঞান-সঙ্গীত-শিল্প-সাহিত্য-চলচিচত্র নিয়ে অতি জীবন্ত।

আকুমলের মতে, এখানকার গ্র্যান্ড থিয়েটারও বিশ্বে অতুলনীয়। এটাও ঠিক মেনে নেওয়া যায় না, এর চেয়ে আরও বড়, আরও সুসজ্জিত থিয়েটার হল আমরা দেখেছি। পূর্ব ইউরোপে এমন থিয়েটার হল আর নেই শুনেছি। আমাদের ভারতে নেই, জাপানের কথা জানি না, এশিয়ার অন্য কোনও দেশেও নেই। আরও বিস্ময়ের কথা এই যে, এই বিশাল, জাঁকজমকপূর্ণ থিয়েটার হলটিও জার্মানরা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল, পোল্যান্ডের মানুষ অবিকল আগের মতন গড়ে তুলেছে।

ব্যালে বলতেই আমাদের মনে পড়ে ধপধপে সাদা পোশাক পরা, পুতুল-পুতুল নারী-পুরুষদের রূপকথা আশ্রয়ী নাচ, সমগ্র মঞ্চের দৃশ্যটা স্বপ্নের মতন। এটা কিন্তু তা নয়, এই ব্যালেটির নাম 'ফাউস্ট গোজ রক', একেবারে অত্যাধুনিক, পাত্র-পাত্রীদের সাজ-পোশাক নানা রঙে উদ্ভট, ব্যাক ড্রপে কখনও আগুন জ্বলে উঠছে, কখনও ধোঁয়ায় সব কিছু ঢেকে যাচ্ছে। সঙ্গীত একেবারে হার্ড রক। কাহিনির পারম্পর্য রক্ষার কোনও চেষ্টাই নেই। পালাটি পুরোপুরি অ্যাবস্ট্র্যাকট। বছর কয়েক আগে এখানে এরকম প্রোডাকশান সম্ভব ছিল না। সোসালিস্ট রিয়েলিজম-এর সঙ্গে অ্যাবস্ট্র্যাকশানের কেন যেন একটা বিরোধ ছিল। কিন্তু সব শিল্পই অ্যাবস্ট্র্যাকশানে যেতে চায়। এই যে এখানে অ্যাবস্ট্রাক্ট ব্যালেটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, মার্কসীয় নীতিবাগীশরা কেন একে সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর মনে করত, তা আমি বুঝতে পারি না। এখন কয়েক হাজার মানুষ গভীর মনোনিবেশে দেখছে, এতে কার কী ক্ষতি হচ্ছে? এর বদলে একটা প্রচারমূলক, শ্লোগানমুখর অনুষ্ঠান দেখলেই বা কী উপকার হত?

অনেক রাত্তিরে, শহরের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে আমরা একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গেলাম। ওয়ারশ শহরে গুণ্ডামি ডাকাতির মতন উপদ্রব বিশেষ নেই, তবে চুরি হয়, গাড়ি বেশ চুরি হয়, চোর বিষয়ে সাবধানতা দেখেছি। এত রাত্রেও রেস্তোরাঁটি জমজমাট। অনেক রকম খাদ্যই পাওয়া যায়। আমি নতুন খাদ্য নিয়ে পরীক্ষা করি। বাদল পছন্দমতন একটা বড় মাছ পেয়ে গেল, খুব সুস্বাদু। আকুমল নিরামিষাশী, তার জন্য কোনও পদই নেই। কিন্তু আকুমল ছাড়বার পাত্র নয়, অতি ব্যস্ত ম্যানেজার-মহিলাকে ডেকে সে নিরামিষ খাদ্যের মাহাত্ম্য বোঝাতে লাগল, শেষ পর্যন্ত একজন রাঁধুনীকে ডেকে আকুমল বিশেষ নিরামিষ রান্নার প্রণালী বর্ণনা করার পর সেইরকমই খাবার রান্না হয়ে এল তার জন্য। ম্যানেজার জানাল যে, এখন থেকে এই পদটি তাদের রেস্তোরাঁর মিনিউতে স্থান পাবে, এর নাম হবে ইন্ডিয়ান ভেজিটেরিয়ান আকুমল!

একটু দূরে কয়েকটা টেবিল জুড়ে বসেছে একটা বিয়ের পার্টি। সুন্দরী পরির মতন সাজপোশাক করা কনেটি চুমু খাচ্ছে অনেকের গালে। এক সময় তারা একটা গান গেয়ে উঠল, অন্যান্য টেবিল থেকে অনেকে গলা মেলাল।

শিল্পী জাসেকও সেই গান গাইতে-গাইতে বলল, আগেকার সঙ্গে এখনকার কী তফাত জানো? এরকম একটা খোলামেলা পরিবেশের অভাব ছিল। মার্শাল ল' জারি থাকলে সব সময়েই মানুষ গম্ভীর, থমথমে হয়ে থাকে। গলা খুলে হাসতে কিংবা গান গাইতেও লজ্জা পায়। কিন্তু ইচ্ছে মতন চলাফেরার স্বাধীনতা থাকবে না, ইচ্ছেমতন হাসি-ঠাট্টা ইয়ারকির স্বাধীনতা থাকবে না, এরকম পরিবেশ মানুষ বেশিদিন সহ্য করতে পারে না।

১৪

শ্রীমতী এলজবিয়েটা ভালটারোভা'র সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল কলকাতাতেই। এই তরুণটি বাংলা সাহিত্য ও ভারততত্ব নিয়ে পড়াশুনো করতে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। মাঝখানে একদিন কলকাতায় এসে অতি শিশুকন্যা ও স্বামীকে নিয়ে আমার বাড়িতে এক সন্ধ্যায় বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে গিয়েছিলেন। সে প্রায় বছর দশেক আগের কথা, তবু মনে আছে এই জন্য যে পোল্যান্ডের এই তরুণীটি বাংলা শব্দগুলি উচ্চারণ করছিলেন খুব সযত্নে এবং তাঁর পরনে ছিল একটা আগুন-লালবর্ণ শাড়ি। দেশে ফিরে এলজবিয়েটা আমাকে দু-তিনবার চিঠিও দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি আর যোগাযোগ রাখিনি, এখানে আসার আগে তাঁকে কোনও খবরও দিইনি, কারণ, এই ধরনের সুচারু কাজকর্ম করা আমার স্বভাবে নেই। ওয়ারশ পৌঁছবার দ্বিতীয় দিনে আকুমল যখন বলল আজ রাত্তিরে অধ্যাপিকা এলজবিয়েটা ভালটারোভার বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন, তখন আমি চমকে উঠলাম। আকুমল আরও বলল, উনি আপনাকে চেনেন, আপনি আসছেন এই খবর আমার মুখে শুনে তিনি আজ সন্ধেটি বুক করেছেন। যেতে হবেই। আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম।

উপহার হিসেবে কিছু ফুল নিয়ে যাওয়ার জন্য আকুমল আমাদের নিয়ে গেল একটা দোকানে। রুমানিয়াতে যেমন সর্বত্র সব দোকানের সামনে লাইন দেখেছি, ওয়ারশতে সে রকম চোখে পড়ে না। এখানে খাদ্যদ্রব্যের অভাব প্রকট নয়। কিন্তু ফুলের দোকানে লাইন। নিছক ফুল নয়, ফুলকে সাজাবার কায়দা পোল্যান্ডে একটি উচ্চাঙ্গের আর্টের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এমনভাবে এই সব দোকানে বিভিন্ন রঙের ফুলের গুচ্ছ বেঁধে দেয়, মনে হয় যেন ছবি। ফুল উপহার দেওয়া এখানে জাতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। সোভিয়েত ইউনিয়নেও এমন দেখেছি। আমেরিকাতে ফুলের এত কদর নেই, প্রাচ্য দেশেও তেমন নেই। আমাদের দেশে মৃতদেহের ওপর ফুলের স্তূপের অপচয় দেখলে গা জ্বালা করে।

যেতে হবে বেশ দূরে। আকুমল আগে থেকে একটি ট্যাক্সি ঠিক করে রেখেছিল। আকুমল এ দেশে অনেকবার এসেছে, ট্যাক্সি ড্রাইভারটি তার পূর্ব পরিচিত, বন্ধু পর্যায়ের। তাঁর নাম ইভান, তিনি একজন ভূতপূর্ব মাইক্রোবায়োলজিস্ট, তাঁর স্ত্রী একজন সাইকোলজিস্ট। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের এমন বিদ্যাবত্তার পরিচয় জেনে কিন্তু আমার মনে শ্রদ্ধা জাগে না, বরং বিরক্ত বোধ করি, শিক্ষার এই অপচয় আমার সহ্য হয় না। হাঙ্গেরিতেও এমন দেখেছি। বেশি টাকা রোজগারের জন্যই এঁরা নিজেদের পেশা ছেড়ে ট্যাক্সি চালাচ্ছেন তা বুঝি। কিন্তু একটা দেশের শাসনব্যবস্থা কেন এমন হবে, যাতে যারা উচ্চ শিক্ষা পেয়েছে, তারা তা প্রয়োগ করতে পারবে না?

ছোটোর মধ্যেও এলজবিয়েটার ফ্ল্যাটটি বেশ ছিমছাম সুন্দর। এলজবিয়েটার স্বামী একজন শিল্পী, মাটি দিয়ে তিনি এক ধরনের ভাস্কর্য নির্মাণ করছেন, যা একেবারে নতুন ধরনের। শান্তিনিকেতনে এসে এক বাঙালি শিল্পীর কাছে তিনি মাটির কাজ শিখেছিলেন, তার সঙ্গে নিজস্ব রীতিতে তিনি ভারি চমৎকার একটা ধারা তৈরি করেছেন। এই বিভিন্ন মৃত্তিকা-ভাস্কর্য দিয়ে ঘরগুলি সাজানো বলে অন্যরকম একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

এলজবিয়েটার বয়েস বেশি নয়, যখন তিনি বাংলা বলেন, তখন তাঁর কণ্ঠস্বরটি একেবারে বাচ্চা মেয়ের মতন শোনায়। তিনি সত্যজিৎ রায়ের বই পোলিশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন, এখন করছেন মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হন্যতে'। বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর কৌতূহলের অন্ত নেই। যে-হেতু বইপত্র বেশি পান না, তাই তিনি আমাকে নানান প্রশ্ন করছিলেন। এখানে যে-কোনও আলোচনায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালা-বদলের প্রসঙ্গ আসবেই। অন্যরা সেই আলোচনায় মেতে ওঠে। এলজবিয়েটার রাজনীতিতে তেমন আগ্রহ নেই, শুধু দু-একবার বললেন, ওঃ, যা সব দিন গেছে না! সব চুকেবুকে গেছে, বেঁচেছি! এখন প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিতে পারছি, এইটাই বড় কথা। এখন ইচ্ছে মতন কাজ করতে পারব।

এদিককার বিভিন্ন দেশে এ রকম কথা অনেকবার শুনতে হয়েছে। যতবার শুনি, আমার একটু একটু মন খারাপ লাগে। সাম্যবাদ বা সমাজবাদ, যার প্রতিশ্রুতি ছিল সমস্ত মানুষের ঐক্য এবং সমান অধিকার, সেখানেও কেন সামান্য কিছু লোক গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষকে প্রায় একটা বন্দিদশায় রেখেছিল, কেন একটা দম বন্ধ আবহাওয়ার সৃষ্টি করছিল? এই আদর্শ-বিচ্যুতির মূল কোথায়? মানুষের অন্তর্নিহিত বৈপরীত্যে?

পরদিন আমরা দেখতে গেলাম ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারততত্ব বিভাগ। এখানে হিন্দি ও বাংলার ক্লাস হয়। ভারততত্ব বিভাগের প্রধান হলেন অধ্যাপক বিরস্কি, যিনি অবিলম্বেই দিল্লিতে পোল্যান্ডের দূতাবাসের কালচারাল ফার্স্ট সেক্রেটারি হয়ে যাচ্ছেন। এলজবিয়েটা বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা, নানা কলেজের অনেকগুলি ছাত্র-ছাত্রী। আমরা ক্লাসরুমে গিয়ে ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ বসে আলাপ-পরিচয়, সাহিত্য বিষয়ে প্রশ্নোত্তর, কবিতা পাঠে অংশগ্রহণ করলাম। এমন নির্মল আনন্দ বহুদিন পাইনি। এতদূর বিদেশে বাংলা ভাষা সম্পর্কে এত মানুষের আগ্রহ দেখলে আমাদের তো আনন্দ হবেই। আমার মাঝে-মাঝে বুখারেস্টের অমিতা বসুর কথা মনে পড়ছিল। সেখানে বাংলা-হিন্দির রেষারেষিতে দুটি বিভাগই উঠে গেল। এখানে সে রকম কোনও পরিবেশ নেই। পোল্যান্ডের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেকেই ভারত সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী।

অনেককাল আগে আমি হিরন্ময় ঘোষাল নামে একজন লেখকের 'কুলটুর কামপফ' নামে একটি বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। হিটলারের রচনা 'মাইন কামফপ'-এর ঠাট্টায় বইটির নাম, অর্থাৎ 'সাস্কৃতিক লড়াই', আসলে সেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতিকথা। ভাষা চমৎকার, দারুণ লেখা। সে বই এখন আর বোধহয় পাওয়া যায় না। বইটা পড়ে আমি শুধু জানতাম যে হিরন্ময় ঘোষাল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে পোল্যান্ডে চাকরি করতেন, যুদ্ধের ডামাডোলে তাঁকে পালাতে হয়। এখানে এসে জানলাম, তিনিই ওয়ারশ বিদ্যালয়ে প্রথম বাংলা বিভাগ চালু করেন, তাঁর স্মৃতিতে অফিস-কক্ষটির নাম দেওয়া হয়েছে 'ঘোষাল রুম।'

পোল্যান্ডের আর একজন লেখকও আমার বন্ধু। তাঁর নাম ক্রিস্তফ জারজেস্কি। ইনি ঠিক লেখক নন, অনুবাদক। এক সময় আমেরিকার আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্রিস্তফ আর আমি শুধু সতীর্থ নয়, ছিলাম একই বাড়িতে প্রতিবেশী। আমার বান্ধবী মার্গারিটের সঙ্গে ক্রিস্তফেরও বন্ধুত্ব ছিল, ক্রিস্তফের ঘরে আমরা অনেক আড্ডা দিয়েছি। এখানে খোঁজ করে জানলাম, ক্রিস্তফ শহরে নেই, সে আমেরিকা চলে গেছে। সেখানেই সে থাকবে। আমেরিকার মোহিনী মায়া কতজনকে যে টানে! পোল্যান্ডে এসে অবশ্য ডলার-লোভীদের ফিসফিসানি তেমন শুনতে পাইনি পথেঘাটে। অথচ আগেকার ভ্রমণকারীরা সকলেই 'ডলার, ডলার, চেইঞ্জ মানি!' এই ফিসফিসানি ও দালালদের উৎপাতের কথা লিখে গেছেন। এখন তা বন্ধ দেখে প্রথম একটু অবাক হয়েছিলাম, পরে জানলাম, নতুন সরকার ব্ল্যাক মার্কেট রেটটাকেই মেনে নিয়ে বাস্তব অবস্থার স্বীকৃতি দিয়েছেন। অর্থাৎ এখন ব্যাঙ্ক থেকেই ডলার ভাঙিয়ে অনেক বেশি জলোটি পাওয়া যায়। কিছু কিছু দালাল এখনও রাস্তায় ঘোরাফেরা করে, বোধহয় পুরোনো অভ্যেসবশত, কিন্তু তাদের কেউ আর পাত্তা দেয় না।

সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ মোটামুটি একই রকম। কৃষির বদলে যন্ত্রপাতি উৎপাদনের দিকে অত্যধিক ঝোঁক, বিশ্বের বাজারে সেগুলি রফতানি করতে গিয়ে অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে সব সময় পাল্লা দিতে পারেনি। পশ্চিমের বাজারে চাহিদা কমে গেলে উৎপন্ন দ্রব্যগুলি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কল-কারখানাগুলির সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিতে হয়েছে বৈদেশিক ব্যাংক থেকে, পোলন্ডে এক সময় এই ঋণের বোঝা দাঁড়িয়েছিল সাতাশ বিলিয়ান ডলার। তখন সেই ঋণ শোধ দেওয়ার জন্য দেশের খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্য বিক্রি করতে হয়েছে বাইরে, তার ফলে দেশের মানুষের পেটে টান পড়েছে। টাকার অভাবে কল-কারখানাগুলির আধুনিকীকরণও হয়নি, তাতে সেগুলি রুগ্ন হয়ে পড়েছে একে একে। জীবনযাত্রার মান নেমে যাওয়ায় ক্ষোভ জমেছে মানুষের মনে। এরই মধ্যে শ্রমিকদের মধ্য থেকে সলিডারিটির উত্থান হওয়ায় তা সর্বশ্রেণির মানুষের সমর্থন পায়।

শাসকদল বদলের পর পোল্যান্ডের মানুষ যেন অনেককাল পরে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। এর মূলে যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি পুরোপুরি অবিশ্বাস রয়েছে তা হয়তো নয়। মূল কারণ বোধহয় তীব্র স্বাজাত্যাভিমান। সোভিয়েত ইউনিয়নের তাঁবেদারি থেকে মুক্তিই যেন বড় কথা। পৃথিবীর সর্বত্রই এরকম একটা মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী আর মিলিত হয়ে থাকতে চাইছে না, বড় দেশগুলি টুকরো টুকরো হতে চলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে এই বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবণতা, যেমন আমাদের ভারতেও। যুক্তি থাক বা না থাক, পৃথিবীর সমস্ত ভাষার মানুষই যেন নিজস্ব খালিস্থান চায়। বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব নিছক আজগুবি ধারণা?

এই স্বাধীনতাবোধের মধ্যে এমনই জাদু আছে, যা কিছুদিনের জন্য অনেক অভাব-অভিযোগও ভুলিয়ে দেয়। পোল্যান্ডের অনেক কিছুর অভাব আছে, ভবিষ্যতে অর্থনীতি কীভাবে চাঙ্গা হবে তা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছে, কিন্তু বর্তমানের অনটন সবাই স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছে, কারুর মুখে বিরক্ত ভাব নেই, যেমন দেখেছি, রুমানিয়ায়। ওয়ারশ'র জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক ও সুশৃঙ্খল। ক্ষমতা বদলের সময় এখানে রক্তপাত হয়নি, তাই আর যখন-তখন হিংসা কিংবা অস্ত্র ঝিলিক দেয় না।

আকুমলের সঙ্গে আমাদের রোজ কোপারনিকাসের মূর্তির পাদদেশে দেখা হয়। তারপর আমরা টো টো করে ঘুরি, দেখা করি বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে। একদিন গেলাম চিটেলনিক নামে এক প্রকাশন সংস্থায়। চিটেলনিকের বেশ সুনাম আছে প্রকাশক হিসেবে। আকুমলের লেখা একটি ছোটদের বই এঁরা প্রকাশ করছেন। এই সংস্থার প্রধান জেকফি সিটো'র সঙ্গে আলোচনা হল অনেকক্ষণ। ভারতের অন্যতম মুখ্য প্রকাশক হিসেবে বাদল বসু অনেক তথ্য বিনিময় করলেন তাঁর সঙ্গে। জেকফি সিটো নিজে একজন নাট্যকার, শেকসপিয়রের অনেক নাটক অনুবাদ করেছেন। তিনি সম্প্রতি এই সংস্থার ভার নিয়েছেন, অনেক ধরনের বই প্রকাশের পরিকল্পনা আছে তাঁর। কিন্তু কাগজের অভাবে ছাপা শুরু করা যাচ্ছে না। কাগজের অভাবের জন্যও তিনি খুব ক্ষুব্ধ নন, বললেন, নতুন সরকারি নীতি এখনও ঠিক মতন গড়ে ওঠেনি, তাই এই সময়টা কিছুদিন তো অসুবিধে থাকবেই।

অনেকের মুখেই এরকম কথা শুনি, তবু মনে প্রশ্ন জাগে, এইসব দেশগুলির ভবিষ্যৎ রূপ কী হবে? আপাতত সকলে গণতান্ত্রিক অধিকার, অবাধ ভোট, বিরোধী দল গড়ার স্বাধীনতা পেয়েই খুশি। এরই নাম স্বাধীনতা। কিন্তু গণতন্ত্রে ফিরে এসে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সব কিছুই কি বর্জন করা হবে? মানুষের ইতিহাসে গণতন্ত্রের পরবর্তী ধাপই কি সমাজতন্ত্র নয়? সকলের স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করার অধিকারের পরেই তো আসে সকলের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবিকার সমান সুযোগ। ইতিহাস কি এক পদক্ষেপ সামনে ফেলে আবার পিছিয়ে আসে?

জানুসির সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, একদলীয় শাসনে কিছু কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে সমাজতন্ত্রের বিকৃতি ঘটেছে, সাধারণ মানুষের ওপর জোর-জবরদস্তি খাটিয়ে, ব্যক্তি-মানুষকে অগ্রাহ্য করে, শিল্প-সাহিত্যের স্বাভাবিক বিকাশ রোধ করার জন্য অনেক নিয়ম-কানুন চাপিয়ে সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্যটাই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তা হলেও সমাজতন্ত্রের আদর্শটিকে কি ব্যর্থ বলা যায়? ভুল প্রয়োগে কি মূল বিষয়টিকে নস্যাৎ করা চলে? সমাজতন্ত্র নিশ্চয়ই অন্য কোনও রূপ নিয়ে ফিরে আসবে।

জানুসি জিগ্যেস করেছিলেন, কী রূপ?

আমি বলেছিলাম, তা ঠিক জানি না। নিশ্চিত কোনও পরিচ্ছন্ন রূপ। সর্বজনগ্রাহ্য কোনও মানবিক রূপ, সোসালিজম উইথ এ হিউম্যান ফেস।

জানুসি ঈষৎ বিদ্রুপের সুরে বলেছিলেন, হিউম্যান ফেস-এর তো নানারকম মুখোশও হয়। চমৎকার সব মুখোশ। আবার সুযোগ দিলেই ওরা মানব দরদীর মুখোশ পরে এসে ক্ষমতা দখল করে যথেচ্ছাচার চালাবে। স্টালিনের আমলে তাকেও তো মহান আদর্শবাদী বলা হত, কিন্তু সেই স্টালিন পাঁচ কোটি মানুষকে হত্যা করিয়েছে।

এইসব দেশে এখন সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রতি তুলনা ও তর্ক-বিতর্ক সব জায়গায় চলছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিদারুণ ক্ষতচিহ্নগুলি এখনও চতুর্দিকে ছড়ানো বলে সবাই গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার পক্ষে। পরপর এতগুলি দেশ সমাজতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করল, তার কারণ সর্বত্রই এই একই নজির। এক পার্টির শাসনে পার্টি সদস্যরা হয়ে যায় সর্বেসর্বা, তারা অনেকরকম সুযোগ-সুবিধার অধিকারী, অন্যরা বঞ্চিত হয় হোক। পার্টির উঁচু মহলের কর্তারা আজীবন ক্ষমতা দখল করে থাকে, তাদের নড়ানো যায় না, শ্রমিকরা পায় না কল-কারখানার নীতি নির্ধারণে কোনও ভূমিকা, যুবসমাজ পায় না সমাজ পরিচালনার কোনও অধিকার। উঁচু মহলের কর্তারা এমনকি ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাজা-মহারাজার মতন বাড়িয়ে গেলেও বাধা দেওয়ার কোনও উপায় নেই। হো-চি-মিন-এর মতন আদর্শ নেতা যেন নিছক ব্যতিক্রম, বাকি সকলেই গোপনে গোপনে বিলাসী ও ভোগী। শুধু চাউসেস্কুকে একা দোষ দেওয়া হবে কেন, আরও অনেকের এই স্বরূপ এখন উদঘাটিত।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন রাষ্ট্রীয়করণের ফলে কেউই আন্তরিক শ্রম দিতে চায় না। প্রতিযোগিতা নেই বলে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার অধিকার চলে যাওয়ায়, সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের সম্পত্তিকে আপন মনে করে না। প্রতিযোগিতা মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি, নারী-পুরুষের প্রেমের সম্পর্কের মতনই, ভূমির ওপর আকর্ষণও অতি ব্যক্তিগত। সূচ্যগ্র মেদিনী আজও স্বেচ্ছায় ছাড়তে চায় না কেউ।

অর্ধ শতাব্দী ধরে সমাজতন্ত্রের পরীক্ষাতে দেশ ও জাতির সীমা মুছে দেওয়া গেল না। এমনকী সমাজতন্ত্রের বর্ণবৈষ্যমও কি ঘোচানো গেছে? দিকে দিকে ফুঁসে উঠেছে বিচ্ছিন্নতাবাদ। সম্পূর্ণ শোষণমুক্ত, শ্রেণিহীন সমাজ কি শুধুই একটা সুন্দর স্বপ্ন? ইউটোপিয়া? একে বাস্তবে সার্থক করার ক্ষমতা মানুষের নেই? মানুষের চরিত্রের অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য, সমভ্রাতৃত্ব ও স্বার্থপরতার লড়াই চলতেই থাকবে?

বয়স্ক-নেতৃত্ব সুবিধাবাদকে আঁকড়ে ধরে, তারা কথার ফুলঝুরি দিয়ে সাধারণ মানুষের মন ভোলায়, মঞ্চের ওপর উদ্দীপ্ত ভাষণের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের কোনও মিল থাকে না, তাদের নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার লালসা আর সব কিছুকে তুচ্ছ করে দেয়। কিন্তু কৈশোর-তারুণ্যের সময় অনেকটাই খাঁটি আদর্শবাদী থাকে। আদর্শের জন্য তারা যে-কোনও মুহূর্তে জীবন দিতেও ইতস্তত করে না। যে-বয়সে জীবন সবচেয়ে মূল্যবান, সেই বয়েসেই মানুষ মাথা উঁচু করে মৃত্যুর দিকে যেতে পারে। সারা দেশে অনাচার, বৈষম্য ও দুর্নীতি দেখে ফুঁসে ওঠে তরুণ সমাজ, একটা বিপ্লবের ডাক শুনলে তারা সব তুচ্ছ করে বেরিয়ে আসে, নিজেদের প্রাণের বিনিময়েও বিপ্লব সফল করতে চায়। কিন্তু বিপ্লব সফল হলে তারা নতুন শাসনভার তুলে দেবে তাদেরই হাতে, যারা আবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সাধারণ মানুষদের স্তোকবাক্যে ভোলাবে? বিপ্লব যারা সফল করে আর বিপ্লবের পরবর্তীকালে যারা দেশ গড়ার ভার নেয়, এদের চরিত্রগত একটা তফাত এসে যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। এই যদি হয় বিপ্লবের পরিণাম, তা হলে পরবর্তীকালের তরুণরা কোন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখবে?

পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে এখন আর বিপ্লব বলা হচ্ছে না, যে-অভ্যুত্থানের ফলে সেই ব্যবস্থার পতন হল, তাকেই এখন বলা হচ্ছে বিপ্লব। এটা একটা নিয়তির পরিহাস নয়? যতবার এই বিপ্লব শব্দটি শুনেছি, আমার কানে খট করে লেগেছে। ইরানে যখন রাজতন্ত্র সরিয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মৌলবাদের, তাকেও বলা হয়েছিল বিপ্লব!

গণতন্ত্রই বা মানুষকে কতখানি মুক্তি দিতে পারে? সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে অসংখ্য ছিদ্র। নির্বাচন ও ভোটে জিতে যারা ক্ষমতা হাতে পায়, তারা যদি সত্যিই দেশের সমস্ত মানুষের ইচ্ছ-অনিচ্ছার মূল্য দেয়! ভোটে জেতার জন্য সর্বত্রই চলে টাকার খেলা এবং গায়ের জোর, সুতরাং যারা জয়ী হয়, তারাই যে যোগ্যতম, তা কিছুতেই বলা যায় না। ব্রিটেন এবং আমেরিকা গণতন্ত্রের গর্ব করে, কিন্তু ওইসব দেশের শাসকরা যখন একটা আগ্রাসী যুদ্ধ বাধিয়ে দেয় তখন কি তারা দেশের মানুষের মতামতের তোয়াক্কা করে? তারা চিন্তার স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতার ধ্বজা তুলে ধরলেও যুদ্ধের প্রকৃত খবর জানতে দেয় না দেশবাসীকে, মিথ্যে খবর জানাতে দ্বিধা করে না। যুদ্ধের সময় পরিকল্পিতভাবে দেশের মধ্যে কুৎসিত রকমের উগ্র দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা হয়, ছড়ানো হয় অন্য দেশের প্রতি ঘৃণা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যখন প্রকাশ্যে বলেন যে, তিনি ইরাকের প্রেসিডেন্টের মৃত্যু চান, তখন মনে হয় পৃথিবী কি সত্যিই সভ্য হয়েছে? এই কি সভ্যতার নমুনা? তা হলে বর্বরতা কাকে বলে?

আমাদের ভারতবর্ষে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় আমরা কী পেয়েছি? দিন দিন বেড়ে চলেছে গণতন্ত্রের ব্যভিচার। এক রকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন হয়, শাসনভার হাতে পেলেই তা তুচ্ছ হয়ে যায়। একই দল বিরোধী পক্ষে থাকলে বলে, হরতাল ডাকো, শাসনক্ষমতা পেলে বলে, হরতাল ভাঙো! নির্বাচিত হওয়ার পর আজ যে বিরোধী পক্ষে কাল সে সরকার পক্ষে। নীতির কোনও বালাই নেই। যে দল গতকাল বৃহৎ ব্যবসায়ীগোষ্ঠীকে শোষক ও শ্রেণিশত্রু বলেছে, আজ সে তাদেরই সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। আমাদের গণতন্ত্র বাক-স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অথচ দেশের শতকরা ষাটজন মানুষকেই অশিক্ষিত রেখেছে। ধর্ম-নিরপেক্ষতার নীতি কাগজে-কলমে গ্রহণ করা হলেও এত বছরের মধ্যে সাধারণ মানুষকে বোঝানোই হল না ধর্ম-নিরপেক্ষতা কাকে বলে।

আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে, আধা মফঃস্বলে আমি ঘুরেছি অনেক। আমি দেখেছি বাঁধের ওপর বসে থাকা বিষণ্ণ মানুষ, যার কোনও কাজ নেই, পেটে ভাত নেই। দেখেছি খরায় বিবর্ণ ফসলের খেতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিমর্ষ চাষিকে। বস্তির ধারে ছোট ছোট বাচ্চারা খেলা করে ধুলোর মধ্যে। শহরের চৌরাস্তায় গাড়িগুলো থামলে শিশু কোলে নিয়ে ভিক্ষে চাইতে আসে জননী। পূরীষের পাত্র মাথায় করে নিয়ে যায় হরিজন। এরা যেন অনন্তকালের স্রোতে এক একটি বিন্দু। কোনও পরিবর্তন নেই। আমাদের শৈশবে যেমন শিশু-কোলে জননীকে ভিক্ষে করতে দেখেছি, আজও তাই দেখছি। গণতন্ত্র এই শিশু ও তার জননীকে মাথার ওপর একটা আচ্ছাদন দিতে পারেনি, দিতে পারেনি একটা সম্মানজনক জীবিকা। কোনও শিল্পী হয়তো সেই ভিখারিণীর মর্মন্তুদ ছবি আঁকেন, তার জন্য বাহবা পান, লেখা হয় কবিতা, মঞ্চস্থ হয় নাটক, তবু চৌরাস্তার মোড়ে শিশুকোলে জননীকে দেখতে পাওয়া যাবেই। ছেলেবেলায় রাস্তার মুচিকে ঠিক যে-অবস্থায় যে পোশাকে বসে থাকতে দেখতাম, এখনও তারা ঠিক সেরকমই রয়েছে। বাড়িতে ধাঙড়েরা আসে খালি পায়ে, নেংটি পরে, আমাদের ঠাকুরদারা যেমন দেখেছিলেন, আমরাও সে রকমই দেখছি। প্রতিদিন যে-মানুষটি আসে তার নামও আমরা জানি না, ওরা সবাই ধাঙড় বা মেথর। আফ্রিকার কেনিয়া শহরে আমি জুতো-পায়ে মেথর দেখেছি, পরনে প্যান্ট-শার্ট, আমাদের এখানকার যে-কোনও ধনী কিংবা সাম্যবাদীর বাড়ির মেথরের একইরকম চেহারা। কাশী শহরে ভিখারির লাইনের মধ্যে এক বৃদ্ধকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম, তার মুখে অজস্র আঁকিবুকি, সামনে হাত পেতে বসে সে ঘুমে ঢুলছে। আমার মনে হয়েছিল, ওই ভিখারির বয়েস আড়াই হাজার বছর, গৌতম বুদ্ধ ওকে যেমন দেখেছিলেন, আমরাও সেই অবস্থাতেই দেখছি। কিছুই বদলাতে পারিনি।

এই গণতন্ত্র আমাদের কোন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে? কোন পথে আসবে সমস্ত মানুষের মুক্তি? নাকি সেই মুক্তি কোনওদিনই আসবে না? তার আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী কিংবা মানব সভ্যতা? যদি মানব সভ্যতার বিনাশ হয়ই, তবে তা পরমাণু অস্ত্র বা বিষবাষ্পে হবে না। হবে বঞ্চিত মানুষদের দীর্ঘশ্বাসে।

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট