তিস্তার চকোলেট - সোমা মুখোপাধ্যায়


তিস্তার চকোলেট
ডঃ সোমা মুখোপাধ্যায়


তিস্তার জন্মদিন, মা রেঁধেছেন পায়েস, পোলাও, কষা-মাংস ও আরো অনেক কিছু। তিস্তার জন্মদিন ছোট থেকে ভালোমতো ঘটা করেই পালন করা হয়; খুড়তুতো মাসতুতো ভাই-বোন, মা-বাবা-র, ভাই বাপ্পার অনেক বন্ধুবান্ধব - সব মিলিয়ে আয়োজন মন্দ হয় না। এবারে তার ওপরেও আরও যেন একটু বেশি ধুম-ধাম, এরা ছাড়াও আরও অনেকেই নিমন্ত্রিত। তিস্তার জন্মদিনের সঙ্গে আরও আরো একটা বিশেষ সেলিব্রেশনও আছে; তিস্তা একটা ফেলোশিপ নিয়ে ট্রেনিং-এ যাচ্ছে আটলান্টায় সিডিসি বা সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল-এ। এদেশে খাবার দাবার যেভাবে নাড়াচাড়া করে লোকে বাজার- ঘাটে, রেস্তোরাঁয় ভাবলেই কেমন যেন লাগে তিস্তার; স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সাবধানতা বলতে কিছুই যেন নেই। নিজে যে ফুচকা, ঝালমুড়ি একেবারে খায় না তা নয়, কিন্তু ইদানিংকালে একটু যেন পরিবর্তন নিজেই লক্ষ্য করতে পারছে । রাস্তার ওপর আঢাকা খাবার খাওয়া কতটা ঠিক এই ভাবনাটা একটু অস্থিরই করছে । হরদমই শোনা যায় ফুড পয়জেনিং-এ লোকে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। কাজেই এইরকম নানা ভাবনা নিয়ে কেমিস্ট্রি-তে এম-এস-সি করার পর আপলাই করেছিল সিডিসির ফেলোশিপে, পেয়েও গেলো। উত্তেজনা আছে স্বাভাবিক ভাবেই আর সেই সুবাদেই জন্মদিনের সাথে এই হচ্ছে আর একটা কারণ এই পার্টির। রাস্তার খাবারে আজকাল একটু অনীহা হলেও চকলেটের প্রতি আগ্রহটা ছাড়তে পারে নি তিস্তা। মাসীমণি এসেছে ব্যাঙ্গালোর থেকে, মাসীমণি দারুণ চকলেট কেক, পেস্ট্রি সব বানায়। ওর তৈরী এইসব ডেলিকেসি ব্যাঙ্গালোরের অনেক কর্পোরেট ক্যান্টিনেও চলে গেছে। তিস্তার ধারণা ওর মাসীমণি একদিন প্যারিসে পেস্ট্রি শেফকে শেখাবে কারণ ও কিসব টপিং বার করেছে নলেন গুড়ের। কিন্তু আপাততঃ সব আশায় গুড়ে-বালি মনে হচ্ছে কারণ যে দুজনকে এই সন্ধ্যেয় সবথেকে বেশি চাইছে তিস্তা সে দুজনেরই কোনো পাত্তা নেই সাতটা বেজে গেলেও।

বাপ্পা অনর্গল বকবক করে চলেছে সবার সাথে; দিনরাত অদ্ভুত অদ্ভুত সব তথ্য জোগাড় করবে আর সবাইকে ধরে ধরে বোঝাবে। যদিও বলতে বাধা নেই চকোলেট খাওয়া ছাড়াও এর সম্বন্ধে নানারকম খবর জোগাড় করার উৎসাহটা বাপ্পার কাছ থেকেই পেয়েছে তিস্তা। সংহিত-এর এখনো দেখা নেই. ক্রমশঃ ক্রমশঃ রাগ বাড়ছে তিস্তার, জমা হচ্ছে অভিমানও। সংহিত এর সম্বিৎ কবে যে ফিরবে; এমন খ্যাপা যে তিস্তার জন্মদিন বলে দিলেও মনে আছে কিনা কে জানে! তবু সংহিত কে ভালোবাসার থেকে সংহত করতে পারে না নিজেকে তিস্তা। ওর ইচ্ছে ছিল সংহিতকে বিশেষ ভাবে সবার কাছে ইন্ট্রোডিউস করবে আজ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হবে কে জানে !

তিস্তাদের আপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সটা রীতিমতো বড়, তার ক্লাব-হাউসে পার্টির আয়োজন হয়েছে। সুইমিং পুলের পাশে ক্লাব-হাউস, সারা বছরই খ্রীষ্টমাস ট্রি আর লাইট দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। বাবার খুব ইচ্ছে বাপ্পা গান করে আর তিস্তা সেতার বাজায় , এই ব্যবস্থাটা তিস্তার বাবা অশোক নিজেই করেছেন তদারকি করে। নিমন্ত্রিতদের প্রবেশ ঘটলে তিস্তাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করতে হচ্ছে।, ওর মা শর্মিলা এখনো সন্ধ্যে দিতে ব্যস্ত। সকাল থেকে রান্না-বান্না অনেক করলেও মেয়ের জন্মদিনে তার মঙ্গলকামনায় পূজোর ঝোঁকে অন্যদিকে বাড়িতে এতো লোকের দিকে এখন যেন কোনো খেয়াল নেই। যার জন্মদিন তাকেই অতিথি আপ্যায়ণ করতে হচ্ছে। তিস্তার মেজাজ সপ্তকের ওপর দিকে উঠছে নিঃশব্দে। চকলেট, চিপস ট্রেতে ঘোরাফেরা করছে সবার হাতে হাতে। তিস্তা নিজের বিরক্তি কমানোর জন্য একটা রাস্পবেরি ক্রিম ভরা একলেয়ার্স নিয়ে সবে যখন একটা কামড় দিয়েছে ঠিক সেই সময়েই শর্মিলা এসে পূজোর ফুল ঠেকালো মাথার ওপর। একটু উদাসীনভাবে প্রসাদও নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একলেয়ার্সটা ছেড়ে প্যাঁড়ার দিকে মনটা দিতে পারে নি। সেটা দেখে শর্মিলা হঠাৎ করে রেগে গিয়ে "কি দিনরাত আজেবাজে খাবার খাওয়া" বলে অসমাপ্ত একলেয়ার্সটা তিস্তার হাত থেকে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলতেই দুবার লাফিয়ে সেটা সুইমিং পুলের জলে টুপ্ করে ডুবে গেলো। । মাসীমণি ও নেই, তার কেকও নেই, সংহিতের এখনো দেখা নেই, একলেয়ার্সটাও উপভোগ করা গেলো না; এইবার ভীষণ ভাবে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙল তিস্তার। চেপে রাখা কান্নাভেজা গলায় ফরফর করে উঠলো তিস্তা, “আজে বাজে খাবার? চকলেট ? জানো কি চারহাজার বছর আগে এই চকলেটকেই ঠাকুরের কাছে নৈবেদ্য দেওয়া হতো, তোমার প্যাঁড়া নয়? জানো কি চকলেট আদিতে ছিল চায়ের মতো পানীয়, ভোগের মতো খাবার নয়? শুধু একটাই তফাৎ ছিল যে সেই চকলেট মিষ্টি ছিল না তোমার প্যাঁড়ার মতো, ছিল ভীষণ তেতো। জানো কি চকোলাট বা চকলেট কথাটাই এসেছে মায়ানদের ভাষায় "জোকোলাট" অর্থাৎ "তেতো জল" থেকে”।

"তবু সবাই খেত? থুড়ি পান করতো", তিস্তার হাঁফ নেবার অবকাশে ফোড়ন কাটলো বাপ্পা।

তিস্তা আবার ফরফর করে উঠলো, “শুধু পান করতো নয় রে, এতো দামী ছিল যে মায়ানদের হারিয়ে আজটেক-রা যখন ওদের রাজত্ব কেড়ে নিলো, তখন ওই কাকাও বীজ নিত উপঢৌকন হিসেবে”।

এর মধ্যে চারিদিকে ছড়ানো ছেটানো লোকজন বিক্ষিপ্ত আড্ডা ছেড়ে সবাই এদিকে নজর দিলো, যার জন্মদিন তাকে কি অবজ্ঞা করা যায়? কাকাও শুনে ওদের কাকু অবশ্য বললেন, “এ সবই তাহলে মায়া”?

বাপ্পা একটু শুধরে দিলো, “সে মায়া নয় কাকু, এ হলো প্রাচীন কালের মায়াসভ্যতার মায়া-প্রজাতি যারা প্রায় হাজার চারেক বছর আগে এখনকার মেক্সিকো অঞ্চলে বসবাস করতো”।

অশোক এসে উৎসাহ দিলেন, “বাঃ! দারুণ তো”! তিস্তার কথার রেশ টেনেই বললেন, “তা কি কি পাওয়া যেত কোকো বীজের বিনিময়ে”? এবারে আস্তে আস্তে সব অতিথিরাই এদিকে এসে জমায়েত হলেন, জন্মদিনে এ এক অন্য আলোচনা, মন্দ নয়!

“কি কি পাওয়া যেত? চারটে বীজে একটা কুমড়ো, দশটা বীজে একটা খরগোশ, এমনকি বীজের বিনিময়ে একরাত্তিরের জন্য মে....য়ে...”.বলে চারদিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে থেমে গেলো তিস্তা। শর্মিলা খুব অবাক হয়ে তিস্তার দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন, তিস্তা সাধারণতঃ এতো কথা বলে না; ভাবলেন, মুখে যাই বলুক ক'দিন বাদে একবছরের জন্য বাড়ি থেকে অতো দূরে যাবে বলে অশান্ত হয়ে আছে মন। চট করে থালা ভর্তি সন্দেশগুলো সবাইকে দিয়ে পূজোর থালাটা নামিয়ে রেখে যোগদান করলেন কাকাও আর চকোলেটের বিনিময়ে র মজার ফর্দে ।

তিস্তা সেটা দেখে বললো, “ওরা চকলেট কে বলতো “দেবতার খাবার”। দেবতাকে উৎসর্গ করে সেই বীজগুলো পিষে পানীয় বানাতো যার থেকে শক্তি আসে”। খুড়তুতো বোন রূপসা বললো, “তাহলে তো সেটা তেতো চিরতার জলের মতোই রে”!

“বলতে পারিস অনেকটা। শোনা যায় আজটেক-দের রাজা মন্টিজুমা সোনার পাত্রে ঢেলে খেত সেই কাকাও পানীয়। মায়া প্রজাতি থেকে আজটেকরা যখন পানীয় বানাতো তারওপরে ফেনা হয়ে থাকতো, ওদের বিশ্বাস ছিল ওই ফেনাই শক্তির উৎস"।

“তাহলে তো চিরতা নয় রে, বরং বলা যায় আমাদের সিদ্ধির শরবত! ও, অব সমঝা! এখন বুঝছি কেন শোনা যায় মন্টিজুমা তার প্রেমিকার কাছে যাবার আগে পঞ্চাশ গেলাস পান করেছিল সোনার পাত্রে", একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললো বাপ্পা।

চারিদিকে সবাই ঘিরে শুনছিলো; তিস্তা হঠাৎ সবার দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বললো, “ইস দেখো কান্ড! আটটা বেজে গেলো। মা, তাহলে সবার খাবার ব্যবস্থা করা যাক”!

রূপসা বললো, “আরে এরকম মাঝ পথে গল্পটা থামিয়ে দিচ্ছ, তুমি আচ্ছা বেরসিক তো”।

সবাই রূপসার সাথে একমত, এখনো তো সেরকম রাত হয় নি। আটটাই তো বাজে, বাপ্পা বড়ো ভালো ক্লাসিক্যাল গায় সেটাও তো বাকি আছে। ওর প্রস্তুতি নিতে নিতে আরও কিছুটা চলুক নাহয় চকোলেট কাহিনী।

অগত্যা তিস্তাকে চালিয়ে যেতে হয়। “আজটেক, ইনকা সভ্যতা যখন পড়ন্ত বেলায় তখন এদের থেকে কলোম্বাস কোকোয়া বীজ নিয়ে যায় স্পেনে তার রাজার কাছে, কিন্তু ওই তেতো বীজ-এর প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায় নি রাজা । আস্তে আস্তে ইউরোপে স্পেন থেকে প্যারিসে আসে কোকো বীজ। ইতিমধ্যে স্প্যানিশ-রা কোকোর সাথে চিনি মিশিয়ে তেতো পানীয়কে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়। রাজা লুইস থারটিন্থ এর বিয়ে হয় স্পেনের রাজকন্যা এনির সাথে। এনি তখন তার সাথে নিয়ে গিয়েছিলো কাকাও বীজ এবং সেই শেফ যে প্রাণশক্তি ভরা ফেনিত পানীয় বানাতে পারে। তখন রাজ-অনুকূল্যে ওই রহস্যভরা পানীয় এলো বাজারে পার্লারে, ওই আর কি এখনকার ষ্টারবাকস এর মতো। প্রথমে যথারীতি বড়লোকদের জন্যই ছিল এই বিশেষ পানীয়, তারপর আস্তে আস্তে বাজারে বিভিন্ন কোম্পানি আনতে লাগলো চকলেট যেমন লন্ডনে ক্যাডবেরী”

"আর তিস্তার জন্মদিনে মাসীমণির স্পেশ্যাল চকলেট কেক!"

সংহিত-এর গলা শুনে সবার সাথে তিস্তার চোখ গেলো দরজার দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে মাসীমণি আর বিরাট এক চকোলেট কেক হাতে সংহিত। এক নিমেষেই বুঝতে পারলো দুজনের দেরি হবার কারণ। দৌড়ে গেলো তিস্তা। সংহিতকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারলে খুশি হতো, কিন্তু হাতে অতো বড় এক কেক সে এক বাধা আর তাছাড়া লোকজনও তো ভর্তি ক্লাব-হাউসে। নিঃশব্দ ইশারায় কিছু কথা বিনিময় হয়ে গেলো তিস্তা আর সংহিত-এ। বাপ্পা ডায়াস থেকে বলে উঠলো, বাঁচালে মাসীমণি, তোমার বোনঝি কেকের বেদনায় কোকোর গল্পে লোকজনকে আর একটু হলে পাগল করে দিত। তিস্তা বাপ্পার পিঠে দৌড়ে গিয়ে একটা কিল মেরে ফেরত এলো সংহিতের পাশে। বাবা অনেক কিছু বললেন তিস্তার সম্বন্ধে, সেদিকে বিশেষ খেয়াল নেই তিস্তার, ছেঁড়া ছেঁড়া কথা ভেসে আসছে সবার, অনেক অভিনন্দন, অনেক ভালোবাসা। বাফে টেবিল থেকে খাবার নিয়ে সবাই ডায়াসের চারপাশে পাতা চেয়ারে বসলেন।

আলতো করে তিস্তার হাতটা ধরে সংহিত বললো, কি ভাবছিলে? সংহিত-এর সম্বিৎ কবে ফিরবে?

উফ! ঠিক বুঝতে পেরেছে, আর এই জন্যই ছেলেটাই ভাসিয়েছে ভালোবাসায়, ভাবে তিস্তা।

আর তখনি আভোগী কানাড়ায় আলাপ ধরে বাপ্পা "আয়ি সাজানওয়া মেরি অঙ্গনে "!

 
***

লেখক পরিচিতিঃ 
কলকাতায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা। নিউক্লিয়ার মেডিসিন-এ পি.এইচ.ডি. করে আমেরিকায় কর্মজগতের শুরু। পেশা অধ্যাপনা ও গবেষণা; বিষয় শরীরবিদ্যা ও জীববিদ্যা। নেশা সাহিত্য পাঠ ও রচনা, সঙ্গীত, কবিতা এবং সঞ্চালনা। দেশে ও বিদেশে বহু পত্র-পত্রিকায় কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। 

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট