বর্ণবাদ প্রসঙ্গে: নীল ডিগ্রাসি টাইসন | অনুবাদ আশফাক স্বপন


বর্ণবাদ প্রসঙ্গে: নীল ডিগ্রাসি টাইসন 
অনুবাদ আশফাক স্বপন

বর্ণবাদী শাদাদের কালোদের প্রতি তাচ্ছিল্য, ক্ষোভ, ঘৃণা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মস্ত রাজনৈতিক পুঁজি। কালোদের কথা উঠলেই ওরা বলে: আরে দুরবস্থা হবে না কেন? লেখাপড়া করে না, ঠিকমত সংসার করে না, গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা পয়দা করে, ঠিকমত বাচ্চা মানুষ করে না, চুরি-চামারি, খুন-খারাপি করে। তারপর শুধু সরকারী সাহায্যের জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর, নাহলে অত্যাচারের ইতিহাসের পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটে। অলস অপদার্থের দল! হ্যা, অতি লজ্জার কথা – অনেক বাঙালি অভিবাসীরাও একথা বলে।

আচ্ছা, ধরা যাক একজন কালো মানুষ সমাজের সব নিয়ম মেনে চলল। মধ্যবিত্ত ঘরে মানুষ হলো। প্রচণ্ড পরিশ্রমী, মেধাবী। এমনই মেধাবী যে সে আজ আমেরিকার অন্যতম শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের অধ্যাপক। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ব্রতে এমনই সফল যে ঘরে ঘরে লোকে তার চেহারা টিভিতে দেখে। তার তো হেনস্তা হবার কথা নয়, তাই না?

কিন্তু সেও বর্ণবাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বিশ্ববিখ্যাত মহাকাশ পদার্থবিজ্ঞানী প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীল ডিগ্রাস টাইসন-এর কাছে শুনুন তার সারা জীবনের বিষময় অভিজ্ঞতার কথা।

(লেখাটা ভালো লাগলে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব Riton Khan-এর। ও-ই আমাকে ইংরেজি লেখাটা পাঠায়। অনুবাদের জন্য অষ্টপ্রহর ও আমার পেছনে চীনা জোকের মত লেগে থাকে।

আমার চামড়ার রঙ নিয়ে চিন্তাভাবনা
নীল ডিগ্রাস টাইসন
৩ জুন ২০২০
অনুবাদ আশফাক স্বপন

মূল রচনার লিঙ্ক (ইংরেজি)

বহুদিন আগে পদার্থবিজ্ঞানের এক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সর্বশেষ নৈশভোজের পড়ে থাকা ওয়াইন পান করতে করতে আমরা গোটা বারোজন আলাদা একটা জটলায় বিজ্ঞানের খটোমটো অথচ মজার মজার ব্যাপার নিয়ে তর্ক শুরু করলাম। আচ্ছা, সুপারম্যানের পিঠে চাদর বাঁধতে হয় কেন? ডায়েট পেপসিভরা টিনের কৌটো পানিতে ভাসে, কিন্তু চিনিভরা পেপসির কৌটো ডোবে কেন? আচ্ছা, কল্পবিজ্ঞানের জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল স্টার ট্রেক (জ্যোতিষ্ক বিহার)-এ যে পরিবহকযন্ত্র মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহুদূর নিয়ে যায়, সেটা আসলে কীভাবে কাজ করে? সন্ধ্যা গড়াতে লাগল। গাড়ি দুর্ঘটনায় ভরবেগ প্রতিস্থাপনের আড্ডার ঠিক পরপরই আমাদের মধ্যে একজন গাড়ি চালাবার সময় তাকে পুলিশ ধরে কী করেছিল সেই ঘটনার উল্লেখ করল। পুলিশ তাকে তার স্পোর্টস গাড়ি থেকে নামার নির্দেশ দিয়ে, তার শরীর, গাড়ির ভেতর এবং জিনিসপত্র রাখার স্থান তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করল। তারপর মোটা অঙ্কের জরিমানা ধার্য করে তাকে বাড়ি পাঠাল। কী অপরাধে তাকে থামানো হয়েছিল? স্থানীয় গতিসীমার ২০ মাইলের বেশি দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিল সে। অনেক চেষ্টা করেও আমরা তার জন্য তেমন একটা সমবেদনার উদ্রেক করতে পারলাম না।

সেই রাতে আমার সহকর্মী আইনরক্ষাকারী সংস্থার সাথে তার আরো মোলাকাতের গল্প করেছিল, তবে তার প্রথম গল্পটি আমাদের মধ্যে একটার পর একটা লাগাতার গল্পের ধারা শুরু করে দিল। একে একে আমরা সবাই পুলিশ আমাদের কখন কখন থামিয়েছে তার একাধিক ঘটনার কথা বলতে শুরু করলাম। কোন ঘটনাতেই যে খুব বলপ্রয়োগ করা হয়েছে বা জান নিয়ে টানাটানি পড়ে গেছে তা নয়, যদিও তার হাত ধরে একটু এগুলেই এমন বহুচর্চিত ঘটনায় আসা যায় যেখানে সত্যি জানমালের ক্ষতি হয়েছে। আমার এক সহকর্মীকে অতিরিক্ত আস্তে গাড়ি চালাবার জন্য আটকানো হয়েছিল। হেমন্তে নিউ ইংল্যান্ডের এক শহরে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সে ঘণ্টায় ৫ মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছিল। আরেকজনকে পুলিশ বেশী তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাবার জন্য ধরেছিল। অবশ্য সে গতিসীমার চাইতে মাত্র ৫ মাইল বেশি বেগে চালাচ্ছিল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ কোন জরিমানা না করেই ছেড়ে দেয়। আরেকজন সহকর্মীকে গভীর রাতে জগিং করার জন্য পুলিশ থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

আমার নিজের বেলায় গোটা বারো এধরনের অভিজ্ঞতার রয়েছে। একবার নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যে একটা সেতুর তলা দিয়ে যাবার সময় পাশের লেইনে সঙ্কেত না দিয়ে যাবার জন্য আমাকে পুলিশ আটকায়। গাড়ির পেছনে দাড় করিয়ে, পুলিশের গাড়ির কড়া আলো আমার মুখে ফেলে আমাকে দশ মিনিট ধরে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। এটা আপনার গাড়ি? হ্যা। পাশে বসা মহিলাটি কে? আমার স্ত্রী। কোথার থেকে আসছেন? আমার বাবা-মার বাসা থেকে। কোথায় যাচ্ছেন? বাড়ি। কী করেন? আমি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ পদার্থবিজ্ঞানী। আপনার গাড়ির পেছনে কী আছে? একটা বাড়তি টায়ার, আর তেলচিটচিটে কিছু ফেলনা টুকিটাকি। পুলিশ আমায় বলল যে আমাকে আটকাবার ‘আসল কারণ’ আমার ১৭ বছর পুরনো ফোর্ড গাড়ির তুলনায় তার নম্বর প্লেটটা অনেক বেশি নতুন আর চকচকে। গাড়ি কিম্বা নম্বর প্লেট কোনটাই চোরাই নয় সেটা পুলিশ অফিসার নিশ্চিত করল আর কি।

অন্যান্য ঘটনার মধ্যে একবার স্নাতোকোত্তর কলেজের নতুন অফিসে বাড়ি থেকে পদার্থবিদ্যার পাঠ্যবই নেবার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ আমাকে আটকায়। পদার্থবিদ্যা ভবনের প্রবেশপথে আমাকে আটকে আমি এখানে কী করছি, এ নিয়ে নানান সন্দেহপূর্ণ প্রশ্ন করে। তখন রাত ১১:৩০। গাড়ির পেছনে খোলা বাক্সভর্তি স্নাতকোত্তর গণিত আর পদার্থবিদ্যার পাঠ্যবই। সেই বইগুলো আমি ভবনের ভেতর নিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, এইরকম একটা পরিস্থিতি কীভাবে পুলিশ প্রশিক্ষণের ভিডিওতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সম্ভব।

এই নিয়ে ঘণ্টা দুই আমাদের আড্ডা চলল। রাতে বিদায় নেবার আগে এই সব ঘটনায় কোন জায়গাটাতে মিল রয়েছে আমরা সেটার খোঁজ করলাম। আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের গাড়ি চালাই – কারোটা পুরনো, কারো নতুন, কারো অতি সাধারণ, কারও দামী বিদেশী গাড়ি। পুলিশ কখনো দিনে থামিয়েছে, কখনো রাতে। একটা একটা করে আইনের সাথে মোলাকাতের ঘটনা আলাদা করে বিবেচনা করলে সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। আধুনিক যুগে সবার জন্য নিরাপদ সমাজ নিশ্চিত করার জন্য আমাদের খানিকটা স্বাধীনতা তো ছাড়তে হবেই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে, আপনার এই ধারণা হবেই, যে পুলিশ পদার্থবিদদের ওপর একহাত নিতে বদ্ধপরিকর। কারণ আমাদের সবার মধ্যে ঐ একটা বিষয়েরই মিল। গাড়ি থামিয়ে তল্লাশির এই গল্পগুলোতে একটা কথা পরিষ্কার – এগুলো হাল্কা মেজাজে চর্চিত অনন্য ঘটনা নয়। এধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। আমাদের প্রত্যেকের দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি – পিএইচ ডি – থাকা সত্ত্বেও এই সব উচ্চশিক্ষিত বিজ্ঞানীর দল কি করে বারবার পুলিশি অনুসন্ধানের খপ্পরে পড়ছে? হয়তো আমাদের চামড়ার রঙ এর জন্য দায়ী। আমি যেই সম্মেলনে যোগ দিয়েছি, সেটা জাতীয় কৃষ্ণাঙ্গ পদার্থবিদ সমিতির ২৩তম অধিবেশন। আমরা মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাবার দোষে দোষী নই। আমরা হয়তো বা এমন সব অপরাধে অভিযুক্ত, যে সব অপরাধ আমাদের জানামতে কোন দণ্ডবিধিতে নেই – যেমন কালো মানুষ হয়ে গাড়ি চালানো, বা কালো মানুষ হয়ে হাঁটা, এবং অবশ্যই, স্রেফ কালো মানুষ হওয়া।

আমাদের কাউকেই পিটিয়ে সংজ্ঞাহীন করা হয়নি। কাউকে গুলিবিদ্ধও করা হয়নি। তবে পুলিশের সাথে মোলাকাত কখন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসে? গড়পরতায় আমেরিকায় পুলিশ প্রতিবছর ১০০জন নিরস্ত্র কালো মানুষ হত্যা করে। আমাদের চক্রে ওদের মধ্যে কে কে শরীক হতে ব্যর্থ হয়েছে? আমার তো গভীর সন্দেহ হয় আমাদের কয়েক ঘণ্টা যেই প্রসঙ্গ নিয়ে আড্ডা হলো এমনটা আর কোন নীতিনিষ্ঠ ভদ্র জনগোষ্ঠীতে অত্যন্ত বিরল।

আমি যখন এই প্রবন্ধটি লিখছি, তখন নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যানহাটানে আমার জানালার সামনে দিয়ে মিছিলে ১০,০০০ আন্দোলনকারী শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ মুখর করে এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে লুটপাট হয়েছে, সেই সাথে কিছুটা সহিংসতার কারণে গত কয়েক দিনের রাত ১১টার বদলে সান্ধ্য আইন আজ রাত ৮টায় এগিয়ে আনা হয়েছে। মিছিলে সবচেয়ে বেশি যে পোস্টারটা দেখলাম সেটা হলো ‘কৃষ্ণপ্রাণ মূল্যবান’ (Black Lives Matter). অন্য পোস্টারে শুধুমাত্র জর্জ ফ্লয়েড-এর নাম। জর্জ ফ্লয়েডকে হাতকড়া পড়িয়ে মাথা নীচের দিকে দিয়ে মাটিতে শুইয়ে পুলিশ তার ঘাড় হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছিল। পুলিশ অফিসারটি তার শরীরের ওজনের অন্তত অর্ধেক ভার দিয়ে ঘাড় চেপে বসেছিল। ফলে তার মৃত্যু ঘটে। এ এক অদ্ভুত ভাগ্যের পরিহাস যে আমেরিকান ফুটবল তারকা কলিন কেপারনিকও মাটিতে হাঁটু চেপে বসেছিলেন, সেটা ফুটবল খেলা শুরু হবার আগে মার্কিন জাতীয় সঙ্গীত বাজবার সময়ে। সেটা ছিল পুলিশের হাতে কালো মানুষের ভয়াবহ দুর্গতির প্রতি সহমর্মিতা ও উদ্বেগ প্রকাশ। (একটি সংবাদ মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করা হয় যে ও জাতীয় সঙ্গীতের প্রতিবাদ করছিল।) একটি জাতীয় সমস্যার প্রতি তার নিরব উদ্বেগের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের সারা খেলার মৌসুমে উত্তপ্ত ক্ষোভ প্রকাশিত হয়, ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে কোন দল তাকে চুক্তিবদ্ধ করতে অস্বীকার করায় ফুটবলার হিসেবে তার জীবিকা পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে হাঁটু গেড়ে বসার থেকে এখন ঘাড়ে হাঁটু গেড়ে খুন করায় পৌঁছেছি।

যেভাবে আমাদের শহরের রাজপথে রাজপথে বিষাক্ত পদার্থ, কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে, ধাক্কাধাক্কি ও ধ্বস্তাধ্বস্তি করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ও সাংবাদিকদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়েছে (যেখানে পুলিশের উচিত ছিল যারা লুটপাট করছে তাদের ধরপাকড় করা), তাতে মনে হয় যেন আন্দোলনকারীরা এমন কিছু করছিল যেটা হয় বেআইনি অথবা আমেরিকা-বিরোধী। এ সম্বন্ধে আমাদের মার্কিন সংবিধানের কিছু বলবার আছে।

মার্কিন সংসদ এমন কোন আইন পাশ করবে না ... যাতে সংবাদ মাধ্যম, অথবা মানুষের শান্তিপূর্ণভাবে একত্র হওয়া, বা সরকারের কাছে অভিযোগের প্রতিকারের জন্য আবেদন করা ... এসবের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়।

এটা কোন সংশোধনী? মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনী। সুতরাং এদেশের যারা ভিত্তি স্থাপন করেছে, তাদের জোরালো অভিমত ছিল যে অভিযোগের প্রতিকারের জন্য প্রতিবাদ করার অধিকার দেওয়াটা অত্যন্ত আমেরিকান একটি কাজ। যদি আপনি পুলিশ হন, তাহলে এক মুহূর্তের জন্য ভেবে দেখুন – যে দেশের সংবিধানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সমর্থন রয়েছে তা কি অত্যাশ্চর্য দেশ!

আমরা আমাদের পুলিশ অফিসারদের থেকে কী আশা করি? শান্তি রক্ষা করা আর খারাপ লোকগুলোকে ধরা, এই তো? সেই সাথে প্রয়োজনে মারণাস্ত্র প্রয়োগের ক্ষমতাও থাকবে। তার জন্য কখন ও কীভাবে সেটা প্রয়োগ করবে (বা করবে না) তার যথাযথ প্রশিক্ষণ আবশ্যক। মিনিয়াপোলিস পুলিশ একাডেমির ‘নিবিড়’ প্রশিক্ষণের সময়কাল মাত্র ছয় মাস।

অথচ কোন নামকরা রান্না শেখার স্কুলেও পেস্ট্রি বাবুর্চির সনদ পেতে আট মাস প্রশিক্ষণ নিতে হয়। ক্রোয়াসো রুটি নিখুঁত বানাবার জন্য কোন ছাড় সম্ভব নয়। সুতরাং পুলিশ শিক্ষার্থীরা হয়ত অফিসার হবার আগে আরেকটুখানি বেশি সময় প্রশিক্ষণ পেলে লাভবান হবে।

১৯৯১ সালে লস এঞ্জেলেসের চারজন পুলিশ অফিসার ২৫ বছর বয়স্ক রডনি কিং-কে প্রথমে বিদ্যুতস্পৃষ্ট করে, তারপর মাটিতে শায়িত অবস্থায় পঞ্চাশ বারের বেশি লাঠি দিয়ে মারে। সেই ১৯৯০ দশকের ঝাপসা ভিডিও সংবাদ মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। যে কোন দর্শক দেখে স্তম্ভিত, মর্মাহত হয়।

আমি কিন্তু বিন্দুমাত্র স্তম্ভিত হইনি।

আমার চারপাশের পৃথিবী সম্বন্ধে আমি যা জানি, তার ওপর নির্ভর করে প্রথম যে চিন্তাটা মাথায় এল তা হলো: ‘অবশেষে এসব ঘটনা একটা ভিডিওতে ধরা পড়েছে।’ তারপর ভাবলাম: ‘হয়ত এবার তাহলে এর একটা বিহিত হবে।’ হ্যা, ঠিক তাই ভেবেছি। কেন? সেই ছেলেবেলা থেকে প্রতি মাসে, কখনো প্রতি সপ্তাহে আমার আর আমার ভাইবোনদের বাবা-মা আমাদের পুলিশের গুলি এড়াবার জন্য কী করা আবশ্যক তার নিয়মকানুন শেখাতেন।

‘পুলিশ থামালে সে যেন সব সময় তোমার দুই হাত দেখতে পায়, সেটা নিশ্চিত করবে।’

‘হঠাৎ নড়াচড়া করবেনা।’

‘আগাম পুলিশকে না জানিয়ে কোন কিছু বের করার জন্য পকেটে হাত দেবে না।’

‘যদি নড়তেই হয়, আগে পুলিশকে বলে নেবে কী করছ।’

আমি তখন ইস্কুলে উদীয়মান বিজ্ঞানী, মহাবিশ্ব সম্বন্ধে যত কিছু জানার আছে সব কিছু জানার চেষ্টায় মগ্ন। আমার গায়ের চামড়ার কী রঙ সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই – মহাবিশ্ব নিয়ে ভাবনার সময় সেটা খুব প্রাসঙ্গিক নয় কিনা। অথচ বাড়ির সদর দরজা পেরুলেই আমি সন্দেহভাজন, সম্ভাব্য অপরাধী। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ইদানিং যাকে বলা হয় ‘শাদা মানুষের সন্দেহ’ – যেখানে নিরীহ কালো মানুষ কোন অপরাধ করছে এই সন্দেহে ভীত শাদা লোকে পুলিশ ডাকে। এত কাণ্ডের মধ্যে আমরা কীভাবে বিকশিত হই সে এক তাজ্জব ব্যাপার।

কী হারে এই হেনস্থা ঘটেছে? আমার সারাজীবন প্রতি সপ্তাহে এক থেকে পাঁচটি গাত্রবর্ণ সম্পর্কিত ঘটনা ঘটেছে। আমাদের এই সংগ্রামের কথা খোলাখুলিভাবে না হলেও নিশ্চয়ই মনে মনে শাদা মানুষ জানত। নাহলে কেন সেই কুখ্যাত বচন, ‘আমি মুক্ত, শাদা, এবং আমার বয়স ২১’ -এই কথাটার সৃষ্টি হয়েছে? পুরনো কত ছায়াছবিতে কথাটা ব্যবহৃত হয়েছে। কথাটা অত্যন্ত আপত্তিকর। কিন্তু আমেরিকায় কথাটা সত্যিও বটে। আজ ‘শাদা অগ্রাধিকার’-এর অপবাদ যতই অস্বীকার করা হোক না, ঐ সময় সেটা খোলাখুলিভাবে সগর্বে ঘোষণা করা হতো।

রডনি কিং-এর ঘটনার সাথে জড়িত লস এঞ্জেলেস-এর যে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা হয়, সেটাকে অনেক সময় পুলিশের পিটুনির প্রতিক্রিয়া বলে ভাবা হয়। কিন্তু না। পিটুনির পর লস এঞ্জেলেস ১৩ মাস শান্ত ছিল। আদালতে ক্ষমতার অপব্যবহারের অপরাধ প্রমাণের জন্য ঐ ভিডিওটাই মোক্ষম প্রমাণ, এই ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত ছিল। আমিও ছিলাম। কিন্তু বাস্তবে তো সেটা ঘটেনি। সেই পিটুনির ঘটনা নয়, বরঞ্চ সেই ঘটনায় জড়িত চারজন পুলিশের বেকসুর খালাস হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসাবে দাঙ্গা বাঁধে। আসলে দাঙ্গা অসহায় হতাশার সর্বশেষ আর্তনাদ ছাড়া আর কি?

স্পাইক লি-এর ১৯৮৯ সালের ছবি ‘Do the Right Thing’ (‘ঠিক কাজটি করুন’) - এই ছবিতে নিউ ইয়র্ক শহরের ব্রুকলিনে ১৯৮০-এর দশকে শাদা পুলিশ বনাম কালো মানুষের মধ্যে উত্তেজনা মূল বিষয়। ছবিটির শেষে ছয়জন মানুষের পরিবারের প্রতি ছবিটি উৎসর্গ করার কথা ঘোষিত হয়। এরা হল: এলেনর বাম্পার্স (৬৬ বছর), মাইকেল গ্রিফিথ (২৩ বছর), এডমান্ড পেরি (১৭ বছর), ইভন স্মলউড (২৮ বছর) ও মাইকেল স্টুয়ার্ট। সবাই কালো। একজনকে উন্মত্ত শাদা জনতা খুন করেছে। বাকিরা সবাই নিরস্ত্র ছিল। হয় পুলিশের গুলিতে নতুবা ওদের জিম্মায় মারা গিয়েছে। ছবিটি তৈরির আগে ১০ বছরের মধ্যে খোদ নিউ ইয়র্ক শহরেই এই সব মৃত্যু ঘটেছে। পুলিশি কারণে এই সব মৃত্যুর জন্য কেউ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়নি। পুলিশি হত্যার ৯৯% ক্ষেত্রে এই কথা সত্যি।

এই সব ঘটনা সম্বন্ধে আমরা জানতে পেরেছি কারণ প্রতিটি ঘটনার শেষে কারো মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু তারপরও সেই সময় এসব শুধুমাত্র স্থানীয় সংবাদ ছিল। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম: তাহলে কি এটা শুধুমাত্র নিউ ইয়র্ক শহরের সমস্যা? যে কোন স্থানে পুলিশের সাথে জড়িত কোন মৃত্যুর কত গুণ নিরস্ত্র মানুষকে পুলিশ গুলি করে কিন্তু তাদের মৃত্যু হয় না? অথবা অন্যায়ভাবে তারা আহত হয়, পঙ্গু হয়? এইসব ঘটনা তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় সংবাদেও স্থান পায় না। তবে আপনি সেখানে থাকলে ঠিক জানতে পারতেন। আমরা সবাই জানতাম। কে জানে এই তথ্যের মূল্য কতটুকু, তবে মার্কিন দেশের সবচাইতে বড় ৬০টি শহরের মধ্যে নিউ ইয়র্ক শহরে জনপ্রতি পুলিশি হত্যার হার সব চাইতে কম। এ কি পুলিশ একাডেমিতে বাড়তি দুই মাস প্রশিক্ষণের ফল?

ভিডিও প্রমাণ সত্ত্বেও এই ধরনের ঘটনার ফলে আইন ব্যবস্থার ওপর আমাদের আস্থার অবক্ষয় ঘটতে ঘটতে তলানিতে এসে ঠেকেছে, আর সেই কারণেই প্রতিবাদের ৎসুনামিতে পৃথিবী কেঁপে উঠেছে। এই অন্যায়ের যারা শিকার, তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে মিছিলে মিছিলে নানা শহরের রাজপথ ভরে গিয়েছে। যেখানে এইরকম আচরণের জন্য কারাবাসের ঝুঁকি নেই – যা থাকলে হয়ত এসব ঠেকানো যেত – সেখানে নিজে নিজেই এইরকম আচরণ থামতে হবে।

কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে যে পুলিশের হাতে নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি গাত্রবর্ণনির্বিশেষে সবার বেলাতেই মোটামুটি এক। বেশ। কিন্তু আপনার যে বর্ণ, সেই বর্ণের মানুষকে যদি পুলিশ ১০গুণ বেশি থামায়, তাহলে আপনার বর্ণের মানুষের মৃত্যুর হারও দশগুণ হবে। সুতরাং শাদা পক্ষপাতের দিকটাকে প্রথমে শূন্যের কোঠায় আনতে হব। তারপরও নিরস্ত্র মানুষকে – শাদা মানুষসহ - অপরাধী সন্দেহে পুলিশের হত্যার ব্যাপারটি রয়ে যায়।

আমি মেলা বকবক করি, নানা জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াই। কিন্তু এই যে দুর্গম বাধার দুস্তরতম পথ পেরোতে গিয়ে কত অজস্র ঘটনার সাক্ষী হলাম, এসব নিয়ে তেমন মুখ খুলিনা। কেন? কারণ সারাজীবন এইসব ঘটনা আমি আরো সাফল্যের দিকে এগিয়ে চলার প্রেরণার উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছি। হ্যা, সমাজের প্রত্যাখ্যান – যা আজ ক্ষুদ্র আক্রমণ হিসেবে অভিহিত হবে - তাকে আমি অর্জনের চালিকাশক্তিতে পরিণত করেছি। আমার বাবা ছিলেন ১৯৫০ আর ১৯৬০ দশকে কালোদের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী, তাঁর থেকেই এটা শিখেছি।

এক অর্থে আমি যে আজ যেখানে এসেছি, তার জন্য দায়ী অজস্র মানুষ, যারা তাদের আচরণ অথবা নিষ্ক্রিয়তা দিয়ে আমাকে পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত দিয়েছিল যে আমি কোনদিন ঠিক এখানে এসে পৌঁছুতে পারবনা। কিন্তু আপনার যদি সেরকম মানসিক শক্তির উৎস না থাকে? তখন আপনার পরিণতি কি হবে? প্রান্তিক, ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী – এদের মধ্যে নারী, সমকামী, শাদা ভিন্ন অন্য বর্ণের মানুষ রয়েছে - এদের মধ্যে এমন কত মানুষ আছে যারা অনুপ্রেরণার অভাবে হাল ছেড়ে দেবার ফলে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছুতে পারেনি।

আজ কি সেদিনের চেয়ে অবস্থার উন্নতি হয়েছে? তা হয়েছে। তবে এই বিচারের মানদণ্ডটি একটু অদ্ভুত। কয়েক দশক আগে পুলিশ নিরস্ত্র কালো মানুষকে মারধর করলে বা মেরে ফেললে সেটা হত স্থানীয় সংবাদ। আজ দেশের যেখানেই এমন ঘটুক সেটা জাতীয় সংবাদ, এমনকি শীর্ষ সংবাদ হয়েছে।

এখন কথা হচ্ছে এই অবস্থা পরিবর্তনের উপায় কি? নানা সংগঠন নিশ্চিতভাবে পুলিশের সংস্কারের ব্যাপারে তাদের দাবি দাওয়া পেশ করবে। আমার নিজেরও একটা তালিকা আছে, যেটা বিশেষজ্ঞ নীতি-নির্ধারকদের বিবেচনার জন্য নিবেদন করছি।

পুলিশ প্রশিক্ষণ একাডেমিগুলোতে কয়েক মাস শিক্ষার্থীদের বহুবর্ণের সমাজ সম্বন্ধে সচেতনতা, সংবেদনশীলতা ভালোভাবে শেখানো হোক – যাতে পুলিশ মারাত্মক শক্তি প্রয়োগ করা থেকে বিরত হতে শেখে।

প্রত্যেক পুলিশ অফিসারের চিন্তাভাবনায় ভেদবুদ্ধি বা পক্ষপাত আছে কিনা, সেটা পুলিশ একাডেমির গ্রহণযোগ্যতার ঘোষিত মানদণ্ড অনুযায়ী যাচাই করতে হবে। একথা সত্যি আমাদের সবার কমবেশি পক্ষপাত রয়েছে। তবে আমাদের প্রায় কারোরই ওপর অন্য কারো বাঁচা-মরা নির্ভর করেনা।

প্রতিবাদের সময় জানমাল ও সম্পত্তি রক্ষা করুন। যদি আপনি অহিংস প্রতিবাদীদের আক্রমণ করেন, তাহলে আপনি মার্কিন মূল্যবোধের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। পুলিশ যদি প্রতিবাদকারীদের ধরপাকড় না করে যারা লুটপাট করে তাদের ধরত, তাহলে আর সান্ধ্য আইনের প্রয়োজন হতো না।

যদি সহকর্মী পুলিশ অফিসার অনৈতিক বা মাত্রাতিরিক্ত সহিংস আচরণ করে, আর আপনি তার প্রত্যক্ষদর্শী হন, অনুগ্রহ করে তাকে থামান। কেউ না কেউ এটার ভিডিও ধারণ করবে, এবং ফলে আপনারা যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম সেই বিষয়ে আমাদের বাকি সবার আস্থা সুদঢ় হবে। এই রকম পরিস্থিতিতে আপনারা পরস্পরকে কতটুকু রক্ষা করছেন তার চাইতে আপনাদের প্রতি আমাদের কতখানি আস্থা আছে সেটা সুশীল সমাজের কাছে বেশি জরুরি।

মিনিয়াপোলিস পুলিশ বিভাগের জন্য একটা অভূতপূর্ব পরামর্শ – দায়িত্বে থাকাকালীন মৃত্যু ঘটলে পুলিশকে যেমন আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বিদায় জানান, জর্জ ফ্লয়েডকে সেভাবে বিদায় জানালে কেমন হয়? সেই সাথে শপথ নিন আর কখনো এইরকম মৃত্যু ঘটবে না।

আর সবার শেষে একটা কথা: যখন কালো কিশোরদের দেখেন, তাদের আপনি কী মনে করেন, সেটা না ভেবে তার বদলে তারা কী হতে পারে, সেই কথাটা একটু ভাবার চেষ্টা করুন।

বিনীত নিবেদন
নীল ডিগ্রাস টাইসন – এখনো আশাবাদী হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টায়
নিউ ইয়র্ক সিটি

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট