এক যে ছিল প্রেসিডেন্ট: ব্যারাক ওবামার স্মৃতিকথার আলোচনা অনুবাদ আশফাক স্বপন

এক যে ছিল প্রেসিডেন্ট: ব্যারাক ওবামার স্মৃতিকথা

চিমানান্ডা ন্‌গোসি আডিচি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১২ নভেম্বর ২০২০ অনুবাদ আশফাক স্বপন

Chimamanda Ngozi Adichie on Barack Obama’s ‘A Promised Land’ The New York Times, Nov. 12, 2020

A PROMISED LAND By Barack Obama Illustrated. 768 pp. Crown. $45.

(আজ সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামার স্মৃতিকথার প্রথম খণ্ড A Promised Land প্রকাশিত হলো। গত চার বছরে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভব্য আচরণ আমাদের বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, চার বছর আগেও এই দেশে প্রেসিডেন্ট এমন একজন লোক ছিলেন যিনি নানাভাবে অসাধারণ। পড়াশোনায় তুখোড়, বাগ্মী, জ্ঞানী, স্বভাবে নম্র ও মিতবাক এমন চৌকশ প্রেসিডেন্ট আমেরিকায় খুব কম এসেছে। আর হ্যা, তাঁর গাত্রবর্ণ কালো ছিল।

ওবামার সম্বন্ধে দুটো বিষয় আমার লক্ষণীয় মনে হয়। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে পৃথিবীতে হেন বিষয় নেই – সেটা পরিবেশ সঙ্কট হোক বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হোক - যে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি তৎক্ষণাৎ অত্যন্ত সুচিন্তিত, সারবান, বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিতে পারতেন, এমনই ছিল তার জ্ঞানের ভাণ্ডার। আর দ্বিতীয় বিষয় হলো তাকে তার রাজনৈতিক শত্রুরা কুৎসিততম ভাষায় গালাগাল করার পরও (‘ওবামার এদেশে জন্ম নয়,’ ‘ও আসলে মার্ক্সিস্ট দেশদ্রোহী’) কক্ষনো, এক মূহুর্তের জন্য তাঁর মুখ দিয়ে কোন অসৌজন্যমূলক কথা বের হয় নি।

ওবামার কথা ভাবলে মনে হয় আসলে ওবামার বিচার আমরা কী করব, ওবামার সাথে আমেরিকা কী আচরণ করল, সেজন্য আমেরিকাকেই ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে।

এবার বইটির সমালোচনা নিয়ে দুই-একটা কথা। আমি মাঝে মাঝেই ইংরেজিতে লেখা বইয়ের সমালোচনার বাংলা অনুবাদ পোস্ট করি। এই দেশে পুস্তক সমালোচনা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও পরিণত একটি শিল্প এবং সেটা পুস্তকপাঠ ও তার প্রসারে অমূল্য ভূমিকা রাখে। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার পুস্তক সমালোচনা এদেশে সবচেয়ে নন্দিত। তারা ওবামার বইটি সমালোচনার ভার দিয়েছেন এক তেজস্বিনী নাইজেরিয়ান বংশোদ্ভুদ লেখিকাকে যিনি নিজেও স্বনামধন্যা। ওবামার মতো তিনিও কালো, আবার সুশিক্ষিতা, সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তার দৃষ্টিতে ওবামার স্বভাব আর লেখায় যেন অন্যভাবে আলো পড়ে – ওবামার গুণে তিনি যেমন মুগ্ধ, তেমন তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে কড়া কথা বলতে পিছপা নন।

হ্যা পুস্তক সমালোচনাটা একটু দীর্ঘ। Facebook আর instant gratification যুগে কার বাপু এতো সময় আছে? এই বিচারটা পাঠকের, তবে পড়লে ঠকবেন না, এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারি। মন্তব্য ও সমালোচনার অপেক্ষায় রইলাম। কড়া সমালোচনা করতে দ্বিধা করবেন না। - অনুবাদক)

লেখক হিসেবে ব্যারাক ওবামা অতি উঁচুমানের। আয়তনে এতো বড়ো ভাবগম্ভীর একটা আত্মজীবনীর বইয়ে একটা ভারিক্কী চাল থাকতেই পারতো, এবং সেটা থাকলে আমরা হয়তো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখতাম। কিন্তু ওঁর বইটা শুধু যে সেদিক মাড়ায় না তাই নয়, বইটা প্রায় সবসময়ই অত্যন্ত সুখপাঠ্য। একেবারে বাক্য ধরে ধরে এই কথাটা বলা যায় - গদ্যলাবণ্য ঝলমলে, অনুপুঙ্খের বর্ণনায় সুবিশদ ও প্রাঞ্জল। দক্ষিণপূর্ব এশিয়াই হোক বা দক্ষিণ ক্যারোলাইনার কোন ভুলে যাওয়া স্কুল, ওবামার আলতো, সুদক্ষ লেখনীর ছোঁয়ায় সেই স্থানের আবহটা যেন বই থেকে উঠে বাস্তবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। এই বইটি তার দুইটি খণ্ডের প্রথম খণ্ড। তার জীবনের শুরু দিয়ে বইয়ের সূচনা, আর শেষ হয় কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের এক সভায়। সেই সভায় পাকিস্তানের এবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার অভিযানে সংশ্লিষ্ট চৌকশ SEAL কমান্ডোদের সাথে ওবামা দেখা করেন।

ওবামার নজরটা যত না ব্যক্তিগত তার চাইতে বেশি রাজনৈতিক। তবে পরিবারের কথা যখন তিনি লেখেন, তখন তার ভাষার সৌন্দর্য মনকে স্মৃতিমেদুর করে তোলে। কতো উজ্জ্বল টুকরো টুকরো স্মৃতি। ছোট্ট মালিয়াকে শরীর চেপে ব্যালের আটোসাঁটো পায়জামাকে পরানো। শিশু সাশার ছোট্ট পায়ে কামড় দেবার পর তার খিলখিল হাসি। ক্লান্ত মিশেল তার ঘাড়ে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ঢিমে হয়ে যাওয়া। ওবামার অসুস্থ মা বরফ চুষছেন, ক্যান্সারে তার সমস্ত গ্ল্যান্ড নষ্ট হয়ে গেছে। এই সাবলীল গল্প বলার গুণটির মূলে কথকতার একটা পরম্পরা রয়েছে, তাতে অনেক প্রতীকী উদাহরণ রয়েছে। যেমন ইলিনয় রাজ্য সেনেটের নির্বাচনী অভিযানের এক মহিলা কর্মীর বর্ণনা - ‘সিগারেটে সে সুখটান দিয়ে কুণ্ডুলি পাকিয়ে ধোঁয়া ছাদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে।’ হিলারি ক্লিন্টনকে নিয়ে পরিবেশ নিয়ে এক শীর্ষ সম্মেলন চীনের সাথে জোর করে এক বৈঠকের বন্দোবস্ত করার বর্ণনায় এতটা টান টান নাটকীয় উত্তেজনা যে সেই বর্ণনায় আলো-আঁধারি রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাসের স্বাদু মেজাজ রয়েছে। সাধে কি ঐ সময়ে তার কাণ্ডকারখানা দেখে তার অন্তরঙ্গ সহকারী রেজি লাভ মন্তব্য করেছিলেন, ‘এ তো দেখছি দিনে দুপুরে সন্ত্রাস।’ তার বর্ণনায় কল্পনা যখন পাখা মেলে তখন তিনি পিছু হটেন না। এক ক্যাথলিক নান মহিলা তাকে একটা ক্রুশ দেয়। তার চেহারায় ‘পরতে পরতে ভাঁজে ভরা, ঠিক যেন পিচ ফলের বিচি।’ হোয়াইট হাউসের মালিরা যেন ‘কোন এক খৃষ্টীয় যাজক সম্প্রদায়ের নিরব পাদ্রী।’ নিজেকে নিয়ে তাঁর সংশয় - ‘মানবসেবার মোহময় আবরণ কি আসলে আমার ক্ষমতার ক্ষুধাকে আড়াল করে রেখেছে?’ তার সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোথায় একটা রোমান্টিকতা রয়েছে, যার ভেতরে বিষণ্ণতার একটা সুরও রয়েছে। অসলোতে যখন তিনি বাইরে তাকিয়ে দেখেন ভিড় করে লোকে হাতে মোমবাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অন্ধকার রাতে শিখাগুলো নড়ে নড়ে উঠছে, তখন আমরা বুঝি নোবেল পুরস্কার বিতরণী সভার আনুষ্ঠানিকতার চাইতে এই ঘটনাই তার মনকে বেশি ছুঁয়ে যায়।

আর সেই নোবেল! যখন তিনি পুরস্কার পাবার খবর পান ওবামা তো বিশ্বাসই করতে পারেননি।

‘কীসের জন্য পুরস্কার?’ ওবামার প্রশ্ন। বাস্তবে তিনি যেমন আর তার সম্বন্ধে মানুষের যে আশা তার মধ্যে যে একটা মস্তবড় ফাঁক রয়েছে, এই পুরস্কার তাকে সে বিষয়ে সচেতন করে তোলে। তিনি মনে করেন তার সম্বন্ধে মানুষের প্রচলিত ধারণায় অতিরঞ্জন রয়েছে, নিজের সম্বন্ধে নানান রঙিন ধারণার ফানুস তিনি নিজেই নাকচ করে দেন।

তার রাজনৈতিক কর্মজীবন যারা লক্ষ করেছেন তারা সবাই জানেন ওবামা মানুষ হিসেবে কতটা চিন্তাশীল, সংবেদনশীল। এই বইয়ে আমরা তার গভীর আত্মজিজ্ঞাসার পরিচয় পাই। সে বড় নির্মম আত্মজিজ্ঞাসা। প্রথম যেবার তিনি নির্বাচনে নামেন, তখন তার উদ্দেশ্য কি সত্যি সত্যি জনসেবা ছিল? নাকি আত্মম্ভরিতা বা আত্মপ্রশ্রয়? নাকি আশেপাশের সফলতর মানুষকে দেখে ঈর্ষা? তিনি লিখেছেন যে পাড়ার মানুষকে সংগঠিত করার কাজ ছেড়ে যখন তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ স্কুলে পড়তে যান, তখন তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন অসঙ্গত নয়। যেন উচ্চাশা থাকাটাই প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি স্বভাবে কিছুটা অলস কিনা এই কথাটা তাকে ভাবায়। স্বামী হিসেবে তার দোষের কথা তিনি স্বীকার করেন, তার ভুল ভ্রান্তি নিয় আক্ষেপ করেন এবং ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের লড়াইয়ের প্রথম দিকে কোথায় কী উলটাপালটা কথা বলেছেন তাই নিয়ে আজও মন খারাপ করেন। নিজের জীবনটাকে ভালোভাবে জানতে বুঝতে ওবামা কতখানি আগ্রহী, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না। তবে এটা কি আত্মরক্ষামূলক চাল, যার ফলে অন্যরা তার খুঁত ধরবার আগে তিনিই সেই কাজটা সেরে রাখছেন? তিনি লেখেন যে নিজের সম্বন্ধে তার বেশ খানিকটা স্পর্শকাতরতা রয়েছে, মানুষের তাচ্ছিল্য বা মানুষের কাছে বোকা প্রতিপন্ন হবার ব্যাপারে তার বড্ড আপত্তি।

নিজের অর্জন নিয়ে গর্ব করতে তার অনীহা রয়েছে। এই ধরনের ন্যাকামি মার্কিন দেশে একটি প্রচলিত প্রবণতা। তার আগে আরো অনেক তুখোর মেধাবী আমেরিকান উদারপন্থী মানুষের মাঝে একই ধরনের বিনয় দেখা গেছে – এ যেন অনেকটা বহুচর্চিত, আরোপিত ভঙ্গিমা। দেখে দেখে বলতে ইচ্ছে করে, আরে বাপু, মেলা হয়েছে, এবার নিজের পাওনা তারিফ খানিকটা গ্রহণ করো!

ওবামা অবশ্য বলেছেন যে তার অর্থনৈতিক পুনুরুদ্ধার নীতির ফলে আমেরিকার অর্থব্যবস্থা যেভাবে পুনরুজ্জীবিত হয়, বিশ্ব ইতিহাসে এত তাড়াতাড়ি এত বড় সঙ্কট থেকে আর কোন দেশে সেটা করতে পারেনি। তবে ওবামা এতটা কালে ভদ্রে নিজের কৃতিত্বের কথা বলেন যে তার এধরনের কথা একটু কানে বাজে। তার বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে প্রথম সামাজিক সচেতনতার কথা বলতে গিয়ে তিনি নিজের ওপর বড্ড খড়্গহস্ত হয়েছেন। তখনকার আত্মমগ্নতার রাজনীতি নিয়ে কড়া, প্রাপ্তবয়স্ক রায় দিয়ে বলেছেন, যে সেই রাজনীতি বড্ড বেশি নিজের সততা নিয়ে তুষ্ট ছিল, একটু বেশি নিবেদিত ছিল, নিরস, কাঠখোট্টা ছিল। তা তো ছিলই, ঐ বয়সে তাই তো হবার কথা।

ওবামার এই প্রবণতা আত্মসচেতনতার চাইতে একটু বেশি নেতিবাচক, তবে ঠিক আত্মধিক্কারের পর্যায়ে পৌছে না। কিন্তু এর একটা ভালো দিকও রয়েছে। এর ফলে যেন ওবামার মনটা আরো বড়ো হয়েছে, তার চরিত্রে মানবিকতা আর গভীর ঔদার্য যুক্ত হয়েছে। এ যেন নিজেকে কঠোরভাবে বিচার করবার ফলে তিনি মানসিক মুক্তিলাভ করেছেন, নিজেকে আর দশজনের চাইতে অনেক উঁচুতে বসাতে পেরেছেন। ফলে অকাতরে তিনি মানুষকে ক্ষমা করে দেন, তাদের তারিফ করেন, এমনকি অনেক সময় যারা উপযুক্ত নন তাদের ব্যাপারেও উদারমনস্ক হন। কিছু কিছু নেতাদের তিনি বড়ো মাপের মানুষের মর্যাদা দেন। এদের মধ্যে রয়েছে এক কালের সেনেটর ক্লেয়ার ম্যাকক্যাস্কিল, যিনি বিবেকের দোহাই দিয়ে অল্পবয়স্ক অভিবাসীদের সমর্থনে Dream Act- এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন; অর্থব্যবস্থার সঙ্কটের উথালপাথাল সময়ের তখনকার বড় নীতিনির্ধারক টিম গাইথনারের যার শিষ্টতা ওবামার সম্ভ্রম আকর্ষণ করেছে; রিপাবলিকান সেনেটর চাক হেগেল, যিনি ওবামার পররাষ্ট্রনীতির প্রতি নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন। মন ছুঁয়ে যায় ওবামার প্রেসিডেন্ট থাকার প্রথম মেয়াদের সময়কালের একেবারে ঘনিষ্ঠ সহকারীদের প্রতি গভীর মমতা – ভ্যালের জ্যারেট, ডেভিড এ্যাক্সেলরড, ডেভিড প্লাফ, রবার্ট গিবস, রাম এমানুয়েল। মনে সম্ভ্রম যায়গায় তার অত্যন্ত উঁচু মাপের কর্মস্পৃহা ও মূল্যবোধ – কোন সমস্যা হলে কখনো তিনি দোষী ধরার জন্য ব্যস্ত হতেন না। শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে জানবার জন্য নয়, নিজের মনকে চাঙ্গা করবার জন্য, নিজের সংশয় দূর করার জন্য তিনি নিয়মিতভাবে সাধারণ আমেরিকান মানুষের চিঠিপত্র পড়তেন।

প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লু বুশের কর্মজীবনের শেষ দিনে প্রতিবাদীদের দেখে তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন। তার কথা হলো মানুষটার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শেষ দিনে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অশিষ্টতা, কারণ এখন তার কোন প্রয়োজন নেই। খুব সুন্দর, মানবিক ভাবনা। তবে এখানেও ওবামার নিজেকে দূষবার বাতিকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ওবামা বলছেন, বুশের প্রতি সমবেদনায় তার নিজের খানিকটা স্বার্থও আছে, কারণ এখন তিনিই তো প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন।

তবে যতই কঠোরভাবে নিজেকে বিচার করুন, সেরা স্মৃতিকথাগুলোতে একটা মূল্যবান জিনিস থাকে সেটা কিন্তু ওবামার বইটিতে নেই। সেটা হলো যথার্থ লেখকসত্তার আত্মোদ্ঘাটন। মানুষটার সত্তা যেন একটা চৌকশ আস্তরণের নীচে চাপা পড়ে গেছে। যেন আবেগের আতিশয্যের প্রতি বিরাগের ফলে মানবিক আবেগকেও কঠোর শাসনে রাখা হয়েছে। ঐতিহাসিক ওবামাকেয়ার স্বাস্থ্য আইন পাশের খুঁটিনাটি নিয়ে তিনি বিশদভাবে লিখেছেন, কিন্তু সেই বিবরণে তার মনের অন্তর্জগতটা যেন অধরাই থেকে গেল। মার্কিন সেনেট-এ যখন ওবামাকেয়ার ঠেকাতে রিপাবলিকান সেনেটররা ফন্দি আঁটছে, তখন ওবামা মার্কিন হাউসের পরাক্রান্ত ডেমোক্র্যাট নেত্রী ন্যান্সি পেলোসির সাথে কথা বলেন। প্রসঙ্গ রিপাবলিকানদের ঠেকাতে একমাত্র উপায় সেনেটে যে বিল রয়েছে, হুবহু সেটা হাউসে পাশ করা। এই প্রসঙ্গে ওবামা বলেন - ‘ঐ মহিলাকে আমি দারুণ ভালোবাসি।’ কিন্তু যেই কারণে ফোনের কথোপকথন এতো জরুরি হলো, সেই হীন রিপাবলিকান কৌশল, তাদের বিদ্বেষের ফলে তার মনোকষ্ট বা বৌদ্ধিক কী খেসারত দিতে হয়েছে, তার কোন হদিস আমরা তার বইটিতে আর পাইনা। ‘মাঝে মাঝে চতুর্দিকে (স্বাস্থ্য নীতি নিয়ে) মিথ্যা কুৎসার ছড়াছড়ি দেখে যদিবা মনটা খারাপ হতো, এমনকি রাগও হতো, আমার এই অভিযানের সহযাত্রীদের হতোদ্যম না হয়ে আরো একনিষ্ঠভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাবার উদ্যম দেখে মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে যেত।’ শুনেই মনে প্রশ্ন জাগে – যদিবা মানে?

আজ যখন আমরা পেছন ফিরে তাকাই, তখন রিপাবলিকানদের ইচ্ছাকৃত একগুঁয়ে ওবামা বিরোধিতা খুব বেপরোয়া মনে হয়। হাউসের কংগ্রেস সদস্যরা প্রস্তাবিত বিল না পড়েই বিরোধিতা করছে, শুধুমাত্র প্রস্তাবগুলো ওবামা করছেন বলেই। তাদের বিরোধিতার ফলে দেশ রসাতলে গেলেও তাদের তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। রিপাবলিকানদরা এভাবে শত্রুতা না করলে কেমন হতো ওবামার শাসন? এই নিয়ে ওবামা কী ভেবেছেন সেটা জানতে মন চায়। যদি কট্টর রক্ষণশীল মতাদর্শে বিশ্বাসী বিলিয়নেয়ার ধনপতি ডেভিড ও চার্লস কোক শুধুমাত্র ওবামাকে ঠেকানোর জন্য আমেরিকার সবচাইতে ধনাঢ্য রক্ষণশীল মতাবলম্বী মানুষদের এক অশুভ জমায়েতের আয়োজন না করতেন? কেমন হতো যদি ওবামার শাসনের প্রতি মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তীব্র রিপাবলিকান বিরোধিতার কারণে এতটা বিকৃত না হতো? ‘ওবামাকেয়ার’ কথাটা প্রথমদিকে ওবামার স্বাস্থ্যসেবার আইনের প্রতি তাচ্ছিল্যসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। সেই ‘ওবামাকেয়ার’ কথাটা ওবামা যখন নিজেই ব্যবহার করেন, তাতেই বোঝা যায় তার শাসনের সময় ডানপন্থীরা আলোচনার দিকনির্দেশে কতখানি প্রভাবশালী ছিল। ওবামা যখন লেখেন যে ডানপন্থী তৃণমূল আন্দোলন টি পার্টি শুধূ তার নীতিমালার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছে তাই নয়, ব্যক্তিগতভাবে তাকেও কটুভাবে আক্রমণ করেছে, তখন তার কথায় কেমন যেন একটা দূরত্ব রচিত হয়, যেন তার হৃদয় বহুদূরে, আমাদের অগম্য।

বিদেশ নীতির ব্যাপারে অবশ্য ওবামা অতটা রয়ে সয়ে কথা বলেন না। তার মধ্যে একধরনের কাব্যিক, ভাবালুতামগ্ন কড়া জাতীয়তাবাদ দেখি। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যে কোন সমালোচনা যেন স্বদেশের সপক্ষে উচ্চকণ্ঠ, চৌকশ বক্তব্য রাখবার মুখবন্ধ মাত্র। সেই অর্থে মার্কিন উদারপন্থী প্রবণতা সম্বন্ধে যে ধারণা চালু রয়েছে – যে সচরাচর বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চে মার্কিন বিদেশ নীতির ব্যর্থতা কোন গৌণ বিষয় নয় বরঞ্চ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ, সেদিক থেকে ওবামা একেবারেই ভিন্ন। তিনি বরঞ্চ আমেরিকার অপ্রতিম উৎকর্ষের মুগ্ধ সমর্থক। ওবামার যুক্তি হলো মার্কিন দেশকে শুধু অন্যরা ভয় করে না, সমীহও করে। তাতেই প্রমাণ হয় যে অনেক ত্রুটি সত্ত্বেও মার্কিন দেশ পৃথিবীকে নিশ্চয়ই ভালো কিছু দিয়েছে। ওবামা লিখেছেন: ‘বিশ্বে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে যারা সবচাইতে বেশি অভিযোগ করেছে, তারাই আবার বিশ্বব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে আমেরিকার ওপর নির্ভর করেছে।’ এই ধরনের চিন্তায় প্রতিক্রিয়াশীলতার ছাপ পরিষ্কার। ওবামার ভাবখানা এমন যে সারা বিশ্বে মোড়লী করবার যে দায়িত্ব আমেরিকা নিজেই নিয়েছে, সেখানে তার সুষ্ঠু ভূমিকা আশা করলে সেই সাথে আমেরিকার বাড়াবাড়ি ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় মৌলিক একটা অসামঞ্জস্য রয়েছে।

রাজনৈতিক স্মৃতিকথার সবচাইতে আকর্ষনীয় দিক হলো একেবারের ভেতরের সব গোপন মুখরোচক কাহিনি। এমন সব ছোট ছোট তথ্য যা আমাদের প্রচলিত ধারণ উলটে দেয়। ওবামার নির্বাচনী অভিযানের সেই বিখ্যাত শ্লোগান, ‘হ্যা, আমরা পারি।’ (Yes, We Can)-এর কথা ধরা যাক। এটা ওবামার রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ডেভিড আক্সেলরড-এর মস্তিষ্কপ্রসূত। ওবামার অবশ্য বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। কিন্তু ওর স্ত্রী মিশেল বললেন মোটেও বাড়াবাড়ি নয়। অথবা কৃষ্ণাঙ্গ মানবাধিকার নেতা জেসি জ্যাকসনের কথা ধরা যাক। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামার প্রথম বিজয়ের পর, যখন ওবামা শিকাগোতে বিজয়ীর ভাষণ দেন, তখন জেসি জ্যাকসনের অশ্রুসজল মুখ বহু লক্ষ মানুষের মনে গেঁথে আছে। অথচ বইটিতে আমরা জানতে পারি যে ওবামার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেসি জ্যাকসনের সমর্থন অকুণ্ঠ ছিলনা, বরঞ্চ তার ছেলে জেসি জ্যাকসন জুনিয়রের সমর্থন অনেক জোরালো ছিল। আরো বিচিত্র কিছু তথ্য। যেমন হোয়াইট হাউসে থাকাকালে নিজেদের টয়লেট টিস্যু আর খাওয়া দাওয়ার খরচ ওবামা পরিবার নিজে বহন করেছে। আরেকটা কথা। কেউ কি ভাবতে পারে যে আট বছর প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বেসামরিক উপদেষ্টা নয়, সামরিক জেনারেলরাই ওবামাকে শক্তিপ্রয়োগের ব্যাপারের সংযমের পরামর্শ দিয়েছেন? এতদিন আমরা যারা তাকে টিভি পর্দায় বহুবার হন হন করে হোয়াইট হাউসে ঘাসের গালিচার ওপর দিয়ে চলতে দেখেছি বা দ্রুতপদে প্লেনে উঠতে দেখেছি, তারা কি জানি যে ওবামা হাঁটেন ধীরে ধীরে, তার স্ত্রী মিশেল যাকে ঠাট্টা করে বলেন হাওয়াইয়ান চালে। আমরা বরাবর তার সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের তারিফ করেছি। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছেলেমানুষের মতো অগোছাল। এর মধ্যে একটুখানি পুরুষতান্ত্রিকতা আছে, কারণ এর পেছনে যে যুক্তি কাজ করে তা হলো আর কেউ এসে সব গোছগাছ করে দেবে। সেই ব্যক্তি সচরাচর একজন নারীই হয়ে থাকে।

মিশেলের সাথে তার মমতাময় বন্ধুত্ব খুব খাঁটি বলেই এতটা উজ্জ্বল। তার জন্য মিশেল অনেক আত্মত্যাগ করেছেন, তার রাজনৈতিক কর্মজীবনের অনেক ঝক্কি মিশেলকে সামাল দিতে হয়েছে, এসব কথা ওবামা খোলাখুলি স্বীকার করেন। যখন মিশেলের সাথে তার প্রথম সাক্ষাত হয়, তখন ‘মিশেল এক কেতাদুরস্ত মহিলা, কর্মজীবনের ওপর তার পূর্ণ মনোযোগ, জীবনে সঠিক, শুদ্ধ পথে চলতে সে বদ্ধপরিকর, কোন এলেবেলে ব্যাপারে এক মূহুর্ত সময় নষ্ট করতে নারাজ।’ খুব অল্প সময়ের জন্য মিশেল তার পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন। ওবামার জীবনে মিশেল এবং আরো দুজন অসাধারণ নারী - ওবামার মা আর নানী - এঁদের উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলেই হয়তোবা ওবামা নারীবিদ্বেষের ব্যাপারে এতটা সচেতন। মেয়েদের নানান প্রতিবন্ধকতা, তাদের প্রতি অবিচার, তাদের বেলায় ভিন্ন মানদণ্ড প্রয়োগ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পরস্পরবিরোধী প্রবণতা – এইসব কিছু ওবামা এত স্বচ্ছন্দে আর সহজে বর্ণনা করেন যে তাতে একটা অদ্ভুত ক্ষোভ জন্মায়। যেন মধ্যবিত্ত আমেরিকায় এক নবজাতকের মা তার ধৈর্যশীল, সবরকম-সাহায্য-করতে-প্রস্তুত স্বামীকে দেখে ক্ষেপে যান কারণ তার কাছে যেটা কাঙ্খিত সেটা স্বামীর সমবেদনা নয়, সেটা হলো এমন একটা সমাজ যেখানে সেই সমবেদনার আর কোন প্রয়োজন নেই। এতদিন পর একজন পুরুষমানুষের দেখা মিলল যিনি নারীর অবস্থাটা সত্যি বুঝতে পারেন। কিন্তু এতটাই ভালোভাবে বুঝতে পারেন যে তার মধ্যে যেন একটা প্রচ্ছন্ন অপমান নিহিত। আরেকটা বিষয় – ওবামা বারবার পুরুষের দৈহিক সৌন্দর্যের উল্লেখ করেন কিন্তু নারীদের ব্যাপারে নিরব – এর মধ্য দিয়ে ওবামা কি নারী-পুরুষের অসম সামাজিক অবস্থান উলটে দিয়ে তাকে ঠারেঠোরে কটাক্ষ করছেন? চার্লি ক্রিস্ট বা রাম এমানুয়েল যে কত সুপুরুষ সে কথা আমরা শুনি, কিন্তু সোনিয়া গান্ধীর মতো দুই একটা উদাহরণ ছাড়া আমরা নারীর সৌন্দর্য নিয়ে আর কিছু শুনি না।

বাস্তবজীবনে ওবামা নারীদের চাকুরিতে নিয়োগ করেন, তার অধীনস্থ নারী কর্মীরা পুরুষ সহকর্মীদের নারীবিদ্বেষী আচরণ নিয়ে অভিযোগ করলে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করেন। তবে হিলারি রড্যাম ক্লিনটন-এর সাথে আর একটা গোলমেলে ইতিহাস আছে বলে হিলারির যে চিত্র তিনি আঁকেন, তাতে তিনি রাজনীতিতে নারীদের সমকক্ষ মনে করেন কিনা সে ব্যাপারে কোন বৃহত্তর পরামর্শ আছে কিনা সেটার খোঁজ নেবার জন্য সেটা খুঁটিয়ে পড়ার লোভ সম্বরন করা কঠিন। হিলারির জন্য তার সমীহে কোন খাদ নেই। সেনেটে প্রথম দিকের দিনগুলোতে ওবামা আর তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা হিলারির থেকে অনুপ্রেরণা পেতেন, তাকে পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখতেন। ঠিক যেমন তিনি রাজনৈতিক স্টান্টবাজিতে বিশ্বাস না করে অর্থবহ রাজনৈতিক পরিবর্তনে কাজ করায় বিশ্বাস করতেন, ওবামা ও তার সহকর্মীদেরও তেমন লক্ষ্য ছিল। নিউ হ্যাম্পশায়ারে যখন হিলারি প্রকাশ্যে কাঁদেন, তখন মিডিয়াতে অন্যায়ভাবে তার বিদ্রুপ করা হয়। ওবামা সেই অশ্রুবর্ষণকে বলেন ‘এমন সত্যিকার আবেগের বহিঃপ্রকাশ, যা কালে ভদ্রে দেখা যায়।’ বিতর্কের সময় ওবামা হিলারিকে বলেন, ‘তোমাকে মানুষ তো যথেষ্ট পছন্দ করে।’ কথাটা কেন বলেছিলেন বইয়ে ওবামা তার কৈফিয়ত দেন। ওবামা কথাটা এই ভেবে বলেছিলেন যে প্রশ্নটাই আপত্তিকর, কারণ সেখানে এমন ইঙ্গিত রয়েছে যে মেয়েদের মানুষের কাছে পছন্দনীয় হবার নানান হ্যাপা আছে যেসব পুরুষদের পোয়াতে হয় না। এই বিষয়ে আলোচনার সন্তোষজনক সমাপ্তি ঘটতে না ঘটতেই ওবামা বলেন যে তিনি হিলারিকে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাছাই করার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু পরে ঠিক করেন যে তাতে ঝামেলা বাঁধতে পারে। যথার্থই ঝামেলা বাঁধাবার মতো কারণ আছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, তবে ওবামার আসল কারণ কি ছিল শুনবেন? হোয়াইট হাউসের মূল দফতর ওয়েস্ট উইং-এ একজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট কোন সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ছাড়া ঘোরাঘুরি করবে, সেটা বড্ড অস্বস্তিকর। অর্থাৎ তার স্বামীর কারণে হিলারি দায়িত্বটা পেলেন না।

বইটিতে ওবামার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবনীমূলক রেখাচিত্র রয়েছে সেগুলো সংক্ষিপ্ত অথচ সুক্ষ্ম রসবোধ আর তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টিতে ঋদ্ধ। যেমন আইওয়া অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী অভিযানে নির্বাচন কর্মী এমিলির সম্বন্ধে ওবামা বলছেন ‘আমার রসবোধ, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব সবই তার নির্মোহ দৃষ্টির কাছে সম্পূর্ণ পরাস্ত হলো, শেষমেশ ঠিক করলাম ও যা যা বলবে ঠিক তাই করবো।’ ভ্লাদিমির পুতিনকে দেখে তার শিকাগোর ধূর্ত, মাস্তান ওয়ার্ড প্রধানদের কথা মনে পড়ে যায় – এরাই শিকাগোর স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করে। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বব গেটস বা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ-এর মধ্যে ওবামা একধরনের নিরাসক্ত সততা দেখতে পান। জেনারেল স্ট্যানলি ম্যাকক্রিস্টালকে দেখে তার মনে হয় ‘মানুষটা যেন জীবন থেকে সব আলতু ফালতু কাজ ও চিন্তা ভাবনা ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন।’ রাহুল গান্ধী সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘ওর মধ্যে কেমন একটা অপরিপক্ক, কম্পমান ভাব রয়েছে, যেন সে এক শিক্ষার্থী, পাঠ্যসূচি অধ্যয়ন সমাপ্ত করে শিক্ষককে সন্তুষ্ট করতে আগ্রহী, কিন্তু অধীত বিষয় আত্মস্থ করবার ক্ষমতা অথবা নিষ্ঠা নেই।’ জো বাইডেন একজন সজ্জন, সৎ, স্বজননিষ্ঠ লোক। তবে ওবামার অনুমান ‘বাইডেন যদি মনে করেন তাকে যথাযোগ্য সম্মান করা হচ্ছে না তাহলে ক্ষেপে যেতে পারেন। বয়সে তরুণ ওপরওয়ালার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।’ রিপাবলিকান সেনেটর চাক গ্রাসলি ‘ঠারে ঠোরে প্রস্তাবিত বিল নিয়ে তার দ্বিধার কথা বললেও ঠিক কী পরিবর্তন আনলে তার সম্মতি পাওয়া যাবে সেই কথাটা আর আমাদের বলেন না।’ স্যারা পেলিন দেশশাসন সম্বন্ধে ‘কী যে বলে তার মাথামুণ্ডু সে নিজেই কিসসু বোঝে না।’ সেনেটের রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল-এর ‘ব্যক্তিত্ব বা রাষ্ট্রনীতিতে যে খামতি রয়েছে সেটা তিনি পুষিয়ে নিয়েছেন সুশৃঙ্খল, ধূর্ত নির্লজ্জতা দিয়ে – এবং সেটা তিনি নির্মোহ্ একাগ্রতার সাথে ক্ষমতা আহরণের উদ্দেশ্যে ব্যয় করেন।’ ফরাসী প্রেসিডেন্ট নিকলাস সার্কজি সাহসী, সুযোগসন্ধানী, ওবামার চোখে তিনি ‘উদ্ধত ছোট্ট মোরগের মতো বুক চিতিয়ে চলেন।’

এক একান্ত বৈঠকে চীনের রাষ্ট্রপ্রধান হু জিনতাও যখন একগুচ্ছ নথি থেকে পাঠ করেন তখন সেটা এতটা একঘেয়ে হয়ে ওঠে যে ওবামা একবার ভাবেন যে তিনি পরামর্শ দেবেন ‘নথি বিনিময় করে নিজে নিজে সুবিধামতো পড়ে নিলে তাতে উভয়েরই সময় বাঁচবে।’ সাউথ ক্যারোলাইনার সেনেটর লিন্ডসে গ্যায়াম সম্বন্ধে ওবামার মন্তব্য, তিনি হলেন গোয়েন্দা ছবি বা ব্যাঙ্ক ডাকাতির ছবির সেই চরিত্রের মতো ‘যে নিজেকে রক্ষার জন্য সবার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।’ ডেমোক্র্যাট সেনেট নেতা হ্যারি রিড ঠোঁটকাটা স্বভাবের, তবে মানুষটা সজ্জন ও সৎ। ওবামা জিততে পারবেন এই আত্মবিশ্বাস হবার বহু আগেই তাকে চমকে দিয়ে রিড বলেছিলেন: ‘তোমার জেতার ক্ষমতা রয়েছে।’ সেনেটর টেড কেনেডি ওবামাকে কেনেডি ঘরানার ঐতিহাসিক পরম্পরার সুর টেনে বলেছিলেন, ‘তুমি সঠিক সময় বাছাই করবে না, সময়ই সঠিক মূহুর্তে তোমাকে বাছাই করবে।’

কেনেডির কথায় নিয়তির একটা আভাস রয়েছে, কিন্তু ওবামা সেই নিয়তিকে স্বাগত জানিয়েছেন কিনা সেটা কিন্তু মোটেও পরিষ্কার নয়। রাজনীতিতে তার অংশগ্রহণে দ্বিধা ও কখনো কখনো কুণ্ঠা রয়েছে। তার জন্য মানুষের ভীড় যত স্ফীত হয়, তার একাকীত্ব যেন আরো বাড়ে। তার মনের ভেতরে যে বাউন্ডুলে মানুষটা বাস করে সে প্রথাগত রাজনীতিকে গভীর সন্দেহের চোখে দেখে, আবার তার মধ্যে একটা বাস্তববাদী মানুষ আছে সে রাজনীতির সীমাবদ্ধতার ব্যাপারেও সজাগ। কী অভাবিতভাবেই না তার রাজনৈতিক উত্থান ঘটে! যখন ২০০০ সালে ওবামা এক বন্ধুর অনুরোধে ডেমোক্র্যাটিক সম্মেলনে যান, তখন তার ভবিষ্যত অন্ধকার, ক্রেডিট কার্ডে পয়সা নেই বলে গাড়িভাড়া করবারও সামর্থ্য নেই। সম্মেলনের মূল মিলনায়তনে তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়না, কারণ দলীয় পদমর্যাদায় তিনি অকিঞ্চিতকর। তার মাত্র চার বছর পরে তিনি এমন এক মূল বক্তৃতা দেন যে সেটাই শেষ পর্যন্ত তার প্রেসিডেন্ট হবার যাত্রাপথ সুগম করে। প্রথম থেকেই যেন কেমন একটা আবহ ছিল তাঁকে ঘিরে – তিনি গড়পড়তা রাজনীতির নোংরামি থেকে ঊর্দ্ধে। ইলিনয় রাজ্য সেনেটে এক সহকর্মী একবার একটি নৈতিকভাবে ধোঁয়াটে সমঝোতায় সমর্থনের জন্য ওবামাকে আর চাপ দিলেন না – কারণ ‘ব্যারাক অন্যরকম, ও অনেক ওপরে উঠবে।’

ওবামা যখন মার্কিন সেনেটের পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তখন বেশ বড় ঝুঁকি নেন। মিশেল ঘোর আপত্তি করেন। একে তো লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার আরামটার বারোটা বাজবে। তার ওপর ব্যাঙ্কে সঞ্চয় যৎসামান্য, ওবামার আইনের প্র্যাকটিস বন্ধ করলে সেটা আরো সঙ্কুচিত হবে। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওবামা যথেষ্ট মেহনত করেন, কিন্তু তারপরও বোঝা যায় যে পরাজয় হলে যে তার জীবন বৃথা হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী অভিযানের সময় তার রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ডেভিড এ্যাক্সেলরড ওবামাকে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় না প্রেসিডেন্ট না হলে আপনি খুব দুঃখ পাবেন।’ হয়ত তিনি প্রেসিডেন্ট হতে চান, কিন্তু প্রেসিডেন্ট হতেই হবে এমনটা নয়। তিনি শুধু ক্ষমতার জন্য ক্ষমতা চান না, ক্ষমতা পেলে কী করতে পারবেন সেই কথা ভেবেই ক্ষমতা চান, এবং পরিবর্তন আনার জন্য তিনি যে কোন পথে যেতে পারেন, তাতে যদি ক্ষমতা অর্জন না হয় তাও সই।

হয়তো এজন্যই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার আট বুছর পরও তাকে হাবেভাবে আগন্তুক মনে হয়। মনে হয় যেন একজন অংশগ্রহণকারী হিসেবে নয়, তিনি যেন একজন বহিরাগতের চোখ দিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রত্যক্ষ করছেন। প্রতি বছর হাউস ও সেনেটের মিলিত সভায় প্রেসিডেন্টের State of the Union বক্তৃতা নিয়ে তার বর্ণনায় একতা শ্রান্তির সুর রয়েছে। যখন ওবামা এই বক্তৃতার গতবাঁধা নাটুকে ধরন, একমাত্র বিদেশে মার্কিন সেনাবাহিনীর উল্লেখ ছাড়া সর্বদলীয় করতালির অভাব – এসব কথা উল্লেখ করেন, তখন তাতে একটা প্রচ্ছন্ন শ্লেষ রয়েছে, আবার ভগ্নহৃদয়ের বেদনাও রয়েছে। ওবামার খুব সাধ পরিস্থিতি অন্যরকম হোক। সেনেটে প্রেসিডেন্টের নিয়োগকৃত প্রার্থীদের সেনেটে অনুমোদনের ব্যাপারে শুধু প্রশাসনকে বিপাকে ফেলার জন্যই বিপক্ষ দল যদি সব সময় বাগড়া না দিত? যদি সাধারণ মানুষের জন্য গুরুত্ব বহন করে এমন সব বিষয় শুধুমাত্র তাদের পক্ষে জাঁদরেল লবিইস্ট নেই বলে উপেক্ষা না করা হতো? রিপাবলিকান সেনেটর অলিম্পিয়া স্নো যখন ওবামার স্বাস্থ্য নীতির সপক্ষে ভোট দেবার কথা ভাবছিলেন তখন রিপাবলিকান সেনেট নেতা মিচ ম্যাককনেল বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাকে উচ্চপর্যায়ের কমিটি পদ থেকে বরখাস্ত করা হবে, এই শাসানি দিয়ে নিরস্ত করেছিলেন। যদি সেনেটরদের ভোট দিতে এভাবে শাসানি না দেওয়া হতো?

এই অন্য রকম একটা বিপক্ষবান্ধব পরিবেশের জন্য ওবামার আকুতি এতটাই পরিষ্কার যে তিনি সেনেটের তেজী বর্ষীয়ান নেতাদের বিপক্ষ দলের সহকর্মীদের সাঙ্গে বন্ধুত্বকে শ্রদ্ধা করেন। ডেমোক্র্যাট টেড কেনেডি, জন ওয়ার্নার আর রিপাবলিকান অরিন হ্যাচ-এর মধ্যে যে গভীর সৌভ্রাতৃত্ব বিদ্যমান, সেটা আরো অল্প বয়সের সেনেটরদের মধ্যে নেই। এদের মধ্যে ওবামা “আরো কট্টর মতাদর্শগত উগ্রতা দেখেন, যেটা সাবেক রিপাবলিকান হাউস স্পিকার নিউট গিংগ্রিচ-এর আমলের হাউসের রাজনৈতিক আবহের মতো।’ দুই দলের মধ্যে সমঝোতা তার কাছে খুব বড়ো জিনিস। তিনি রিপাবলিকান বব গেটসকে তার প্রশাসনে চেয়েছেন যাতে তার নিজের পক্ষপাতের ব্যাপারে তিনি সাবধান করতে পারেন। এই কথাটা বারবার মনে হয় ওবামা যাদের মন জয় করতে পারেননি তাদেরকে যেন যাদের মন জয় করতে পেরেছেন তাদের সমান, এমনকি তাদের চাইতে বেশি সমীহ করেন। কিছু কিছু প্রগতিশীল আশাহত হয়েছেন, কিন্তু ওবামার কাছে তারা যা চেয়েছেন সেটা তো তিনি কখনোই দেবেন বলে কথা দেননি। তাদের উদ্দেশ্যে বইটিতে তার পরিষ্কার বক্তব্য রয়েছে। তার সম্বন্ধে কল্পনাবিলাসী আদর্শবাদী হিসেবে যে ধারণা চালু হয়েছে সেটা সঠিক নয়। তার আদর্শবাদ অনেক বেশি বাস্তবমুখী, তাতে তার নানীর গভীর প্রভাব রয়েছে। ওবামা লিখছেন: ‘ওর কারণেই তরুণ বয়সে আমার সবচাইতে বৈপ্লবিক চেতনার মূহুর্তেও আমি একটা সুপরিচালিত ব্যবসা দেখে বাহবা দিতাম, আর পত্রিকার ব্যবসার পাতার খোঁজখবর রাখতাম। সেকারণেই আমি সবকিছু ভেঙে আবার নতুন করে সমাজ গড়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছি।’

একই কারণে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি খুব স্বচ্ছ দৃষ্টিতে শাসনের বাস্তবতা উপলব্ধি করেন। ‘যে সমঝোতাটা হলো, সেটা আমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু এ যেন এক পরিচিত ছক হয় উঠছে। বিকল্প যা আছে, সেগুলো আরো খারাপ।’ এখানে ওবামা যা লিখেছেন, সেটা তার প্রায় সব বড়ো বড়ো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে খাটে। মার্কিন দেশের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র ওয়াল স্ট্রিট-এ তাকে কখনো বলা হয় ওয়াল স্ট্রিট-বিরোধী আবার প্রগতিশীলরা তাকে কখনো বলে ওয়াল স্ট্রিট-বান্ধব, এটা ওবামা এবং তার প্রেসিডেন্ট শাসনামলের জটিল বাস্তবতার ইঙ্গিতবহ। আর যাদের মনে এখনো প্রশ্ন রয়েছে, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই তিনি প্রেসিডেন্ট জর্জ হার্বার্ট ওয়াকার বুশ যেভাবে ইরাক যুদ্ধ সমাপ্তি ঘটিয়ে ছিলেন, সেখানে তার বিদেশ নীতির অনুরাগী। তিনি ইরাক যুদ্ধ সমর্থন করেননি, তবে আফগানিস্তানে যুদ্ধ প্রয়োজনীয় মনে করেন।

তিনি লেখেন যে রিপাবলিকানরা জয়ের জন্য লড়াই করতে বেশি দক্ষ। বামপন্থীদের মাঝে ঠিক একই রকম ঐক্যের জন্য তার অনুচ্চারিত আকুতি দেখি। স্বাস্থ্য আইনের থেকে সরকার-চালিত স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা বাদ দেওয়া হলো কারণ সেটা থাকলে আইন পাশ করা সম্ভব হতো না। বহু ডেমোক্র্যাট বোধগম্য কারণে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। ওবামা আশা করেছিলেন প্রগতিশীলরা তার বাস্তববাদিতার সাথে একমত হবেন, তারা বুঝতে পারবেন যে বিলটি পাশ করার জন্য তার আর কোন বিকল্প ছিলনা। বইয়ে তিনি এই অশুদ্ধ স্বাস্থ্যনীতির আইন পাশের পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন। এর আগেও নাগরিক অধিকার আইন, ১৯৪০ দশকে ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের New Deal এর মতো গভীর অর্থবহ সমাজ সংস্কারমূলক আইনগুলো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পাশ করানো হয়েছিল। তারপর সেগুলো ঠিকঠাক করা হয়। কিন্তু তখন ওবামা খোলাখুলিভাবে ঘনঘন এই যুক্তির পক্ষে বলেন নি কেন?

বর্ণবাদ নিয়ে তার কাছে আরো কিছু কথা আশা করেছিলাম। তিনি বর্ণবাদ নিয়ে এমনভাবে মন্তব্য করেন যেন সারাক্ষণ তার মনে এই চিন্তাটা ঘুরপাক খাচ্ছে যে একজন স্পর্শকাতর শাদা পাঠক তার কথায় ক্ষুব্ধ হতে পারেন। বর্ণবাদের কোন উদাহরণ উল্লেখ করলেই তার আগে আরো কিছু উদাহরণ দেন যাতে আপাতদৃষ্টিতে বর্ণবাদের অভাব প্রতীয়মাণ হয়। সেজন্য যখন আমরা শুনি যে আইওয়াতে এক সমর্থক বলছে ‘ভাবছি নিগারটাকেই ভোট দেব,’ তখন আমরা আরো বহু ভালো আইওয়া বাসিন্দাদের কথা শুনি যারা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে ভাবছেন। এই যে বর্ণবাদী মূহুর্ত, সেটাকে কখনো ঠিক খোলাসা করে, বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার সুযোগ দেওয়া হয় না, তার ওপর জটিলতার মায়াজাল বিস্তার করা হয়। বর্ণবাদ বিষয়টি অবশ্যই জটিল, তবে জটিলতার ধারণাটা গা বাঁচানোর ছুতো হিসেবে বড্ড বেশি ব্যবহার করা হয়, যাতে আলোচনাটা স্বস্তিকর থাকে, বর্ণবাদের পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি বিবেচনা করার ফলে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের দূরে না ঠেলে দেওয়া হয়।

প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনী লড়াইয়ে ওবামা উপলব্ধি করেন যে জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে হোক, বা গেরস্থ অধিকার বা অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণের দাবি, ইত্যাদির ভিত্তিতেই হোক, গোষ্ঠীগত স্বার্থে রাজনীতি আমেরিকার মজ্জাগত। শুধুমাত্র কালো আমেরিকানরাই এই রাজনীতি করলে সমূহ বিপদ। নাগরিক অধিকার বা পুলিশী অত্যাচারের মতো ‘কালো বিষয়’ নিয়ে বেশি মাতামাতি করলে শাদারা বিগড়ে যেতে পারে। আইওয়া-তে নিজ দলের মনোনয়নের নির্বাচনী লড়াইয়ে ওবামার রাজনৈতিক পরামর্শদাতা রবার্ট গিবস ওবামাকে বলেন – ‘বিশ্বাস করুন, আপনার সম্বন্ধে লোকে আর কিছু জানুক বা না জানুক, আপনি যে আমেরিকার প্রথম ৪২ জন প্রেসিডেন্টের চাইতে দেখতে অন্যরকম, সেটা লোকে ঠিকই দেখেছে।’ অর্থাৎ - ‘ওদের আবার মনে করিয়ে দেবার দরকার নেই যে আপনি কালো।’ যেই কথাটা অনুচ্চারিত রয়ে গেল সেটা হচ্ছে কালো হওয়াতে যদি সমস্যা না থাকত, তাহলে ভোটারদের সেটা মনে করিয়ে দিলে কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। এটা এত বড় অন্যায়, অথচ আমরা বুঝতে পারি যে এই পন্থাই সবচাইতে বাস্তবানুগ, জেতার একমাত্র উপায় – যদিও এই বিষয়ে বাস্তবানুগ হওয়াটাই গর্হিত।

তার শাসনামলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কালো অধ্যাপক হেনরি লুইস গেইটস একবার যখন নিজের বাড়িতে তালা ভেঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করেন তখন তাকে এক শাদা পুলিশ অফিসার গ্রেফতার করেন। ওবামা অধ্যাপকের দৃষ্টিভঙ্গি ‘সোজা-সাপ্টা ভালো বনাম মনের নীতিকাহিনি নয়, বরঞ্চ আরেও ব্যক্তিগত, মানবিক’ মনে করেন। ওবামার যুক্তি হলো গেইটসকে গ্রেফতার করতে পুলিশ যেমন বাড়াবাড়ি করেছে, ঠিক যেমন তার বাড়িতে পুলিশ আসায় অধ্যাপকের প্রতিক্রিয়াতেও বাড়াবাড়ি রয়েছে। এমন যুক্তি বর্ণবাদ সম্বন্ধে অসচেতন, অজ্ঞ লোকে করে থাকে। উভয় পক্ষেরই দোষ, যেন ক্ষমতা উভয় পক্ষেই সমান! (অভ্যন্তরীণ জরিপে ওবামা জানতে পারেন যে গেইটসের ঘটনার ফলে শাদা ভোটারদের মাঝে তার প্রতি সমর্থন সবচাইতে বেশি হ্রাস পায়।)

শিকাগো শহরে থাকার সময় ওবামা সপরিবারে মাঝে মাঝে একটা গীর্জায় প্রার্থনায় যেতেন, তার ধর্মযাজক ছিলেন জেরেমায়া রাইট। গীর্জায় রাইটের অগ্নিঝরা বক্তৃতা ওবামার শাসনামলে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। তার সম্বন্ধে আলোচনার সময়ও ওবামার মধ্যে খানিকটা উন্নাসিকতা, কিঞ্চিত তাচ্ছল্যমিশ্রিত প্রশ্রয় দেখি। ওবামা লেখেন যে ‘তার উচ্চকণ্ঠ গালাগালে সত্যতা যদিবা ছিল প্রেক্ষিত বিচার ছিল না।’ ওবামা যেন বলতে চাইছেন যে অবস্থাপন্ন সফল কালো মানুষের ধর্মসভায় এসব কথা ঠিক মানায় না। যেন উচ্চশ্রেণির সামাজিক সুবিধায় বর্ণবাদের বিষ নির্মূল হয়ে যায়! আমেরিকার বর্ণবাদ সম্বন্ধে ওবামার উপলব্ধি অত্যন্ত সুক্ষ্ম এবিষয়ে কোন সংশয় নেই, তবে তার অনন্য পারিবারিক ইতিহাসের কারণে হয়তো তিনি নিজেকে মধ্যস্থতাকারী মেঝো সন্তানের ভূমিকায় রাখেন। ফলে যেসব সত্য তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করবে সেটা তিনি অনুচ্চারিত রাখার পক্ষপাতী, আর কিছু সত্য যদিবা উচ্চারণও করেন, সেসব নানান মধুর ছলনার চাদরে জড়িয়ে রাখেন।

গ্রামীণ শাদা মজুর শ্রেণি সম্বন্ধে তার যে মন্তব্য – ‘ওদের মনে পুঞ্জিভূত তিক্ততার কারণে ওরা বন্দুক বা ধর্মবিশ্বাস, বা নিজেদের থেকে দেখতে ভিন্ন এমন মানুষের প্রতি বিদ্বেষ, বা অবাধ বাণিজ্য-বিরোধী ভাবনা – এইসব আঁকড়ে ধরেন, তাদের নিজেদের হতাশা প্রকাশ করবার জন্য এসব ক্ষোভ ব্যবহার করেন’ – সেটা নিয়ে এখনও ওবামা অনেক ভাবেন। কারণ মানুষ তাকে ভুল বুঝুক, এতে তার প্রবল আপত্তি। সঙ্গত কথা। শাদা মজুর শ্রেণির প্রতি তার সমবেদনা রয়েছে, কারণ তাকে কোলে পিঠে বড় করেছে যে নানা, উনিও তো খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্তু যখন নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য তিনি বলেন, ‘আমেরিকার ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, নিজেদের অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা নিয়ে শ্বেতাঙ্গ খেটে খাওয়া মানুষের মনে যে ক্ষোভ, রাজনীতিকড়া সেটাকে কালো বা বাদামী মানুষের প্রতি বিদ্বেষে পরিণত করেছে।’ কথাটার মধ্যে একটা আশ্চর্য ফাঁকি রয়েছে, সত্য কথা স্পষ্টভাবে বলার দায় এড়াবার প্রবণতা রয়েছে। শাদা শ্রমিক শ্রেণির বর্ণবাদ কি শুধুমাত্র নিরীহ শাদা লোককে বজ্জাত রাজনীতিবিদরা ধোকা দেবার ফলশ্রুতি? যখন ওবামা লেখেন যে রিপাবলিকান সেনেটর জন ম্যাককেনের মধ্যে কখনো অন্য অনেক রিপাবলিকান রাজনীতিবিদদের মতো ‘বর্ণাশ্রয়ী স্বজাতির প্রতি পক্ষপাত’ দেখা যায় নি, তখন এই ধরনের ভেদবুদ্ধির আরো পুর্ণাঙ্গ উদাহরণ বইটিতে দেখার ইচ্ছে হয়। বইটি পড়ে মনে হয় অত্যন্ত বিদগ্ধ দৃষ্টিতে বর্ণবাদের বিচার করতে গিয়ে বর্ণবাদকে খানিকটা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্যনীতি আইন নিয়ে বিতর্কে মাত্রাগত পরিবর্তন আনতে ওবামা কংগ্রেসে সেনেট ও হাউসের যৌথ অধিবেশনে বক্তৃতা দেন। এই আইনে বেআইনি অভিবাসীদের স্বাস্থ্য সুবিধা দেওয়া হবে, এই সর্বৈব মিথ্যা কথাটা যখন ওবামা খণ্ডন করেন, তখন জো উইলসন নামে এক নাম-না-জানা কংগ্রেসম্যান রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে (আমার মতে সেটা বর্ণবাদী ক্রোধ) চীৎকার করে বলেন, ‘আপনি মিথ্যা কথা বলছেন!’ এই মূহুর্তটি আমেরিকার ইতিহাসে অতি পরিচিত। সামাজিকভাবে উচ্চতর অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও একজন কালো মানুষের একজন অধস্থন শাদা মানুষের কাছে অপমানিত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম বা শেষ নয়। ওবামা লেখেন যে ‘আমার ইচ্ছে হয়েছিল আমার সুউচ্চ অবস্থান থেকে নেমে গিয়ে আসন সারির মাঝখানের পথ বেয়ে গিয়ে লোকটার মাথায় একটা চাটি মারি।’ ব্যাপারটা খানিকটা ধামাচাপা দেবার চেষ্টার কারণটা আমি বুঝতে পারি – উনি কালো মানুষ, তাই ওঁর রাগ করার অধিকার নেই – কিন্তু আজ সেই ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে চাটি মারার বালখিল্য ভাষা ব্যবহার করছেন দেখে একটু হতবুদ্ধি হলাম। যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের যৌথ সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে এই প্রথম এভাবে জনসমক্ষে অপমানিত হলেন। এর তাৎপর্য কী?

একথা ঠিক তার মধ্যে একটা বিদেশী বিদেশী ভাব ছিল, তার বাবা এমনকি তার নামও বেশ অন্যরকম – এই সব কারণ তার প্রতি আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু তার বিদেশী ভাবটা যদি শ্বেতাঙ্গ বর্ণের হতো, যেমন তার বাবা যদি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, বা আইরিশ বা পূর্ব ইউরোপীয় হতো, তার ডাকনাম যদি ওলাফ বা এমনকি ভ্লাদিমির হতো, তাহলে তার চরিত্রহনন এতটা বীভৎস হতো না। গায়ের রঙ কালো না হলে তিনি এত বেশি হত্যার হুমকির মুখোমুখি হতেন না যে কারণে নির্বাচনের গোড়া থেকেই সিক্রেট সার্ভিসের সুরক্ষা প্রয়োজন হয়েছিল, নির্বাচনে জয়লাভের অনেক, অনেক আগে থেকেই তার শোবার ঘরে বুলেটনিরোধক দেয়াল বসানো হয়েছিল।

অনেক কালো আমেরিকানরা ‘আত্মরক্ষামূলক নেতিবাচকতার’ শিকার হয়েছিলেন। ওরা ধরেই নিয়েছিলেন যে প্রেসিডেন্ট পদে দাড়াবার ঔদ্ধত্য দেখাবার জন্য ওবামাকে হত্যা করা হবে। এতে কালো আমেরিকানদের সম্বন্ধে দেশটার চিন্তার বন্ধ্যাত্যই প্রকাশ পায়। নামে হুসেন থাকা সত্ত্বেও ওবামা হোয়াইট হাউসে যেতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন কেন? কেন উনি যখন জিতেছিলেন আমরা সবাই কেঁদেছি?

ওবামার শাসনামলে আমি সরোষে আমার বন্ধু ও তর্কের সাথী চিনাকু কে ধমক দিতাম – ‘আবার তুই ওবামার চাল মারছিস।’ ওবামার চাল মানে চিনাকু প্রতিটি বিষয় ৭৩টা দিক থেকে দেখত এবং সেটা সবিস্তারে বোঝাত। আমার কাছে ব্যাপারটার মধ্যে একটা ধাপ্পা রয়েছে বলে মনে হতো। মানে এতো বিশদে একটা জিনিস দেখলে সেই দেখায় আর সারবস্তু বলে কিছু থাকেনা, ফলে ঠিক কোন পক্ষই নেওয়া হয় না। এই বইটাতে ওবামা নিজেই মাঝে মাঝে ওবামার চাল মেরেছেন। যেন এক লোক কীভাবে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে সেইটাও পর্যবেক্ষণ করছেন। তার সংশয় বাতিকটা এতই গোঁড়া, সব দিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর যেন কোনটাই তার পছন্দ নয়। কোন মতাদর্শের কট্টর অনুসারী হওয়া তো তার ধাতেই নেই। তাঁদের সম্পর্কের প্রথম দিকে মিশেল তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সব সময় ও সবচাইতে কঠিন পথটা বেছে নেয় কেন। সত্যি তো। এই বইটিতে একজন অবিশ্বাস্যরকমের সজ্জন লোক নিজের সম্বন্ধে সত্যনিষ্ঠ বিবরণ দিয়েছেন। আজকাল একটা কথা খুব চালু হয়েছে, কোন বিখ্যাত মানুষের প্রশংসা করার আগে বলে নেয়া হয় যে লোকটার স্বভাবে সীমাবদ্ধতা আছে। কার স্বভাবে সীমাবদ্ধতা নেই? রীতি হিসেবে এটা একটা অভদ্র চালাকি মনে হয়, যেন একজন ক্ষমতাশালী বা বিখ্যাত ব্যক্তির যতই তারিফ পাওনা হোক, তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে আমাদের একধরনের সংকীর্ণ কুণ্ঠা রয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে ওবামার এই গল্প আরো এগোবে, তবে ইতোমধ্যেই ব্যারাক ওবামা মার্কিন ইতিহাসের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ উজ্জ্বলভাবে আলোকিত করেছেন। আমেরিকা একদম বদলে গেছে, কিন্তু আবার বদলায়ওনি।

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট