একটি দিন - হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (ছোটগল্প)

ছোটগল্প
একটি দিন

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

মেয়েটার জ্বর আর ছাড়ে না৷ কী যে ঘুসঘুসে জ্বর হয়েছে তা বোঝাও যায় না৷ রামরতনবাবু অস্থির হয়ে ওঠেন৷ রমা মেয়েটি আবার অবুঝ৷ রোজ সকালে উঠেই রামরতনবাবুকে বলে, 'বাবা আজ কী খাব?'

উত্তর বাবাকে আর দিতে হয় না— মা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, 'খাবি আবার কী? মেয়ের জ্বর তা যেন বোঝেন না৷ হাড়মাস আমার জ্বালিয়ে খেলে৷'

রামরতনবাবু মৃদুস্বরে বলেন, 'আহা ছেলেমানুষ ওকে অমন করে বকছ কেন? ওরে রমা এবার তোর জ্বর ছেড়ে যাবে রে৷ তার পর তোকে ভাত দেব৷ এই দেখ না আর কটা দিন৷'

বাবার আশ্বাসবাণী শুনে রমার মুখে হাসি দেখা দেয়— বিছানার ওপরে উঠে বসে বলে, 'হ্যাঁ বাবা তাড়াতাড়ি আমার জ্বর সেরে দাও না, তার পর—'

রমা তার কথা শেষ করতে পারে না৷ কথার মাঝেই মা বলেন, 'হ্যাঁ গো, আজকে একটা ডাক্তার ডাকবে তো? আর তো পারা যায় না মেয়েটাকে নিয়ে৷ রোগে ভুগে ভুগে দেখ না মা আমার আধখানা হয়ে গেছে৷'
রামরতনবাবু কোনও উত্তর দেন না৷ ওদিক থেকে বড় মেয়ে রানী ডাকে, 'মা উনুন জ্বলে যাচ্ছে শিগগির এস— চায়ের জল হয়ে গেছে৷' সুরমার আর কথা বলা হয় না৷ মেয়ের ডাকে চলে যেতে হয়৷

রানী চা এনে দেয়৷ রামরতনবাবু তাঁর হোমিওপাথি চিকিৎসার বই এবং বাক্স নিয়ে বসেন৷ সুতোবাঁধা চশমাটা চোখে লাগিয়ে বইটাতে গভীর মনোনিবেশ করেন৷ খানিকটা পড়ে মুখে তুলে জিজ্ঞাসা করেন, হ্যাঁ রে, তোর গায়ে-হাতে ব্যথা আছে?'

রমা মাথা নেড়ে জবাব দেয়, হ্যাঁ বাবা, খু-উ-ব৷'

'কই গো, এখনও যে বাজারে গেলে না?' বলতে বলতে সুরমা এসে পড়ে৷ রামরতনবাবু যেন একটু থতমত খেয়ে গেছেন বলে মনে হয়৷ একদৃষ্টে কয়েক সেকেন্ড রামরতনবাবুর দিকে তাকিয়ে থেকে সুরমা বলে 'কী নুড়োর চিকিচ্ছে হচ্ছে তোমার? এই একটু আগে কথা হল ডাক্তার আনবার জন্যে তা সব বুঝি গুলে খেয়ে ফেললে? আচ্ছা তুমি কি মেয়েটাকে মেরে ফেলতে চাও? তোমার ওই ছাই-এর চিনি খেয়ে কি ওই অসুখ সারে? এত সস্তায় যদি অসুখ-বিসুখ সারত, তা হলে পয়সা খরচ করে আর কেউ ডাক্তারি পড়ত না৷ তোমার ওই মুন্ডুর চিকিচ্ছে শিকেয় তুলে রাখ৷ যদি মেয়েটাকে বাঁচাতে চাও তো ডাক্তার ডাক৷' শেষের দিকে গলা ভারী হয়ে আসে৷ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে সুরমা সশব্দে পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়৷

রামরতনবাবুর মনটা খারাপ হয়ে যায়৷ ডাক্তার ডাকতে তাঁর অসাধ, না সত্যই তিনি মেয়েটাকে মারতে চান? মাসের শেষ— এখন টাকা হাতে নেই৷ শুধু তো ডাক্তার ডাকলেই হল না, তার সঙ্গে দামি দামি ওষুধের দাম জোগাবেন কোথা থেকে? এ-মাসে আবার বাড়ির ট্যাক্স, ইনসিওরেন্স প্রিমিয়াম সব পড়ল এক সঙ্গে৷ রানীর বিয়ের জন্য তিনি ইনসিওর করেছেন৷ রানীর বয়স এখন বারো৷ বাংলাদেশে মেয়ের বিয়ে তো দিতেই হবে৷ সেই জন্য তিনি আগেই কাজ গুছিয়ে নিচ্ছেন৷ ভেতরে ভেতরে তিনি আবার নাকি পাত্রের চেষ্টাও করেন৷ যদি মেয়েটাকে কোনওক্রমে বাগদত্তা করে রাখা যায় তা হলে অনেকটা নিশ্চিত৷ এখন কেবল ভাবনা ছোট মেয়েটাকে নিয়ে৷ বারো মাসের মধ্যে ছ'মাস মেয়েটির অসুখ লেগেই আছে৷ একে তো দেখতে তেমন ভাল নয়, তার ওপর রোগে রোগে মেয়েটির শ্রী দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ কী যে করবেন এটিকে নিয়ে— রামরতনবাবু আর ভেবে কূল কিনারা পান না৷ অগত্যা চটের থলিটা নিয়ে বাজারে চলে যান৷

ঠিক অফিস যাওয়ার সময়টিতে বৃষ্টি নামে৷ এই টিপটিপুনি কেরানি-ভেজানো বৃষ্টি লোককে একেবারে জ্বালাতন করে মারে৷ এ যেন নিয়ম করে আসে৷ অফিস যাওয়ার সময়টাতে বৃষ্টি, তার পরেই ধরে যায়৷

রামরতনবাবু কী আর করেন৷ অফিস তো যেতেই হবে৷ ছাতাটাকে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করেন৷ হঠাৎ সুরমা বলে ওঠেন, 'ডালিম আর কমলালেবু আনতে ভুলো না যেন৷ এবারে বড় মাগ্গি৷ ফলওলাগুলো যেন সব গলা কাটে৷ সেদিন ওই চাটুজ্যেরা কিনলে চার পয়সা জোড়া নেবু৷ তুমি তো পয়সা পয়সা বেশ নেবু আনো৷ ভুলো না যেন৷'

রামরতনবাবু দ্বিতীয়বার রাস্তায় পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে রানী বলে, 'আজ আমার রিবন আনতে ভুলো না যেন৷ লাল রঙের আনবে, বুঝলে বাবা? আর যদি লাল না-পাও তো আসমানি৷ দাঁড়াও বাবা লিখে দিচ্ছি, নয় তো তুমি আবার ভুলে যাবে৷'

একটুকরো সাদা কাগজে 'লাল কিংবা আসমানি রিবন' কথা কয়টি লিখে বাবাকে কাগজটা দেওয়ার জন্য বাইরে এসে রানী দেখে বাবা চলে গেছেন৷ রানীর মুখ গম্ভীর হয়ে যায়৷ পরক্ষণে চৌকিটার দিকে চেয়ে রানী চিৎকার করে ওঠে, 'মা বাবা খাবারের ডিবেটা ফেলে গেছে৷'

সুরমা মাছ রান্না ফেলে তাড়াতাড়ি উঠে এসে বলেন, 'যা, যা, দৌড়ে যা, এখনও বোধহয় মোড় পেরোয়নি, যা শিগগির যা৷ হ্যাঁ, শোন পেছনে ডাকিস না যেন৷'

এক হাতে খাবারের ডিবে আর এক হাতে কাগজের টুকরোটা নিয়ে রানী দৌড়তে থাকে৷ রামরতনবাবুর একটু আস্তে চলা অভ্যেস৷ রানী গিয়ে একেবারে সামনে হাজির হয়৷ খাবারের ডিবেটা হাতে দিয়ে বলে, 'বাবা তুমি খাবার ফেলে এসেছিলে কেন?' ডিবেটা হাতে নিয়ে রামরতনবাবু বলেন, 'যা, যা, বাড়ি যা, বৃষ্টিতে ভিজিসনি, অসুখ করবে৷'

রানী ফিরে যায়৷ বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই সুরমা বলে, 'বৃষ্টিতে ভিজলি তো? তোরা আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খেয়ে তবে ছাড়বি৷ কেন, ছাতাটা নিয়ে যেতে কী হয়েছিল৷ ছাতা ছাতা করে তো প্রাণ অস্থির করে তুলছিল তখন৷ নতুন ছাতাটাকে তো এক বার মাথায় দিতে দেখলাম না এ পর্যন্ত৷'

রানী মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে তাকে৷ তার যে কী দোষ হল, তা বুঝতে পারে না৷ ছাতা নেওয়ার সময়ই বা তখন কোথায়? দেরি হয়ে যাবে যে?

মাছের কড়াটা কলতলায় রাখার সময় সুরমার দৃষ্টি পড়ে মেয়ের হাতের দিকে— জিজ্ঞাসা করেন, 'হাতে ওটা কী দেখি?'

রানী হাতের দিকে চেয়ে দেখে— ওই যা! সেই কাগজটাই দেওয়া হয়নি বাবাকে৷ বাবা নিশ্চয়ই ভুলে যাবেন রিবন আনতে— হয়ত বা নীল রঙের এনে হাজির করবেন৷ রানীর চোখের কোণে জল দেখা দেয়৷ কাগজটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে কাঁদতে থাকে৷

কাগজের টুকরোর লেখা কয়টি পড়ে মা বললেন, 'আজ না-হয় কাল হবে তাতে কাঁদিস কেন? একটুতেই মেয়ের আলগা চোখের পানি বেরিয়ে আসে৷'

অফিস থেকে ফিরতে আজ রামরতনবাবুর একটু দেরি হয়৷ রানী বাবার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে৷ রমা বাবার প্রতীক্ষায় থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়ে৷ রানী বলে, 'মা, বাবার আসতে আজ দেরি হচ্ছে কেন?' সুরমা ছেঁড়া সেমিজটা সেলাই করতে করতে বলেন, 'জানিনে বাপু৷' কার যেন জুতোর শব্দ শোনা যায়৷ অবশেষে রামরতনবাবু এসে পড়েন৷ হাতে তাঁর ফল তো নাই, রিবনও না৷ আছে কেবল একতাড়া কাগজ৷ রানী ছুটে আসে, 'কই বাবা, আমার রিবন?'

বিরক্ত হয়ে রামরতনবাবু উত্তর দেন, 'যা, যা, জ্বালাতন করিসনে বাপু৷ আমার কি মরবার সময় আছে? অফিসের কী কাজই না পড়েছে৷ নাকে দড়ি দিয়ে খাটিয়ে নিচ্ছে৷ আজ সাহেব কী বকুনি না দিলে৷ বাড়িতে কাজ এনে করতে হবে, এখন এত কাজ৷'

সুরমা আর কোনও কথা জিজ্ঞাসা করে না৷ মুখ গম্ভীর করে থাকে৷ রামরতনবাবু ততক্ষণে কাগজের তাড়াটা আলমারির মাথায় রেখে হাত-পা ধুয়ে আসেন৷ সুরমা একটা রেকাবিতে করে একটা সন্দেশ, এক গ্লাস জল এনে হাতে দেয়৷ কোনও কথা বলে না৷ রামরতনবাবু জিজ্ঞাসা করেন, 'আজ সমস্ত দিন রমা কেমন ছিল?' বারুদে আগুন পড়লে যেমন হয়, সুরমা জ্বলে উঠে বলে, 'তার সঙ্গে তোমার কী দরকার? তোমার কাছে তো তার বাঁচা-মরা দুই-ই সমান৷ মেয়েটির চিকিচ্ছে করাবে না, পথ্য দেবে না, ওকে তুমি মেরেই ফেলবে বলে ভেবেছ৷ আহা, মেয়েটা এত ফল ভালবাসে, তা একরত্তি ফল আনতে প্রবৃত্তি হল না?'

রামরতনবাবুর মেজাজও আজ তেমন ভাল থাকে না৷ অফিসে সাহেবের বকুনি খেয়ে অবধি তাঁর মন খরাপ৷ সুতরাং এক পশলা হয়ে যায়৷ অবশেষে সুরমা কেঁদে ফেলে৷ রামরতনবাবু আর বেশিদূর অগ্রসর হন না৷ আলমারির মাথা থেকে কাগজের তাড়াটা নিয়ে অফিসের কাজে বসে যান৷

রানী বলে, 'মা ভাত দাও না গো, বড় খিদে পেয়েছে৷' মা চিৎকার করে ওঠে, 'আমায় খাবি রাক্ষসী৷ তোদের সব নুন গিলিয়ে মারতে হয়৷ সন্তান পেটে ধরা যে কত জন্মের পাপ— এমন কেউ যেন না-করে, তোদের জন্যই না আমার আজ এই দশা৷ বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে৷'

রানী অবাক হয়ে যায়৷ এমন সময় ঝি এসে বলে, 'দিদিমণি, কড়াটা বার করে দাও না, ততক্ষণে মাজি৷' কী জানি কেন রানীও রেগে ওঠে৷ ঝাঁঝের সুরে উত্তর দেয়, 'যা, আমি পারব না, আমি তোর চাকর নই৷'

অগত্যা সুরমাকেই উঠতে হয়৷ ঝি গজগজ করতে করতে কড়া মাজে৷ ভাত বেড়ে সুরমা রানীকে বলে, 'যা বলগে যা, ভাত বাড়া হয়েছে৷' রানীকে আর বলতে হয় না৷ রামরতনবাবু উত্তর দেয়, 'হ্যাঁ যাচ্ছি৷'

খেতে খেতে রামরতনবাবু বলেন, 'বাঃ, চিংড়ির ডালনাটা তো বেশ হয়েছে৷' অমনি সুরমা বলে ওঠে, 'আর একটু দেব হ্যাঁ গা৷'

রামরতনবাবু বলেন, 'না না তোমাদের কম পড়বে৷' সুরমা বলে, 'না গো না৷ খাবার মধ্যে কেবল আমি, নাও না আর একটু৷'

কিছুক্ষণ নীরব থেকে রামরতনবাবু বলেন, 'হ্যাঁ ভাল কথা, আজ সলিলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল৷' সুরমা উৎসাহের সুরে বলে, 'কী বলে সে? পাস-টাস দিতে পারবে না? তোমার চেহারা দিনকে দিন যা হচ্ছে তা আর চোখে দেখা যায় না, মেয়েটারও অসুখ৷ চল না গো এই সামনের পুজোর ছুটিতে মধুপুরে ঘুরে আসি? তুমি কী বল?'

রামরতনবাবু বলেন, হ্যাঁ, সে তো রেলের পাস দেবে বলেছে৷ কিন্তু, শুধু পাস দিলেই তো আর যাওয়া হয় না৷ চেঞ্জে যেতে কত খরচ৷'

সুরমা জিজ্ঞাসা করে, 'কত খরচ হিসেব করে দেখ না৷ আজ রাত্তিরেই হিসেব কর কেমন!'

রামরতনবাবু ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন৷

সুরমা বলে, 'আমি এক্ষুনি খেয়ে আসছি, তুমি ততক্ষণ কাগজ-পেন্সিল নিয়ে বস না?'

এতে রানীরও উৎসাহ দেখা দেয়, বলে, 'হ্যাঁ বাবা চল না বেড়াতে অন্য কোথাও, কলকাতা যেন পুরনো হয়ে গেছে৷ হ্যাঁ মা, চল না?'

'কত দিন যে রেলে চড়িনি!'

খাওয়াদাওয়া সেরে সুরমা ঘরে গিয়ে দেখে রামরতনবাবু অঘোরে ঘুমোচ্ছেন৷

রানী বলে, 'মা, দেখলে মা, বাবা আর হিসেব করলে না৷'

সুরমা বলে, 'চুপ চুপ, চেঁচাসনি৷ সারাদিনের খাটুনির পর মানুষটাকে তোরা একটু ঘুমোতেও দিবি নে? যা গোলমাল করিসনি, শুয়ে পড়৷'

২৪ এপ্রিল ১৯৮৮ আজকাল রবিবাসর-এ প্রকাশিত৷

(প্রথম প্রকাশ তিরিশ বছর আগে 'দেশ' পত্রিকায়৷)

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট