পিঁপড়া - হুমায়ূন আহমেদ (ছোটগল্প)

ছোটগল্প
পিঁপড়া 

হুমায়ূন আহমেদ

আপনার অসুখটা কি বলুন।

রুগি কিছু বলল না, পাশে বসে-থাকা সঙ্গীর দিকে তাকাল।

ডাক্তার নূরুল আফসার, এমআরসিপি, ডিপিএস, অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। তাঁর বিরক্তির তিনটি কারণ আছে। প্রথম কারণ হচ্ছে- আটটা বেজে গেছে, রুগি দেখা বন্ধ করে বাসায় যেতে হবে । আজ তার শ্যালিকার জন্মদিন । দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- গ্রাম থেকে আসা রুগি তিনি পছন্দ করেন না । এরা হয় বেশি কথা বলে, নয় একেবারেই কথা বলে না। ভিজিটের সময় হলে দর-দাম করার চেষ্টা করে। হাত কচলে মুখে তেলতেলে ভাব ফুটিয়ে বলে, কিছু কম করা যায় না ডাক্তার সাব। গরিব মানুষ ।

আজকের এই রুগিকে অপছন্দ করার তৃতীয় কারণটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবু নূরুল আফসার সাহেবের কাছে এই কারণটিই প্রধান বলে বােধ হচ্ছে। লোকটির চেহারা নির্বোধের মতো। এই ধরনের লোক নিজের অসুখটাও ঠিকমতো বলতে পারে না, অন্য একজনের সাহায্য লাগে ।


‘বলুন, তাড়াতাড়ি বলুন। আমার অন্য কাজ আছে।’

লোকটি কিছু বলল না। গলা খাকারি দিয়ে সঙ্গীর দিকে তাকাল। ভাবখানা এ-রকম যে অসুখের কথাবার্তা সঙ্গীটিই বলবে। সে-ও কিছু বলছে না। ডাক্তার নূরুল আফসার হাতঘড়ির দিকে একঝলক তাকিয়ে বললেন, “গরু-ছাগল তার কী অসুখ বলতে পারে না। তাদের অসুখ অনুমানে ধরতে হয়। আপনি তো আর গরু-ছাগল না। চুপ করে আছেন কেন? নাম কী আপনার?”

রুগি কিছু বলল না। তার সঙ্গী বলল, “উনার নাম মকবুল। মোহাম্মদ মকবুল হােসেন ভুইয়া।”

“নামটাও অন্য আরেকজনকে বলে দিতে হচ্ছে। আপনি কি কথা বলতে পারেন, না- পারেন না?”

“পারি।”

‘কী নাম আপনার?”

‘মোহাম্মদ মকবুল হােসেন ভুইয়া।”

“বয়স ক’ত?”

“বায়ান্ন।”

“আপনার সমস্যাটা কী?”

রুগি মাথা নিচু করে ফেলল। নূরুল আফসার সাহেবের ধারণা হলো অস্বস্তিকর কোনো অসুখ, যার বিবরণ সরাসরি দেয়া মুশকিল।

“আর তো সময় দিতে পারব না । আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। যদি কিছু বলার থাকে এক্ষুনি বলবেন। বলার না থাকলে চলে যান।”

রুগি আবার গলা খাকারি দিল ।

তার সঙ্গী বলল, “উনার অসুখ কিছু নাই।”

‘অসুখ কিছু নেই, তা এসেছেন কেন?”

উনারে পিপড়ায় কামরায়।

“কী বললেন?”

“পিপড়ায় কামড়ায় । পিপীলিকা।”

ডাক্তারি করতে গেলে অধৈৰ্য হওয়া চলে না। রুগিদের সঙ্গে রাগারাগিও করা চলে না । এতে পিশার কমে যায়। রোগের বিবরণ শুনে বিস্মিত হওয়াও পুরোপুরি নিষিদ্ধ। রোগের ধরন-ধারণ যতই অদ্ভুত হােক ভান করতে হয় যে, এ জাতীয় রোগের কথা তিনি শুনেছেন এবং চিকিৎসা করে আরাম করেছেন । আসফার সাহেব ডাক্তারির এইসব নিয়ম কানন কঠিনভাবে মানেন। আজ মানতে পারলেন না। ধমকের স্বরে বললেন, “পিপড়ায় কামড়ায় মানে?”

রুগি পকেটে হাত দিয়ে এক টুকরা কাগজ বের করে বলল, “চিঠিটা পড়েন। চিঠির মধ্যে সব লেখা আছে।”

“কার চিঠি?”

“কাশেম সাহেবের ।”

“কাশেম সাহেব কে?”

“এমবিবিএস ডাক্তার। আমাদের অঞ্চলের। খুব ভালো ডাক্তার। উনি আপনার কাছে আমারে পাঠাইছেন । বলছেন নাম বললে আপনি চিনবেন । উনি আপনের ছাত্র ।”

নুরুল আফসার সাহেব কাশেম নামের কাউকে চিন্তে পারলেন না। কাশেম বহুল প্ৰচলিত নামের একটি । ক্লাসে প্রতিবছরই দু’একজন কাশেম থাকে। এ কোন কাশেম কে জানে।

স্যার চিনেছেন?

চিনি না বলাটা ঠিক হবে না। পুরানো ছাত্ররা রুগি পাঠায়। এদেরকে খুশি রাখা দরকার। কাজেই আফসার সাহেব শুকনো হাসি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ চিনেছি। কী লিখেছে দেখি ।”

“উনি স্যার আপনাকে সালাম দিয়েছেন।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখি চিঠিটা দেখি ।” চিঠি দেখে ডাক্তার সাহেবের ভ্র কুঞ্চিত হলো। বাঙালি জাতির সবচেয়ে দোষ হলো- এরা কোনো জিনিস সংক্ষেপে করতে পারে না। দুই পাতার এক চিঠি ফেদে বসেছে। তিনি পড়লেন -

পরম শ্রদ্ধেয় স্যার,

আমার সালাম জানবেন। আমি সেভেন্টি থ্রি ব্যাচের ছাত্র। আপনি আমাদের ফার্মাকোলজি পড়াতেন। আপনার বিষয়ে আমি সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিলাম। সেই উপলক্ষে আপনি আপনার বাসায় আমাকে চায়ের দাওয়াত করেছিলেন ।

আশা করি আপনার মনে পড়েছে। যাই হােক, আমি মকবুল সাহেবকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। মকবুল এই অঞ্চলের একজন অত্যন্ত ধনবান ব্যক্তি। সে বছর চারেক ধরে অদ্ভুত এক ব্যাধিতে ভুগছে। একে ব্যাধি বলা যাবে না। কিন্তু অন্য কোনো নামও আমি পাচ্ছি না। ব্যাপারটা হচ্ছে তাকে সব সময় পিপড়ায় কামড়ায় ।

বুঝতে পারছি বিষয়টা আপনার কাছে খুবই হাস্যকর মনে হচ্ছে। শুরুতে আমার কাছেও মনে হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম এটা এক ধরনের মানসিক ব্যাধি । বর্তমানে আমার সেই ধারণা পুরোপুরি ভেঙে গেছে। আমি নিজে লক্ষ করেছি মকবুল সাহেব কোথাও বসলেই সারি বেঁধে পিঁপড়া তার কাছে আসতে থাকে।

পীর-ফকির, তাবিজ, ঝাড়-ফুক জাতীয় আধি ভৌতিক চিকিৎসা সবই করানাে হয়েছে। কোনাে লাভ হয়নি। আমি কোনো উপায় না দেখে আপনার কাছে পাঠালাম। আপনি দয়া করে ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেবেন না।

বিনীত

আপনার একান্ত অনুগত ছাত্র

আবুল কাশেম।

ব্লু স্টার ফার্মেসি । নান্দাইল । কেন্দুয়া ।

ডাক্তার সাহেব রুগির দিকে তাকালেন। রুগি পাথরের মতো মুখ করে বসে আছে। গায়ে ফতুয়া ধরনের জামা। পরনে লুঙ্গি। অত্যন্ত ধনবান ব্যক্তির পোশাক নয় ।

ডাক্তার সাহেব কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। কিছু-একটা বলতে হয়। মকবুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই জাতীয় উদ্ভট যন্ত্রণার কোনো মানে হয়?

“পিপড়া কামড়ায় আপনাকে?”

“জি স্যার। কোনো এক জায়গায় বসে থাকলেই পিপড়া এসে ধরে।”

নূরুল আফসার সাহেব একবার ভাবলেন বলবেন, “আপনি কি রসগোল্লা না-কি যে পিঁপড়া ছেকে ধরবে? শেষ পর্যন্ত বললেন না।” ।

‘বড় কষ্টে আছি স্যার। যদি ভালো করে দেন। সারাজীবন কেনা গোলাম হইয়া থাকব। টাকা পয়সা কোনো ব্যাপার না, স্যার । টাকা যা লাগে লাগুক।”

“আপনার কি অনেক টাকা?”

“জি স্যার ।”

‘কী পরিমাণ টাকা আছে?”

রুগি কোনো জবাব দিল না। রুগির সঙ্গী বলল, “মকবুল ভাইয়ের কাছে টাকা পয়সা কোনো ব্যাপার না। লাখ দুই লাখ উনার হাতের ময়লা।”

নূরুল আফসার সাহেব এই প্রথম খানিকটা কৌতুহলী হলেন। লাখ টাকা ফতুয়া-গায়ে লুঙ্গি-পরা এই লোকটির হাতের ময়লা- এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় । তিনি নিজেও ধন্যবান ব্যক্তি। ফিক্সড ডিপোজিটে তার এগারো লাখ টাকার মতো আছে। এই টাকা সঞ্চয় করতে গিয়ে জীবন পানি করে দিতে হয়েছে। ভোর ছ’টা থেকে রাত বারোটা— এক মুহূর্তের বিশ্রাম নেই।

একমাত্র ছুটির দিন শুক্রবারটাও তিনি কাজে লাগান। সকালের ফ্লাইটে চিটাগাং যান, লাস্ট ফ্লাইটে ফিরে আসেন। ওখানকার একটা ক্লিনিকে বসেন। ঐ ক্লিনিকের তিনি কনসালটিং ফিজিসিয়ান। আর এই লোককে দেখে তো মনে হয় না। সে কোনো কাজকর্ম করে । নির্বোধের মতো এই লোক এত টাকা করে। কী করে? নূরুল আফসার সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।

মকবুল ক্ষীণ স্বরে বলল, “রোগটা যদি সারায়ে দেন।”

“এটা কোনো রোগ না । আমি এমন কোনো রোগের কথা জানি না- যে রোগে দুনিয়ার পিপড়া এসে কামড়ায়। অসুখটা আপনার মনের। আমি সাইকিয়াট্রিস্টের ঠিকানা লিখে দিচ্ছি- তার সঙ্গে কথা বলুন। আপনার যে সমস্যা এই সমস্যার সমাধান আমার কাছে নেই।”

নূরুল আফসার সাহেব বাক্যটা পুরোপুরি শেষ করলেন না। কারণ, একটা অদ্ভুত দৃশ্যে তাঁর চােখ আটকে গেল। তিনি দেখলেন, টেবিলের উপর রাখা মকবুলের ডান হাতের দিকে এক সারি লাল পিপড়া এগুচ্ছে। পিপড়ারা সচরাচর এক লাইনে চলে, এরা তিনটি লাইন করে এগুচ্ছে।

ডাক্তার সাহেবের দৃষ্টি লক্ষ করে মকবুলও তাকাল পিপড়ার সারির দিকে। সে কিছু বলল না বা হাতও সরিয়ে নিল না।

নূরুল আফসার সাহেব বললেন, “এই পিঁপড়াগুলো কি আপনার দিকে আসছে?”

“জি স্যার ।”

“বলেন। কি!”

‘পায়েও পিপড়া ধরেছে। এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসতে পারি না। স্যার।’ নূরুল আফসার সাহেব কাছে এগিয়ে এলেন। উঁচু হয়ে বসলেন। সত্যি সত্যি দু’সারি পিপড়া লোকটির পা'র দিকে এগুচ্ছে।

“মকবুল সাহেব।”

“জি স্যার ।”

“আমার একটা জরুরি কাজ আছে, চলে যেতে হচ্ছে। আপনি কি কাল একবার আসবেন?”

“অবশ্যই আসব। যার কাছে যাইতে বলেন যাব। বড় কষ্টে আছি স্যার। রাত্রে ঘুমাইতে পারি না। নাকের ভিতর দিয়ে পিঁপড়া ঢুকে যায়।”

“আপনি কাল আসুন। কাল কথা বলব।’ “জি আচ্ছা ।” মকবুল উঠে দাঁড়াল। পর মুহূর্তেই যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্যে নূরুল আফসার সাহেব মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। তার কাছে মনে হলো মকবুল কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। চিন্তা ও বিচার শক্তি পুরোপুরি লোপ পেয়েছে। তিনি দেখলেন মকবুল হিংস্র ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে, পা ঘসে ঘসে পিপড়া মারার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলে, দু'হাতে পিষে ফেলল পিঁপড়ার সারি। মকবুলের মুখ গামে চটচট করছে। চােখের তারা ঈষৎ লালাভ। মুখে হিসহিস শব্দ করছে এবং নিচু গলায় বলছে, “হারামজাদা, হারামজাদা।”

তার সঙ্গী কিছুই বলছে না। মাথা নিচু করে দেয়াশলাইর কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁচাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এ জাতীয় ঘটনার সঙ্গে সে পরিচিত। এই ঘটনায় সে অস্বাভাবিক কিছু দেখছে না।

নূরুল আফসার সাহেব শালীর জন্মদিনের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেলেন। রুগির দিকে হতভম্ব চােখে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর দু'জন অ্যাসিস্ট্যান্টও ছুটে এসেছে। তারা দরজা ধরে দাড়িয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়ের চেয়ে ভয় বেশি।

মকবুল হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেল। নিচু গলায় বলল, “স্যার মনে কিছু নিবেন না। এই পিপড়ার ঝাক আমার জেবন শেষ কইরা দিছে। হারামজাদা পিপড়া! এক গেলাস ঠাণ্ডা পানি দিবেন?”

ডাক্তার সাহেবের অ্যাসিসটেন্ট অতি দ্রুত ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে নিয়ে এল। একজন ভয়ঙ্কর পাগলের পাগলামি হঠাৎ থেমে গেছে এই আনন্দেই সে আনন্দিত ।

মকবুল পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বসে রইল। পানি মুখে দিল না। মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বলল, “যেখানে যাই সেইখানে পিপড়া, কী করব কন। যে খাটে ঘুমাই সে খাটের পায়ার নিচে বিরাট বিরাট মাটির সরা। সারা ভর্তি পানি । তাতেও লাভ হয় না ।”

“লাভ হয় না?”

“জি না । ক্যামনে ক্যামনে জানি বিছানায় পিপড়া উঠে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিছানার চাদর বদলাইতে হয় ।”

‘বলেন। কি!”

‘সত্যি কথা বলতেছি জনাব। একবর্ণ মিথ্যা না । যদি মিথ্যা হয় তা হইলে যেন আমার শরীরে কুণ্ঠ হয়। আমি জনাব এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেও পারি না। জায়গা বদল করতে হয় । আমার জীবন শেষ ।”

ডাক্তার সাহেব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। যে লোকটিকে শুরুতে মনে হয়েছিল কথা বলতে পারে না, এখন দেখা যাচ্ছে সে প্রচুর কথা বলতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। গ্রামের লোকজনের প্রাথমিক ইনহিবিশন কেটে গেলে প্রচুর কথা বলে। প্রয়োজনের কথা বাদ দিয়ে অপ্রয়োজনের কথাই বেশি বলে।

“চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি করি নাই জনাব। কেরোসিন তেলে কপূর দিয়ে সেই তেল শরীরে মাখছি। যদি গন্ধে পিপড়া না আসে। প্রথম দুই-একদিন লাভ হয়, তারপর হয় না। পিপড়া আসে। এমন জিনিস নাই যে শরীরে মাখি নাই । যে যা বলেছে মাখছি। একজন বলল, বাদুড়ের গু শরীরে মাখলে আরাম হইব। সেই বাদুড়ের গু”ও মাখলাম। এর চেয়ে জনাব আমার মরণ ভালো।”

ডাক্তার সাহেব তার অ্যাসিস্টেন্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাসায় টেলিফোন করে দাও যে আমি একটা ঝামেলায় আটকে পড়েছি। আসতে দেরি হবে । আর আমাদের চা দাও।”

“আপনি চা খান তো?”

“জি চা খাই ।”

“চা খেতে খেতে বলুন কীভাবে এটা শুরু হলো, প্রথম কখন পিপড়া আপনার দিকে আকৃষ্ট হলো।”

“একটু গোপনে বলতে চাই জনাব।”

‘গোপনে বলার ব্যাপার আছে কি?”

জি আছে।'

“বেশ । গোপনেই বলবেন । আগে চা খান ।”

লোকটি চা খেল নিঃশব্দে । চা খাবার সময় একটি কথাও বলল না । তার কথা বলার ইচ্ছা সম্ভবত ঢেউয়ের মতো আসে। ঢেউ যখন আসে তখন প্রচুর বকবক করে, ঢেউ থেমে গেলে চুপচাপ হয়ে যায়। তখন কথা বলে তার সঙ্গী। এখন সঙ্গীই কথা বলছে ‘ডাক্তার সাব, সবচেয়ে বেশি ফল হয়েছে যে চিকিৎসায় সেইটাই তো বলা হয় নাই। মকবুল ভাই, ঐ চিকিৎসার কথা বলেন।”

“তুমি বল।”

“এই চিকিৎসা মকবুল ভাই নিজেই বাইর করছে। বিষে বিষক্ষয় চিকিৎসা। গুড়ের গন্ধে পিপড়া সবচেয়ে বেশি আসে। মকবল ভাই করলেন কি, সারা শ‍ইলে গুড় মাখলেন। এতে লাভ হইছিল। সাত দিন কোনো পিঁপড়া আসে নাই।”

মকবুল গম্ভীর গলায় বলল, “সাতদিন না পাচদিন।”

ডাক্তার সাহেব বললেন, “পাচদিন পরে আবার পিপড়া আসা শুরু হলো?”

জি

“পিপড়ার হাত থেকে বাঁচার জন্যে মনে হয় অনেক কিছু করেছেন।”

“জি । নদীর মাঝখানে নৌকা নিয়া কয়েক দিন ছিলাম। তিন দিন আরামে ছিলাম। চাইর দিনের দিনে পিপড়া ধরল।”

“সেখানে পিপড়া গেল কীভাবে?”

'জানি না জনাব, অভিশাপ ।'

“কীসের অভিশাপ?”

“আপনারে গোপনে বলতে চাই।”

ডাক্তার সাহেব গোপনে বলার ব্যবস্থা করলেন। পুরো ব্যাপারটায় তিনি এখন উৎসাহ পেতে শুরু করেছেন । শালীর জন্মদিনের কথা মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে। খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছেন । এই পর্যন্তই। কোনো রুগির ব্যাপারে এ জাতীয় কৌতুহল তিনি এর আগে বোধ করেননি। অবিশ্যি এই লোকটিকে রুগি বলতেও বাঁধছে। কাউকে পিপড়া ছেকে ধরে এটা নিশ্চয়ই কোনো রোগব্যাধির পর্যায়ে ফেলা যাবে না ।

ঘর থেকে সবাইকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। মকবুলের সঙ্গীও নেই। দরজা ভেজানো। মকবুল নিচু গলায় কথা শুরু করল—

“জনাব, আপনেরে আমি আগেই বলছি আমি টাকা পয়সাওয়ালা লোক । আমাদের টাকা পয়সা আইজ-কাইলের না। ব্রিটিশ আমলের। আমার দাদাজান পাকা দালান দেন। দাদাজানের দুইটা হাতি ছিল । একটার নাম ময়না, অন্যটার নাম সুরভি। দুইটাই মাদি হাতী।”

“ঐ প্রসঙ্গ থাক, আপনার পিঁপড়ার প্রসঙ্গে আসুন।”

‘আসতেছি। আমি পিতামাতার একমাত্র সন্তান। বিরাট ভূ-সম্পত্তির মালিক। টাকা পয়সা, ক্ষমতা এইসব জিনিস বেশি থাকলে মানুষের স্বভাব-চরিত্র ঠিক থাকে না । আমারো ঠিক ছিল না । আপনারা যারে চরিত্র-দোষ বলেন। তাই হইল। পনেরো-ষোল বছর বয়সেই। বিরাট বাড়ি— সুন্দরী মেয়েছেলের অভাব ছিল না। দাসী-বাদি ছিল। দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনের মেয়ে-বউরা ছিল।

আমারে একটা কঠিন কথা বলার বা শাসন করার কেউ ছিল না। আমার মা অবশ্য জীবিত ছিলেন । কেউ-কেউ তার কাছে বিচার নিয়ে গেছে। লাভ হয় নাই। উল্টা আমার ধমক খাইছে।” “আপনি বিয়ে করেননি?’ 'জি বিবাহ করেছি। বিবাহ করব না কেন? দুটি বিবাহ করেছি। সন্তানদি। আছে। স্বভাব নষ্ট হইলে বিয়ে-সাদী করলেও ফায়দা হয় না। মেয়েছেলে দেখলেই...

“আপনি আসল জায়গায় আসুন। আজেবাজে কথা বলে বেশি সময় নষ্ট করছেন ।”

“জি আসতেছি। বছর পাঁচেক আগে আমার দূর-সস্পকীয় এক বোনের মেয়ের উপর আমার চোখ পড়ল। চইদ-পনেরো বছর বয়স। গায়ের রঙ একটু ময়লা, কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো। আমার চরিত্র তো কারো অজানা না । মেয়ের মা মেয়েকে আগলায়ে রাখে। খুবই বজাত মা, মেয়েকে নিয়ে আমার মা’র ঘরে মেঝেতে ঘুমায়। এত কিছু কইরাও লাভ হইল না। এক রাতে ঘটনা ঘটে গেল ।”

‘কী বললেন, ঘটনা ঘটে গেল?”

“জি ।”

“আশ্চর্য ব্যাপার! আপনি যেভাবে বলছেন তাতে মনে হচ্ছে খুবই তুচ্ছ একটা ব্যাপার। জিনিসটা তুচ্ছই। কিছুই না। হে হে হে।”

“হাসবেন না । হাসির কোনো ব্যাপার না ।”

“জি আচ্ছা । তারপর কী হলো- ঐ বজাত মা সেই রাইতেই মেয়েটারে ইদুর-মারা বিষ খাওয়াইয়া দিল। আর নিজে একটা দড়ি নিয়ে বাড়ির পিছনে একটা আমগাছে ফাস নিল। আমারে বিপদে ফেলার চেষ্টা, আর কিছু না। মাগী চূড়ান্ত বজাত। আমি চিন্তায় পড়লাম।

দুইটা মৃত্যু সোজা কথা না। থানা-পুলিশ হবে। পুলিশ তো এই জিনিসটাই চায়। এরা বলবে খুন করা হয়েছে।”

“আপনি খুন করেননি?’ 'আরে না। খুন করব কী জন্যে। আর যদি খুনের দরকারও হয় নিজের ঘরে খুন করব? কাউরে খুন করতে হইলে জায়গার অভাব আছে? খুন করতে হয় নদীর উপরে। রক্ত ধুইয়ে ফেলা যায়। তারপর লাশ বস্তার ভিতর বইরা চুন মাখায়ে চার-পাঁচটা ইট বস্তার ভিতর দিয়ে বিলে ফালায়ে দিতে হয়। এই জন্মের জন্যে নিশ্চিন্ত । কোনো সম্মুন্ধির পুত কিছু জানব না।”

“আপনি খুনও করেছেন?”

“জি না। দরকার হয় নাই। যেটা বলতেছিলাম। সেইটা শুনেন, ঘরে দুইটা লাশ । আমি বললাম, খবরদার লাশের গায়ে কেউ হাত দিবা না । যে রকম আছে সে রকম থাক, আমি নিজে গিয়ে থানার ওসি সাহেবেরে আনতেছি, ওসি সাহেব আইয়্যা, যা করবার করব ।

থানা আমার বাড়ি থাইক্যা পনেরো মাইল দূর। পানসি নৌকা নিয়া গেলাম। দারোগা সাহেব আর থানা স্টাফের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা নজরানা নিয়া গেলাম। গিয়া দেখি বিরাট সমস্যা । দারোগা সাব গিয়েছেন বোয়ালখালী ডাকাতি মামলার তদন্তে। ফিরলেন পরের দিন। তারে নিয়ে আমার বাড়িতে আসতে লাগলো তিন দিন।

বর্ষাকাল । গরমের দিন। তিন দিনেই লাশ গেছে পচে । বিকট গন্ধ । দারোগা সাবরে নিয়া কঁঠাল গাছের কাছে গিয়া দেখি অদ্ভুত দৃশ্য। লাখ লাখ লাল পিপড়া লাশের শরীরে । মনে হইতেছে মাগীর সারা শইলে লাল চাদর।

মেয়েটারও একই অবস্থা। মুখ হাত পা কিছুই দেখার উপায় নাই। পিপড়ায় সব ঢাকা । মাঝে মাঝে সবগুলি পিপড়া যখন একসঙ্গে নড়ে, তখন মনে হয় লাল চাদর কেউ যেন ঝাড়া দিল ।”

ডাক্তার সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, “আপনি তো দেখি খুবই বদলোক ৷”

“জি না, আমার মতো টেকা পয়সা যারার থাকে তারা আরো বদ হয়। আমি বাদ না । তারপর কি ঘটনা সেইটাই শুনেন- আমি একটা সিগারেট ধরাইলাম। সিগারেটের আগুন ফেলার সাথে সাথে মেয়েটার শরীরের সবগুলি পিপড়া নড়ল। মনে হলো যেন একটা বড় ঢেউ উঠল। তারপর সবগুলি পিপড়া একসঙ্গে মেয়েটারে ছাইড়া মাটিতে নামল। মেয়েটার চোখ মুখ সব খাইয়া ফেলেছে- জায়গায় জায়গায় হাডিড বের হয়ে গেছে। দারোগা সাহেব রুমাল দিয়ে নাক চেপে ধরে বললেন, মাবুদে এলাহি। তারপর অবাক হয়ে দেখি সবগুলি পিপড়া একসঙ্গে আমার দিকে আসতেছে। ভয়ঙ্কর অবস্থা। আমি দৌড় দিয়ে বাইরে আসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে পিঁপড়াগুলি বাইরে আসল। মনে হইল আমারে খুঁজতেছে। সেই থাইক্যা শুরু। যেখানে যাই পিপড়া। জনাব, আপনার এই ঘরে কি সিগারেট খাওয়া যায়? খাওয়া গেলে একটা সিগারেট খাইতে চাই |

‘খান ।”

‘শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।”

মকবুল সিগারেট ধরাল। তার মুখ বিষন্ন। সে আনাড়িদের মতো ধুয়া ছাড়ছে। খুকধুক করে কাশছে। খানিকটা দম নিয়ে বলল, “আমার কাশি ছিল। না। এখন কাশি হয়েছে। নাকের ভিতর দিয়া পিপড়া ঢুকে গেছে ফুসফুসে। ওরা ঐখানেই বসবাস করে। ক্যামনে বুঝলাম জানেন? কাশির সাথে রক্ত আসে। আর আসে মরা পিপড়া।”

ডাক্তার সাহেব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মকবুল সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, “সিগারেট খাইতেছি। যাতে ভালো মতো কাশি উঠে। কাশি উঠলে কাশির সাথে পিঁপড়া আর পিপড়ার ডিম বাইর হবে। আপনি দেখবেন নিজের চােখে । আমি ঘোষণা দিছি, যে আমারে পিপড়ার হাত থাইক্যা বাঁচাইব তারে আমি নগদ দুই লাখ দিব। আমি বদ লোক হইতে পারি। কিন্তু আমি কথার খেলাপ করি না । আমি টাকা সাথে নিয়ে আসছি। আপনে আমারে বাচান।”

ডাক্তার সাহেব কিছু বললেন না। তিনি তাঁর বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরের কাচের দিকে তাকিয়ে আছে। মকবুলের বাম হাত টেবিলের উপর। দুই সারি পিপড়া টেবিলের দু'প্রান্ত থেকে সেই হাতের দিকে এগুচ্ছে। মকবুলেরও সেই দিকে চোখ পড়ল। সে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, “আপনের কিছু করা সম্ভব না। ঠিক না ডাক্তার সাব?”

“হ্যাঁ ঠিক ।”

“আমি জানতাম। আমার মরণ পিপড়ার হাতে।” মকবুল মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে আসা পিঁপড়ার সারি দু'টির দিকে তাকিয়ে আছে। তার চােখ চকচক করছে। সে তার বা-হাত আরেকটু এগিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বলল, “নে খা ।”

পিপড়ারা মনে হলো একটু থমকে গেল। গা বেয়ে উঠল না— কিছুক্ষণ অনিশ্চয়তার ভুগল।

মকবুল বলল, “নিজ থাইক্যা খাইতে দিলে এরা কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে, সঙ্গে সঙ্গে শরীরে উঠে না । শলাপরামর্শ করে। এই দেহেন ডাক্তার সাব উঠতেছে না।”

“তাই তো দেখছি।” ‘দুই এক মিনিটের ব্যাপার। দুই-এক মিনিটে শলাপরামর্শ শেষ হইব, তখন শাইলে উঠা শুরু হইব ।”

হলোও তাই। ডাক্তার সাহেব লক্ষ করলেন, পিপড়ার দল মকবুলের বা হাতেই উঠতে শুরু করেছে। দু'টি সারি ছাড়াও নতুন এক সারি পিপড়া রওনা হয়েছে। এই পিপড়াগুলির মুখে ডিম। ডাক্তার সাহেব ভেবে পেলেন না, মুখে ডিম নিয়ে পিপড়াগুলি যাচ্ছে কেন? এরা চায় কী? কে তাদের পরিচালিত করছে। কে সেই সূত্রধর?

1 comment:

  1. গল্পের শেষ টা ভারী অদ্ভুত ।

    ReplyDelete

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট