প্রমীলার প্রতীক্ষা - গােলাম মুরশিদ


প্রমীলার প্রতীক্ষা
গােলাম মুরশিদ


পােশাকী নাম আশালতা সেনগুপ্ত। ডাকনাম দোলেনা/দোলন। বড়ােরা আরও সংক্ষেপ করে ডাকেন দুলি। কিন্তু বাঙালি সমাজে তাঁর প্রধান—ভুল বললাম—তাঁর একমাত্র পরিচয় তিনি নজরুল ইসলামের স্ত্রী-প্রমীলা। নিশ্চয় হাসতে জানতেন তিনি, হাসতেনও; কিন্তু তাঁর যে-কটি ছবি দেখা যায়, তার কোনােটিতে তার মুখে হাসি তাে দূরের কথা, হাসির রেখাটি পর্যন্ত দেখা যায় না। ছবি তােলার মুহূর্তে অনেকে আড়ষ্ট হয়ে যান। হয়তাে তিনিও তাই হতেন। তবে তাঁর ছবির সঙ্গে তাঁর জীবনেরও একটা আশ্চর্য মিল রয়েছে। ছবির বিষন্ন প্রমীলা, বাস্তব জীবনেরও আমৃত্যু দুখিনী।

তিনি তাঁর পিতার দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র সন্তান। তাঁর কোনাে সৎ ভাইবােন ছিলাে কিনা, জানা যায় না। কিন্তু তার মায়ের তিনি ছিলেন একমাত্র সন্তান। তাঁর পিতাকে তিনি হারান তাঁর বাল্যকালে। কাকার সংসারে আশ্রয় পেয়ে সেই সংসারেই বড়াে হচ্ছিলেন। লেখাপড়ায় ভালাে ছিলেন। বড়াে হয়ে কয়েকটা কবিতা লিখেছিলেন এবং সেগুলাে প্রকাশিত হয়েছিলাে। তা ছাড়া, কুমিল্লায় যখন রাজনৈতিক মিছিল বেরিয়েছে, তখন কিশােরী দুলি তাতেও অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায়। গান জানতেন, গান গাইতেন। তবে সর্বজন-সমক্ষে গাইতেন কিনা, তার প্রমাণ মেলে না।

তিনি যখন তেরাে বছরের কিশােরী সেই সময় এক চৈত্র মাসের শেষে তাদের কান্দিরপাড়ের শান্ত সংসারে অকাল বৈশাখীর মতাে আবির্ভাব নুরুদার-নজরুল ইসলামের। মাত্র কদিনের জন্যে এসেছিলেন। সেই কদিন বাড়ির হাওয়ায় ঝড় তুলে তিনি আবার ঝড়ের গতিতেই চলে গেলেন দৌলতপুর নামে এক গ্রামে। সেখান থেকে মাস দেড়েক পরেই খবর এলাে নুরুদার বিয়ে। কী মজা’ বলে দুলি তখন হাততালি দিয়েছিলেন কিনা, জানা যায় না। কিন্তু বাড়ির অন্যদের সঙ্গে তিনি বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলেন তেসরা আষাঢ় (১৩২৮)। দুঃখের বিষয় সেই রাতেই বিয়েটা হতে হতে ভেঙে গেলাে। তারপরই ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত নুরুদা আর রাঙাদা (দুলির খুড়তুতাে দাদা বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত) বিয়ে-বাড়ি ত্যাগ করে আষাঢ়ের সেই জোছনা-রাতে কান্দিরপাড়ে চলে যান। পরের দিন পরিবারের আর সবার সঙ্গে ফিরে আসেন দুলিও।

এই দুর্ঘটনার প্রচণ্ড আঘাতে নুরুদার প্রেমের সাজানাে বাগান রাতারাতি শুকিয়ে গেলাে। স্বাভাবিকভাইে নুরুদা মুষড়ে পড়েছিলেন। দুলি আর তাঁর বালিকা ভাইঝি এবং বাড়ির বড়ােরা অকৃপণ স্নেহত্ন দিয়ে নুরুকে চাঙা করে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। তিনি সামলে ওঠেন। তারপর, বিয়ে ভেঙে যাবার সপ্তাহ তিনেক পরে, কলকাতা-থেকে-আসা এক বন্ধু-মুজফফর আহমদের সঙ্গে তিনি কলকাতায় ফিরে যান। তবে মাস তিনেক পরে, অক্টোবর মাসে, নজরুল আবার কান্দিরপাড়ে বেড়াতে আসেন। সেবারে সেখানে ছিলেন পাঁচ-ছ সপ্তাহ। তারপর তিনি আবার দুলিদের বাড়িতে আসেন পরের বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে (১৯২২)।

তখনাে দুলির বয়স চোদ্দো হতে কয়েক মাস বাকি। তাঁর জন্ম ১৩১৫ সালের ২৭শে বৈশাখ (৮ই মে ১৯০৮)। সেই কিশােরীর চোখে চোখ রাখলেন নুরুদা। তিনি একদিন তাঁকে একটা কবিতা উপহার দিলেন, যার প্রথম পংক্তিতেই আছে ‘হে মাের রানী তােমার কাছে হার মানি আজ শেষে।' এ কথার মানে দুলি বােঝেন, আবার বােঝেন না। এ কি তাকেই বলা? সেবার এসে নজরুল কান্দিরপাড়ে ছিলেন প্রায় চার মাস। শেষ দিকে তাই নিয়ে রক্ষণশীল হিন্দুরা কুৎসা রটাতে আরম্ভ করেন, তাঁকে অপমান করতে উদ্যত হন। ওদিকে কলকাতা থেকেও কাজের ডাক আসে। তাই মে মাসের শেষে তিনি কলকাতায় ফিরে যান। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যান চোদ্দো বছরের এক কিশােরীর সমগ্র হৃদয়। কৈশােরের অবুঝ ভালােবাসা—টিনএইজ ক্রাশ’ আর কী!

তারপর নভেম্বর মাসে (১৯২২) তাদের আবার দেখা—বিহারের সমস্তিপুরে, দুলির মামার বাড়িতে। নজরুলের কাছ থেকে শুনলেন, তার পেছনে পুলিশ লেগেছে। দুলির হৃদয় আশঙ্কায় দুলে ওঠে। নজরুল তাঁদের সমস্তিপুর থেকে কান্দিরপাড়ে পৌছে দিলেন। কিন্তু সেখানে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কবিতায় কী একটা কথা লেখার অভিযােগে নুরুদা গ্রেফতার হলেন পুলিশের হাতে । মামলা হলাে, মামলায় তার সাজা হলাে এক বছরের। জেল থেকে ছাড়া পান পরের বছর (১৯২৩) পনেরােই ডিসেম্বর। তার তিন-চার দিনের মধ্যেই বিরহিণী দলির সঙ্গে মিলন হলাে নজরুলের । কিন্তু কদিন পরেই নজরুলের আরএকটা মামলা ছিলাে। তাই কান্দিরপাড়ে বেশি দিন থাকা সম্ভব হলাে না। তা ছাড়া, কুৎসার ভয়ও ছিলাে। তাই দুলি আর তার মাকে সমস্তিপুরে পৌছে দিয়ে নজরুল কলকাতায় চলে যান। এদিকে দুলি গভীর আগ্রহ নিয়ে নজরুলের প্রতীক্ষা করতে থাকেন। নজরুল কদিনের জন্যে একবার তাঁকে দেখেও আসেন। কিন্তু স্থায়ীভাবে দুলি আর নজরুলের প্রতীক্ষা শেষ হয় তাঁদের বিয়ের মাধ্যমে—২৫শে এপ্রিল (১৯২৪)। এবারেও সমস্তিপুর থেকে দুলি আর তার মাকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন নজরুল। বিদ্রোহী কবি দুলির নাম দিলেন মহাকাব্যের এক বীরনারীর নামানুসারে—প্রমীলা।

বিয়ের আগে প্রমীলাকে পার হতে হয়েছিলাে দুস্তর সমুদ্র। প্রথমেই ছাড়তে হয়েছিলাে তাঁর পরিবারকে, যে-পরিবারের আশ্রয়ে তিনি বড়াে হচ্ছিলেন, যে পরিবারের লােকেরা ছিলেন তাঁর একমাত্র আপনজন। তা ছাড়া, প্রবল বাধা এসেছিলাে হিন্দু সমাজের তরফ থেকে। কারণ সেকালে হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে বিয়ের কথা ভাবাও যেতাে না। তখনকার একাধিক রাজনীতিক এ বিয়ের প্রতি তাঁদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও বেশ গােপনীয়তা অবলম্বন করে কলকাতার একটি মুসলমান-অধ্যুষিত সড়কের এক বাড়িতে তাঁদের বিয়ে হয়েছিলাে।

তাঁদের বিয়ে হতে আইনের বাধাও কম ছিলাে না। বাধা থাকতাে না, যদি প্রমীলা মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হতেন। কারণ, তেমন অবস্থায় তাঁর বিয়ে হতে মুসলিম আইন অনুযায়ী। কিন্তু তিনি মুসলমান হননি। তিনি মুসলমান হতে চাননি, নাকি তার মা গিরিবালা দেবীর তাতে সম্মতি ছিলাে না, তা জানা যায় না। তাঁর ভাবী স্বামী নজরুল বিয়ের পরেও প্রমীলার ধর্মপালনে কোনাে হস্তক্ষেপ করেননি। তা থেকে মনে হয়, বিয়ের আগেই প্রমীলা ধর্মান্তরিত হবেন কিনা, সে বিষয়ে কথাবার্তা হয়ে গিয়েছিলাে । প্রমীলার বয়স অন্তত আঠারাে হলেও বিয়েতে আইনগত বাধা হতাে না। কারণ তেমন অবস্থায় তাঁদের বিয়ে হতাে ১৮৭২ সালের ৩ আইন অনুযায়ী। কিন্তু প্রমীলার বয়স ছিলাে ষােলাে বছরের থেকেও সপ্তাহ দুয়েক কম। অবশ্য আইনের এই বাধাকে গোজামিল দিয়ে অতিক্রম করেন নজরুল এবং তার বন্ধুরা। আলাপ-আলােচনা করে তারা ঠিক করেন যে, প্রমীলা এবং নজরুলের বিয়ে হতে পারে ইসলামী রীতি আহলুল কিতাব অনুযায়ী। আহলুল কিতাব অর্থাৎ ইসলামী মতে ‘কিতাবধারীদের মধ্যে বিয়ে। আইনগত বাধা দূর করা হলেও, সামাজিক বাধা থেকেই গেলাে। তাই নজরুলের বেশির ভাগ বন্ধু হিন্দু হলেও বিয়েতে তারা একজনও উপস্থিত ছিলেন না।

বিয়েতে ধুমধাম করার মতাে টাকাপয়সা নজরুলের ছিলাে না। বিয়ে হয়েছিলাে মাসুদা রহমান নামে এক বিশিষ্ট মহিলার সার্বিক আনুকূল্যে। বিয়ের সঙ্গে যুক্ত আনন্দউৎসবেরও বলতে গেলে কিছু মাত্র ছিলাে না। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দেয় বিয়ের পরে। 'বিদ্রোহী কবি' হিসেবে বিখ্যাত হলে কী হবে-মুসলমান নামধারী নজরুলের পক্ষে বাড়ি ভাড়া পাওয়া প্রায় অসম্ভব হলাে। আর প্রমীলা এবং গিরিবালা দেবী পড়লেন নিজেদের স্বরূপের সংকটে। তাঁরা না মেশার সুযােগ পাচ্ছিলেন হিন্দু পাড়াপ্রতিবেশীদের সঙ্গে, না পারছিলেন মুসলমানদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে মিশতে। সংসারের মধ্যে থেকেই তারা একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। এই নিঃসঙ্গতা আংশিকভাবে তারা কাটিয়ে উঠতে পারতেন নজরুল যদি ঘরমুখী হতেন। কিন্তু তিনি বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন ঘরের বাইরে। তাঁর জগৎটা ছিলাে সংসার থেকে অনেক দূরে-বন্ধুদের মধ্যে। তাঁর সময় কাটতাে আড্ডা দিয়ে, গান গেয়ে, হৈচৈ করে। তাঁর ধারণা ছিলাে ‘বেলা যাবে এবে গান গেয়ে আর পান খেয়ে। স্ত্রীকে সঙ্গ দেবার মতাে অফুরন্ত সময় কোথায় তার?

বিয়ে হওয়ায় প্রমীলা কতােটা আনন্দিত হয়েছিলেন অথবা সুখী হয়েছিলেন, সেটা অনুমান-সাপেক্ষ। তবে স্বস্তি লাভ করেছিলেন নিঃসন্দেহে। বিয়ের সতেরাে সপ্তাহ পরে প্রমীলার পুত্রসন্তান হলাে জন্মাষ্টমীর দিন—আঠারােই অগস্ট। সে কথা মনে রেখে নজরুল তার নাম দিলেন কৃষ্ণ মহম্মদ। পরে আরও একটা নাম দিয়েছিলেন তাকে। আকিকা করেছিলেন সব ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে–যদুর সম্ভব হৈচৈ করে। সেই সন্তান মারা যায় প্রায় চার মাস বয়সে। দু বছর পরে তাঁদের আর-একটি সন্তান, বুলবুলও মারা যায় আকস্মিকভাবে। দুটি ঘটনাই প্রমীলাকে মর্মাঘাত দিয়েছিলাে। নজরুলের বাইরের জগৎ ছিলাে, কল্পনার জগৎ ছিলাে, কবিতা-গানের জগৎ ছিলাে। প্রমীলার অন্তর্লোক থাকলেও, বাইরের জগৎ ছিলাে না, সামাজিক জগৎও ছিলাে না।

সন্তান জন্মের পর দরিদ্র সংসারের খরচ আরও বেড়ে গিয়েছিলাে । যখনকার কথা বলছি (১৯২৪-২৬), তখন নজরুলের একমাত্র আয়ের উৎস ছিলাে তাঁর কবিতা। সে আয় সচ্ছলভাবে সংসার চালানাের জন্যে যথেষ্ট ছিলাে না। এমন কি, সে আয় নিয়মিতও ছিলাে না। সেই অপ্রতুল আয় দিয়েই নিজেদের খাওয়া-দাওয়া, আহুতঅনাহুত যখন-তখন-আসা অতিথিদের আপ্যায়ন, কাপড়-চোপড় ইত্যাদির ন্যূনতম চাহিদা মেটানাের অসাধ্য সাধন করতে হতাে। কান্দিরপাড়ে যে-সংসারে তিনি মানুষ হচ্ছিলেন, সে সংসারে আর যাই হােক, এমন দুঃসহ দারিদ্র্য ছিলাে না। নিজের সংসারে প্রমীলাকে এবং গিরিবালা দেবীকে যে কখনাে কখনাে অনশনে কাটাতে হয়েছে, তার সাক্ষ্য দিয়েছেন নজরুলের এক কনিষ্ঠ বন্ধু খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন। এমন কি, সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর সবচেয়ে দরদী বন্ধুদের একজন-মুজফফর আহমদ। এ রকম একবার যখন প্রমীলা এবং তাঁর মায়ের অনশন-অর্ধাশন চলছিলাে, তখন জরুরী বার্তা পেয়ে আবদুল হালিম কৃষ্ণনগরে গিয়ে তাঁদের চাল-ডাল কিনে দিয়ে এসেছিলেন। নজরুল তখন ঢাকায় গান শেখানাের কাজে মশগুল ছিলেন।

কেবল ঢাকায় নয়, কলকাতায়ও একই অবস্থা। কলকাতার বাইরে-চুঁচুড়ায়ও তাই। গান শেখাতে গেলে সেখানেই আহার, সেখানেই নিদ্রা। এদিকে স্বামী হঠাৎ লাপাত্তা হওয়ায় প্রমীলার যে কতাে বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়েছে, কোনাে জীবনী-গ্রন্থে তার হদিস মেলে না। স্বামী খেলার মাঠে গেলেন ফুটবল খেলা দেখতে, কিন্তু খেলাশেষে চলে গেলেন কলকাতা থেকে ঢাকায়—এ দিয়ে নজরুলের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বােঝানাে যায় বটে, কিন্তু এই উচ্ছলতা এবং দায়িত্ববােধের ঘাটতি তার। স্ত্রীর জন্যে কতাে উদ্বেগ এবং অশান্তির কারণ হতে পারে—তার পরিমাপ করা যায় না। মা গিরিবালা দেবী সঙ্গে না-থাকলে প্রমীলা একা কী করে বাস করতেন, তা চিন্তা করলে উত্তর মেলে না।

ওদিকে, এক মুসলমান ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হওয়ায় গিরিবালা দেবীর কোথাও যাবার উপায় ছিল না। এমন কি, ভাইয়ের বাড়ি সমস্তিপুরেও নয়। তিনি মেয়ের পরিবারে বাস করায় প্রমীলা খানিকটা রক্ষা পেয়েছিলেন দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন স্বামীর উচ্ছখল আচরণের হাত থেকে। মা তাঁকে আগলে রেখেছিলেন। অপর পক্ষে, এটা অনুমান করা অসংগত হবে না যে, মা সঙ্গে থাকায় কমবয়সী প্রমীলা অনেক সময়ই মায়ের বুদ্ধিতে কাজ করেছেন। ফলে প্রমীলার সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্ক যতােটা প্রত্যক্ষ এবং নিবিড় হতে পারতাে, ততােটা হতে পারেনি। একে অন্যকে বুঝতে পারার যে-সম্পর্ক তৈরি হতে পারতাে, তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে তাও হতে পারেনি।

একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। একদিন প্রতিভা সােম এবং তাঁর মা নজরুলের সঙ্গে নজরুলের বাসায় গিয়েছিলেন। নজরুল যখন সিড়ি দিয়ে উঠে যে-ঘরে প্রমীলা ছিলেন, সেই ঘরে যেতে উদ্যত হন, তখন গিরিবালা দেবী অন্য ঘর থেকে এসে দৃঢ় কণ্ঠে নজরুলকে বলেন, খবরদার নুরু। ওই ঘরে তুমি যাবে না। দুলির অসুখ।' এ হলাে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ। এর ফলে দুই অতিথির সামনে নজরুলের যে-অপমান হয়েছিলাে, তা সমগ্র পরিবারের পারস্পরিক সম্পর্ককেই প্রবলভাবে নাড়া দেবার কথা। বিশেষ করে প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের। বস্তুত, মা সঙ্গে থাকায় প্রমীলা স্বতন্ত্র একজন ব্যক্তি হিসেবে পরিণতি লাভ করতে পারেননি।

জীবনধারণের স্বল্পতম উপকরণের অভাব, স্বামীর কাছ থেকে যথেষ্ট সঙ্গ নাপাওয়া, আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব না-থাকা এবং সর্বোপরি স্বামীর একনিষ্ঠতা ও আনুগত্যের অভাবে প্রমীলা খুব সুখী হয়েছিলেন বলে মনে করা শক্ত। একেবারে প্রথম দিক ছাড়া স্বামীর ভালােবাসা তিনি কতােটুকু পেয়েছিলেন, তাতেও সন্দেহ হয়। নজরুল ছিলেন প্রেমের কবি। অসংখ্য নারীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন তিনি এবং তাদের অনেককে তাঁর ভালাে লেগেছিলাে। ভালােও বেসেছিলেন কাউকে কাউকে এবং তাঁদের নিয়ে অসংখ্য প্রেমের কবিতা ও গান রচনা করেছিলেন। কিন্তু দুলিকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখলেও, প্রমীলাকে নিয়ে তিনি প্রেমের গান অথবা কবিতা লিখেছিলেন বলে মনে করা কঠিন। তাঁর সুস্থ থাকা কালে প্রকাশিত প্রায় চল্লিশটি গ্রন্থের মধ্যে কোনাে গ্রন্থও উৎসর্গ করেননি তাঁর নামে—যদিও বিশেষ নারীকে সরাসরি উৎসর্গ করতে নাপেরে সে নারীর পিতার নামে অথবা কোনাে নারীর নামে উৎসর্গ করতে না-পেরে রবীন্দ্রনাথের নামেও গ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন। (দোলনচাঁপা বইটির নামের মধ্যে অবশ্য দুলির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।)।

দৌলতপুরে বিয়ে ভেঙে যাবার পর কান্দিরপাড় থেকে নজরুলকে কলকাতায় নিয়ে যেতে এসেছিলেন মজফফর আহমদ। তখন (জুলাই ১৯২১) তিনি প্রমীলাকে দেখেছিলেন। দেখে তাঁর মনে হয়েছিলাে দুলি একটি হাসি-খুশি চঞ্চল কিশােরী। সেই কিশােরীকেই প্রমীলা নজরুল হিসেবে তিনি দ্বিতীয়বার দেখেন ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রমীলার বয়স তখনও আঠারাে হয়নি। কিন্তু মুজফফর আহমদ অন্য-এক মেয়েকে দেখতে পান প্রমীলার মধ্যে। বয়সের তুলনায় একটু বেশি ধীর, স্থির এবং শান্ত'। তাঁর সেই হাসি-মুছে-যাওয়া মুখের ছবিই আমরা দেখতে পাই তাঁর বিভিন্ন আলােকচিত্রে।

যদি আর্থিক অভাবজনিত কষ্টের দরুন প্রমীলা অসুখী হতেন, তা হলে ১৯৩০-৩১ সাল থেকে তাঁর সুখী হবার কথা ছিলাে। কারণ এ সময় গ্রামােফোন কম্পেনির জন্যে গান লেখা, তাতে সুর দেওয়া এবং সে সুর গায়ক-গায়িকাদের শেখানাে বাবদ নজরুল অনেক টাকা পেতেন। বেতারের সঙ্গেও তাঁর যােগাযােগ ঘটেছিলাে। এমন কি, মঞ্চের সঙ্গেও। এতােটাই সচ্ছল হয়েছিলেন যে, তিনি একটা বড়াে গাড়িও কিনেছিলেন ১৯৩১ সালের শেষ দিকে। গাড়ি কেনার জন্যে অবশ্য অগ্নিবীণার গ্রন্থ-স্বত্বও বিক্রি করতে হয়েছিলাে। কিন্তু ১৯২৬-২৭ সালের আর্থিক অনটনের কথাকে তখন প্রমীলা এবং গিরিবালা দেবী হয়তাে কেবল দুঃস্বপ্ন বলেই বিবেচনা করতেন। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যই অবশ্য সুখ আনতে পারে না। ওদিকে, নজরুল গান-বাজনা আর গানের নরনারীদের নিয়েই মত্ত থাকলেন। পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়লাে না। উচ্ছল জীবনে শৃঙ্খলা এলাে না একটুও।

তদুপরি, ১৯৩০ সালের ৭ই মে তিন বছর আট মাস বয়সে বসন্ত রােগে ভুগে নজরুল এবং প্রমীলার—যাকে বলে—নয়নমণি দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল মারা যায়। সেদিন অথবা তার আগের দিন ছিলাে প্রমীলার জন্মদিন। পুত্রশােকে নজরুল যে-কষ্ট পেয়েছিলেন, তা তিনি কোনাে দিনই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। গানে-গানে তিনি সেই শােকের কথা বলেছেন। কিন্তু প্রমীলা কী মর্মান্তিক আঘাত পেয়েছিলেন, আমরা তা জানতে পারিনি। কারণ, স্বামীর মতাে তিনি গান অথবা কবিতার মধ্য দিয়ে তাঁর শােকের কথা ব্যক্ত করে মনকে লঘু করতে পারেননি। বিভিন্ন জনের লেখা থেকে মনে হয়, বুলবুলের ছিলাে অসাধারণ প্রতিভা। তিন বছর বয়সে নজরুল হারমােনিয়ামে কোনাে সুর বাজালে সে বলে দিতে পারতাে সুরটা কোন রাগরাগিণীর। জীবজন্তুর নাম ইংরেজিতে বলে দিতে পারতাে ছবি দেখলে। তদুপরি, স্নেহ কেড়ে নেওয়ার মতাে ব্যবহার ছিলাে তার। প্রতিভা সােম যেদিন নজরুলের সঙ্গে তাঁর বাসায় গিয়েছিলেন, সেদিন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বুলবুল দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাে, ‘এই যে কাজীদা, কোথায় ছিলে?' নজরুল তাকে বুকের মধ্যে ধরে হেসে বলেন, আবার কাজীদা বলেছিস!' এ রকম সহস্র স্মৃতি প্রমীলা এবং নজরুলকে তিলে তিলে দংশন করছিলাে।

কিন্তু প্রমীলার সবচেয়ে বড় বিপদ ঘনায় ১৯৩০-এর দশকে কবির বেহিসেবী বিলাসিতা এবং অপরিমেয় অপব্যয় থেকে। যে-নজরুল কয়েক হাজার গান লিখে হাজার হাজার টাকা আয় করেছিলেন, ১৯৪০ সাল আসার আগেই তিনি প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান। তার চেয়েও বড় বিপদ প্রমীলার দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা। ট্রান্সভার্স মায়অলাইটিস নামক এই রােগের পরিণতিতে ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে তিনি তাঁর নিম্নাঙ্গে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। মা তখন তাঁর একমাত্র সহায় হয়েছিলেন। স্বামীও তাঁকে রােগমুক্ত করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন—প্রথমে চিকিৎসা, তারপর টোটকা চিকিৎসা এবং সবশেষে গুরু বরদাচরণ মজুমদারের নির্দেশে যােগ, পূজো ও নামাজের আশ্রয় নিয়ে। তবু প্রমীলা আরােগ্যলাভ করেননি। কিন্তু প্রমীলার দুর্ভাগ্যের তখনও শেষ হয়নি। সেটা হলাে স্বামী যখন ১৯৪২ সালের গােড়া থেকেই রােগাক্রান্ত হলেন। সেই রােগ জুলাই মাসে নজরুলকে বাকরুদ্ধ এবং অপ্রকৃতিস্থ করে তােলে। ক্রমে তিনি স্মৃতিভ্রংশ হন। সে সময়ে প্রথম চার বছর পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রমীলাকে এবং সংবিৎ-হারা নজরুলকে সর্বশক্তি দিয়ে সাহায্য করেছেন গিরিবালা দেবী। তারপর গিরিবালা দেবী নিরুদ্দেশ হওয়ায় কী দুঃসহ পরিবেশে প্রমীলা তাঁর গুরুতর ভাবে অসুস্থ স্বামী এবং দুই বালক পুত্রকে নিয়ে বেঁচে ছিলেন, তা বর্ণনাতীত।

এভাবে কেটে যায় বছরের পর বছর। তারপর দীর্ঘদিন রােগে ভুগে ১৯৬২ সালের ৩০শে জুন প্রমীলা মারা যান। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় চুরুলিয়ায় নজরুলের পৈতৃক বাড়িতে। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তার কবরের পাশে জায়গা রাখা হয় স্বামীর জন্যে। প্রমীলা প্রতীক্ষা করে থাকেন মৃত্যুর পরও তিনি থাকবেন স্বামীর পাশে। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস! বাংলাদেশের ফৌজী একনায়ক প্রমীলার স্বামীকে গ্রেফতার করে ঢাকায় বন্দী করে রাখেন—বন্দী করে রাখেন চিরতরে। প্রমীলার প্রতীক্ষা পরিণত হয় অনন্ত প্রতীক্ষায়।

প্রবন্ধটি লেখকের বই “বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল-জীবনী” থেকে সংগৃহীত






No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট