ভূমিপুত্র - পারভীন সুলতানা [ছোটগল্প]

ভূমিপুত্র
পারভীন সুলতানা।


আজ অমাবশ্যা। সমস্ত আলো শিকার করে নিয়ে গেছে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ।রাত এখানে র্নিজন,অচঞ্চল। স্থলচর আমরা কয়জন এখন জলের কাছাকাছি। গাঙচরা বিলে জয়নাল ভাই,উসমান আর আবেদ আলীর সাথে মাছ মারা কিস্তি নাওয়ের গলুইয়ে বসে ওদের নিরলস র্কমকাণ্ড দেখি । এরা মাছ ধরার সময় কথা কয় না। যেন ধ্যান রত মুনি-ঋষি! বর্ষার শুরু কেবল। আজ সারাদিন মনের সুখে বৃষ্টি হয়েছে। আবেদ আলীর ভাষ্য, তাজা পানির গন্ধে মাছের নিশা দরে! নয়া পানিতে ঝাঁক ঝাঁক নবজাতক নিয়ে ভ্রমণরত শোল জননীর উপর জয়নাল ভাইয়ের র্নিদয় কোঁচের নিশানা ফসকায় না। বৈঠাতে উসমান। বড় জ্যাঠার ছেলে।আবেদ আলীর কাজ কেবল র্টচ মারা। ও আমাদের বছুরে কামলা হলেও সর্ম্পকটা প্রায় ইয়ার দোস্তের মতো। অপ্রাসঙ্গিক আলোয় উসমানের ঘাড় শিকারি বকের মতো একটুখানি বাঁকতে দেখি কেবল। বিলম্বিত র্বষায় পানি এখনও কোমর সমান হয়নি। নৌকার তলে আউসের চারা । মাঝে মঝে অস্পস্ট ক্রিচ্স্স্ শব্দ হয় কী হয় না! শোল বড় তেজিলা মাছ! কোঁচ থেকে তুলে এর বন্দোবস্তু করতে এরা বিরতি নেয়। র্টচ টিপতে টিপতে আবেদ আলীর পেট ফোলা র্তজনি চেপ্টে গেছে। অনেক্ষণ পর শুক্লপক্ষ স্ব মেজাজে ফিরে যায়। অন্ধকারে উসমান পকেট থেকে বেনসন বের করে। বয়সে আমার চেয়ে মাস ছয়েকের বড়। যদিও এইসব ছোট-বড় আমরা মানি না। উপহার হিসেবে ওকে আমিই দিয়েছি। লাইটারে আগুনের যোগান দিতে না দিতেই নিবিড় অন্ধাকার নেমে আসে। আঁঠালো এ অন্ধকারকে আরো মজবুত করে তোলে বিদ্যুতের অনুপস্থিতি। পল্লী বিদ্যুৎ থাকলেও প্রায়ই অদৃশ্য এখানে! কাছেই বিলের পাশ ঘেষা পাকা রাস্তা। এবার বর্ষা সিডিউল ট্রেন মিস করেছে। লাস্ট ট্রিপের লোকাল ধরে আসছে বোধ হয়! আষাঢ়ের আজ সাত। হাওড়ের পানি এখনও কোমর ছাড়ায়নি! কালো বোরখা পরা নিপাট অন্ধকার ফুটো করে দেয় বিলের পাশের পাকা রাস্তায় দৌড়ে আসা একটা ট্রাক। হেড লাইটের উজ্জ্বল আলো মসৃণ আঁধার ফালা ফালা করে তুললে আমাদের পলাতক ছায়ারা কিছুক্ষণের জন্য ফিরে আসে। কায়ার ঘেরটোপে বন্দি আমরা আবার ভুস করে জেগে উঠি। তবে বেশিক্ষণ সঙ্গ দেয় না পিছলে যাওয়া ভৌতিক আলো। বাহনটি অদৃশ্য হতেই রাত তার আগের অবয়বে ফেরে। বৈচিত্রহীন অন্ধকার কিন্তু রাতপাখির নিঃসঙ্গ রোদন, পোকার ডাক,বিলে ঘাই দেয়া মাছের সংলাপ, গাছ-গাছালিতে জড়ানো-মড়ানো লতা-পাতার বনজ গন্ধের ওপর খবরদারি করতে পারে না। নাওএর তলানির সাথে ঘষা খাওয়া পানির টলল্ টলল্ শ্রুতিমধুর গান শুনতে শুনতে মন বেভুলা হয় দুর অতীতে।কিছু আব্বার মুখে শোনা, কিছু আমার শৈশবে দেখা।

জলো বিল,নিরলস বয়ে চলা কংসঘেষা নদীর গলাগলি ধরা আমার বাপ-দাদার গ্রাম চিরাং। দাদা জাহাবক্স তালুকদারের বেশুমার জোত-জমি।বিশাল সয়-সম্পত্তির মালিক হলেও দাদা কী তার ছেলেরা ঠেঙের উপর ঠেঙ তুলে বসে থাকতো না। ধুম কাজের দিনে বাড়ির কায়-কামলার সাথে তারাও খাটতো সমান তালে । রোয়া লাগানো,জমিতে লাঙল দেয়া এসব কায়িক শ্রমে আলসেমি ছিলো না কোন । আব্বাদের ছয় ভাই-তিন বোনের মধ্যে একজনেরই মন ছিলো উচাটন! আব্বার সব চেয়ে ছোট ভাই চানফর আলী গাথক,নিজেই গান বানায়,নিজেই গায়। গানের দলের সাথে কই কই ঘুরে বেড়ায়! সুনাম গঞ্জ, নিকলি,মিঠামইন,খালিয়াজুড়ি! বাড়ি ফিরলে হাটবার ছাড়া সেও হাওরে চাষের জমিনে পড়ে থাকে। মনফর জ্যাঠার ঝোঁক ব্যবসায় । বাজারে জ্যাঠার থান কাপড়ের বড় দোকান। বাড়ির লাগোয়া বিছানে আবার আনাজপাতির চাষ করতো। এটা ছিলো তার হাউশ! । এদের সবার প্রাণ ভোমরা যেন মাটির অতলে গোঁজা! এতো বড় বাড়ির মধ্যে খালি আব্বারই লেখা-পড়ার শখ জাগে। হ্যাঁ, এ বাড়ির রেসালামতে এইটারে শখই বলা লাগে! ধান-ফান, সরিষা-তিসি,আলু- মরিচের আবাদ করার ইচ্ছা পিছলে কেমনে কেমনে যে আমার আব্বার ইস্কুলে যাওয়ার মন লাগে! সেটা বোধ হয় দাদার বাড়িতে লজিং থাকা প্রাইমারি স্কুলের ইসমাইল স্যারের সুবাদে। লজিং মাস্টারের বাড়ি ২০/৩০ মাইল উজানে। সেদিনের হিসাবে এই পথের দূরত্ব অনেক বেশী বৈকি! নাই রাস্তা-ঘাট,নাই যান-বাহন। বর্ষাকালে নাও-নৌকাই ভরসা। লজিং মাস্টার নিয়া আমার কিচ্ছা না,কিচ্ছা আব্বারে নিয়া। চৌদ্দগুষ্টির মধ্যে পড়ালেখা না থাকলে কী! আব্বা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তেলেসমাতি দেখানো শুরু করে। শুধু ক্লাসে প্রথম হয়ে না ; মেট্রিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে স্টেন্ড করে (পঞ্চম) তালুকদার বাড়ির মধ্যে একটা ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটায়। আব্বা আরো লেখা-পড়া করার জন্য টাউনে পাড়ি জমায়। বাপের টাকা-পয়সার অভাব নাই আর পুত্রের র্ধৈয্যের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্নাস ,এমএ শেষ করে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। অনার্স পড়ার সময়ই আব্বার শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়। গাঁয়ের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আম্মাও গ্রাম ভালোবাসেন। আব্বা সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। বদলির চাকরি। আগের মতো হুটহাট বাড়ি যাওয়া কমে যায়। তবে বার্ষিক পরীক্ষার পর স্কুলের র্দীঘ ছুটিতে গ্রামে যাওয়া ছিলো আমাদের জন্য উৎসব।

সড়ক উঁচা করে এর মধ্যে রাস্তাঘাট হয়েছে।তবু ভাটির দেশ বলে কথা! বাড়ি অবধি গাড়ি যায় না। চৈতার হাওরের কাছে নেমে বাড়ি যাবার বাকিটা পথ হাঁটতে হয়। পথে ফসলি মাঠেই দেখা হয়ে যায় জ্যাঠা,কাকাদের সাথে। ওদের পরিশ্রমী পিঠের নানামাত্রিক ঘামের রেখা আমার শিশু হৃদয়ে গভীর হয়ে দেবে থাকে।সে সব তরল জলকণা আমার বুকে সযতনে লিখে দেয় ‘ভূমিপুত্র’ শব্দটা। বাড়ির দিনগুলো খড়ের গাদায় লুটোপুটি করে,ছিপ দিয়ে মাছ ধরে, গাছের ফল-পাকুর খেয়ে ব্যাখ্যাতিত আনন্দে ফুরুৎ করে শেষ হয়ে যেতো! দিন তো পায়ে পায়ে হাঁটে না, দৌড়ায়! বড় হওয়ার পর গ্রাম প্রীতি ক্রমশ ফিকে হয়ে আসতে থাকে। নগরের চটকদার জীবন গ্রামের সবুজ আকর্ষণ কেড়ে নেয়ায় ঘোর তৎপর হয়ে ওঠে। আম্মাও শহরে গোছানো সংসারের ছককাটা ফ্রেমে ঢুকে পড়ে। ঢাকা এক রকম আমাদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠে। ইস্ত্রি করা মসৃন আভিজাত্য ধান ক্ষেতের ইঁদুরের মতো ঢুকে পড়ে আমাদের গিরস্ত ঘরে। কেবল আমার বোধের কোথায় যেন মাটির নেশা রয়ে যায়! টবের অনুর্বর মৃত্তিকায় নানাজাতের গাছ লাগাই। অচেনা লাল মাটিতে অভিমানি গাছ বাড়ে না। বিরক্ত হয়ে হাল ছাড়ি।

ভাইজান উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকা উড়াল দেয়; বড় আপাও বিয়ের পর কানাডা পাড়ি জমায়। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আমি ময়মনসিংহ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে পিওর অ্যাগ্রিকালচারে ভর্তি হই। ব্রহ্মপুত্র নদ, বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে থাকা চারপাশের দৃশ্যমান গ্রামগুলো আমার ভেতরের ভূমিপুত্রকে খুঁচিয়ে তোলে। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে ক্যাম্পাসের জমিতে হাল-চাষ করতে করতে আমার পিঠেও র্পূবপুরুষের মতো শ্রমক্লান্ত ঘাম জমে। ওদের আদলে তর্জনির পেট দিয়ে কপালের ঘাম ঝরাই।ক্লান্তির সাথে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ বোধ করি। ফসলের জমি তৈরি,আবাদের সঠিক পদ্ধতি,পর্যাপ্ত ফসল ফলানোর থিউরি খুব নতুন লাগে না আমার কাছে।বেশি ফলনের জন্য সারি বেঁধে ধানের চারা লাগানো,পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের জন্য মাটিকে মিহি তুলতুলে করে তোলা, পানির যোগান দেয়া চাচা-জ্যাঠাদের কাছে দেখা এসব আমার শৈশবের পাঠ । এখন বাসে ময়মনসিংহ থেকে বাড়ি যাওয়া যেন এক দৌড়ের পথ!। যোগাযোগের নড়বড়ে সাঁকোটা মেরামতে তৎপর হই। সত্যি বলতে কী, দাদা-দাদি মারা যাবার পর আব্বাও গাঁয়ে যাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে...।উসমানের শিকারি চোখ ঘুরতে আসা এক বে-ভুলা কালা বাউসের পিঠ ক্কচাৎ শব্দে গেঁথে নিলে আমার স্মৃতি ভ্রমনে আবেদ আলীর উল্লাস ঢুকে পড়ে। বিড়ি টানার উছিলায় সবাই গাল-গল্পে মাতি। -তাইলে তুমি ঠিক করছো বিদেশ চইলাই যাইবা? আবেদ আলী সকাল থেকে এ নিয়ে ৬/৭ বারের মতো জিগেশ করেছে কথাটা।যতোবার আমি জানাই হ্যাঁ,চইলাই যাইতাছি ;ততোবার হতাশায় ওর লম্বা থুতনি আরো লম্বা হয়ে যায়। ফজরের আজানের আগে আগে বাড়ি ফিরি আমরা। ঘুমের ওজনে কেউ কারো দিকে তাকাতে পারি না।

এক আজানে ঘুমিয়ে আরেক আজানে ঘুম থেকে জেগে দেখি আলো ঝলমলে দুপুর। ক্ষিধায় পেট জ্বলছে। সকাল থেকে পেটে কোন দানা-পানি পড়েনি। জ্যাঠি ভাত বেড়ে আমাকে ডাকে- এলা খাইতো আয়া ফরো, বহুত মাছ ধরা অইছে! আমি হাত ধুতে ধুতে জানতে চাই জয়নাল,উসমান আর আবেদ আলী খেয়েছে কী না। -হেরা এক গড়ান ঘুমানি শেষ কইরা কুমবালা উঠ্যা রায়ের বাজারো গেছে গা! জ্যোঠির কথায় মনে পড়ে, আরে আজকে না হাটবার!

হাটবার আমার একটা পছন্দের দিন। আশ-পাশের পুরা এলাকার পরিস্কার একটা নকশা পাওয়া যায় হাটে গেলে। রায়ের বাজারের হাট অনেক বড় হাট! কত জিনিস বেচা-কেনা হয়! শুধু কী কেনা বেচা! গায়েন আর কবিয়ালরা আসে। আসে কিচ্ছা গাথকের দল। আরো কত রকমের পসরা বসে! মিঠাই এর দোকানই বসে নানা কিসিমের। গজা, তিলের খাজা, আঙ্গুর ভাজা, তিলুয়া। আর রসগোল্লা,কালোজাম, ছানার মিষ্টির কথা বাদই থাক। বিশাল মাছের আরত দেখার মতো। সেই মোহন গঞ্জ, ইটনা, মিঠামইন থেকে জাউল্লারা মাছ নিয়ে আসে। ভাত খেতে খেতে খেয়াল করি জ্যাঠি আঁচলে চোখ মুছছে। আমি এ অশ্রুর কারণ জানি তাই আর জিগেশ করি না। বরং খেয়ে অন্যদিন যেখানে বসে আরো একটু গল্প করি; আজ হাত ধোয়া শেষ করে সোজা উঠে ছাদে চলে যাই। এও এক গপ্পো, আব্বা নিয়মিত না এলেও বাড়িতে পাকা তিনতলা বিল্ডিং তুলে রেখেছে। তাঁর উপ সচীব হওয়ার গরীমা এখানে এভাবে টাঙ্গিয়ে রেখেছেন তিনি। আগে আমাদের বাড়িটাকে ‘তালুকদার ’বাড়ি নামে চিনতো সবাই,এখন ডাকে তিনতলা বাড়ি। ইটের প্রাণহীন কাঠামো বংশের পরিচয় উপরে নেয়ার পায়তারা জুড়েছে। অনিয়মিত হলেও বেশ আগে থেকেই এখানে কারেন্ট চলে এসেছে। ফলে সবুজের বিস্তারে একখণ্ড নগরের অপ্রাসঙ্গিক জবরদস্তি! বাড়িটাকে দূর থেকে লক্ষ করলে গ্রামের সবুজের মাঝখানে কেমন বেমানান লাগে।

ছাদে দাঁড়িয়ে প্রিয় বেনসন ধরাই। সড়ক ধরে যাওয়া লোকজন দেখি। বেশির ভাগের গন্তব্য হাট। মাথায় আনাজ-তরকারি , হাতে ঝুলানো হাসটা,মুরগিটা। হাটে বেচবে। এ দৃশ্যও অচিরে লোপ পেয়ে যাবে। ভাটির রিমোট এলাকা হলে কী! দালাল আর ফড়িয়াদের লম্বা হাত এখান র্পযন্ত পৌঁছে গেছে। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে এরা এলাকার সেরা জিনিসগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যায় শহরের পেটমোটা লোভিদের জন্য। যাদের বিন্দুমাত্র মায়া নাই ,ভালোবাসা নাই আপ্রাণ ভুলে যাওয়া গাঁয়ের মাটি ও মানুষের প্রতি। র্বষার আকাশে মেঘের খঞ্জনি বেজে ওঠে । মেঘের সাঁজোয়া বাহিনী দলবল নিয়ে নামার পায়তারা করছে। বিকেল মোহময় হয়ে উঠলে আমার যুবক হৃদয়ে আয়েশার স্মৃতি উজিয়ে ওঠে। কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দ্বিতীয় র্বষ থেকে মধুর আনন্দে প্রেমের গাঁটছড়া বাঁধি আমরা। কথা হয় পাশ করার পর গ্রামে থাকবো। স্বপ্নে নয়, বাস্তবের মৃত্তিকায়। ফাইনালের পর কথা না রেখে আয়েশা উড়াল দিলো জাপান। বুক টনটন করলেও এক রোখার মতো আমি রোজ তাকে ভুলে যেতে থাকি। কিন্তু প্রেম ভোলা সহজ কথা ! একটা মচমচে হুল্লুরে রাস্তায় তাকাই।সামনের সড়কে হৈহৈ করে ফিরছে হাটুরে দল। এদের কয়েকজনের হাতে মানুষ সমান বিশাল এক বোয়াল। মাছটা দেখার মতো বটে। ওদের দলে ভিড়ে যায় কৌতূহলী আমুদে লোকজন। দূরে দেখা যায় চানফর চাচার গাথক দলটাকে। ওরা হাটবার এলে বিনে পয়সায় গান ফেরি করে। ঠোঁটে বহন করে নিয়ে আসা সুরকে প্রান্তরে প্রান্তরে ছড়িয়ে অপার আনন্দে মাতে গায়েনরা ।
ও বন্ধুরে পরান বন্ধু আমার
তুমারো বিচ্ছেদে কান্দি
অন্তরে পাষানও বান্ধি
তেও পিরিতির কমেনা গো ধার...।
গানের বেভুলা কষ্টের বাণী আর মীরের মসৃণ মুন্সিয়ানা ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয় আমাকে। এক বেবুঝ মায়া আরো মাটি সংলগ্ন করে আমাকে! আব্বার খুব ইচ্ছা আমি অস্ট্রেলিয়া গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি র্অজন করি। যাবার আয়োজনও সম্পন্ন প্রায়। সবাই তাই জানে। শুধু আমি জানি যে, কোথাও যাচ্ছি না আমি। কোন দেশ এমন আপনতা দেবে আমাকে! চানফর চাচার গায়েন দলের মতো এমন মিঠাস গান কোন দেশের গাথকরা শোনাবে এমন চেনা দরদি গলায়! কোথায় হাটুরেদের দল স্রেফ একটা মাছ কিনে এমন আনন্দ আয়োজনে মাতে!

থানা কৃষি অফিসারের পোস্টে পরীক্ষা দিয়েছি। চাকরি হবে জানি। কোন দিন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হইনি । আমিতো আব্বারই ছেলে! পরিকল্পনা করে কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়েছিলাম। শৈশবে দেখা মগ্ন কৃষকের সেই সব পাঠ সযতনে কে কখন আমার কলবের ভেতর সিলগালা মেরে দিলো নিজেও জানি না। গ্রামের সবুজ,ফসলি মাঠ যেন আমার ইবাদতের জায়নামায হয়ে ওঠে! ফসলের সূরা পড়ে বাতাস আমাকে ফুঁ দিলে যেন জিকির ওঠে আমার পরানে!

স্বপ্ন দেখি বাপের ঘর-ভিটায় সংসার পাতার। নয়া টিনের ঘর তুলবো। টিনের চালে আষাঢ়ের বৃষ্টি নামবে ঝম ঝম। বকুল আর কদমের ফুল ফুটবে বেশুমার। এ বাড়িটাকে সবাই আগের মতো ‘তালুকদার বাড়ি’ ডাকবে।বিশাল উঠানে ধান মাড়াইয়ের আয়োজনে কামলারা বেসুরে গলায় চানফর চাচার ফসলি গান গাওয়ার সময় আমার পুত্রও সে গানে গলা মিলাবে।
ও বন্ধু পরান বন্ধুরে আমার...।
উডান ভরা ধান যে বেশুমার
কই যে গেলা ঠিকানা নাই তুমার
তেও পিরিতির কমেনা যে ধার
বাবিজানে ঢেঁকিতে দেয় পার
ও বন্ধু পরান বন্ধুরে আমার।
জাহাবক্স তালুকদারের মাঠ মাঠ জমিন। সেখানে সবুজ ফসলের কাব্য বুনবে তার উত্তর ভূমিপুত্র। আব্বা পড়াশোনা শিখে নকল সাহেব বনে গেছে ; আমি সন্তান হিসেবে তার প্রায়শ্চিত্য করার জন্য অপার আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করি।

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট