বিশ্বমহামারির বিস্ময়: নারীর শাসন (সেরা) - আশফাক স্বপন


ফেসবুকের মেয়ে বন্ধুরা, এই লেখাটি তোমাদের উদ্দেশ্যেও উৎসর্গ করা হয়েছে! দেখা যাচ্ছে, করোনা মহামারি মোকাবেলায় যেসব দেশ এগিয়ে, তার অনেকগুলোর নেতৃত্বে নারী। তাহলে কি নারীর নেতৃত্ব শ্রেয়? এই প্রসঙ্গে আমার অভিমত। The Daily Star-এ প্রকাশিত ইংরেজী প্রবন্ধে লিঙ্ক নীচে। পাঠকদের সুবিধার্থে বাংলা অনুবাদ নীচে নিবেদন করলাম।

বিশ্বমহামারির বিস্ময়: নারীর শাসন (সেরা)
নারীর উপযুক্ত মর্যাদাদানে সকলের কল্যাণ

আশফাক স্বপন

ডেইলি স্টার। ৩০ মে, ২০২০

আমাদের জীবদ্দশায় এত বড় স্বাস্থ্য সঙ্কট আমরা দেখিনি। সারা পৃথিবীর আজ টালমাটাল অবস্থা। তার মধ্যে এই করোনা মহামারির মোকাবেলায় অঙ্গুলিমেয় কিছু দেশ বেশ সফল হয়েছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে: ‘ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি অথবা স্পেনের চাইতে আঙ্গেলা মার্কেলের নেতৃত্বে জার্মানিতে মৃত্যুর হার অনেক কম। ফিনল্যান্ডে প্রতিটি দলের নেতৃত্বে মহিলা, এমন চারটি দলের জোট সরকারে চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন। মাত্র ৩৪ বছর বয়স তার। পাশের দেশ সুইডেনের তুলনায় তার দেশে করোনায় মৃত্যুর হার শতকরা ১০ ভাগেরও কম। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট ৎসাই ইং-ওয়েন-এর নেতৃত্বে করোনা সংক্রমণের পরীক্ষা, তার গতিবিধি অনুসরণ করে সংক্রমিত ব্যক্তিদের আলাদা করা – এই নিয়ে দেশটির ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ অভিযান। দেশ সম্পূর্ণ লকডাউন না করে এটি সারা পৃথিবীতে সফলতম ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ অভিযানের একটি।’

নিউ জিল্যান্ডের দুর্দান্ত প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্টা আর্ডার্নের কথা ভুললে চলবে না।

লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ: ‘মাত্র ৩৯ বছর বয়স্কা নিউ জিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রী আর্ডার্ন পুরো লকডাউনের সময়টা যেন সমগ্র দেশবাসীর হাতে হাত ধরে গভীর সহানুভূতির সাথে ‘বাড়িতে থাকুন, জীবন বাঁচান’ ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন, প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলনে নির্বিবাদী ভঙ্গিতে মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন।’

‘নিউ জিল্যান্ডের মানুষ যেন পড়শিদের দেখভাল করে, দুর্বলকে রক্ষা করে, আর বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবে যেন হাসিমুখে ব্যক্তিগত ত্যাগে সম্মত হয়, এই বিষয়গুলোর ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। এতে তার ভক্তের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে।’

সেই সাথে এতে হাতেনাতে অবিশ্বাস্য ফল পাওয়া গেছে। নিউ জিল্যান্ডের ৪৮ লক্ষ মানুষের মধ্যে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা শুনলে চমকে উঠতে হয়। মাত্র ২২ জন। নতুন সংক্রমণের সংখ্যা এখন শূন্যের কোঠায়।

একটা জিনিস লক্ষ করছেন? ওপরের সবকটা নেত্রীই নারী।

এবার করোনা প্রতিরোধে কোন দেশগুলোর অবস্থা সবচাইতে খারাপ, তার দিকে নজর দেওয়া যাক। যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসেব অনুযায়ী ২৭ মার্চ যে দেশগুলোতে সবচাইতে বেশি করোনা সংক্রমণ ঘটেছে, তার মধ্যে শীর্ষে যথাক্রম যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল আর রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা শুনে আঁতকে উঠতে হয়। ১৬.৭ লক্ষ। নিকটতম দেশ ব্রাজিলের চার গুণ। ব্রাজিলে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ৪ লক্ষ ছুঁই ছুঁই। রাশিয়াও খুব পিছিয়ে নেই।

এই দেশগুলোর নেতৃত্বে কারা? যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, প্রেসিডেন্ট জায়ির বোলসোনারো আর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের মধ্যে এমন উগ্র, উদ্ধত পৌরুষের নজির খুঁজে পাওয়া ভার।

ট্রাম্প জনসমক্ষে করোনা চিকিৎসায় বিষাক্ত জীবাণুনাশক সেবনের পরামর্শ দিয়েছেন। (পরে বলেন, সবটাই নাকি ব্যঙ্গ!) করোনার জন্য যে ওষুধ বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে বাতিল করে দিয়েছেন বোলসোনারো সেই হাইড্রোক্লোরোকিউন খাচ্ছেন বলে জানান। যাদের তাতে আপত্তি, তাদের প্রতি তাচ্ছিল্যভরে বলেছেন – তাদের ইচ্ছা হলে তারা সোডাভর্তি কোমল পানীয় পান করতে পারে।

এককালের হলিউড তারকা জা জা গাবর একবার রসিকতা করে বলেছেন: ‘উদ্ধত পৌরুষের লম্ফঝম্পই সার, ভেতরে ঠনঠন।’

এই করোনা মহামারির মোকাবেলায় বহু নেত্রীর ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল।

দ্য এ্যাটলান্টিক সাময়িকীতে হেলেন লুইস লিখেছেন: ‘আইসল্যান্ডের কাটরিন জ্যাকব্‌স্‌ডটির বিনামূল্যে সারা দেশের নাগরিকদের করোনা পরীক্ষার প্রস্তাব দিয়েছেন। নরওয়ের এর্না সোলবার্গ শুধু শিশুদের জন্য একটা সংবাদ সম্মেলন ডেকে বাচ্চাদের বলেন, শোন, তোমরা যদি ভয় পাও তাতে একদম ঘাবড়াবে না। এটা মোটেও অন্যায় কিছু নয়।’

তবে একে শ্রেফ উদ্ধত পৌরুষ বনাম মমতাময়ী নারীর দ্বন্দ্ব ভাবলে সেটা কিন্তু অতিসরলীকরণ হয়ে যাবে। রাজনৈতিক সামাজিক বাস্তবতা আরো জটিল, অতো সোজা-সাপ্টা নয়। যেমন মন-মানসিকতায় নিউ জিল্যান্ডের আর্ডার্নের অনেক মিল কানাডার পুরুষ নেতা জাস্টিন ট্রডোর সাথে। যুক্তরাষ্ট্রে মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাট সমর্থক মহিলা গভর্নর গ্রেচেন হুইটমারের রিপাবলিকান মহিলা গভর্নর – যেমন আলাবামার কে আইভি বা সাউথ ডাকোটার ক্রিস্টি নোম – এদের চাইতে বরং ডেমোক্র্যাট সমর্থক পুরুষ গভর্নর – যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার গ্যাভিন নিউসোম বা নিউ ইয়র্কের এ্যান্ড্রু কুওমো – এদের সাথে মিল অনেক বেশি। আর চীনের কড়া একনায়ক শাসক শি জিনপি পুরুষ হলে কী হবে –করোনা মহামারি মোকাবেলায় গোড়ার দিকে ভয়ঙ্কর হোঁচট খেলেও পরে যেভাবে ঐ বিশাল দেশটাকে করোনার শনির গ্রাস থেকে বের করে এনেছেন তাতে সারা বিশ্ব তাজ্জব বনে গেছে।

আমাদের নারী নেত্রী আর পুরুষ নেতার বাছবিচার অতিক্রম করে আরো গভীরে গিয়ে সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটা উপলব্ধি করতে হবে। নেত্রীরা যে সব সময় নেতাদের চাইতে শ্রেয়, আসল কথা সেটা নয়।। আসল কথা হলো যেই জাতি নারী নেতৃত্বকে সাদরে গ্রহণ করে সেই জাতিটা শ্রেয়।

নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক ক্যাথলিন গার্সন দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘যে রাজনৈতিক আবহে সরকারে আস্থা ও সমর্থন তুলনামুলকভাবে বেশি, যেখানে নারী পুরুষে তেমন ভেদাভেদ নেই,’ সেখানে নারী নেত্রীদের নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা বেশি। ঐ আবহের ফলেই ‘আপনি একধাপ এগিয়ে গেলেন।’

দ্য আটলান্টিক সাময়িকীতে হেলেন লুইস লেখেন: ‘যে দেশ একনায়ক নির্বাচিত করে – অথবা ভুয়ো নির্বাচনের পর একনায়ক ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে – সেই দেশের এমনিতেই অবস্থা সুবিধার নয়।’

লুইস আরো লেখেন: ‘সুতরাং ঐ বস্তাপচা লিঙ্গবাদী বুলি উলটে দিয়ে কিছু লাভ নেই। শত শত বছর ধরে এই মন্ত্র আউড়ানো হয়েছে যে পুরুষমানুষের প্রকৃতি তাকে নেতৃত্বের জন্য আরো উত্তমভাবে প্রস্তুত করেছে। আজ হঠাৎ করে তার উল্টোটা সত্যি হয়ে যায়নি। নারী নেতৃত্বের কারণে সুশাসন আসেনি। বরঞ্চ সুশাসনের গুণে নারী নেতৃত্ব বিকশিত হয়েছে।’

বৃহত্তর পরিসরে সমাজের ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। সমাজে নারীর কদর কতখানি, সেটা দিয়ে সেই সমাজ কতখানি আলোকিত তার পরিচয় পাওয়া যায়।

সবচাইতে যেটা অবাক কাণ্ড তা হলো আজও আমাদের এতটা পথ বাকি। কিছু দেশ নিজেদের খুব উন্নত মনে করে, কিন্তু তাদের অনেক দূর পথ বাকি। যুক্তরাষ্ট্র এখনো প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্টের অপেক্ষা করছে। দেশের সেনেট-এ প্রতি চারজনে মাত্র একজন মহিলা সেনেটর। অর্থনৈতিক আয়তনের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ কুড়িটি দেশের সংগঠন জি-২০। সেখানে সবেধন নীলমণি আঙ্গেলা মার্কেল একমাত্র মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান।

দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্তা আরো খারাপ। ধর্মীয় গোঁড়ামির ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন যে পিতৃতান্ত্রিকতা আর নারীবিদ্বেষ লালিত হয়েছে, তার ভারি বোঝা আজও আমাদের টানতে হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে এই ব্যাপারে ধর্মভেদে বিশেষ তারতম্য নাই – সব ধর্মেই গোঁড়ামি মানেই যে করে হোক নারীকে শৃঙ্খলিত রাখার চেষ্টা। আমাদের অঞ্চলের নারী রাষ্ট্রপ্রধান নিয়ে আমাদের আত্মপ্রসাদ অর্থহীন, কারণ এর ষোল আনাই ফাঁকি। (অধিকাংশ নারী রাষ্ট্রনায়কদের রাজনৈতিক সাফল্য পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত – সে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী হোক, বাংলাদেশের শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়াই হোক, পাকিস্তানের বেনজীর ভুট্টোই হোক, আর শ্রীলঙ্কার সিরিমা বন্দরনায়েকেই হোক।)

নারী-পুরুষের সমতার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক সময় পড়শি দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে – সেটা খুব আশার কথা। তবে আমাদের কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের এখনও অনেক, অনেক কাজ বাকি।

আমাদের কবে যে বোধোদয় হবে! আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে জাতির অর্ধেকের মধ্যে যে সুপ্ত সম্ভাবনা, তাকে পূর্ণভাবে বিকশিত হবার উদার, অবারিত সুযোগদান করলে তাতে লাভ আমাদের সকলের – বস্তুগতভাবে, নীতিগতভাবেও।

নারীর সম্পূর্ণ মুক্তি আসতে সময় লাগতে পারে, কিন্তু একদিন না একদিন সেই মুক্তি আসবেই। নারীপুরুষ নির্বিশেষে সেই দিনটি সবার জন্য এক নতুন স্বর্ণালী অধ্যায়ের সূচনা করবে।

(অজস্র ভালোবাসা, আনন্দ আর ভরসা দিয়ে যেসব নারী আমার জীবনকে আলোকিত করেছেন, এই ছোট্ট প্রবন্ধটি তাদের সবাইকে উৎসর্গ করলাম। এঁদের মধ্যে আছেন: ঢাকায় আমার আদরের ছোট দুই বোন আলপনা আর কল্পনা – রূপে, গুণে সাফল্যে তারা তাদের বাউণ্ডুলে ভাইয়াকে বহু আগে অতিক্রম করেছে, তবে ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা তাদের একবিন্দু কমেনি; আমার প্রয়াত মা, যার ঊষ্ণ হৃদয় ছিল অফুরন্ত স্নেহের উৎস; আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অবিসংবাদিত অভিভাবক আমার বড়ো খালা – যার রক্তচক্ষু আর কড়া শাসনের আড়ালে লুকানো ছিল মমতার গাঢ় প্রস্রবণ; মেলবোর্ণে আমার অতি আদরের খালাত বোন আপুমণি, যিনি এখনো আমার আরেকটি স্নেহময়ী মায়ের মতো, শুধু তফাত এই যে তার থেকে সারাজীবন ভালোবাসাই পেয়েছি, কোনদিন বকুনি খেলাম না; হিউস্টন আর নিউজার্সির ভুরহিস শহরে আমার দুই বন্ধুপত্নী, আমার প্রতি যাদের গভীর মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অপূর্ব সব রান্নায়। এছাড়া আরো অনেকে আছে, স্থানাভাবে যাদের নাম উল্লেখ সম্ভব নয়।

তোমাদের কাছে আমি হাতে কলমে মেয়েদের ভালোবাসতে শিখেছি, শ্রদ্ধা করতে শিখেছি, সমীহ করতে শিখেছি। তোমাদের কাছে আমি নারীর সমতা ও সম্মানের অবিচ্ছেদ্দ্য অধিকারকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করতে শিখেছি। তোমাদের জন্য আজ আমি একজন আলোকিত পুরুষ হতে শিখেছি।)

No comments:

Post a Comment

প্রকাশক : রিটন খান, সম্পাদকমন্ডলী : এমরান হোসেন রাসেল, রিটন খান
Copyright © 2020. All rights reserved by বইয়ের হাট